ফেরেশতা
ফিরিশতা বা ফেরেশতা(আরবি: ملاءكة)(ইংরেজি: Angels) ইসলামী বিশ্বাসমতে স্বর্গীয় দূত। আরবিতে ফেরেশতাদের একবচনে মালাক ও বহুবচনে মালাইক বলে। তাদের সম্পর্কে বলা হয়, তারা মানুষের ন্যায় আল্লাহর আরেক সৃষ্টি।
তাঁরা দিনরাত ক্লান্ত না হয়ে আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করেন[১] এবং আল্লাহর অবাধ্য হবার কোনো ক্ষমতা তাদের নেই। ফেরেশতারা নূর তথা আলোর তৈরি।[২] তারা খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করেন না। তারা পবিত্র স্থানে অবস্থান করেন। তারা যেকোনো স্থানে গমনাগমন ও আকৃতি পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখেন। ইসলাম, খ্রিস্টান ও ইহুদী ধর্মে বলা হয়েছে ।
কুরআনে ফেরেশতাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে,
"তারা আল্লাহ তা’আলা যা আদেশ করেন, তা অমান্য করে না এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাই করে।"[কুরআন ৬৬:৬]
শব্দ ব্যবহারসম্পাদনা
কিছু মুসলিম আলেম মূল ইসলামী আরবী শব্দ "মালাক" (ملك)-এর ব্যবহারকে অধিক উৎসাহিত করে থাকেন, যুক্তি হিসেবে তারা বলেন, মালাক শব্দটি কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে, তাই শব্দটি বলার সময় প্রতি হরফে দশ নেকি করে ৬ হরফে মোট ৬০ নেকি সাওয়াব পাওয়া যাবে, যা ফেরেশতা বা অন্যান্য অ-কুরআনীয় প্রতিশব্দ উচ্চারণে পাওয়া যাবে না। কুরআনীয় শব্দ বলায় প্রতি হরফে দশ নেকির ক্ষেত্রে তারা নবী মুহাম্মদের উক্ত হাদীসটি পেশ করেন,
রাসূল (সা.) বলেছেন,
مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ
‘আল্লাহ তাআলার কিতাবের একটি হরফ যে ব্যক্তি পাঠ করবে তার জন্য এর সওয়াব আছে। আর সওয়াব হয় তার দশ গুণ হিসেবে। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ।’
— [সুনানে তিরমিযি, হাদিস: ২৯১০]
ফেরেশতা কারা, তাদের পরিচয় কী?সম্পাদনা
ফেরেশতা আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টি। আল্লাহ তাআলা নুর বা ঐশী জ্যোতি থেকে তাদের সৃষ্টি করেছেন। তারা আল্লাহর অতি সম্মানিত ও পুণ্যবান সৃষ্টি। তারা সবসময় আল্লাহর ইবাদতে মগ্ন থাকেন। পানাহার, বৈবাহিক ও জৈবিক চাহিদা থেকে তারা পুরোপুরি মুক্ত থাকেন। তারা পুরুষও নন, নারীও নন।
আল্লাহর হুকুমে ফেরেশতারা বিভিন্ন আকার ও রূপ ধারণ করতে পারেন। মানুষের মতো রক্ত-মাংসের সৃষ্টি না হওয়ায়, তাদের কামনা-বাসনা, পানাহারের প্রয়োজনীয়তা ও ঘুম-বিশ্রাম কিছুই নেই। তাদের সংখ্যা মোট কত, তা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। ফেরেশতা শব্দের কথা
‘ফেরেশতা’ মূলত একটি ফার্সি শব্দ। আরবির ‘মালাকুন’ (একবচন) ও ‘মালাইকা’ (বহুবচন)-এর প্রতিশব্দ এটি। কোরআন ও হাদিসে ‘মালাইকা’ শব্দটিই ব্যবহৃত হয়েছে। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বার্তাবাহক।
