মাহদী
মাহদী বা মাহদি ( আরবি: ٱلْمَهْدِيّ, প্রতিবর্ণীকৃত: al-Mahdī, অনুবাদ 'সুপথপ্রাপ্ত') হল ইসলামি পরকালবিদ্যায় চর্চিত একজন মসীহ বা ত্রাণকর্তা, যিনি মন্দ ও অন্যায় থেকে বিশ্বকে পরিত্রাণ দেওয়ার জন্য কেয়ামতের কিছু দিন আগে উপস্থিত হবেন বলে বিশ্বাস করা হয়। তাকে নবি মুহাম্মদ সা. এর বংশধর বলা হয়, যিনি নবী ঈসা আ. এর আগে আবির্ভূত হবেন এবং মুসলিমদেরকে পুরো বিশ্ব শাসনে নেতৃত্ব দেবেন। যদিও কুরআনে মাহদীর উল্লেখ নেই এবং সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দুইটি হাদিসগ্রন্থ: সহীহ আল-বুখারি ও সহিহ মুসলিমসহ হাদিসের বেশ কয়েকটি প্রামাণিক সংকলনেও তার আলোচনা তেমন পাওয়া যায় না; তবে হাদিসের অন্য কিছু কিতাবে তার উল্লেখ রয়েছে এবং নববী যুগ থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত তাঁর আগমনের বিষয়টি মুসলিম উম্মাহের মাঝে চর্চিত হয়ে আসছে।
ইসলামের ১ম ও ২য় শতাব্দীতে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উত্থান-পতনের বিভ্রান্তি ও অস্থিরতার সময়ে মাহদির মতবাদটি আকর্ষণ লাভ করেছে বলে মনে করা হয়। যদিও মাহদি ধারণাটি নববী যুগ থেকে চলে এসেছে। মাহদি মতবাদটি সবচে' বেশি আকর্ষণ লাভ করে ৭ম শতাব্দীর শেষের দিকে, যখন বিপ্লবী মুখতার ইবনে আবি উবায়দ ( আনু. ৬২২-৬৮৭ ) ঘোষণা দেন যে, খলিফা আলী (র.) এর পুত্র মুহাম্মদ ইবনুল হানাফিয়া ( শা. ৬৫৬–৬৬১ ) কাঙ্খিত মাহদি হতে পারেন। এটি মুসলমানদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এটি ১৪০০ বছর যাবত মুসলমানদের আক্বিদার একটি অংশ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মাহদির দাবীদারদের একটি বিশাল সংখ্যাও রয়েছে এবং প্রতিবারই তারা ভণ্ড বলে ত্যাজ্য হয়েছে।
ইসলামের শিয়া ও সুন্নি উভয় শাখায়ই মাহদির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। যদিও তারা তার গুণাবলী এবং মর্যাদার ক্ষেত্রে ব্যাপক ভিন্নতা পোষণ করেন। ইসনা আশারিয়া শিয়াদের মতে, মাহদী হলেন একাদশ ইমাম মুহাম্মদ আল-মাহদীর পুত্র ইমাম হাসান আল-আসকারি (মৃ: ৮৭৪), যার ব্যাপারে তাদের ধারণা হলো যে, তিনিই কাঙ্খিত মাহদি এবং আল্লাহর ইচ্ছায় তাকে অদৃশ্য করে রাখা হয়েছে। এই ধারণাটি সুন্নিদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। সুন্নিদের বিশ্বাস হলো, মাহদি এখনও জন্মগ্রহণ করেননি। তিনি কিয়ামতের আগে আগে জন্মগ্রহণ করবেন এবং তার আত্মপ্রকাশই হবে কিয়ামতের বড় নির্দশনসমূহের একটি।[১]
ব্যুৎপত্তি
সম্পাদনামাহদী শব্দটি আরবি ক্রিয়ামূল ه-د-ي থেকে এসেছে, যা সাধারণত "ঐশ্বরিক পথপ্রদর্শন" বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। [২] যদিও এর মূলটি কুরআনে একাধিক স্থানে ও বিভিন্ন প্রসঙ্গে আবির্ভূত হয়েছে; তবে মাহদী শব্দটি কখনোই কুরআনে আসেনি। [৩] এর সংশ্লিষ্ট ক্রিয়া হল হাদা (هدي), যার অর্থ পথপ্রদর্শন করা। তবে মাহদীকে একটিভ ভয়েসে পড়লে তখন এর অর্থ হবে ‘যিনি পথ দেখান’; প্যাসিভ ভয়েসেও এর অর্থ হতে পারে, ‘যিনি নির্দেশিত’। [৪] ধর্মীয় মতামত অনুসারে, মাহদি হলেন ইসলামি সম্প্রদায়ের শেষ-কালের পরকালকেন্দ্রীক ত্রাণকর্তা।
হাদিস অনুযায়ী ইমাম মাহদি
সম্পাদনাআহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের ( সুন্নি ইসলাম) মতে, তার নাম হবে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ। তিনি সবচেয়ে লম্বা কপাল এবং সরু নাকের অধিকারী হবেন। তার খেলাফতের আগে পৃথিবী অন্যায় ও অত্যাচারে ভরে যাবে এবং তারপরে আল্লাহ তাকে দিয়ে এসব সংস্কার করাবেন। তিনি খেলাফত কায়েম করে ন্যায়-ইনসাফ দিয়ে গোটা পৃথিবী পূর্ণ করবেন এবং সেটা হবে শেষ সময়ে। তিনি সাত বছর বা তার বেশি সময় ধরে রাজত্ব করবেন। আল্লাহ তার ওসিলায় প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি বর্ষাবেন। ফলে জমিন গাছপালা উৎপন্ন করবে। গবাদি পশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। মানুষ তখন এমন নিয়ামত ভোগ করবে, যা ইতোপূর্বে কেউই উপভোগ করেনি। [৫]
সুন্নীদের মাঝে মাহদি সম্পর্কিত হাদিস
