কুরাইশ
কুরাইশ (আরবি: قُرَيْشٍ) একটি আরব গোত্র, যারা ইসলামের আবির্ভাবের আগে মক্কার নিয়ন্ত্রণে ছিল। এই গোত্রটি দশটি প্রধান উপগোত্রে বিভক্ত ছিল, যার মধ্যে বানু হাশিম উল্লেখযোগ্য, যেখানেই ইসলামের প্রবর্তক নবী মুহাম্মদ জন্মগ্রহণ করেন। সপ্তম শতকে কুরাইশরা সমৃদ্ধ ব্যবসায়ী গোত্রে পরিণত হয়, যারা ভারত মহাসাগর, পূর্ব আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগর অঞ্চলের বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত।[১] তারা গ্রীষ্মকালে গাজা ও দামেস্ক এবং শীতকালে ইয়েমেনের দিকে কাফেলা চালাত। এছাড়াও, এই বাণিজ্যপথে তারা খনিজ আহরণ ও অন্যান্য ব্যবসাও পরিচালনা করত।[২]
কুরাইশ قُرَيْشٍ | |
---|---|
আরবের অধিবাসী আদনানীয় গোত্র | |
![]() ৬৫৭ সালের জুলাইয়ে সিফফিনের যুদ্ধে ব্যবহৃত কুরাইশ পতাকা (প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী) | |
নৃগোষ্ঠী | আরব |
নিসবা | আল-কুরাইশী (الْقُرَشِي) |
অবস্থান | মক্কা, হিজাজ, আরব |
এর বংশ | ফিহর ইবনে মালিক |
প্রধান উপজাতি | কিনানা |
শাখা | তালিকা দেখুন:
|
ধর্ম | আরব পৌত্তলিকতা (৬৩০ সালের পূর্বে) ইসলাম (৬৩০–বর্তমান) |

যখন মুহাম্মদ(সাঃ) মক্কায় ইসলাম প্রচার শুরু করেন, তখন কুরাইশরা শুরুতে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মুহাম্মদের (সাঃ)প্রচারণা আরব পৌত্তলিকতার বিরোধিতা করতে থাকায় তারা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে।[৩][৪][৫] সম্পর্কের অবনতি ঘটলে, মুহাম্মদ(সাঃ) ও প্রাথমিক মুসলিমরা মদিনায় হিজরত করেন। সেখানে বানু আওস ও বানু খাজরাজ গোত্রের মধ্যে বিরোধ মেটাতে তারা সমঝোতা করেন।[৬][৭] তবে শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব না হওয়ায় কুরাইশরা মুহাম্মদের (সাঃ)অনুসারীদের হজ পালনে বাধা দিতে থাকে। এর ফলে মুহাম্মদ তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করেন, প্রধানত কুরাইশ কাফেলার ওপর আক্রমণের মাধ্যমে।[৮] এই আক্রমণগুলো ধীরে ধীরে বড় আকারের যুদ্ধে রূপ নেয়, যেমন বদরের যুদ্ধ, উহুদের যুদ্ধ ও "খন্দকের যুদ্ধ" (মদিনার উপকণ্ঠে)।[৯] এই সংঘর্ষ ও মদিনার রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে, যার মধ্যে তিনটি ইহুদি গোত্রের বিতাড়ন অন্তর্ভুক্ত, মুহাম্মদ তার সামরিক অভিযানের লক্ষ্য কুরাইশ কাফেলার পরিবর্তে উত্তরাঞ্চলের আরব গোত্রের দিকে সরিয়ে নেন, যেমন বানু লাহিয়ান ও বানু মুস্তালিক।[১০]
মদিনায় মুহাম্মদের (সাঃ)অবস্থান বজায় থাকায়, তার নিজ শহর মক্কার মানুষের মনোভাবও ধীরে ধীরে অনুকূল হয়। হুদায়বিয়ার সন্ধি ৬২৮ সালের মার্চে কুরাইশদের সঙ্গে দশ বছরের শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে এবং পরের বছর তাকে উমরাহ পালনের অনুমতি দেয়। এই তীর্থযাত্রার সময় মুহাম্মদ (সাঃ)তার গোত্রের সঙ্গে পুনর্মিলন করেন, যা মাইমুনার সঙ্গে তার বিয়ের মাধ্যমে প্রতীকীভাবে প্রকাশ পায়। এর পাশাপাশি খালিদ ইবনে ওয়ালিদ ও আমর ইবনে আস-এর মতো বেশ কিছু প্রভাবশালী মক্কাবাসী মুহাম্মদের প্রভাব অনুধাবন করে ইসলাম গ্রহণ করেন, এবং পরে প্রাথমিক মুসলিম বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।[১১]