ইসলামের পরিভাষায় ফেরেশতা এমন ‘নুরানি’ (আলোকিত) সৃষ্টির নাম, যারা যেকোনো সময় বিভিন্ন রূপ-আকৃতি ধারণ করতে পারেন। তারা কখনো আল্লাহর নির্দেশের বিরুদ্ধাচরণ করেন না। বরং সর্বদা আল্লাহর নির্দেশ আত্মসমর্পিত থাকেন। (কাওয়াইদুল ফিকহ, সাইয়েদ মুহাম্মদ আমিমুল ইহসান, পৃষ্ঠা ৫০৪)
ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান
ফেরেশতাদের অস্তিত্ব বিশ্বাস করা ঈমানের অন্যতম স্তম্ভ। আল্লাহ ইরশাদ, ‘...কেউ আল্লাহ, তার ফেরেশতা, তার কিতাবসমূহ, তার রাসুলগণ ও পরকালে বিশ্বাস না করলে সে তো মারাত্মকভাবে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়বে। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৩৬)
ফেরেশতাদের সম্মানের কথা উল্লেখ করে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘(এ কোরআন) মহান, পূত-পবিত্র লিপিকরের ( ফেরেশতার) হাতে লিপিবদ্ধ। ’ (সুরা আবাসা, আয়াত : ১৫-১৬)
ফেরেশতা সৃষ্টির ব্যাপারে হাদিস শরিফে এসেছে, ‘ফেরেশতাদের সৃষ্টি করা হয়েছে, আল্লাহর নুর বা ঐশী আলো থেকে। ’ (মুসলিম শরিফ, হাদিস নং : ২৯৯৬)
ফেরেশতাদের রূপ-বৈশিষ্ট্য
ফেরেশতাদের ডানা রয়েছে। অনায়াসে তারা যেখানে-সেখানে বিচরণ করতে পারেন। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘সব প্রশংসা আকাশ ও পৃথিবীর স্রষ্টা আল্লাহর, যিনি ফেরেশতাদের বার্তাবাহক করেন, যারা দুই দুই, তিন তিন বা চার চার পক্ষবিশিষ্ট। তিনি সৃষ্টিতে যা ইচ্ছা বৃদ্ধি করেন। আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। (সুরা ফাতির, আয়াত : ০১)
ফেরেশতারা অত্যন্ত সুন্দর আকৃতির অধিকারী। মহান আল্লাহ হজরত জিবরাঈল (আ.) সম্পর্কে ইরশাদ করেছেন, ‘তাকে (হজরত মুহাম্মদ (সা.) শিখিয়েছে শক্তিশালী ও প্রজ্ঞাবান এমন একজন (ফেরেশতা), যে নিজে (সুন্দর আকৃতিতে) স্থির ছিল। ’ (সুরা নাজম, আয়াত : ৫-৬)
ফেরেশতাদের রূপ ও সৌন্দর্য উপমা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। তাই হজরত ইউসুফ (আ.)-কে দেখে নারীরা বলেছিল, ‘...অদ্ভুত আল্লাহর মাহাত্ম্য! এ তো মানুষ নয়, এ তো এক মহিমান্বিত ফেরেশতা। ’ (সুরা : ইউসুফ, আয়াত : ৩১)
দায়িত্ব পালনে তাদের ক্লান্তি ও অবাধ্যতা নেই
সৃষ্টিগতভাবে ফেরেশতাদের আল্লাহর অবাধ্যতার শক্তি দেওয়া হয়নি। সর্বদা তারা আল্লাহর হুকুম পালন করেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘...তারা (ফেরেশতারা) তা অমান্য করে না, যা আল্লাহ তাদের আদেশ করেন। তারা যা করতে আদিষ্ট হয়, তা-ই করে। ’ (সুরা : তাহরিম, আয়াত : ৬)
নিজ নিজ দায়িত্ব পালনে কোনো ক্লান্তি-শ্রান্তি ও অবসাদ ফেরেশতাদের আসে না। মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘...যারা তোমার প্রতিপালকের সামনে আছে, তারা তো দিন ও রাতে তার পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তারা ক্লান্তি বোধ করে না। ’ (সুরা হামিম সিজদা, আয়াত : ৩৮)
তারা খুবই শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকেন
ফেরেশতারা খুবই শৃঙ্খলাপরায়ণ। তাদের শৃঙ্খলা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, ‘(কিয়ামতের দিন) তোমার প্রতিপালক উপস্থিত হবেন। সারিবদ্ধভাবে ফেরেশতারাও (উপস্থিত হবেন)। ’ (সুরা : ফাজর, আয়াত : ২২)
তাদের রয়েছে বিভিন্ন দায়িত্ব ও কর্তব্য
আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের কারো কারো নাম ও কর্ম সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছেন। আর অবশিষ্টদের সম্পর্কে কেবল তিনিই জানেন। আল্লাহ তাদের দায়িত্বে বিভিন্ন কর্ম-দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। একেক দলকে একেক কাজে নিয়োজিত করেছেন।
শ্রেণীবিন্যাসসম্পাদনা
ফেরেশতাদের সংখ্যা অগণিত। কোনো কোনো ইসলামী চিন্তাবিদ কাজের উপর ভিত্তি করে ফেরেশতাদের চৌদ্দটি শ্রেণীতে ভাগ করে থাকেন। যাদের মধ্যে চারজনকে উচ্চমর্যাদার ফেরেশতা বলা হয়ে থাকে।
- হামালাতুল আরশ: এরা হল আল্লাহর আরশের বাহক।
- জিবরাইল [আ.]: এই ফেরেশতার নাম তিনবার ইসলাম ধর্মের ধর্মগ্রন্থ কুরআন শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে তাকে পবিত্র আত্মা বা রুহুল কুদুস বলা হয়েছে।[৩] আল্লাহর আদেশ-নিষেধ এবং সংবাদ আদান-প্রদান যেসব ফেরেশতার দায়িত্ব, জিব্রাইল তাদের প্রধান। বলা হয়, জিব্রাইল-ই আল্লাহর নবীদের বা বাণীবাহকদের কাছে ওহী পৌছিয়ে দিতেন।
- মিকাইল [আ.]: কুরআনে এই ফেরেশতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।[৪] ইনি বৃষ্টি ও খাদ্য উৎপাদনের দায়িত্বপ্রাপ্ত।
- ইসরাফিল [আ.]: এই ফেরেস্তা কিয়ামত বা মহাপ্রলয় ঘোষণা করবেন। তার নাম কুরআন শরীফে নেই কিন্তু হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে।
- আজরাইল [আ.]: তাকে কুরআনে মালাক আল-মাউত নামে অভিহিত করা হয়েছে।[৫] ইনি মৃত্যুর ফেরেশতা ও প্রাণ হরণ করেন।
- সাতটি বেহেশতের ফেরেশতাগণ।
- হাফাজা বা তত্ত্বাবধায়ক ফেরেশতাগণ।
- মুনকার ও নাকীর: কবরে প্রশ্নকারী ফেরেশতাদ্বয়।
- দারদায়িল[৬]
- মালিক: জাহান্নাম বা নরক তত্ত্বাবধানকারী ফেরেশতা।
- রেদওয়ান: জান্নাত বা স্বর্গ তত্ত্বাবধানকারী ফেরেশতা।
- জাবানিয়া: জাহান্নামে দায়িত্ব পালনকারী ফেরেশতাগণ।
- নিয়ম শৃঙ্খলা পালনকারী ফেরেশতাগণ।
এছাড়াও বিশেষ দুজন ফেরেশতা কিরামুন ও কাতিবীন প্রতিজন মানুষের ভালো-মন্দ কাজের হিসাব রাখেন।[৭]
আল কুরআনে ফেরেশতাগণসম্পাদনা
চার ফেরেশতাগনের নাম ও পরিচয়সম্পাদনা
কোরআন হাদীসের আলোকে বোঝা যায় চার জন সবচেয়ে বড় ফেরেশতা আছেন। যাদের নাম ভিন্ন এবং কাজও ভিন্ন। তাহারা আল্লাহর হুকুম পালনে বদ্ধপরিকর। কোন ফেরেশতা মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণ করতে পারে না। আল্লাহ্ ছাড়া কেউ কারো কোন কল্যাণ-অকল্যাণের মালিক নয়। ফেরেশতা, জিন, মানুষ, নবী, ওলী কেউ না।