সম্পাদনা- সহিহ বুখারি ও সহীহ মুসলিম শরিফে ইমাম মাহদি সম্পর্কে কোন স্পষ্ট হাদিস বর্ণিত হয়নি। তবে এমন কিছু হাদিস আছে, যার ব্যাপারে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে যে, এটি সম্ভবত মাহদী সম্পর্কে। যেমন: নিম্নে বর্ণিত হাদিসটি :
আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত ,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তখন তোমরা কেমন থাকবে, যখন তোমাদের মাঝে ঈসা (আ.) অবতরণ করবেন এবং তোমাদের ইমাম (মাহদি) তোমাদের মাঝে অবস্থান করবেন ( বুখারী ও মুসলিম)।[৬] - ইমাম মাহদী সম্পর্কে হাদিসগুলি ইামম আবু দাউদ, তিরমিযী , ইবনে মাজাহ, বাজ্জার, হাকিম, তাবারানি ও আবু আলী মাওসিলিসহ হাদীস শাস্ত্রের ইমামদের একটি বড় জামাত বর্ণনা করেছেন এবং তারা সেই হাদিসগুলি আলী ইবনে আবি তালিব, তালহা, ইবনে আব্বাস, ইবনে ওমর, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ,আবু হুরায়রা, আনাস ইবনে মালিক , আবু সাঈদ আল-খুদরি, উম্মে হাবিবা, উম্মে সালামা, সাওবান ও কুর্রা বিন আয়াস প্রমুখ সাহাবির প্রতি সম্পৃক্ত করেছেন এবং এসব হাদিসের মধ্যে সহিহ, হাসান ও জঈফ সব রকমের বর্ণনা রয়েছে।
- ইমাম মাহদির ব্যাপারে সুন্নিদের মতামত হল, তারা বিশ্বাস করেন যে, তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করার কয়েক দশক আগে জন্মগ্রহণ করবেন। বিপরীতে শিয়ারা বিশ্বাস করে যে, মাহদি আজ থেকে হাজার বছরের বেশি আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তার পিতা হাসান আল-আসকারি তাঁর পক্ষ থেকে ৩ শত পশু আকীকা সম্পন্ন করেছিলেন। জন্মের কয়েক বছর পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান এবং এখনো সেই অবস্থাতেই আছেন। তার আত্মগোপনের কারণ হল, নিহত হওয়ার আশঙ্কা অথবা যাতে তিনি অত্যাচারী শাসকের প্রতি বায়াতবদ্ধ হতে বাধ্য না হন ইত্যাদি।
- অনেক আলেমের মতে, মাহদীর হাদীসগুলি অর্থের দিক থেকে তাওয়াতুরের স্তরে পৌঁছেছে ( যা মিথ্যা হওয়া অসম্ভব)। তাদের মধ্যে ইমাম কাজি মুহাম্মদ বিন আলী শাওকানীও রয়েছেন, যিনি ইমাম মাহদী, দাজ্জাল ও মাসিহ সম্পর্কিত বর্ণনাগুলি তাওয়াতুর স্তরে পৌঁছানোর ব্যাখ্যায় বলেন, মাহদী সম্পর্কে যে হাদীসগুলো উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে সহীহ , হাসান ও দুর্বল সব বর্ণনা আছে এবং এসব একত্রে কোন সন্দেহ ছাড়াই মুতাওয়াতির স্তরে পৌঁছে যায়। আর এ ব্যাপারে সাহাবিদের থেকে যা বর্ণিত হয়েছে তাও (মারফু) হাদিসের পর্যায়ে। কারণ এ ব্যাপারে নিজে ইজতিহাদ করে কিছু বলা সম্ভব নয়।
- আবু সাইদ আল-খুদরি কর্তৃক বর্ণিত নবি সা. বলেন যে, মাহদি আমার বংশ থেকে হবে। সে বড় কপাল ও সরু নাকের অধিকারী হবে। সে পৃথিবীকে ন্যায় ও ইনসাফে পরিপূর্ণ করে দিবে, যেভাবে এটি তার পূর্বে জুলুম ও অন্যায়ে পরিপূর্ণ থাকবে। সে ৭ বছর রাজত্ব করবে ( সুনানে আবু দাউদ)।
- আলী বিন আবি তালিব কর্তৃক বর্ণিত যে, নবি সা. বলেন, "যদিও (কিয়ামতের আগে) মাত্র একটি দিন সময় বাকি থাকে; তবুও আল্লাহ তা'য়ালা আমার বংশ থেকে এমন একজন ব্যক্তিকে প্রেরণ করবেন, যে পৃথিবীকে ন্যায় ও ইনসাফে পরিপূর্ণ করে দেবে, যেভাবে এটি তার পূর্বে জুলুম ও অত্যাচারে পরিপূর্ণ থাকবে ( সুনানে আবু দাউদ)।
- আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আমরা একবার মুহাম্মাদ সা. এর সাথে বসেছিলাম, তখন বনু হাশেম গোত্র থেকে একজন যুবক এলো। যখন তিনি তাঁকে দেখলেন তাঁর চোখ ছলছল করে উঠল এবং তার চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেল। ( বর্ণনাকারী) বলেন, আমি বললাম, আমরা আপনার চেহারায় এমন কিছু দেখছি, যা আমরা মোটেই পছন্দ করি না। তিনি বলেন, আমার আহলে বায়তের জন্যে আল্লাহ দুনিয়ার বদলে আখিরাত পছন্দ করেছেন। আমার পরে আমার পরিবারের লোকেরা বিপর্যয়, ক্ষমতাচ্যুত ও বিতাড়িত হওয়ার সম্মুখীন হতে থাকবে, যতক্ষণ না পূর্ব দিক থেকে কালো পতাকাবাহী একদল লোক আসবে। তারা কল্যাণ কামনা করবে; কিন্তু তা হতে দেওয়া হবে না। তাই তারা যুদ্ধ করবে এবং বিজয়ী হবে। এর পর তাদের তা দেওয়া হবে; কিন্তু তারা তা গ্রহণ করবে না, যতক্ষণ না তারা তা আমার পরিবারের একজন লোককে দেয়। সে পৃথিবীকে ন্যায়-ইনসাফে পরিপূর্ণ করে দেবে, যেভাবে এটি পূর্বে জুলুম ও অত্যাচারে পরিপূর্ণ থাকবে। তোমাদের মধ্যে যে তাকে পাবে, সে যেন বরফের উপর হামাগুড়ি দিয়ে হলেও তার কাছে যায় ( সুনানে আবু দাউদ)। তবে এর সনদে কিছু কালাম আছে। সবমিলিয়ে এটি গ্রহণযোগ্য।
- আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী সা. বলেন: ততক্ষণ পর্যন্ত পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে না, যতক্ষণ না আরবরা আমার পরিবারের একজন ব্যক্তি দ্বারা শাসিত হবে, যার নাম আমার নামের মত হবে (জামে তিরমিযী)।
হাদিসগ্রন্থ থেকে মাহদীর গুণাবলী
সম্পাদনামাহদির পিতামাতার অন্তত একজন কুরাইশী হতে হবে এবং নবি-পরিবার থেকে ফাতেমা রা. এর বংশধরদের থেকে হতে হবে। তবে এক্ষেত্রে কেউ বলেন যে, সে তাঁর পুত্র হাসান বিন আলির বংশধরদের থেকে হবে। আর কিছু লোক বলে যে, তিনি হবেন নবী কর্তৃক উল্লেখিত বারোজন কুরাইশ খলিফাদের একজন। যেমন: সহীহ বুখারির একটি হাদিসে বর্ণিত আছে যে, সে উম্মাহের শেষের দিকে আসবে। তাঁর নাম নবীজির নামের সাথে সাথে এবং তাঁর পিতার নামও নবিজির পিতার নামের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হবে (অর্থাৎ তাঁর নামও মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ হবে )। সে আচার–আচরণে নবীজির সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হবে। সে প্রশস্ত কপাল ও সরু নাকবিশিষ্ট হবে এবং সে মাঝারি গড়নের হবে।
সুন্নিদের বিশ্বাস অনুসারে এ কথার কোনো ভিত্তিই নেই যে, মুসলমানরা তাঁর অপেক্ষায় ইবাদত বন্দেগী করবে এবং বের হওয়ার উপর কোন ইবাদত নির্ভর করে না। এভাবে বলা যাবে না যে, মাহদি আত্মগোপনে আছেন এবং তিনি বের হয়ে না আসা পর্যন্ত আমরা জামায়াত, জুমার নামায, জিহাদ, হুদুদ, শরয়ী হুকুম ইত্যাদি কিছু পালন করব না; বরং মুসলিমরা তাদের সাধারণ জীবন যাপন করতে থাকবে; ইবাদত ও আমলের অনুশীলন করবে; সংস্কারমূলক কাজ করবে; নিজেরা ইলম শিখে অন্যদের তা শেখাবে। যখন এই ধার্মিক ব্যক্তি পাওয়া যাবে এবং তার সুনির্দিষ্ট দ্ব্যর্থহীন প্রমাণ পাওয়া যাবে, তখন তারা তাকে অনুসরণ করবে। এটাই হল সকল সাহাবা, তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী ও ইমামদের দেখানো পথ।
- পূর্বসূরী আলেমগণ বইগুলি; যেমন: ইমাম হাফিজ হায়তামির কিতাব 'আল-কওল আল-মুখতাসার ফী আলামাতিল মাহদি আল মুনতাজার; ইমাম আবু নাইম আসবাহনী রচিত "আল আরবাউন ফিল-মাহদী" ও জালালুদ্দীন সুয়ুতীর কিতাবুল উরফিল ওয়ারদি ফি আখবারিল মাহদি ইত্যাদি গ্রন্থে বর্ণিত আছে:
তিনি হবেন মুহাম্মাদ বা আহমাদ বিন আবদুল্লাহ এবং একটি বর্ণনা অনুসারে তার ডাকনাম হবে আবদুল্লাহ। এ ব্যাপারে কোন সহীহ হাদীস নেই যে, যা দ্বারা ক্ষমতা গ্রহণকালীন তার বয়স নির্দিষ্ট করে বলা যাবে; তবে বলা হয় যে, তখন তাঁর বয়স হবে চল্লিশ বছর। সহীহ ও দূর্বল বর্ণনা মিলিয়ে গুণাবলীর ব্যাপারে উল্লেখ করা হয় যে, তাঁর মুখমণ্ডল উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত হবে। তাঁর কপাল প্রশস্ত এবং নাক সরু হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। তার মাথায় একজন আওয়াজকারী ফেরেশতা থাকবে, যে আওয়াজ দিবে যে, ইনি আল্লাহর খলিফা মাহদী এবং তোমরা তাঁকে অনুসরণ করো। তিনি মক্কা মুকার্রামায় আনুগত্যের বায়াত নিবেন; তারপর শাম ও খোরাসান ও অন্যান্য স্থানে। এরপরে তার অবস্থান হবে বায়তুল মাকদিস; তিনি রুকন ও মাকামের মাঝে আনুগত্যের শপথ নিবেন। তবে তিনি তা অপছন্দ করবেন। এরপর আল্লাহ তাকে জয় দান করবেন। তার খেলাফতকালে পৃথিবী ও আসমানের বাসিন্দা, আকাশের পাখি সবাই সন্তুষ্ট থাকবে।
তার ওসিলায় আল্লাহ মানুষের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করবেন এবং গোটা উম্মাহ বহুত নিয়ামত ভোগ করবে। গবাদি পশু বেড়ে যাবে এবং জমিন প্রচুর গাছ উৎপন্ন করবে। তিনি কিয়ামতের আগে দ্বীন প্রতিষ্ঠা করবেন, যেভাবে নবি সা. দীন কায়েম করেছিলেন। তাঁর হাতে বড় বড় মহাযুদ্ধ সংঘটিত হবে এবং তিনি সুন্নাহ মেনেই লড়াই করবেন, যেভাবে নবী সা. ওহী মেনে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি শিরকে আচ্ছন্ন শহরগুলি জয় করবেন। তিনি কনস্টান্টিনোপল এবং দাইলাম পাহাড় জয় করবেন। তিনি জেরুজালেমে অবতরণ করবে। তখন ইসলাম বিজয় হবে এবং পৃথিবীকে ন্যায়বিচারে পূর্ণ করবেন তিনি সাত বছর শাসন করবেন এবং গোটা পৃথিবীর রাজত্ব করবেন; যেমনটি যুলকারনাইন ও সুলায়মান আ. করেছিলেন। তখন ঈসা আ. অবতীর্ণ হবেন এবং তার পেছনে সকালের নামাজ আদায় করবেন।