ইসলামী সূত্র অনুযায়ী, হুদায়বিয়ার সন্ধি প্রায় দুই বছর পর কুরাইশরা ভঙ্গ করে; এই গোত্রের এক উপগোত্র প্রধান আবু সুফিয়ানের পরামর্শ উপেক্ষা করে তাদের অনুগত এক গোত্র বানু খুজা'আর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালায়, যারা মুহাম্মদের(সাঃ) মিত্র ছিল। এর ফলে মুহাম্মদ(সাঃ) ১০,০০০ সৈন্য নিয়ে মক্কা অভিযানে অগ্রসর হন। এই বাহিনীর আগমনে ভীত হয়ে আবু সুফিয়ান ও তার সঙ্গীরা, যার মধ্যে মুহাম্মদের(সাঃ) মিত্র খুজাঈ বুদাইল ইবনে ওয়ারকাও ছিলেন, তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে প্রতিরোধ না করা কুরাইশদের জন্য সাধারণ ক্ষমা চান। ফলে মুহাম্মদ (সাঃ)ও তার সৈন্যরা প্রায় বাধাহীনভাবে মক্কা প্রবেশ করেন এবং প্রায় সকল মক্কাবাসী ইসলাম গ্রহণ করে।[১২] মুহাম্মদের (সাঃ)৬৩২ সালের মৃত্যু পর, মুসলিম নেতৃত্ব সাধারণত কুরাইশ গোত্রভুক্ত ব্যক্তিদের হাতেই ন্যস্ত হয়। যেমন রাশিদুন, উমাইয়া ও আব্বাসীয়রা, এমনকি দাবি করা হয় ফাতিমীয়রাও কুরাইশ বংশোদ্ভূত ছিলেন।
নাম
সম্পাদনাকুরাইশ নামটির উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন উৎসে ভিন্ন ভিন্ন মত পাওয়া যায়। একটি মতে, এটি qirsh (শার্ক) শব্দের ক্ষুদ্র রূপ।[১৩] আরব বংশানুক্রমবিদ হিশাম ইবনে আল-কালবি দাবি করেন, কুরাইশ নামের কোনও নামধারী প্রতিষ্ঠাতা ছিল না;[১৪] বরং এই নাম এসেছে taqarrush শব্দ থেকে, যা একটি আরবি শব্দ এবং এর অর্থ "একত্র হওয়া" বা "সমিতি"। কুরাইশ নামটি গ্রহণ করা হয় তখন, যখন কুসাই ইবনে কিলাব, যিনি ফিহর ইবনে মালিকের ষষ্ঠ প্রজন্মের বংশধর, তার আত্মীয়স্বজনদের একত্র করেন এবং কাবার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এর আগে, ফিহরের বংশধরেরা তাদের কিনানা আত্মীয়দের মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, যাযাবরভাবে বসবাস করত।[১৫]
কুরাইশ গোত্রের নিসবা বা বংশগত উপাধি হলো কুরাইশী (Qurashī); তবে ইসলামের প্রাথমিক যুগে উম্মাহর মধ্যে অধিকাংশ কুরাইশ সদস্য তাদের নির্দিষ্ট উপগোত্রের নামেই পরিচিত হতেন। পরবর্তী সময়ে, বিশেষ করে ১৩শ শতকের পর, যেসব ব্যক্তি কুরাইশীয় বংশধর বলে দাবি করতেন, তারা কুরাইশী উপাধি ব্যবহার করতে শুরু করেন।[১৩]
ইতিহাস
সম্পাদনাউৎপত্তি
সম্পাদনাকুরাইশদের প্রসূতা ছিলেন ফিহর ইবনে মালিক। প্রথাগত আরব সূত্র অনুযায়ী, তার পূর্ণ বংশপরিচয় ছিল: ফিহর ইবনে মালিক ইবনে আন-নাদর ইবনে কিনানা ইবনে খুজাইমা ইবনে মুদরিকা ইবনে ইলিয়াস ইবনে মুদার ইবনে নিজার ইবনে মা'দ ইবনে আদনান।[১৫] সুতরাং, ফিহর কিনানা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন এবং তার বংশধারা আদনান পর্যন্ত পৌঁছে, যিনি ছিলেন ইসমাইলি বংশধর ও কথিতভাবে "উত্তর আরবদের" জনক।