ফেরেশতাগন মানুষের ন্যায় আল্লাহর আরেক সৃষ্টি। তারা দিনরাত ক্লান্ত না হয়ে আল্লাহ্-র পবিত্রতা ও মহিমা বর্ণনা করেন এবং আল্লাহর অবাধ্য হবার কোনো ক্ষমতা তাদের নেই। ফেরেশতারা নূর তথা আলোর তৈরি। তারা খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করেন না। তারা পবিত্র স্থানে অবস্থান করেন। তারা যেকোনো স্থানে গমনাগমন ও আকৃতি পরিবর্তনের ক্ষমতা রাখেন[৬]।
চার ফেরেশতা গনের নাম সমূহ ।
【1】হযরত জিবরাঈল ( আঃ )
【2】হযরত ইসরাফিল ( আঃ )
【3】হযরত মীকাইল ( আঃ )
【4】হযরত আজরাইল ( আঃ )
■ হযরত জিবরাঈল ( আঃ ) এর পরিচিতি:
ওহী নাযিল করার দায়িত্ব ছিল হযরত জিবরাঈল (আঃ) এর কাজ। হযরত জিবরাঈল ( আঃ) কে বলা হয় সকল ফেরেশতা গনের সরদার। তিনার নাম তিনবার কুরআন শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনে তাকে পবিত্র আত্মা বা রুহুল কুদুস বলা হয়েছে। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ এবং সংবাদ আদান-প্রদান যেসব ফেরেশতার দায়িত্ব, জিব্রাইল তাদের প্রধান। বলা হয়, জিব্রাইল-ই আল্লাহর নবীদের বা বাণীবাহকদের কাছে ওহী পৌছিয়ে দিতেন।
■ হযরত ইসরাফিল ( আঃ ) এর পরিচিতি :
হযরত ইসরাফীল (আঃ) এর দায়িত্ব হচ্ছে আল্লাহর নির্দেশ ক্রমে শিঙায় ফুৎকার দেয়া। এবং তিনাকে এই কাজের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আর এই কাজটি করা হবে পৃথিবী ধ্বংসের দিন অর্থাৎ কেয়ামতের দিন। এই দিন সকাল থেকেই যথাক্রমে তিনবার ফু দেওয়া হবে তখনই পুরো পৃথিবীসহ পুরো জগত চন্দ্র সূর্য আকাশ গ্রহ নক্ষত্র সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে। তার নাম কুরআন শরীফে নেই কিন্তু হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে।
■ হযরত মীকাইল ( আঃ ) এর পরিচিতি ।
হযরত মীকাঈল ফেরেশতার কাজ হচ্ছে তিনি আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ অনুযায়ী বৃষ্টি বর্ষণ করান, উদ্ভিদ উৎপাদন, প্রভৃতি কাজে নিয়োজিত। কুরআনে এই ফেরেশতার নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
■ হযরত আজরাইল ( আঃ ) পরিচিতি :
প্রাণীকুলের জান কবজের কাজে নিয়োজিত ফেরেশতা হলো মালাকুল মাওত হযরত আজরাঈল ( আঃ )। কুরআনে মালাক আল-মাউত নামে অভিহিত করা হয়েছে হযরত আজরাইল ( আঃ ) কে।
ইবলিশ কি একজন ফেরেশতা ছিল নাকি জিন?সম্পাদনা
খ্রিষ্টানদের মধ্যে এমন ধারণা আছে যে, ইবলিস আসলে একজন সম্মানিত ফেরেশতা ছিল, তারপর তাকে বের করে দেওয়া হয় এবং সে শয়তান হয়ে যায়। অনেক মুসলিমও এই ধারণা রাখেন, যখন তারা এই আয়াতটি পড়েন—
“যখন ‘আমি’ ফেরেশতাদেরকে বলেছিলাম, ‘আদমের প্রতি সিজদা করো’, তখন তারা সিজদা করেছিল, তবে ইবলিস ছাড়া।…” [সূরা বাকারাহ ২:৩৪]
ইবলিসকে তার জ্ঞান এবং যোগ্যতার জন্য ফেরেশতা উপাধি দেয়া হয় আর তার নতুন নাম দেয়া হয় আজাজিল (“আল্লাহ্ শক্তিদানকারী” in Hebrew) [(Hebrew: עֲזָאזֵל, Azazel; Arabic: عَزازِيل, Azāzīl)]। অর্থাৎ ইবলিস জেনেটিকালি জিন হলেও সে ফেরেশতার সম্মান প্রাপ্ত ছিল। এরপর আদমকে সিজদার আদেশ অমান্য করার পর তার নাম হয় ইবলিস বা অভিশপ্ত। তারমানে এখানে ফেরেশতা হিসেবে সম্বোধন করলেও কোন সমস্যা থাকে না[২]।
