ফার্সি সাহিত্য (ফার্সি: ادبیات فارسی, আদাবিইয়তে-ফর্সী) বলতে মূলত ইসলামী যুগে আধুনিক ফার্সি ভাষায় ও আরবি লিপিতে লেখা সাহিত্যকে বোঝায়। এই বিপুল সাহিত্যসম্ভারের অধিকাংশই পদ্য এবং এর ভৌগোলিক বিস্তার কেবল ইরানের চৌহদ্দীতেই সীমাবদ্ধ নয়, তুরস্ক ও উত্তর ভারতেও এর চর্চা হত। ফার্সি গদ্য ও পদ্যসাহিত্যের ঐতিহ্য দুইটি প্রায় হাজার বছর ধরে বেশ স্থিতিশীল ছিল। তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসে ফার্সি সাহিত্যে পশ্চিমা সংস্কৃতির ছোঁয়া লাগে এবং এর ফলে নতুন নতুন সাহিত্যিক ধারার সৃষ্টি হয়।

ইসলাম-পূর্ব যুগের ফার্সি সাহিত্য ৬৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রাচীন ও মধ্য ফার্সি ভাষায় লেখা হয়েছিল। এগুলি মধ্যে আছে "গাথা" নামের ঐশ্বরিক গানের সম্ভার, এবং অবেস্তা নামের প্রাচীন ধর্মীয় রচনাবলির সংগ্রহ। মধ্য ফার্সি ভাষাতে রয়েছে অবেস্তার অনুবাদ এবং ইরানের রাজদরবারে উপস্থাপিত অনেক মহাকাব্য।

ধ্রুপদী পর্ব সম্পাদনা

৭ম শতকে ইসলামের ইরান বিজয়ের পর ধীরে ধীরে একটি সাহিত্যিক ভাষা হিসেবে আধুনিক ফার্সির আবির্ভাব ঘটে। ভাষাটিতে আরবি ভাষা থেকে প্রচুর শব্দ ধার নেয়া হয় এবং লেখার জন্য আরবি লিপি গ্রহণ করা হয়। ৯ম-১০ম শতকে সামানিদ রাজবংশের অধীনে এক নতুন সাহিত্যিক যুগের সূচনা হয় এবং পারস্যের প্রাচীন ঐতিহ্যগুলি ইসলামের সংস্কৃতির সাথে মিশে যেতে শুরু করে। একই সাথে ইসলাম ও আরবির মধ্যে একক সম্পর্ক ঘুচিয়ে ইসলামের এক নতুন বিশ্বজনীন ভাষা হিসেবে ফার্সি আবির্ভূত হয়, যা একাধারে ইসলামের প্রসার এবং সংরক্ষণে বড় ভূমিকা রাখে।

৯ম শতকের দিকে বিচ্ছিন্নভাবে পূর্ব পারস্যে আরবি কাঠামোর আশ্রয়ে ফার্সি কবিতা লেখা শুরু হয়। এগুলির মধ্যে চারটি প্রধান ঘরানা লক্ষ্য করা যায়: মহাকাব্য, কাসিদা বা উদ্দেশ্যমূলক কবিতা, মাসনাভী (দীর্ঘ আখ্যানমূলক কবিতা) এবং গজল (গীতিকবিতা)। ১০ম শতক নাগাদ ফার্সি ভাষা একটি পরিণত ও সুমিষ্ট সাহিত্যিক মাধ্যমে পরিণত হয়। এসময়কার শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন রুদাকি, যাঁকে ফার্সি কবিতার জনক বলা হয়।