হাদিস মতে তার আনুগত্য, তাঁর ক্ষমতায়ন ও তাঁর আবির্ভাবের লক্ষণসমূহ
সম্পাদনা- ইরাক ও শামের জনগণ অবরুদ্ধ হওয়া। যেমনটি মুসলিম শরিফের হাদিসে আছে (নং- ২৯১৩): "ইরাকের জনগণের ব্যাপারে আশঙ্কা হয় যে, তাদের কাছে কোনো কাফিজ বা দিরহাম নেওয়া হবে না। আমরা বললাম, এটা (অবরোধ) কোথা থেকে হবে? তিনি বলেন, অনারবদের কাছ থেকে; তারা তাদের বাধা দিবে। শামের জনগণের ব্যাপারেও আশঙ্কা হয় যে, তাদের নিকট কোন দিনার বা মাদি পৌঁছবে না। আমরা বললাম, এটি কোত্থেকে হবে? তিনি বলেন, রোমের পক্ষ থেকে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে তিনি বললেন, আমার উম্মতের শেষ ভাগে এমন একজন খলিফা আগমন করবে, যে এমনভাবে মাল ছড়িয়ে দিবে, যা গণনা করা সম্ভব হবে না।
- মানুষের মাঝে শত মতভেদ এবং ভূমিকম্পের সময় তাকে উম্মাহর কাছে পাঠানো হবে; যেমনটি ইমাম জাহাবি এবং ইবনে কাসির বর্ণনা করেছেন : "আমি তোমাদের কাছে মাহদীর সুসংবাদ দিচ্ছি, যে আমার উম্মতের কাছে প্রেরিত হবে মানুষের মাঝে মতভেদ ও প্রচণ্ড ভূমিকম্প হওয়ার সময়।
- মাওয়ারান্নাহর থেকে দু'জন লোক বেরিয়ে আসবে (যা বর্তমান উজবেকিস্তান ও তার পরবর্তী অঞ্চল), তাদের একজনের নাম হারিস বিন হেরাস ও অপর জন তার অগ্রভাগে থাকবে এবং তাকে মনসুর বলা হবে, তারা মুহাম্মদের বংশধরদের শক্তিশালী করবে; যেমন কুরাইশরা করেছিল। প্রত্যেক মুমিনের জন্যে তাকে সাহায্য করা বা তার আহ্বানে সাড়া দেওয়া জরুরি (আবু দাউদ: নং–৪২৯০)।
- পূর্বদেশ ও খুরাসানে কালো পতাকাবাহীবাহিনী বের হওয়া। যেমন: ইবনে মাজাহর হাদিসে বর্ণিত হয়েছে: নবি সা. বলেন, তোমাদের একটি ধনাগারের নিকট ৩ জন নিহত হবে। তাদের প্রত্যেকই হবে খলীফার পুত্র। এরপর সেই ধনাগার তাদের কেউ পাবেন না। প্রাচ্য দেশ থেকে কালো পতাকা উত্তোলন করা হবে। তারা তোমাদের এমনভাবে হত্যা করবে, যেমনটি ইতেপূর্বে কোন জাতি করেনি। অতপর তিনি আরো কিছু উল্লেখ করেন, যা আমার স্মরণে নেই। আর তিনি এও বলেন, যখন তোমরা তাঁকে দেখতে পাবে, তখন তোমরা তাঁর হাতে বায়াত গ্রহণ করবে, যদিও তোমাদের হামাগুড়ি দিয়ে বরফের উপর দিয়ে অতিক্রম করতে হয়। কেননা তিনি আল্লাহর খলীফা হবেন মাহদী ( নং–৪০৮৪)। আহমাদ কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে আছে, যদি তোমরা খোরাসান থেকে আগত কালো পতাকাবাহীবাহিনী দেখতে পাও; তবে তাদের কাছে এসো; কারণ সেখানে আল্লাহর খলিফা মাহদী থাকবেন।
মাহদীর পূর্বে খেলাফতের প্রত্যাবর্তন
সম্পাদনাঅধিকাংশ আলেমের মতে সঠিক মত হল, খেলাফত প্রত্যাবর্তনের পর এই ধার্মিক শাসকের প্রতি বায়াতের ঘটনাটি অনুষ্ঠিত হবে। খেলাফত মাহদি মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহর পূর্বে প্রত্যাবর্তন করবে এবং এর রাজধানী হবে জেরুজালেম। সে খলিফার মৃত্যুর পর সৃষ্টি হওয়া মতভেদ ও গোলযোগ এবং তিনজন শাসকের মাঝে সংঘটিত হওয়া যুদ্ধের সময় মাহদি আগমন করবেন। এরপর তিনি মক্কার হারামের মাকামে বাইয়াত গ্রহণ করবেন এবং লোকদের নেতৃত্ব দিবেন। তিনি মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রহমতস্বরূপ হবেন। এতেই বুঝা যায়, মাহদির আগে ইনসাফপূর্ণ খেলাফত প্রত্যাবর্তন করবে।
- এভাবেই মাহদি খেলাফত প্রত্যাবর্তন করবেন এবং এমন একজন খলিফা হবেন, যিনি গোটা পৃথিবীকে ন্যায়বিচারে পূর্ণ করবেন। তাঁর রাজত্বকালে অর্থের প্রাচুর্য থাকবে, যা তার আগে বা পরে কোনো জাতি দেখেনি। পৃথিবীর মানুষ তাঁকে ভালবাসবেন। তিনি মুসলমানদের নেতৃত্ব দেবেন এবং জেরুজালেমের মুক্তি তাঁর হাতেই হবে। ইহুদিদের ফিলিস্তিন থেকে ইসফাহানে উচ্ছেদ করা হবে এবং এর প্রমাণ হল ইরানের ইসফাহানে ৭০ হাজার ইহুদি নিয়ে দাজ্জাল বের হবে।