তাছাড়া আরবি ভাষা এই ধরনের বাক্য গঠন করতে দেয়— “সেদিন সন্ধায় দাওয়াতে আমার সব আত্মীয়রাই এসেছিল, ফখরুদ্দীন ছাড়া।” এখানে ফখরুদ্দীন আমার আত্মীয় ছিল না, সে ছিল বাবুর্চি।
আরবি ব্যাকরণে তাগ্লীব নামে একটা ব্যাপার আছে। এর মানে, যদি Majority-কে সম্বোধন করা হয়, তবে Minority-ও এতে সাড়া দেবে। যেমন, এক ক্লাসে ১০০ জনের মধ্যে ৯৯ জন ছেলে, একজন মেয়ে। যদি বলা হয় আরবিতে, ছেলেরা দাঁড়াও, তবে, সেই মেয়েও উঠে দাঁড়াবে। এটাই তাগ্লীব। মেয়েকে আলাদাভাবে সম্বোধনের দরকার নেই।
একইভাবে কুরআনে আল্লাহ্ যখন ফেরেশতাদের ডাকলেন, তখন আলাদাভাবে জিন ইবলিসকে ডাকার দরকার নেই।
ইবলিস ফেরেশতা ছিল না- এর আরও একটা প্রমাণ হল সে যদি ফেরেশতা হত, তাহলে আল্লাহ্র নির্দেশ অমান্য করতো না। কারণ কুরআনেই ফেরেশতাদের প্রাথমিক গুণ সম্পর্কে বলা হয়েছে- “তারা আল্লাহ্র আদেশ অমান্য করে না, এবং যা করতে আদেশ করা হয়, তাই করে।” [সূরা আত-তাহরীম ৬৬:৬]
ইবলিস যে জিন ছিল এব্যাপারে কুরআনে পরিষ্কার আয়াত রয়েছে-
“‘আমি’ যখন ফেরেশতাদেরকে বললাম, “আদমের প্রতি সিজদা করো’, তারা সবাই করেছিল, ইবলিস ছাড়া—সে ছিল জিনদের একজন।” [সূরা আল-কাহফ ১৮:৫০]
যে ৭ জন ব্যক্তির জন্য ফেরেশতারা দোয়া করেন :সম্পাদনা
১. ওযূ অবস্থায় ঘুমানো ব্যক্তিসম্পাদনা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "যে ব্যক্তি পবিত্র অবস্থায় (ওজূ অবস্থায়) ঘুমায় তার সাথে একজন ফেরেশতা নিয়োজিত থাকে। অতঃপর সে ব্যক্তি ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার সাথেই আল্লাহতালার সমীপে ফেরেশতাটি প্রার্থনায় বলে থাকে, হে আল্লাহ! তোমার অমুক বান্দাকে ক্ষমা করে দাও, কেননা সে পবিত্রাবস্থায় ঘুমিয়েছিল।"
(আল ইহসান ফি তাকরির সহীহ ইবনে হিব্বান ৩/৩২৮-৩২৯)
২. সালাতের জন্য মসজিদে অপেক্ষারত ব্যক্তিসম্পাদনা
আবু হুরাইরা (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "তোমাদের মাঝে কোন ব্যক্তি যখন ওযূ অবস্থায় সালাতের অপেক্ষায় বসে থাকে সে যেন সালাতেই রত। তার জন্য ফেরেশতারা দোয়া করতে থাকে, হে আল্লাহ! তুমি তাকে ক্ষমা করো, হে আল্লাহ! তুমি তার প্রতি দয়া করো।"
(সহীহ মুসলিম ৬১৯)
৩. প্রথম কাতারে সালাত আদায়কারীসম্পাদনা
বারা' (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, "প্রথম কাতারের নামাযীদেরকে নিশ্চয়ই আল্লাহতালা ক্ষমা করেন ও ফেরেশতারা তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে।"
৪. রাসূল (সাঃ) এর প্রতি দুরূদ পাঠকারীসম্পাদনা
"যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ওপর দুরূদ পাঠ করবে আল্লাহতালা তার ওপর সত্তর বার দয়া করেন ও তার ফেরেশতারা তার জন্য সত্তরবার ক্ষমা প্রার্থনা করবে। অতএব বান্দারা অল্প দুরূদ পাঠ করুক বা অধিক দুরূদ পাঠ করুক (এটা তার ব্যাপার)।"