রুদাকির মৃত্যুর কয়েক বছর পরে অবেস্তা এবং মধ্য ফার্সি ভাষার সাহিত্যগুলিকে অবলম্বন করে শুরু হয় মহাকাব্য লেখার ঐতিহ্য। ফার্সি ভাষার প্রথম মহাকবি ছিলেন মারভাজি; ধারণা করা হয় তিনি ৯১০ সালে একটি শাহ্‌নমে (শাহনামা, রাজাদের বই) রচনা করেছিলেন। ৯৭৫ সালে কবি দাগিগি (আনুমানিক ৯৮০ সালে মৃত্যুবরণ করেন) রচনা করেন আরেকটি উন্নততর শাহ্‌নমে। কিন্তু সবচেয়ে বিখ্যাত শাহ্‌নমেটির লেখক হলেন ইরানের জাতীয় কবি ফেরদৌসী। তার রচিত শাহ্‌নমেটি ইরানের জাতীয় মহাকাব্য হিসেবে সম্মানপ্রাপ্ত। ফিরদৌসী সুদীর্ঘ ৩৫ বছর ধরে ৬০ হাজার দ্বিপদীবিশিষ্ট এই পর্বতসমান কীর্তিটি গড়েন; ১০১০ সালে এসে তার শাহ্‌নমে লেখার কাজ শেষ হয়। ফিরদৌসীর শাহ্‌নমেতে পারস্যের সবচেয়ে প্রাচীন রাজা থেকে শুরু করে ৬৫১ সালে শেষ সসনীয় রাজার মৃত্যু পর্যন্ত ইরানের রাজাদের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। এতে রাজবংশগুলির বর্ণনাপ্রদানের পাশাপাশি পরিবর্তনের অবশ্যম্ভাবিতা কথা বলা হয়েছে, যুদ্ধের দৃশ্যগুলি নিপুণভাবে, জীবন্তভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ফিরদৌসী ছিলেন এক অসাধারণ কথাশিল্পী। তার কাব্যের চরিত্ররা নায়ক আর দৈত্য হলেও তার ভাষা ছিল তুলনামূলকভাবে অতিরঞ্জনবর্জিত।

মহাকাব্যের চেয়ে কাসিদা ঘরানার কবিতাগুলি অনেক ভিন্ন। কবি রুদাকি প্রথম এই ধাঁচে কবিতা লিখেছিলেন। বেশিরভাগ কাসিদাই স্তুতি বা প্রশস্তিগাথা (panegyric), কিন্তু কিছু কিছু শোকগাথা এবং নীতিকথাও এ ঘরানাতে রচিত হয়েছিল। কখনও কখনও এগুলি দার্শনিক বা আত্মজীবনীমূলক বক্তব্যও প্রকাশিত হয়েছে। কাসিদার বৈশিষ্ট্য হল এর সমগ্রতা জুড়ে একই অন্ত্যমিল ব্যবহৃত হয়, যদিও মাত্রা (meter) বিভিন্ন হতে পারে। কাসিদাগুলির গড় দৈর্ঘ্য দ্বিপদীতে ৬০ থেকে ১০০ লাইন, তবে ২০০ লাইনের বড় কাসিদাও বিচিত্র নয়। কাসিদার প্রাথমিক কবিরা ছিলেন ফিরদৌসীর সমসাময়িক। এদের মধ্যে উনসুরি (মৃত্যু আনুমানিক ১০৪৯), আসজাদি এবং ফাররোখির নাম উল্লেখযোগ্য। বলা হয় ফাররোখি ছিলেন গাজনার সুলতান মাহমুদের দরবারের ৪০০ কবির মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি। ফার্সি ভাষার দীর্ঘ ইতিহাসে প্রশস্তিগাথা লিখেছেন অনেকে, তবে তাদের মধ্যে কবি আনভারিকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া হয়। দার্শনিক কাসিদার লেখক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন নাসারে খসরু (১০৭২ সালের দিকে মারা যান)। নাসারে খসরুর সমসাময়িক ছিলেন ওমর খাইয়াম। খাইয়াম ছিলেন রুবাই বা চতুষ্পদী কবিতার শ্রেষ্ঠ কবি। খাইয়াম ছিলেন এক অনন্যসাধারণ কবি। তিনি তার কবিতায় নিজের জীবনদর্শন বর্ণনা করে গেছেন, যে দর্শনে প্রেয়োবাদের (hedonism) পাশাপাশি সংশয়বাদী চিন্তাভাবনা স্থান পেয়েছে।