- ইমাম হাকিম আল-মুসতাদরাক গ্রন্থে মুয়াবিয়া রা. এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন: পৃথিবীর বাদশাহ মোট চারজন: সুলায়মান বিন দাউদ, যুল-কারনাইন, হিলওয়ানের একজন বাসিন্দা এবং অন্য একজন ব্যক্তি। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হল, অপরজন কি খিজির? তিনি বললেন, না। ইমাম জাহাবি এই হাদিসের সনদের ব্যপারে চুপ থেকেছেন ( যা হাদিস সহিহ হওয়ার একটি আলামত)। ইবনে জাওযী তার ইতিহাস গ্রন্থে ইবনে আব্বাসের সূত্রে এটিকে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন: আল্লাহর রাসূল ( সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, পৃথিবীর বাদশাহ ছিলেন চারজন। দুজন কাফের; দুজন মুমিন। মুমিন দুইজন হলেন, সুলায়মান ও জুলকারনাইন। কাফের দুইজন হলেন, নমরুদ এবং বুখতে নাসর। অচিরেই আমার পরিবারেরে একজন পঞ্চম বাদশাহ হিসেবে পৃথিবীতে রাজত্ব করবে। ইবনে তাইমিয়া মাজমুউল ফাতাওয়া বলেছেন, মুজাহিদ বলেন, গোটা পৃথিবীর বাদশাহ দুজন মুমিন ও দুজন কাফের। মুমিন দুজন হলেন, সুলায়মান ও জুলকারনাইন। কাফের দুজন হলেন, বুখতেনসর ও নমরুদ। অচিরেই এ উম্মতের পঞ্চম একজন তাদের মত গোটা পৃথিবীতে রাজত্ব করবে।[৭]
ইসনা আশারিয়া মাজহাবে মাহদি
সম্পাদনাইসনা আশারিয়া শিয়ারা বিশ্বাস করেন, মুহাম্মদ আল-মাহদি হলেন তাদের বারো ইমামের সর্বশেষ, যিনি তাঁর পিতা হাসান আল-আসকারির পরে ইমাম হন। মাহদি ২৫৫ হিজরি সালের ( ৮৬৯ খ্রি.) ১৫ শা'বান জন্মগ্রহণ করেন উত্তর ইরাকের সামারা শহরে এবং তার মাতার নাম ছিল নারজিস, যিনি হাসান আল-আসকারির স্ত্রী। তিনি দুবার আত্মগোপনে যান। প্রথমবার তুলনামূলক কম সময়ব্যাপী, যার ব্যাপ্তি ছিল ৬৯ বছর (২৬০-৩২৯ হি.)। আত্মগোপনের সময় তার শিষ্য শিয়ারা দূতদের মাধ্যমে ইমামের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন। দূতেরা হলেন:
- উসমান ইবনে সাঈদ উমরী
- মুহাম্মদ বিন উসমান
- আল-হুসাইন বিন রুহ
- আলী বিন মুহাম্মদ আল সামারি
দ্বিতীয় আত্মগোপনটি ছিলো একটি দীর্ঘ আত্মগোপন, যা ৩২৯ হিজরি সালে শুরু হয়েছিল এবং কেয়ামতের আগে আগে পুনরায় তিনি মাহদি হিসেবেই আবির্ভূত হবেন বলে বিশ্বাস করা হয়। শিয়ারা বিশ্বাস করেন যে, তার জীবন ও হায়াত হজরত ঈসা ও খিজিরের মতো এবং কিয়ামতের আগে তার বের হওয়ার নির্দশন হল, দাজ্জাল বের হওয়া, উম্মাহের মাঝে জুলুম ও নির্যাতন বৃদ্ধি পাওয়া, খুরাসান থেকে কালো পতাকাবাহীবাহিনী আবির্ভূত হওয়া ইত্যাদি। শিয়া পণ্ডিত মজলিসির বই বিহারুল আনওয়ারের মত হাদীসের বইগুলিতে তার প্রকাশ আগে ঘটবে এবং তারপর তারপর হুসাইন বিন আলীর প্রত্যাবর্তন হবে। তারা বিশ্বাস করে যে, মাহদি মক্কার রুকন ও মাকামের মাঝখানে আসবেন। তারপর লোকেরা তার প্রতি আনুগত্যের বায়াত প্রদান করবে।
আহমদ বিন জাইনুদ্দীন আহসাই এবং শাইখিয়াদের (এটি ইসনা আশারিয়া আকিদার পাশাপাশি কালামি ধারণায় বিশ্বাসী) মতে, মাহদি সাধারণ মানুষের মতই জন্মগ্রহণ করবেন; আত্মগোপন থেকে আবির্ভূত হবেন না।[৮]
শিয়াদের হাদীসে মাহদীর আবির্ভাবের আলামত
সম্পাদনাশিয়া বিশ্বাসে মুহম্মদ আল-মাহদী আবির্ভাবের পাঁচটি আলামত রয়েছে। জাফর আল-সাদিক থেকে বর্ণিত, হাদিস অনুসারে তিনি বলেছিলেন: ইমামের উত্থানের আগে পাঁচটি অনিবার্য লক্ষণ রয়েছে: আল-ইয়ামানি, আল-সুফিয়ানির আত্মপ্রকাশ, বিকট চিৎকার, নফসে জাকিয়ার হত্যা ও আল-বাইদা ধসে যাওয়া।
- আল-ইয়ামানি হলেন শিয়াদের দৃষ্টিকোণ থেকে মানবতার চূড়ান্ত ত্রাণকর্তা। তিনি বারো ইমামের শেষ ইমাম মুহাম্মাদ আল-মাহদির আবির্ভাবের পথ প্রশস্ত করে।
- আল-সুফিয়ানী একজন ভবিষ্যত ব্যক্তিত্ব, যাকে শিয়া এবং সুন্নি ঐতিহ্যের বইগুলিতে একইভাবে উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু শিয়ারা তাকে আবু সুফিয়ান হিসেবে ব্যাখ্যা করে। বিপরীতে সুন্নিরা তাকে মাহদীর শত্রু মনে করে।
- খোরাসানি পতাকাবাহী বাহিনী বের হওয়া।
- আল-বাইদা ধসে যাওয়া।
- নফসে জাকিয়ার হত্যাকাণ্ড, যিনি ফাতিমা রা. এর বংশধর ছিলেন। রুকন ও মাকামের মধ্যে তার জীবনের প্রথম দিকে এই হত্যা সংঘটিত হয়।
ইসমাঈলী মাজহাবে মাহদি