৫. রোগী পরিদর্শনকারীসম্পাদনা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে কোন মুসলিম তার অপর মুসলিম ভাইকে দেখতে যায়, আল্লাহতালা তার জন্য সত্তর হাজার ফেরেশতা প্রেরণ করেন, তারা দিনের যে সময় সে দেখতে যায় সে সময় থেকে দিনের শেষ পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে এবং সে রাতের যে সময় দেখতে যায় সে সময় থেকে রাতের শেষ পর্যন্ত তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকে।"
(সহীহ ইবনে হিব্বান ২৯৫৮)
৬. মুসলিম ভাইয়ের জন্য দোয়াকারীসম্পাদনা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, কোন মুসলিম তার অনুপস্থিত ভাইয়ের জন্য দোয়া করলে তা কবুল করা হয় এবং তার মাথার কাছে একজন ফেরেশতা নিযুক্ত থাকে। যখনই সে ব্যক্তি তার ভাইয়ের জন্য কল্যাণের দোয়া করে তখন সে নিযুক্ত ফেরেশতা বলে, আমীন অর্থাৎ হে আল্লাহ! কবুল করুন এবং তোমার জন্য অনুরূপ। " (তোমার ভাইয়ের জন্য যা চাইলে আল্লাহ তোমাকেও তাই দান করুন।)
(সহীহ মুসলিম ৮৮)
৭. কল্যাণের পথে দানকারীসম্পাদনা
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "প্রতিদিন সকালে দু'জন ফেরেশতা অবতরণ করেন, একজন বলেন, হে আল্লাহ! দানকারীর সম্পদ বাড়িয়ে দাও। আর অপরজন বলেন, হে আল্লাহ! যে দান করে না তার সম্পদকে বিনাশ করে দাও।"
(বুখারী ১৪৪২)
ফেরেশতারা কী কী করে জানেন?সম্পাদনা
ফেরেশতা— আল্লাহর এক অপার সৃষ্টি। তাদের বাসস্থান আসমানে, নিজস্ব জগতে তাদের আকার-আকৃতি আছে; কিন্তু মানুষের কাছে তাদের প্রকাশ্য কোনো রূপ-আকৃতি নেই। তারা মহান আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে নবী ও রাসুলদের কাছে বিভিন্ন বার্তা পৌঁছে দিতেন[৬]।
কোরআন-হাদিসের বহু জায়গায় ফেরেশতাদের নিয়ে আলোচনায় এসেছে। এখানে তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য আলোচনা করা হলো—
ফেরেশতারা কীসের তৈরি?সম্পাদনা
আল্লাহ তাআলা এই জাতিকে নুর থেকে সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা মানুষের মতো রক্ত-মাংসের সৃষ্টি নয়। মানবজাতিকে সৃষ্টি করার আগেই তাঁদের আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছেন। আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ফেরেশতাদের নুর দ্বারা সৃষ্টি করা হয়েছে। আর জিন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছে ধোঁয়াশূন্য অগ্নিশিখা থেকে এবং আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে ওই বস্তু থেকে যে সম্পর্কে তোমাদের বর্ণনা করা হয়েছে। (মুসলিম, হাদিস : ৭৩৮৫)
ফেরেশতাদের কি ডানা আছে?সম্পাদনা
আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের পালকবিশিষ্ট ডানা দান করেছেন, যা দ্বারা তারা উড়তে পারে। আল্লাহ তাআলা বলেন, সকল প্রশংসা আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহরই, যিনি প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করেন ফিরিশতাদের যারা দুই দুই, তিন তিন অথবা চার চার ডানাবিশিষ্ট। তিনি সৃষ্টিতে যা ইচ্ছা বৃদ্ধি করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান। (সুরা ফাতির, আয়াত: ১)
ফেরেশতাদের পাখার সংখ্যা বিভিন্ন। কারো দুই, কারো তিন এবং কারো চার পাখা রয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে একেক ফেরেশতাকে আল্লাহ একেক রকমের শক্তি দান করেছেন। যাকে দিয়ে যেমন কাজ করাতে চান তাকে ঠিক তেমনিই দ্রুতগতি ও কর্মশক্তিও দান করেছেন। এক হাদিসে এসেছে, জিবরাইল (আ.)-এর ছয় শ পাখা রয়েছে। (বুখারি, হাদিস : ৪৮৫৬)
ফেরেশতারা কেমন সুন্দর?সম্পাদনা
আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের অত্যন্ত সুন্দর কাঠামো ও শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, তাকে (রাসুলকে) শিক্ষা দান করেছেন প্রচণ্ড শক্তিশালী, সৌন্দর্যপূর্ণ সত্তা। অতঃপর তিনি স্থির হয়েছিলেন। (সুরা নাজম, আয়াত : ৫-৬)
এর দ্বারা বোঝা যায় যে ফেরেশতারা অত্যন্ত সুন্দর। তারা যেমন সুন্দর তাদের চরিত্রও তেমনি। তাই তারা কোনো খারাপ আকৃতি গ্রহণ করেন না।
ফেরেশতারা কি পানাহার করে?সম্পাদনা
ফেরেশতারা কোনো কিছু আহার ও পান করেন না। আল্লাহ তাআলা তাদের এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন যে তাদের কোনো আহার তন্দ্রা-নিদ্রার প্রয়োজন হয় না। তারা সর্বদাই আল্লাহর ইবাদতে লিপ্ত থাকে। একদা একদল ফেরেশতা মানবাকৃতিরূপে ইবরাহিম (আ.)-এর কাছে আগমন করে। তিনি দ্রুততার সঙ্গে তাদের জন্য খাবার পরিবেশন করলেন। কিন্তু তারা খাবার গ্রহণ করল না, তারা বলল, আমরা ফেরেশতা। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘অতঃপর ইবরাহিম তার স্ত্রীর কাছে দ্রুত চুপিসারে গেলেন এবং একটি মোটা-তাজা গো-বাছুর (ভাজা) নিয়ে এলেন। অতঃপর তিনি তা তাদের সামনে রেখে বলেন, ‘তোমরা কি খাবে না? এতে তাদের সম্পর্কে তার মনে ভীতির সঞ্চার হলো। তারা বলল, ‘ভীত হবেন না।’ আর তারা তাকে এক জ্ঞানীপুত্র সন্তানের সুসংবাদ দিল।’ (সুরা জারিয়াত, আয়াত : ২৭-২৮)
তারা যেকোনো রূপ ধারণ করতে পারে : ফেরেশতাদের আল্লাহ তাআলা এমন যোগ্যতা দিয়েছেন যে তারা যখন যে রূপ ধারণ করতে মন চায় তা ধারণ করতে পারে। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, জিবরাইল (আ.)-কে দেখলাম তার কাছাকাছি সদৃশ ব্যক্তি হচ্ছে দিহইয়া। (মুসলিম, হাদিস : ৩১২)
ফেরেশতারা কখনো ক্লান্ত হয় নাসম্পাদনা
ফেরেশতারা কখনো বিরক্ত কিংবা ক্লান্তিবোধ করেন না। মানুষ যেভাবে অনেক পরিশ্রমের ফলে ক্লান্ত হয়ে যায় তারা সে রকম নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা দিন-রাত তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে, তারা ক্লান্তও হয় না।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ২২০)
ফেরেশতাদের বংশবিস্তার হয় কি?