প্রথাগত সূত্র অনুযায়ী, ফিহর কাবার রক্ষায় কিনানা ও খুজাইমা গোত্রের যোদ্ধাদের নেতৃত্ব দেন, যখন ইয়েমেন থেকে আগত কিছু গোত্র কাবার ওপর আক্রমণ করে। সে সময় কাবা ছিল মক্কার একটি প্রধান পৌত্তলিক তীর্থস্থান। তবে, তীর্থস্থানের দায়িত্ব ও সংশ্লিষ্ট সুযোগ-সুবিধা ইয়েমেনি খুজাআ গোত্রের হাতেই রয়ে যায়।
কুরাইশ নামটি গৃহীত হয় তখন, যখন কুসাই ইবনে কিলাব, যিনি ফিহর ইবনে মালিকের ষষ্ঠ প্রজন্মের বংশধর, তার আত্মীয়স্বজনদের একত্র করেন এবং কাবার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। এর পূর্বে, ফিহরের বংশধরেরা তাদের কিনানা আত্মীয়দের মাঝে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাযাবর জীবন যাপন করতেন।[১৫]
উপগোত্রসমূহ
সম্পাদনাউপগোত্র | বংশপরিচয় | জোট | উল্লেখযোগ্য সদস্য |
---|---|---|---|
বানু আবদ আদ-দার | আবদ আদ-দার ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুর্রা ইবনে কাআব ইবনে লু'য়্য ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।[১৫] | আহলাফ | মুসআব ইবনে উমায়র |
বানু মাখজুম | মাখজুম ইবনে ইয়াকাজা ইবনে মুর্রা ইবনে কাআব ইবনে লু'য়্য ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।[১৫] | আহলাফ | আবু জাহল, ওয়ালিদ ইবনে আল-মুগীরা, আবু হুযাইফা ইবনে মুগীরা খালিদ ইবনে ওয়ালিদ |
বানু আদি | আদি ইবনে কাআব ইবনে লু'য়্য ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।[১৫] | আহলাফ | আল-খাত্তাব ইবনে নুফাইল উমর ইবনে আল-খাত্তাব, জায়দ ইবনে আমর, আল-শিফা বিনতে আবদুল্লাহ আবদুল্লাহ ইবনে উমর |
বানু সহম | সহম ইবনে আমর ইবনে হুসাইস ইবনে কাআব ইবনে লু'য়্য ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।[১৫] | আহলাফ | আল-আস ইবনে ওয়াঈল, আমর ইবনে আস |
বানু জুমাহ | জুমাহ ইবনে আমর ইবনে হুসাইস ইবনে কাআব ইবনে লু'য়্য ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।[১৫] | আহলাফ | উমাইয়া ইবনে খালাফ, সুফওয়ান ইবনে উমাইয়া |
বানু আবদ শামস (পরে বানু উমাইয়া) |
আবদ শামস ইবনে আবদ মানাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুর্রা ইবনে কাআব ইবনে লু'য়্য ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।[১৫] | মুত্তাইয়াবুন পরে আহলাফ |
উমাইয়া ইবনে আবদ শামস, আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, উকবা ইবনে আবু মুয়াইত উসমান ইবনে আফফান, উম্মে হাবিবা মুআবিয়া ই |
বানু নওফাল | নওফাল ইবনে আবদ মানাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুর্রা ইবনে কাআব ইবনে লু'য়্য ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।[১৫] | মুত্তাইয়াবুন পরে আহলাফ |
জুবাইর ইবনে মুত্তইম |
বানু আমির | আমির ইবনে লু'য়্য ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।[১৫] | সুহাইল ইবনে আমর, আবদুল্লাহ ইবনে সুহাইল | |