সম্পাদনাইসমাঈলি শিয়াদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে ইমাম মাহদির প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে তাদের মধ্যে ইসমাইলি ইমাম নির্বাচনের মাধ্যমে মাহদির একটি স্বতন্ত্র ধারণা গড়ে উঠেছে। যখন ষষ্ঠ শিয়া ইমাম জাফর সাদিক দুনিয়া ত্যাগ করেন, তখন তার কিছু অনুসারী তার মৃত পুত্র ইসমাইল বিন জাফরকে ইমাম হিসেবে বিবেচনা করে দাবি করে যে, তিনি বেঁচে আছেন এবং মাহদী হিসেবে ফিরে আসবেন। [৯] আরেকটি দল তার মৃত্যুকে মেনে নেয় এবং তার পরিবর্তে তার পুত্র মুহাম্মাদকে ইমাম হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তিনি ইন্তেকাল করলে তার অনুসারীরাও তার মৃত্যুকে অস্বীকার করে এবং বিশ্বাস করে যে, তিনিই শেষ ইমাম ও মাহদী।
খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ইসমাঈলী গোষ্ঠীগুলি সিরিয়ার সালামিয়াকে কেন্দ্র করে একটি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে একত্রিত হয়[৯] এবং মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইলের প্রত্যাবর্তনের জন্য কর্মীদের একটি নেটওয়ার্ক অর্থ সংগ্রহ ও অস্ত্র সংগ্রহের কাজ করে, যিনি আব্বাসীয়দের উৎখাত করে ন্যায়পরায়ণ খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।[১০] মাহদি প্রত্যাবর্তনের প্রচারটি কৃষক, বেদুইন ও অনেক ইসনা আশারিয়ার কাছে বিশেষ আবেদন করেছিল, যারা তাদের ১১তম ইমাম হাসান আসকারির মৃত্যুর পরে বিভ্রান্তির মধ্যে ছিল। এ আন্দোলনের নেতা আবদুল্লাহ ইবনে হুসাইন নিজেকে মাহদি ঘোষণা করেছিলেন [১০] এবং এর ফলে ঐক্যবদ্ধ ইসমাঈলি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভক্তি দেখা দেয়। কারণ আন্দোলনের সকল অনুসারী তার মাহদি হওয়ার দাবি মেনে নেয়নি। ইরাক ও আরবে বাসকারী কারমাতীয়রা এখনও বিশ্বাস করে যে, মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাইলই প্রত্যাশিত মাহদি।
৯৩১ সালে তৎকালীন কারামাতীয় নেতা আবু তাহির আল-জানাবি পারস্য বন্দী আবুল ফাদল ইসফাহানি নামে একজনকে মাহদী হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন। এরপর সে কথিত মাহদি মূসা, ঈসা ও মুহাম্মদ সা.কে মিথ্যাবাদী বলে তাদের নিন্দা করতে থাকে এবং সে ইসলামকে বাতিল ঘোষণা করে আগুনের উপাসনা প্রতিষ্ঠা করে। শেষমেশ ভণ্ডামি থেকে ফিরিয়ে আনার জন্যে আল জানাবিকে তাকে হত্যা করতে হয়েছিল। [১১] [১২]
এদিকে সিরিয়ায় আবদুল্লাহ আল-মাহদির আনুসারীরা আব্বাসীয়দের কাছে পরাজিত হওয়ার আগে ৯০৩ সালে মধ্য সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেয়। এরপর তিনি উত্তর আফ্রিকা যান এবং ৯০৯ সালে কাইরুয়ানে ফাতেমীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। মাহদির সাথে আন্দোলনে যুক্ত খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রত্যাশা পূর্ণ হয়নি।[১৩] তিনি খ্রিস্টধর্মকে সত্য মনে করতেন না এবং জোর দেন যে, মাহদি হিসাবে মুহাম্মদ ইবনে ইসমাইলের প্রত্যাবর্তনের প্রচার ছিল আব্বাসিদের নিপীড়ন এড়াতে এবং তার প্রকৃত পূর্বপুরুষদের রক্ষা করার একটি কৌশল মাত্র। মাহদি আসলে জাফর সাদিকের বংশধরদের থেকে প্রকৃত ইমামদের জন্য একটি যৌথ উপাধি ছিল। [১৪] [১৫] [১৬]
জায়েদী মাজহাবে মাহদি
সম্পাদনাজায়েদী শিয়ারা মাহদি ও আত্মগোপনকারী ইমামের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে এবং তারা বিশ্বাস করে যে, এর (মসীহ) প্রতি বিশ্বাস একটি খ্রিস্টীয় ও ইহুদীবাদী মতবাদ, যা ইরাকে ইসলামে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল এবং তারা নবী মুহাম্মদ সা. বিরুদ্ধে মিথ্যাভাবে তৎসম্পর্কিত হাদিস বানিয়েছিল। কারণ এগুলো দুর্বল, বানোয়াট, ভাষাগতভাবে দূর্বল ও ইহুদি ও খ্রিস্টীয় বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাদের কিছু লোক ইয়েমেনে আবির্ভূত হয়েছিল এবং মাহদীর হাদিস প্রচার করে মাহদি হওয়ার দাবি করেছিল। [১৭]
জাইদিদের মধ্যে ইমামতের ধারণা ইসমাইলি ওইসনা আশারিয়াদের থেকে বহু আলাদা। জায়েদীদের ইমাম হলেন আলী ও ফাতিমার বংশধরদের মধ্য থেকে যে কোনো সম্মানিত ব্যক্তি, যিনি রাজনৈতিক নেতৃত্ব দাবি করেন এবং তা অর্জনের জন্য সংগ্রাম করেন। তাদের নির্দিষ্ট কোনো ইমাম নির্ধারিত নেই। তবে মাহদী উপাধি বহু শতাব্দী ধরে অনেক জায়েদী ইমামের জন্য প্রয়োগ করা হয়েছে।[১৮] [১৯]
ইবাদী মাজহাবে মাহদি