ফেরেশতা কোনো লিঙ্গের অন্তর্ভুক্ত নয়। তাদের আল্লাহ তাআলা কোনো প্রবৃত্তি দেননি, কামভাব সৃষ্টি হয় না। তারা বিবাহ-শাদি করেন না এবং তাদের বংশ বিস্তার হয় না। আল্লাহ তাআলা বলেন, আর তারা বলে, ‘দয়াময় (আল্লাহ) সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি পবিত্র, মহান! তারা (ফেরেশতা) তো তার সম্মানিত বান্দা।’ (সুরা আম্বিয়া[২], আয়াত : ২৬)
ফেরেশতাদের সংখ্যা কতো?সম্পাদনা
তাদের সংখ্যা আল্লাহ ছাড়া কারো জানা নেই। তাদের সংখ্যা একটি হাদিস থেকে অনুমান হয়। মেরাজের ঘটনা বর্ণনার সময় রাসুল (সা.) বলেন, ‘অতঃপর বায়তুল মামুরকে আমার সামনে প্রকাশ করা হলো। আমি জিবরাইল (আ.)-কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বলেন, এটি বায়তুল মামুর। প্রতিদিন এখানে ৭০ হাজার ফেরেশতা নামাজ আদায় করে। এরা এখান থেকে একবার বের হলে দ্বিতীয়বার ফিরে আসে না।’ (বুখারি, হাদিস : ৩২০৭)
ফেরেশতারা যেমন চরিত্রের অধিকারীসম্পাদনা
ফেরেশতারা উত্তম চরিত্রের অধিকারী। তাদের কাজে-কর্মে সততা ও নিষ্ঠা ছাড়া অন্য কিছু পাওয়া যাবে না। আল্লাহ তাআলা তাদের প্রশংসা করে বলেন, (যারা) মহাসম্মানিত ও নেককার। (সুরা আবাসা, আয়াত : ১৬)
ফেরেশতারা যেমন জীবনযাপন করেসম্পাদনা
ফেরেশতারা সর্বদা আল্লাহর আনুগত্য করেন। আল্লাহ তাআলা তাদের যখন যা বলেন তা-ই করেন। কোনো ধরনের অবাধ্যতায় লিপ্ত হন না। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ইমানদাররা, তোমরা নিজেদের এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে রক্ষা করো আগুন থেকে, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে নির্মম, কঠোরস্বভাব ফেরেশতারা, যারা অমান্য করে না তা, যা আল্লাহ তাদের আদেশ করেন। আর তারা যা করতে আদেশপ্রাপ্ত হয় তা-ই করে[৬]।’ (সুরা আত তাহরিম, আয়াত : ৬)
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ কুরআন ২১:২০
- ↑ ক খ গ "Angels"। ১০ এপ্রিল ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ ডিসেম্বর ২০১৬।
- ↑ কুরআন ১৬:১০২
- ↑ কুরআন ২:৯৮
- ↑ কুরআন ৩২:১১
- ↑ ক খ গ ঘ "Darda'il on Dinul-islam.org"। ২৫ জুলাই ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১১।
- ↑ কুরআন ৮২:১০–১১
- ↑ কুরআন ২:৯৭–৯৮
- ↑ কুরআন ৪৩:৭৭