কাজী নজরুল ইসলাম
কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে[ক][১] ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬; ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ – ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ) বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সঙ্গীতকার। তার মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির যে প্রাচুর্য তা তুলনারহিত। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি।
কাজী নজরুল ইসলাম | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ ঢাকা, বাংলাদেশ | (বয়স ৭৭)
মৃত্যুর কারণ | পিক্স ডিজিজ |
সমাধি | কাজী নজরুল ইসলামের সমাধিসৌধ, ঢাকা ২৩°৪৪′০৬″ উত্তর ৯০°২৩′৪২″ পূর্ব / ২৩.৭৩৫০৬৩৮° উত্তর ৯০.৩৯৪৯৮১৪° পূর্ব |
জাতীয়তা |
|
পেশা |
|
কর্মজীবন | ১৯২০–১৯৪২ |
কর্ম | |
রাজনৈতিক দল | কিরতী কিষাণ পার্টি[৪][৫][৬] |
আন্দোলন | বাংলার নবজাগরণ |
অপরাধের অভিযোগ | রাষ্ট্রদ্রোহিতায় প্ররোচণা |
অপরাধের শাস্তি | ৩ মাস কারাদণ্ড |
দাম্পত্য সঙ্গী |
|
সন্তান |
|
পিতা-মাতা |
|
পুরস্কার |
|
লেখক হিসেবে কর্মজীবন | |
ছদ্মনাম | ধূমকেতু |
ডাকনাম | দুখু মিয়া, তারাক্ষ্যাপা[১] |
ভাষা | |
সময়কাল | আধুনিক |
ধরন | |
বিষয় | |
সঙ্গীত কর্মজীবন | |
ধরন |
|
বাদ্যযন্ত্র | |
লেবেল |
|
এর পূর্বে | লেটোগানের দল |
সামরিক কর্মজীবন | |
আনুগত্য | ব্রিটিশ সাম্রাজ্য |
সেবা/ | ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনী |
কার্যকাল | ১৯১৭–১৯২০ |
পদমর্যাদা | হাবিলদার (সার্জেন্ট) |
ইউনিট | ৪৯তম বেঙ্গলি রেজিমেন্ট |
যুদ্ধ/সংগ্রাম | প্রথম বিশ্বযুদ্ধ |
স্বাক্ষর | |
তাঁর জীবন শুরু হয়েছিল সাধারণ পরিবেশে। স্কুলের গণ্ডি পার হওয়ার আগেই ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। মুসলিম পরিবারের সন্তান এবং শৈশবে ইসলামী শিক্ষায় দীক্ষিত হয়েও তিনি বড় হয়েছিলেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ সত্তা নিয়ে। একই সঙ্গে তার মধ্যে বিকশিত হয়েছিল একটি বিদ্রোহী সত্তা। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাকে রাজদ্রোহিতার অপরাধে কারাবন্দী করেছিল। তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন অবিভক্ত ভারতের বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন।
যে নজরুল সুগঠিত দেহ, অপরিমেয় স্বাস্থ্য ও প্রাণখোলা হাসির জন্য বিখ্যাত ছিলেন, ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মারাত্মকভাবে স্নায়বিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে পড়লে আকস্মিকভাবে তার সকল সক্রিয়তার অবসান হয়। ফলে ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যু অবধি সুদীর্ঘ ৩৪ বছর তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। বাংলাদেশ সরকারের প্রযোজনায় ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে তাকে সপরিবারে কলকাতা থেকে ঢাকা স্থানান্তর করা হয়। ১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালে তাকে বাংলাদেশের জাতীয়তা প্রদান করা হয়। এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন।[৭]
বিংশ শতাব্দীর বাঙালির মননে কাজী নজরুল ইসলামের মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে তাকে “জাতীয় কবি“ হিসাবে মর্যাদা দেওয়া হয়। তার কবিতা ও গানের জনপ্রিয়তা বাংলাভাষী পাঠকের মধ্যে তুঙ্গস্পর্শী। তার মানবিকতা, ঔপনিবেশিক শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধতা বোধ এবং নারী-পুরুষের সমতার বন্দনা গত প্রায় একশত বছর যাবৎ বাঙালির মানস পীঠ গঠনে ভূমিকা রেখে চলেছে।
জন্ম ও প্রাথমিক জীবন
১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে (জ্যৈষ্ঠ ১১, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে এক বাঙালি মুসলমান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম।[১] চুরুলিয়া গ্রামটি আসানসোল মহকুমার জামুরিয়া ব্লকে অবস্থিত। পিতামহ কাজী আমিন উল্লাহর পুত্র কাজী ফকির আহমদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের ষষ্ঠ সন্তান তিনি। তার বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাযারের খাদেম। নজরুলের তিন ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ কাজী আলী হোসেন এবং দুই বোনের মধ্যে সবার বড় কাজী সাহেবজান ও কনিষ্ঠ উম্মে কুলসুম। কাজী নজরুল ইসলামের ডাক নাম ছিল "দুখু মিয়া"। নজরুল গ্রামের স্থানীয় মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করতেন। মক্তবে (মসজিদ পরিচালিত মুসলিমদের ধর্মীয় স্কুল) কুরআন, ইসলাম ধর্ম, দর্শন এবং ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়ন শুরু করেন। ১৯০৮ সালে যখন তার পিতার মৃত্যু হয়, তখন তার বয়স মাত্র নয় বছর। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয় এবং মাত্র দশ বছর বয়সে জীবিকা অর্জনের জন্য কাজে নামতে হয় তাকে।[৮] এ সময় নজরুল মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উক্ত মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন। একই সাথে হাজি পালোয়ানের কবরের সেবক এবং মসজিদের মুয়াযযিন (আজান দাতা) হিসেবে কাজ শুরু করেন। এইসব কাজের মাধ্যমে তিনি অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হবার সুযোগ পান যা পরবর্তীকালে তার সাহিত্যকর্মে বিপুলভাবে প্রভাবিত করে।[১] তিনিই বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার চর্চা শুরু করেছেন বলা যায়।[১]
মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশি দিন ছিলেন না। বাল্য বয়সেই লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে একটি লেটো (বাংলার রাঢ় অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল)[৯] দলে যোগ দেন। তার চাচা কাজী বজলে করিম চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের বিশিষ্ট উস্তাদ ছিলেন এবং আরবি, ফার্সি ও উর্দূ ভাষায় তার দখল ছিল। এছাড়া বজলে করিম মিশ্র ভাষায় গান রচনা করতেন। ধারণা করা হয়, বজলে করিমের প্রভাবেই নজরুল লেটো দলে যোগ দিয়েছিলেন। এছাড়া ঐ অঞ্চলের জনপ্রিয় লেটো কবি শেখ চকোর (গোদা কবি) এবং কবিয়া বাসুদেবের লেটো ও কবিগানের আসরে নজরুল নিয়মিত অংশ নিতেন। লেটো দলেই সাহিত্য চর্চা শুরু হয়। এই দলের সাথে তিনি বিভিন্ন স্থানে যেতেন, তাদের সাথে অভিনয় শিখতেন এবং তাদের নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। নিজ কর্ম এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বাংলা এবং সংস্কৃত সাহিত্য অধ্যয়ন শুরু করেন। একইসাথে হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অর্থাৎ পুরাণসমূহ অধ্যয়ন করতে থাকেন। সেই অল্প বয়সেই তার নাট্যদলের জন্য বেশকিছু লোকসঙ্গীত রচনা করেন। এর মধ্যে রয়েছে চাষার সঙ, শকুনীবধ, রাজা যুধিষ্ঠিরের সঙ, দাতা কর্ণ, আকবর বাদশাহ, কবি কালিদাস, বিদ্যাভূতুম এবং রাজপুত্রের গান।[১] একদিকে মসজিদ, মাজার ও মক্তব জীবন, অপর দিকে লেটো দলের বিচিত্র অভিজ্ঞতা নজরুলের সাহিত্যিক জীবনের অনেক উপাদান সরবরাহ করেছে। নজরুল কালীদেবীকে নিয়ে প্রচুর শ্যামা সঙ্গীত ও রচনা করেন, নজরুল তার শেষ ভাষনে উল্লেখ্য করেন - “কেউ বলেন আমার বানী যবন কেউ বলেন কাফের। আমি বলি ও দুটোর কোনটাই না। আমি শুধু হিন্দু মুসলিমকে এক জায়গায় ধরে নিয়ে হ্যান্ডশেক করানোর চেষ্টা করেছি, গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।”
১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। লেটো দলে তার প্রতিভায় সকলেই যে মুগ্ধ হয়েছিল তার প্রমাণ নজরুল লেটো ছেড়ে আসার পর তাকে নিয়ে অন্য শিষ্যদের রচিত গান: "আমরা এই অধীন, হয়েছি ওস্তাদহীন / ভাবি তাই নিশিদিন, বিষাদ মনে / নামেতে নজরুল ইসলাম, কি দিব গুণের প্রমাণ", এই নতুন ছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কুল ছিল রাণীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, এরপর ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে যা পরবর্তীতে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। মাথরুন স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক যিনি সেকালের বিখ্যাত কবি হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তার সান্নিধ্য নজরুলের অনুপ্রেরণার একটি উৎস। কুমুদরঞ্জন স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে নজরুল সম্বন্ধে লিখেছেন,
“ | ছোট সুন্দর চনমনে ছেলেটি, আমি ক্লাশ পরিদর্শন করিতে গেলে সে আগেই প্রণাম করিত। আমি হাসিয়া তাহাকে আদর করিতাম। সে বড় লাজুক ছিল। | ” |
যাহোক, আর্থিক সমস্যা তাকে বেশ দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবিদলে। এর পর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লাহ'র সাথে তার পরিচয় হয়। দোকানে একা একা বসে নজরুল যেসব কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন তা দেখে রফিজউল্লাহ তার প্রতিভার পরিচয় পান। তিনিই নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণি থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। এই স্কুলে অধ্যয়নকালে নজরুল এখানকার চারজন শিক্ষক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। এরা হলেন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল, বিপ্লবী চেতনাবিশিষ্ট নিবারণচন্দ্র ঘটক, ফার্সি সাহিত্যের হাফিজ নুরুন্নবী এবং সাহিত্য চর্চার নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়।[১]
সৈনিক জীবন
১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে নজরুল সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। প্রথমে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে এবং পরবর্তীতে প্রশিক্ষণের জন্য সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় যান। প্রশিক্ষণ শেষে করাচি সেনানিবাসে সৈনিক জীবন কাটাতে শুরু করেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগ থেকে ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক কর্পোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। উক্ত রেজিমেন্টের পাঞ্জাবী মৌলবির কাছে তিনি ফার্সি ভাষা শিখেন। এছাড়া সহ-সৈনিকদের সাথে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র সহযোগে সঙ্গীতের চর্চা অব্যাহত রাখেন, আর গদ্য-পদ্যের চর্চাও চলতে থাকে একই সাথে। করাচি সেনানিবাসে বসে নজরুল যে রচনাগুলো সম্পন্ন করেন তার মধ্যে রয়েছে, বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী (প্রথম গদ্য রচনা), মুক্তি (প্রথম প্রকাশিত কবিতা); গল্প: হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে, কবিতা সমাধি ইত্যাদি। এই করাচি সেনানিবাসে থাকা সত্ত্বেও তিনি কলকাতার বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকার গ্রাহক ছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, ভারতী, মানসী, মর্ম্মবাণী, সবুজপত্র, সওগাত এবং বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা। এই সময় তার কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং ফার্সি কবি হাফিজের কিছু বই ছিল। এ সূত্রে বলা যায় নজরুলের সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি এই করাচি সেনানিবাসেই। সৈনিক থাকা অবস্থায় তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। এ সময় নজরুলের বাহিনীর ইরাক যাবার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আর যাননি। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে যুদ্ধ শেষ হলে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে দেয়া হয়।[১০] এরপর তিনি সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন।