সম্পাদনাইবাদীরা মাহদীর ব্যক্তিত্বকে প্রত্যাখ্যান করেন। কারণ তাদের মতে, এটি পবিত্র কোরানে উল্লেখ নেই। কেবল তাই নয়; ইবাদীরা দাজ্জাল, ঈসা (আ.) এর অবতরণ, কিয়ামতের আগে মহাযুদ্ধ ও ফিতানের সমস্ত বিবরণ প্রত্যাখ্যান করে। কারণ এসব বিষয়ে যা কিছু উল্লেখ করা হয়েছে তা তাদের কাছে দুর্বল হাদিস হিসেবে গণ্য হয়। [২০]
আহমাদিয়া মতবাদে মাহদি
সম্পাদনাআহমদীয়া বিশ্বাসে মসীহ ও মাহদীর প্রকৃতপক্ষে একই ব্যক্তিকে নির্দেশ করে এবং এ আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মির্জা গোলাম আহমদের ( ১৮৩৫–১৯০৮ ) মধ্যে এই ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণ হয়েছিল। [২১][২১][২২] যাহোক, তাদের দৃষ্টিতে ঈসা (আ.) ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছেন এবং মারা গিয়েছেন এবং তিনি ফিরে আসবেন না; পরিবর্তে আল্লাহ্ মির্জা গোলাম আহমদকে গুণাবলী ও ব্যক্তিত্বে হুবহু ঈসার মতো বানিয়েছেন। [২১] [২২] মাহদি বিষয়ে তাদের এমন ধারণা সংখ্যাগুরু সুন্নি ও শিয়া ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত। একইভাবে তাদের মতে, ইমাম মাহদি বিশ্বব্যাপী জিহাদ চালিয়ে বিশ্ব জয় করা কোন ব্যক্তিত্ব নন; বরং তিনি একজন শান্তিপূর্ণ ধর্ম সংস্কারক, যিনি স্বর্গীয় নিদর্শন ও যুক্তি দিয়ে ইসলাম প্রচার করেন। [২১]
মাহদিবাদের সবচেয়ে বড় দাবিদার
সম্পাদনা- কিছু ঐতিহাসিক বর্ণনা করেছেন এবং অনেকেই তা অস্বীকার করে রদ করেন যে, যারা মুহাম্মাদ ইবনুল-হানাফিয়াকে মাহদি দাবি করেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মুখতার আস সাকাফী এবং মুখতার ইরাকে ছিলেন এবং যারা মুহাম্মদ ইবনুল হানাফিয়্যাকে মাহদি হওয়ার দাবি করে, তাদেরকে কাইসানিয়া বলা হয়।
- ইসমাইল বিন জাফর মাহদি হওয়ার দাবি করা হয় এবং দাবীদাররা হল কিছু ইসমাইলী এবং তারা গুপ্ত সম্প্রদায়ের লোক।
- মুহাম্মাদ আহমাদ মাহদি, যিনি ছিলেন মাহদিবাদী আন্দোলনের নেতা এবং সেটি এখনও একটি দল হিসেবে সুদানে বিদ্যমান।
- সৈয়দ মুহাম্মদ জৌনপুরী (ভারত); তিনি হিজরি ৯ম শতাব্দীতে মক্কায় দাবি হওয়ার দাবি করেন। [২৩]
- গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (পাকিস্তান) ; আহমদিয়া কাদিয়ানী সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা।
- মুহাম্মদ ইবনে তুমার্ত (মরক্কো); তিনি মুওয়াহহাদিয়া রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ( হিজরি ষষ্ঠ শতক / খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতাব্দী) ।
- মুহাম্মাদ বিন আবদুল্লাহ কাহতানি, যিনি জুহায়মান ওতাইবির গোষ্ঠীর একজন সদস্য ছিলেন। পঞ্চদশ হিজরি শতাব্দীর প্রথম মহররমে তিনি মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদ দখল করে নিজেকে মাহদি ঘোষণা দেন।
- আলী মুহাম্মদ রেজা শিরাজী, যার ডাকনাম বাব।(২০ অক্টোবর, ১৮১৯ - ৯ জুলাই, ১৮৫০)।
মাহদি ধারণা সমালোচনা
সম্পাদনাঅনেক মুসলিম পন্ডিত মাহদীর আবির্ভাবের ধারণাকে অস্বীকার করেন এবং এতে থাকা বর্ণনাগুলিকে দূর্বল বলে মনে করেন। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বিশিষ্ট হলেন ইবনে খালদুন, মুহাম্মদ রশিদ রিদা, আল আজহারের প্রাক্তন শেখ মাহমুদ শালতুত ও মুহাম্মাদ গাজালী। [২৪]
ইবনে খালদুন বলেন যে, মাহদী একটি শিয়া বিশ্বাস যা শিয়া বর্ণনাকারীরা হাদীসের কিতাবে সন্নিবেশিত করে দিয়েছে। তিনি ইমাম ইবনে মাজাহ কর্তৃক বর্ণিত মাহদি সম্পর্কিত হাদিসের বর্ণনাকারীদের সমালোচনা করে তাদের প্রত্যাখ্যান করেছেন। [২৫]
শায়েখ আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ আলে মাহমুদ বলেন যে, সর্বোত্তম ব্যক্তি মুহাম্মদ সা. এর পর আমাদের কোনো মাহদির জন্য অপেক্ষা করার দরকার নেই। [২৬] [২৭] [২৮] [২৯] [৩০] [৩১]
শেখ ইউসুফ কারযাভী বলেন, ইমাম মাহদির ব্যাপারে দুই সহীহ হাদিসগ্রন্থ বুখারী ও মুসলিমে কোনো হাদিস উল্লেখ করা হয়নি। তিনি বলেন, মাহদির ধারণার কোন ভিত্তি কুরআনে নেই; এমনকি ইশারা ইঙ্গিতেও কিছু বলা হয়নি।[৩২]
মাহদি বিষয়ে এই সকল মুসলিম পণ্ডিতদের বিশ্বাস ও ধারণা মূলধারার প্রাচীন ও আধুনিক সকল ইসলামি পণ্ডিতের বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিপরীত।[৩৩]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ মাওলানা মুহাম্মদ হেমায়েত উদ্দীন: ইসলামি আকিদা ও ভ্রান্ত মতবাদ।