বানু হাশিম (পরে বানু আবদুল মুত্তালিব) |
হাশিম ইবনে আবদ মানাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুর্রা ইবনে কাআব ইবনে লু'য়্য ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।[১৫] | মুত্তাইয়াবুন পরে ফুদুল |
মুহাম্মদ আবদুল মুত্তালিব, হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব, আবু তালিব ইবনে আবদুল মুত্তালিব, আল-আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব আলী |
বানু জুহরা | জুহরা ইবনে কিলাব ইবনে মুর্রা ইবনে কাআব ইবনে লু'য়্য ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।[১৫] | মুত্তাইয়াবুন পরে ফুদুল |
আবদ মানাফ ইবনে জুহরা, ওয়াহব ইবনে আবদ মানাফ, আমিনাহ বিনতে ওয়াহব আবদুর রহমান ইবনে আওফ, সা'দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস |
বানু তৈম | তৈম ইবনে মুর্রা ইবনে কাআব ইবনে লু'য়্য ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।[১৫] | মুত্তাইয়াবুন পরে ফুদুল |
আবু বকর তালহা ইবনে উবাইদুল্লাহ, আয়েশা, আসমা বিনতে আবু বকর |
বানু আসাদ | আসাদ ইবনে আবদুল উজ্জা ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুর্রা ইবনে কাআব ইবনে লু'য়্য ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।[১৫] | মুত্তাইয়াবুন পরে ফুদুল |
খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ওয়ারাকা ইবনে নওফাল জুবাইর ইবনে আওয়াম আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইর |
বানু আল-হারিস ইবনে ফিহর | আল-হারিস ইবনে ফিহর।[১৫] | মুত্তাইয়াবুন পরে ফুদুল |
আবু উবাইদা ইবনে আল-জাররাহ |
বানু মুত্তালিব | আল-মুত্তালিব ইবনে আবদ মানাফ ইবনে কুসাই ইবনে কিলাব ইবনে মুর্রা ইবনে কাআব ইবনে লু'য়্য ইবনে গালিব ইবনে ফিহর।[১৫] | ফুদুল | ইমাম আশ-শাফিঈ (প্রসিদ্ধ ফকিহ) |
বংশবৃক্ষ
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Bosworth এবং অন্যান্য 1998, পৃ. 434।
- ↑ Bosworth এবং অন্যান্য 1998, পৃ. 435।
- ↑ Buhl ও Welch 1993, পৃ. 364।
- ↑ "Muhammad | Biography, History, & Facts | Britannica"। www.britannica.com (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২৩-০৫-২৪। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৫-২৭।
- ↑ Lewis 2002, পৃ. 35–36।
- ↑ Buhl ও Welch 1993, পৃ. 364-367।
- ↑ "Aws and Khazraj"। www.brown.edu। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৫-২৭।
- ↑ Buhl ও Welch 1993, পৃ. 269।
- ↑ Buhl ও Welch 1993, পৃ. 369-370।
- ↑ Buhl ও Welch 1993, পৃ. 370।
- ↑ Buhl ও Welch 1993, পৃ. 371।
- ↑ Buhl ও Welch 1993, পৃ. 372।
- ↑ ক খ Watt 1986, পৃ. 435।
- ↑ Peters 1994, পৃ. 14।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ ঝ ঞ ট ঠ ড ঢ ণ ত থ Watt 1986, পৃ. 434।