সাংবাদিক জীবন
যুদ্ধ শেষে কলকাতায় এসে নজরুল ৩২ নং কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। তার সাথে থাকতেন এই সমিতির অন্যতম কর্মকর্তা মুজফ্ফর আহমদ। এখান থেকেই তার সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রথম দিকেই মোসলেম ভারত, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, উপাসনা প্রভৃতি পত্রিকায় তার কিছু লেখা প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে উপন্যাস বাঁধন হারা এবং কবিতা বোধন, শাত-ইল-আরব, বাদল প্রাতের শরাব, আগমনী, খেয়া-পারের তরণী, কোরবানি, মোহরর্ম, ফাতেহা-ই-দোয়াজ্দম্, এই লেখাগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়। এর প্রেক্ষিতে কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় তার খেয়া-পারের তরণী এবং বাদল প্রাতের শরাব কবিতা দুটির প্রশংসা করে একটি সমালোচনা প্রবন্ধ লিখেন। এ থেকেই দেশের বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সমালোচকদের সাথে নজরুলের ঘনিষ্ঠ পরিচয় শুরু হয়। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে কাজী মোতাহার হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী আবদুল ওদুদ, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আফজালুল হক প্রমুখের সাথে পরিচয় হয়। তৎকালীন কলকাতার দুটি জনপ্রিয় সাহিত্যিক আসর গজেনদার আড্ডা এবং ভারতীয় আড্ডায় অংশগ্রহণের সুবাদে পরিচিত হন অতুলপ্রসাদ সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, শিশিরকুমার ভাদুড়ী, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নির্মেলন্দু লাহিড়ী, ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, ওস্তাদ করমতুল্লা খাঁ প্রমুখের সাথে। ১৯২১ সালের অক্টোবর মাসে তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু পর্যন্ত তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় ছিল। কাজী মোতাহার হোসেনের সাথে নজরুলের বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই তারিখে নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। ঐ বছরই এই পত্রিকায় "মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে" শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লিখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের উপর পুলিশের নজরদারী শুরু হয়। যাই হোক সাংবাদিকতার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান। একইসাথে মুজফ্ফর আহমদের সাথে বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতিতে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতি বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ পেয়েছিলেন। বিভিন্ন ছোটখাটো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কবিতা ও সঙ্গীতের চর্চাও চলছিল একাধারে। তখনও তিনি নিজে গান লিখে সুর দিতে শুরু করেননি। তবে ব্রাহ্মসমাজের সঙ্গীতজ্ঞ মোহিনী সেনগুপ্তা তার কয়েকটি কবিতায় সুর দিয়ে স্বরলিপিসহ পত্রিকায় প্রকাশ করছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে: হয়তো তোমার পাব দেখা, ওরে এ কোন স্নেহ-সুরধুনী- সওগাত পত্রিকার ১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যায় তার প্রথম গান প্রকাশিত হয়। গানটি ছিল: "বাজাও প্রভু বাজাও ঘন"।
পারিবারিক জীবন
১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন। তার সাথেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে যার সাথে তার প্রথমে প্রণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল।
তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনের নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।[১১]
নজরুল সাম্যবাদের একজন অগ্রদূত ছিলেন। তিনি মুসলিম হয়েও চার সন্তানের নাম বাংলা এবং আরবি/ফারসি উভয় ভাষাতেই নামকরণ করেন। যথা: কৃষ্ণ মুহাম্মদ, অরিন্দম খালেদ (বুলবুল), কাজী সব্যসাচী এবং কাজী অনিরুদ্ধ।[১২]
বিদ্রোহী নজরুল
তখন দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। নজরুল কুমিল্লা থেকে কিছুদিনের জন্য দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে থেকে আবার কুমিল্লা ফিরে যান ১৯ জুনে- এখানে যতদিন ছিলেন ততদিনে তিনি পরিণত হন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীতে। তার মূল কাজ ছিল শোভাযাত্রা ও সভায় যোগ দিয়ে গান গাওয়া। তখনকার সময়ে তার রচিত ও সুরারোপিত গানগুলির মধ্যে রয়েছে "এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙ্গিনায়, আজি রক্ত-নিশি ভোরে/ একি এ শুনি ওরে/ মুক্তি-কোলাহল বন্দী-শৃঙ্খলে" প্রভৃতি। এখানে ১৭ দিন থেকে তিনি স্থান পরিবর্তন করেছিলেন। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে আবার কুমিল্লায় ফিরে যান। ২১ নভেম্বর ছিল সমগ্র ভারতব্যাপী হরতাল- এ উপলক্ষে নজরুল আবার পথে নেমে আসেন; অসহযোগ মিছিলের সাথে শহর প্রদক্ষিণ করেন আর গান করেন, "ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী"- নজরুলের এ সময়কার কবিতা, গান ও প্রবন্ধের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব প্রকাশিত হয়েছে। এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বিদ্রোহী নামক কবিতাটি। বিদ্রোহী কবিতাটি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিলাভ করে। এই কবিতায় নজরুল নিজেকে বর্ণনা করেন:-
“ |
আমি বঞ্চিত ব্যথা পথবাসী চির গৃহহারা যত পথিকের, |
” |