- ↑ Madelung 1986।
- ↑ Arjomand 2007।
- ↑ Cook 2002a।
- ↑ ابن كثير। النهاية/ الفتن و الملاحم ( ১/ ৩১)।
- ↑ "الدرر السنية - الموسوعة الحديثية - شروح الأحاديث"। dorar.net (আরবি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৮-২৮।
- ↑ ইবনে তাইমিয়া: মাজমুউল ফাতাওয়া।
- ↑ أحمد محمود صبحي (1991). نظرية الإمامة لدى الشيعة الإثنى عشرية، تحليل فلسفى للعقيدة. القاهرة، مصر: دار النهضة العربية. ص. 432–433.।
- ↑ ক খ https://books.google.com/books?id=Cvr5ngEACAAJ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০২২-০৫-২০ তারিখে
- ↑ ক খ "Apocalypse in Islam"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০১-৩১।
- ↑ Filiu 2011, pp. 50–51.
- ↑ Halm 2004, p. 169.
- ↑ Filiu 2011, p. 51.
- ↑ Daftary 2013, p. 112.
- ↑ Halm 2004, p. 171.
- ↑ Filiu 2011, p. 51.
- ↑ "الامام المهدي في كتب الزيدية والسنة:" (আরবি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১১-২৪।
- ↑ Halm 2004, p. 203.
- ↑ [[Bashir, Shahzad (2003). Messianic Hopes and Mystical Visions: The Nūrbakhshīya Between Medieval and Modern Islam. Columbia, SC: University of South Carolina Press.|Bashir 2003]], p. 8. "نسخة مؤرشفة"। সংগ্রহের তারিখ 31 يناير 2023। এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:
|সংগ্রহের-তারিখ=
(সাহায্য) - ↑ تبديد الضلالات ص98
- ↑ ক খ গ ঘ https://books.google.com/books?id=MdRth02Q6nAC ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০২২-১২-০৯ তারিখে
- ↑ ক খ https://books.google.com/books?id=NjzbzQEACAAJ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০২২-০৫-২০ তারিখে
- ↑ The Promised One
- ↑ msf (২০২২-১০-১৯)। "شبهات حول المهدي (4) - منتدى العلماء" (আরবি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৮-৩১।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ https://www.youm7.com/story/2019/3/17/%D9%81%D9%89-%D8%B0%D9%83%D8%B1%D9%89-%D8%B1%D8%AD%D9%8A%D9%84%D9%87-%D9%84%D9%85%D8%A7%D8%B0%D8%A7-%D9%83%D8%B0%D8%A8-%D8%A7%D8%A8%D9%86-%D8%AE%D9%84%D8%AF%D9%88%D9%86-%D9%86%D8%A8%D9%88%D8%A1%D8%A9-%D8%A7%D9%84%D9%85%D9%87%D8%AF%D9%89-%D8%A7%D9%84%D9%85%D9%86%D8%AA%D8%B8%D8%B1/4174163 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০২৩-০২-১৬ তারিখে
- ↑ "لماذا أنكر شيخ سلفي شهير ظهور المهدي المنتظر؟ - النيلين"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-২৬।
- ↑ [https://web.archive.org/web/20170817075728/http://islamport.com/w/amm/Web/2569/6837.htm "�������� ������� - ����� ����� ��� ������ 1"]। ২০১৭-০৮-১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-২৬। replacement character in
|শিরোনাম=
at position 1 (সাহায্য) - ↑ "المكتبة المركزية - الجامعة الإسلامية بغزة"। ২০২২-১১-২৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-২৬।
- ↑ "لا مهدي يُنتظر بعد الرسول"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-২৬।
- ↑ "Book No Mahdi Is Waiting After The Messenger Muhammad The Best Of Mankind"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১২-১৬।
- ↑ "الرسائل (الكتب) - الغلاف - (9) لا مهدي يُنتظر بعد الرسول محمد صلى الله عليه وسلم خير البشر - الشيخ عبدالله بن زيد آل محمود"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১১-২৬।
- ↑ "القرضاوي ينكر المهدية"। Archived from the original on ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৩১ আগস্ট ২০২৩।
- ↑ "ص310 - كتاب الرد على من كذب بالأحاديث الصحيحة الواردة في المهدي - الرد على من كذب بالأحاديث الصحيحة الواردة في المهدي - المكتبة الشاملة"। shamela.ws। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৮-৩১।