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ আগস্ট নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। এটি সপ্তাহে দুবার প্রকাশিত হতো। ১৯২০-এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন এক সময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের আবির্ভাব ঘটে তাতে ধূমকেতু পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। এই পত্রিকাকে আশীর্বাদ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন,
“ |
কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু। |
” |
পত্রিকার প্রথম পাতার শীর্ষে এই বাণী লিখা থাকতো। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমনে প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশিত হওয়ায় ৮ নভেম্বর পত্রিকার উক্ত সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং একই দিনে তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তাকে কুমিল্লা থেকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দী হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দি প্রদান করেন। চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট সুইনহোর আদালতে এই জবানবন্দি দিয়েছিলেন। তার এই জবানবন্দি বাংলা সাহিত্যে রাজবন্দীর জবানবন্দী নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। এই জবানবন্দীতে নজরুল বলেছেন:
“ |
আমার উপর অভিযোগ, আমি রাজবিদ্রোহী। তাই আমি আজ রাজকারাগারে বন্দি এবং রাজদ্বারে অভিযুক্ত।... আমি কবি,আমি অপ্রকাশ সত্যকে প্রকাশ করার জন্য, অমূর্ত সৃষ্টিকে মূর্তিদানের জন্য ভগবান কর্তৃক প্রেরিত। কবির কণ্ঠে ভগবান সাড়া দেন, আমার বাণী সত্যের প্রকাশিকা ভগবানের বাণী। সেবাণী রাজবিচারে রাজদ্রোহী হতে পারে, কিন্তু ন্যায়বিচারে সে বাণী ন্যায়দ্রোহী নয়, সত্যাদ্রোহী নয়। সত্যের প্রকাশ নিরুদ্ধ হবে না। আমার হাতের ধূমকেতু এবার ভগবানের হাতের অগ্নি-মশাল হয়ে অন্যায় অত্যাচার দগ্ধ করবে...। |
” |
১৬ জানুয়ারি বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। নজরুলকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। এখানে যখন বন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন তখন (১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি ২২) বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ তার বসন্ত গীতিনাট্য গ্রন্থটি নজরুলকে উৎসর্গ করেন। এতে নজরুল বিশেষ উল্লসিত হন। এই আনন্দে জেলে বসে আজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কবিতাটি রচনা করেন।
অসুস্থতা ও মৃত্যু
নবযুগে সাংবাদিকতার পাশাপাশি নজরুল বেতারে কাজ করছিলেন। এমন সময়ই অর্থাৎ ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। তার অসুস্থতা সম্বন্ধে সুষ্পষ্টরূপে জানা যায় ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে। এরপর তাকে মূলত হোমিওপ্যাথি এবং আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা করানো হয়। কিন্তু এতে তার অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়নি। সেই সময় তাকে ইউরোপে পাঠানো সম্ভব হলে নিউরো সার্জারি করা হত। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর নজরুল পরিবার ভারতে নিভৃত সময় কাটাতে থাকে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তারা নিভৃতে ছিলেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এই উদ্যোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল নজরুলের আরোগ্যের জন্য গঠিত একটি সংগঠন যার নাম ছিল নজরুল নিরাময় সমিতি, এছাড়া তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সহযোগিতা করেছিলেন। কবি চার মাস রাঁচিতে ছিলেন।
এরপর ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। মে ১০ তারিখে লন্ডনের উদ্দেশ্যে হাওড়া রেলওয়ে স্টেশন ছাড়েন। লন্ডন পৌঁছানোর পর বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন: রাসেল ব্রেইন, উইলিয়াম সেজিয়েন্ট এবং ম্যাককিস্ক- তারা তিনবার নজরুলের সাথে দেখা করেন। প্রতিটি সেশনের সময় তারা ২৫০ পাউন্ড করে পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন। রাসেল ব্রেইনের মতে নজরুলের রোগটি ছিল দুরারোগ্য বলতে গেলে আরোগ্য করা ছিল অসম্ভব। একটি গ্রুপ নির্ণয় করেছিল যে নজরুল "ইনভল্যুশনাল সাইকোসিস" রোগে ভুগছেন। এছাড়া কলকাতায় বসবাসরত ভারতীয় চিকিৎসকরাও আলাদা একটি গ্রুপ তৈরি করেছিলেন। উভয় গ্রুপই এই ব্যাপারে একমত হয়েছিল যে, রোগের প্রাথমিক পর্যায়ের চিকিৎসা ছিল খুবই অপ্রতুল ও অপর্যাপ্ত। লন্ডনে অবস্থিত লন্ডন ক্লিনিকে কবির এয়ার এনসেফালোগ্রাফি নামক এক্স-রে করানো হয়। এতে দেখা যায় তার মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। ড: ম্যাককিস্কের মত বেশ কয়েকজন চিকিৎসক একটি পদ্ধতি প্রয়োগকে যথোপযুক্ত মনে করেন যার নাম ছিল ম্যাককিস্ক অপারেশন। অবশ্য ড: ব্রেইন এর বিরোধিতা করেছিলেন।
এই সময় নজরুলের মেডিকেল রিপোর্ট ভিয়েনার বিখ্যাত চিকিৎসকদের কাছে পাঠানো হয়। এছাড়া ইউরোপের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানেও পাঠানো হয়েছিল। জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোসার্জন অধ্যাপক রোঁয়েন্টগেন ম্যাককিস্ক অপারেশনের বিরোধিতা করেন। ভিয়েনার চিকিৎসকরাও এই অপারেশনের ব্যাপারে আপত্তি জানান। তারা সবাই এক্ষেত্রে অন্য আরেকটি পরীক্ষার কথা বলেন যাতে মস্তিষ্কের রক্তবাহগুলির মধ্যে এক্স-রেতে দৃশ্যমান রং ভরে রক্তবাহগুলির ছবি তোলা হয় (সেরিব্রাল অ্যানজিওগ্রাফি)- কবির শুভাকাঙ্খীদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাকে ভিয়েনার চিকিৎসক ডঃ হ্যান্স হফের অধীনে ভর্তি করানো হয়। এই চিকিৎসক নোবেল বিজয়ী চিকিৎসক জুলিয়াস ওয়েগনার-জাউরেগের অন্যতম ছাত্র। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর কবিকে পরীক্ষা করানো হয়। এর ফলাফল থেকে ড. হফ বলেন যে, কবি নিশ্চিতভাবে পিক্স ডিজিজ নামক একটি নিউরনঘটিত সমস্যায় ভুগছেন। এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল ও পার্শ্বীয় লোব সঙ্কুচিত হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন বর্তমান অবস্থা থেকে কবিকে আরোগ্য করে তোলা অসম্ভব। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর তারিখে কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকা ভিয়েনায় নজরুল নামে একটি প্রবন্ধ ছাপায় যার লেখক ছিলেন ডঃ অশোক বাগচি- তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ভিয়েনায় অবস্থান করছিলেন এবং নজরুলের চিকিৎসা সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। যাহোক, ব্রিটিশ চিকিৎসকরা নজরুলের চিকিৎসার জন্য বড় অঙ্কের ফি চেয়েছিল যেখানে ইউরোপের অন্য অংশের কোন চিকিৎসকই ফি নেননি। অচিরেই নজরুল ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে আসেন। এর পরপরই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডঃ বিধান চন্দ্র রায় ভিয়েনা যান এবং ড. হ্যান্স হফের কাছে বিস্তারিত শোনেন। নজরুলের সাথে যারা ইউরোপ গিয়েছিলেন তারা সবাই ১৯৫৩ সালের ১৪ ডিসেম্বর রোম থেকে দেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।[১৩]
বাংলাদেশে আগমন ও প্রয়াণ
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারি আদেশ জারী করা হয়।
এরপর যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে কবির সবচেয়ে ছোট ছেলে এবং বিখ্যাত গিটারবাদক কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করে। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তার একটি গানে লিখেছেন, "মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই / যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই":- কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তার সমাধি রচিত হয়। তবে প্রমিলা দেবীর শেষ ইচ্ছা ছিল তার স্বামীকে যেন তার কবরের পাশে (চুরুলিয়ায় নজরুলের পৈতৃক বাড়িতে) সমাধিস্থ করা হয়। কিন্তু প্রমিলার শেষ ইচ্ছাটি আর পূরণ হয়ে উঠে নি।
তার জানাজার নামাজে ১০ হাজারেরও অধিক মানুষ অংশ নেয়। জানাজা নামায আদায়ের পরে রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান, রিয়াল এডমিরাল এম এইচ খান, এয়ার ভাইস মার্শাল এ জি মাহমুদ, মেজর জেনারেল দস্তগীর জাতীয় পতাকামণ্ডিত নজরুলের মরদেহ বহন করে সোহরাওয়ার্দী ময়দান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদ প্রাঙ্গণে নিয়ে যান।[১৪] বাংলাদেশে তার মৃত্যু উপলক্ষে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় শোক দিবস পালিত হয় এবং ভারতের আইনসভায় কবির সম্মানে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়।
সাহিত্যকর্ম
কবিতা
১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে কুমিল্লা থেকে কলকাতা ফেরার পথে নজরুল দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্মের জন্ম দেন। এই দুটি হচ্ছে বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। একই সময় রচিত আরেকটি বিখ্যাত কবিতা হচ্ছে কামাল পাশা- এতে ভারতীয় মুসলিমদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে নজরুলে দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরপর এর কয়েকটি নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: "প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা" ইত্যাদি। এগুলো বাংলা কবিতার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। তার শিশুতোষ কবিতা বাংলা কবিতায় এনেছে নান্দনিকতা খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু ইত্যাদি তারই প্রমাণ। কবি তার মানুষ কবিতায় বলেছিলেন:
“ |
পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল মূর্খরা সব শোন/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ, গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোন |
” |
তিনি কালী দেবিকে নিয়ে অনেক শ্যামা সঙ্গিত রচনা করেন, ইসলামী গজলও রচনা করেন।
সঙ্গীত
নজরুলের গানের সংখ্যা চার হাজারের অধিক। নজরুলের গান নজরুল সঙ্গীত নামে পরিচিত।
১৯৩৮ সালে কাজী নজরুল ইসলাম কলকাতা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হন। সেখানে তিনটি অনুষ্ঠান যথাক্রমে 'হারামণি', 'নবরাগমালিকা' ও 'গীতিবিচিত্রা'র জন্য তাকে প্রচুর গান লিখতে হতো। 'হারামণি' অনুষ্ঠানটি কলকাতা বেতার কেন্দ্রে প্রতি মাসে একবার করে প্রচারিত হতো যেখানে তিনি অপেক্ষাকৃত কম প্রচলিত ও বিলুপ্তপ্রায় রাগরাগিণী নিয়ে গান পরিবেশন করতেন। উল্লেখ্য, এই অনুষ্ঠানের শুরুতে তিনি কোনো একটি লুপ্তপ্রায় রাগের পরিচিতি দিয়ে সেই রাগের সুরে তার নিজের লেখা নতুন গান পরিবেশন করতেন। এই কাজ করতে গিয়ে কাজী নজরুল ইসলাম নবাব আলী চৌধুরীর রচনায় 'ম আরিফুন নাগমাত' ও ফার্সি ভাষায় রচিত আমীর খসরুর বিভিন্ন বই পড়তেন এবং সেগুলোর সহায়তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের রাগ আয়ত্ত করতেন। এসব হারানো রাগের ওপর তিনি চল্লিশটিরও বেশি গান রচনা করেন। তবে স্বভাবে অগোছালো হওয়ায় নজরুল টুকরো কাগজে এসব গান লিখলেও সেগুলো মাসিক ভারতবর্ষের সঙ্গীত বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জগৎ ঘটক একটি মোটা বাঁধানো খাতায় স্বরলিপিসহ তুলে রাখতেন। বাংলা গানের দুর্ভাগ্য যে, এই সংকলিত খাতাটি পরবর্তী সময়ে হারিয়ে যায় যার বিজ্ঞপ্তি তিনি সে সময়কালের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে দিয়েছিলেন কিন্তু সেটি আর পাওয়া যায়নি।[১৫][১৬]
গদ্য রচনা, গল্প ও উপন্যাস
নজরুলের প্রথম গদ্য রচনা ছিল "বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী"। ১৯১৯ সালের মে মাসে এটি সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক থাকা অবস্থায় করাচি সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেছিলেন। এখান থেকেই মূলত তার সাহিত্যিক জীবনের সূত্রপাত ঘটেছিল। এখানে বসেই বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছেন। এর মধ্যে রয়েছে: "হেনা, ব্যথার দান, মেহের নেগার, ঘুমের ঘোরে"। ১৯২২ সালে নজরুলের একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় যার নাম ব্যথার দান- এছাড়া একই বছর প্রবন্ধ-সংকলন যুগবাণী প্রকাশিত হয়।
চলচ্চিত্র
নজরুল 'ধূপছায়া ' নামে একটি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। এটিতে তিনি একটি চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন। ১৯৩১ সালে প্রথম বাংলা সবাক চলচ্চিত্র ‘জামাই ষষ্ঠী’র ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত ‘গৃহদাহ’ চলচ্চিত্রের সুরকার ছিলেন তিনি। গীতিকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ১৯৩৩ সালে পায়োনিয়ার ফিল্মস কোম্পানির প্রযোজনায় নির্মিত চলচ্চিত্র ‘ধ্রুব’ এবং সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন ১৯৩৭ সালের ‘গ্রহের ফের’ চলচ্চিত্রের। ১৯৩৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘পাতালপুরী’ চলচ্চিত্রের ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস অবলম্বনে ১৯৩৮ সালে নির্মিত ‘গোরা’ চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। ১৯৩৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘সাপুড়ে’ চলচ্চিত্রের কাহিনীকার ও সুরকার ছিলেন তিনি। ‘রজত জয়ন্তী’, ‘নন্দিনী’, ‘অভিনয়’, ‘দিকশূল’ চলচ্চিত্রের গীতিকার ছিলেন নজরুল। ‘চৌরঙ্গী’ চলচ্চিত্রের গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন নজরুল। চৌরঙ্গী হিন্দিতে নির্মিত হলেও সেটার জন্য ৭টি হিন্দি গান লেখেন তিনি।[১৭][১৮]
রাজনৈতিক দর্শন
সৈনিক জীবন ত্যাগ করে নজরুল বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে মুজফ্ফর আহমদের সাথে বাস করছিলেন। মুজফ্ফর আহমদ ছিলেন এদেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠার অগ্রদূত। এখান থেকেই তাই নজরুলের রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ শুরু হয়। মুজফ্ফর আহমদের সাথে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক সভা-সমিতি ও বক্তৃতায় অংশ নিতেন। এ সময় থেকেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সাথে পরিচিত হন। ১৯১৭ সালে রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব তাকে নানাভাবে প্রভাবিত করে। তার লাঙ্গল ও গণবাণী পত্রিকায় তিনি প্রকাশ করেন সাম্যবাদী ও সর্বহারা কবিতাগুচ্ছ। এরই সাথে প্রকাশ করেছিলেন কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল-এর অনুবাদ জাগ অনশন বন্দী ওঠ রে যত- তার পত্রিকায় প্রকাশিত হয় রেড ফ্ল্যাগ-এর অবলম্বনে রচিত রক্তপতাকার গান।
তখন মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলন এবং মাওলানা মুহাম্মদ আলি ও শওকত আলীর নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন- অসহযোগ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল শান্তিপূর্ণ উপায়ে ভারতবর্ষ থেকে ইংরেজদের বিতারণ। আর খিলাফত আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল তুরস্কে মধ্যযুগীয় সামন্ত শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা, কারণ এই সমন্বিত সুলতানী শাসন ব্যবস্থার প্রধান তথা তুরস্কের সুলতানকে প্রায় সকল মুসলমানরা মুসলিম বিশ্বের খলিফা জ্ঞান করতো। নজরুল এই দুটি আন্দোলনের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা তথা স্বরাজ অর্জনে বিশ্বাস করতেন যা মহাত্মা গান্ধীর দর্শনের বিপরীত ছিল। আবার মোস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে তুরস্কের সালতানাত উচ্ছেদের মাধ্যমে নতুন তুরস্ক গড়ে তোলার আন্দোলনের প্রতি নজরুলের সমর্থন ছিল। তারপরও তিনি অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। এর কারণ, এই সংগ্রাম দুটি ভারতীয় হিন্দু মুসলমানদের সম্মিলিত সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিল।
তবে সব দিক বিচারে নজরুল তার রাষ্ট্রীয় ধ্যান ধারণায় সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন কামাল পাশার দ্বারা। নজরুল ভেবেছিলেন তুরস্কের মুসলমানরা তাদের দেশে যা করতে পেরেছে ভারতীয় উপমহাদেশে কেন তা সম্ভব হবে না? গোড়ামী, রক্ষণশীলতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে নজরুলের অবস্থান ছিল কঠোর। আর তার এই অবস্থানের পিছনে সবচেয়ে বড় প্রভাব ছিল কামাল পাশার। সে হিসেবে তার জীবনের নায়ক ছিলেন কামাল পাশা। নজরুলও তার বিদ্রোহী জীবনে অনুরূপ ভূমিকা পালনের প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। উল্লেখ্য ১৯২১ সনের সেপ্টেম্বর মাসে মুজফ্ফর আহমদ ও নজরুল তালতলা লেনের যে বাসায় ছিলেন সে বাড়িতেই ভারতের প্রথম সমাজতান্ত্রিক দল গঠিত হয়েছিল। ১৯১৭ সনের রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমেও নজরুল প্রভাবিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে কখনই এই দলের সদস্য হন নি, যদিও কমরেড মুজফ্ফর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আজীবন।
১৯২০ এর দশকের জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে তিনি অংশগ্রহণের চেষ্টা করেন। প্রথমে কংগ্রেসে সমর্থন লাভের জন্য তিনি কলকাতা যান। কিন্তু কংগ্রেসের কাছ থেকে তেমন সাড়া না পেয়ে তিনি একাই নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন। নির্বাচনে তিনি তেমন সাফল্য পান নি। এরপর সাহিত্যের মাধ্যমে তার রাজনৈতিক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ অব্যাহত থাকলেও রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ কমে যায়।[১৯]
সম্মাননা
ভারত
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের চুরুলিয়ায় "নজরুল অ্যাকাডেমি" নামে একটি বেসরকারি নজরুল-চর্চা কেন্দ্র আছে। চুরুলিয়ার কাছে আসানসোল মহানগরে ২০১২ সালে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছে।[২০][২১] আসানসোলের কাছেই দুর্গাপুর মহানগরের লাগোয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির নাম রাখা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।[২২] উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় অবস্থিত নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে রাজধানী কলকাতার যোগাযোগ-রক্ষাকারী প্রধান সড়কটির নাম রাখা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম সরণি। কলকাতা মেট্রোর গড়িয়া বাজার মেট্রো স্টেশনটির নাম রাখা হয়েছে "কবি নজরুল মেট্রো স্টেশন"।
১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাংলা সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার জগত্তারিণী স্বর্ণপদক নজরুলকে প্রদান করা হয়। ১৯৬০ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণে ভূষিত করা হয়।[২৩]
বাংলাদেশ
কাজী নজরুল ইসলামকে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয়।[২৪][২৫] তার রচিত "চল্ চল্ চল্, ঊর্ধগগনে বাজে মাদল" বাংলাদেশের রণসঙ্গীত হিসেবে গৃহীত। নজরুলের জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকী প্রতি বছর বিশেষভাবে উদযাপিত হয়। নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালে (বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলায়) ২০০৫ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় নামক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় কবির স্মৃতিতে নজরুল একাডেমি, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি ও শিশু সংগঠন বাংলাদেশ নজরুল সেনা স্থাপিত হয়। এছাড়া সরকারিভাবে স্থাপিত হয়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান নজরুল ইন্সটিটিউট- ঢাকা শহরের একটি প্রধান সড়কের নাম রাখা হয়েছে কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ।
১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলামকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর তারিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনে (টিএসসি) এক সমাবর্তন উৎসবে এই উপাধি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অসুস্থতার জন্য নজরুলকে এ উৎসবে আনা সম্ভবপর হয়নি। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি তারিখে বঙ্গভবনে একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদউল্লাহ নজরুলকে ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী নজরুলের উদ্দেশে একটি মানপত্র পাঠ করেন। এই মানপত্রে বলা হয় যে [২৬],
“ |
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আপনিই একমাত্র কবি-প্রতিভা যিনি ঐতিহ্য সন্ধানে এবং নির্মাণে ছিলেন স্বচ্ছন্দ, নির্দ্বন্দ্ব। হিন্দু ও মুসলমান, জাতিক ও আন্তর্জাতিক উভয় ঐতিহ্যকেই আপনি আপনার স্বায়ত্তশাসিত চেতনার শব্দরূপে ব্যবহার করেছেন। আপনার জীবনসম্পৃক্ত ঐতিহ্যবোধ, ধর্ম-কথার সীমাবদ্ধতা থেকে ঐতিহ্যকে মুক্তি দিয়েছেন। আপনি বাঙালি ঐতিহ্যের পুনঃনির্মাতা, নব-ভাষ্যকার। […] সংগীতজগতে আপনার অবদান অতুলনীয়, বিচিত্রধর্মী এবং স্বতন্ত্র। আপনার দেশাত্মবোধক সংগীত সর্বকালের বাঙালিকে করবে উদ্দীপিত, উদ্বোধিত। আপনি কেবল বিপুলসংখ্যক গানের রচয়িতাই নন, সুরের সৃজনীশক্তিতে আপনি সংগীত-জগতের নতুন পথনির্দেশক। আজও আপনি বাংলাদেশের বিচিত্রমুখী সংগীতের অনতিক্রমণীয় নিরীক্ষাধর্মী সার্থক সুরকার। […] আজ আপনাকে সম্মান জানাবার সুযোগ পেয়ে আমরা নিজেদের ধন্য মনে করছি। |
” |
১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারিতে তাকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়।[১০] একুশে পদক বাংলাদেশের দ্বিতীয় বেসামরিক সম্মানসূচক পদক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।
চিত্রশালা
আরও দেখুন
টীকা
- ↑ ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ ছিল গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসারে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে। বাংলা একাডেমি কর্তৃক বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধনের পর, সংশোধিত বর্ষপঞ্জি অনুসারে বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ বর্তমানে খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মে তারিখে পড়েছে ও এইদিনে বাংলাদেশে নজরুলের জন্মদিন পালন করা হয়।
তথ্যসূত্র
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ রফিকুল ইসলাম (জানুয়ারি ২০০৩)। "ইসলাম, কাজী নজরুল"। সিরাজুল ইসলাম। ইসলাম,_কাজী_নজরুল (অনলাইন সংস্করণ)। ঢাকা: এশিয়াটিক সোসাইটি বাংলাদেশ। আইএসবিএন 984-32-0576-6। সংগ্রহের তারিখ জুলাই ১৩, ২০১৫।
- ↑ ক খ চক্রবর্তী, বসুধা (১৯৬৮)। Kazi Nazrul Islam। National Biography Series। নতুন দিল্লি: ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট, ভারত। পৃষ্ঠা ১। ওসিএলসি 837539518।
কাজী নজরুল ইসলাম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৮৯৯ সালের ২৪ মে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
- ↑ তালুকদার, রেজাউল করিম (১৯৯৪)। Nazrul, the gift of the century। ঢাকা। পৃষ্ঠা ১২১। আইএসবিএন 978-9848156001।
In 1976 Nazrul was awarded the citizenship of Bangladesh.
- ↑ Banerjee, Prathama (৪ জানুয়ারি ২০২১)। Elementary Aspects of the Political: Histories from the Global South (ইংরেজি ভাষায়)। Duke University Press। আইএসবিএন 978-1-4780-1244-3।
- ↑ Bairathi, Shashi (১৯৮৭)। Communism and Nationalism in India: A Study in Inter-relationship, 1919–1947 (ইংরেজি ভাষায়)। Anamika Prakashan। আইএসবিএন 978-81-85150-00-0।
- ↑ Murshid, Ghulam (২৫ জানুয়ারি ২০১৮)। Bengali Culture Over a Thousand Years (ইংরেজি ভাষায়)। Niyogi Books। আইএসবিএন 978-93-86906-12-0।
- ↑ "কাজির বিচার স্মৃতি ও বিস্মৃতি"। SAMAKAL (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২২-০৫-৩০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২৫।
- ↑ চৌধুরী, দিলিপ (২০০৬-০৯-২২)। "Nazrul Islam: The unparalleled lyricist and composer of Bengal" (HTML)। প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো, ভারত সরকার। সংগ্রহের তারিখ ২০০৬-০৯-২২।
- ↑ compiler., Nāsira, K. M.,। উত্তরবঙ্গের ভাওয়াইয়া ও বিয়ের গীত। ওসিএলসি 13849071।
- ↑ ক খ "Nazrul's death anniversary today"। দ্য ডেইলি স্টার (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ৫ মার্চ ২০১৬।
- ↑ Dr. Rita Ashraf (২০২০-১২-০৫)। "মুসলিম ঐতিহ্য ও নজরুল সাহিত্য"। বাংলাদেশ জার্নাল অফ ইন্টিগ্রেটেড থটস। ১৩ (২০)। আইএসএসএন 2788-5925। ডিওআই:10.52805/bjit.v13i20.176।
- ↑ হুদা, মোহাম্মদ নুরুল (২০০০)। "Nazrul's Personlore"। মোহাম্মদ নুরুল হুদা। Nazrul: An Evaluation [নজরুল: একটি মূল্যায়ন] (ইংরেজি ভাষায়)। ঢাকা: নজরুল ইনস্টিটিউট। পৃষ্ঠা ৩০৬–৩০৭। আইএসবিএন 984-555-167-X।
- ↑ ১. মুজাফফর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা [কলকাতা, ভারত: ন্যাশনাল বুক এজেন্সি, ১০ম মুদ্রণ, ১৯৯৮] ২. রফিকুল ইসলাম, নজরুল জীবনী [বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মে ১৯৭২]; ৩. সুশীলকুমার গুপ্ত, নজরুল চরিত-মানুষ [কলকাতা, ভারত: ডে'স পাবলিশিং, ১৯৯০]
- ↑ author., ঠাকুর, রবীন্দ্রনাথ, ১৮৬১-১৯৪১,। কতক কড়ি, কতক কোমল : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১০৮ কবিতা ও গান = a shade sharp, a shade flat : 108 poems and songs of Rabindranath Tagore। ওসিএলসি 871245601।
- ↑ দাস, অভিজিৎ (নভেম্বর ২০১৮)। "নজরুলের হারামণি"। শিক্ষা পাতা।
- ↑ "জাদুঘরে নজরুলের পাণ্ডুলিপি"। arts.bdnews24.com (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২১-০৮-২৮। ২০২২-০৬-০৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২৫।
- ↑ "চলচ্চিত্র ও নাটকে কাজী নজরুল"। Jugantor (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২৫।
- ↑ "চলচ্চিত্রে নজরুল"। m.mzamin.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-২৫।
- ↑ "::: Star Weekend Magazine :::"। www.thedailystar.net।
- ↑ "Private education Bill passed amidst Opposition walkout" [বিরোধীদের ওয়াকআউটের মধ্যে বেসরকারী শিক্ষা বিল পাস]। দ্য স্টেটসম্যান (ইংরেজি ভাষায়)। ৬ জুলাই ২০১২। ২০ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ জুলাই ২০১২।
- ↑ "Bill passed to set up private varsity"। এশিয়ান এজ (ইংরেজি ভাষায়)। ৭ জুলাই ২০১২। ১১ ডিসেম্বর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ জুলাই ২০১২।
- ↑ "Mamata proposes to name new airport as Kazi Nazrul Islam international airport" [মমতা নতুন বিমানবন্দরের নাম হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর করার প্রস্তাব করেন] (ইংরেজি ভাষায়)। টাইমস অব ইন্ডিয়া। ২০১৩-০৫-২৫। ২০১৩-০৯-২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৩-০৯-২০।
- ↑ কামাল, সাজীদ (২০০০)। "Kazi Nazrul Islam: A Chronology of Life"। মোহাম্মদ নুরুল হুদা। Nazrul: An Evaluation [নজরুল: একটি মূল্যায়ন]। ঢাকা: নজরুল ইনস্টিটিউট। পৃষ্ঠা ৩২৬। আইএসবিএন 984-555-167-X।
- ↑ "Nazrul . . . in the eyes of Benoykumar"। The Daily Star। ১৯ ডিসেম্বর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬।
- ↑ "Kazi Nazrul Islam: Rebel and Lover"। Kazi Nazrul Islam: Rebel and Lover। ৬ জুলাই ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬।
- ↑ ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে নজরুল’
গ্রন্থপঞ্জি
- অনুপম হায়াৎ (ফেব্রুয়ারি ২০১৭)। বহুমাত্রিক নজরুল। বাংলা একাডেমি।
- নীরদবরণ হাজরা (১৯৯৯)। এক নজরুল, সহস্র সংশ্রয়। বুলবুল প্রকাশন, কলকাতা।
- গোলাম মুরশিদ। বিদ্রোহী রণক্লান্ত: নজরুল জীবনী। প্রথমা প্রকাশন।