১৩শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ এবং ১৪শ শতকের প্রথমার্ধকে ফার্সি কবিতার স্বর্ণযুগ বলা হয়। এই পর্বে ইরানে মঙ্গোল আক্রমণ ঘটেছিল, এবং পারস্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবিদের তিনজন এই যুগের বাসিন্দা ছিলেন। এরা হলেন সাদী, রুমি এবং হাফিজ। তারা প্রত্যেকেই গজল নামের এক ধরনের অনুভূতিপূর্ণ আধ্যাত্মিক গীতিকবিতা লেখায় পারদর্শী ছিলেন। কাসিদার মত গজলও একটি মাত্র অন্ত্যমিলের উপর ভিত্তি করে লেখা হয়। প্রতিটি গজল সাধারণত ৫ থেকে ১৫টি দ্বিপদী দিয়ে লেখা হয়, কিন্তু এগুলির মাত্রা বিভিন্ন হতে পারে।

অন্যদিকে মাসনাভি বা মসনবী হল তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ, আখ্যানমূলক, অন্ত্যমিলবিশিষ্ট দ্বিপদীতে লেখা কবিতা, যা ছিল মহাকাব্যিক ও প্রেমের গল্প কিংবা আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক বিষয়বস্তু বর্ণনার উপযুক্ত বাহন। সবচেয়ে বিখ্যাত মাসনাভিগুলি আধ্যাতকিল ব্যক্তিদের লেখা। সবচেয়ে প্রথম আধ্যাত্মিক মাসনাভিটি ছিল সানইয়ের লেখা হাদিকাত আল-হাকিকা। তার পরে আসেন সুফি কবি আত্তার এবং কবি রুমি, যার প্রধান রচনা মাসনাভিয়ে মানাভি, ৬ খণ্ডে বিভক্ত ৩০ হাজার দ্বিপদীর এক সুবিশাল সংগ্রহ। রুমির মাসনাভির মূল উপজীব্য হল প্রেম। জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্যের সাথে জড়িত সমস্যাবলি এবং ঈশ্বরের সাথে মানবাত্মার মিলনাকাঙ্ক্ষা ছিল রুমির আরাধনার বিষয়। রুমির মাসনাভির প্রতিটি পাতাই পাঠককে দোলায়, তাকে বিস্মিত করে। এটি পারস্য সাহিত্যের, এমনকি হয়ত গোটা ইসলামী সাহিত্যের, সবচেয়ে গভীর ও সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে পরিগণিত হয়। রোমান্টিক মাসনাভিগুলির মধ্যে কবি নেজামি রচিত খোসরোও ও শিরিন সবচেয়ে বিখ্যাত। এটি নেজামির খামেশ বা পঞ্চকাব্যের একটি।

১৪শ শতকেই ফার্সি কবিতার অবনতি শুরু হয়। ধ্রুপদী পর্বের শেষ কবি ছিলেন জামি, যার কবিতার পরিমাণ ও মান, দুই-ই ছিল উল্লেখ করার মত। ইরানের বাইরে ১১শ শতক থেকে ফার্সি সাহিত্যের চর্চা হয়ে আসছিল। ভারতীয় কবি আমির খসরু, নেজামির কবিতাগুলিকে অনুসরণ করে বেশ কিছু রোমান্টিক মাসনাভি রচনা করেন এবং সেগুলি ছিল বেশ উন্নত মানের। ১৫শ শতক এবং বিশেষ করে ১৬শ শতকে বহু ফার্সি কবি ভারতের মুঘল রাজাদের দরবারের প্রতি আকৃষ্ট হন। ভারতীয় ঘরানার এই ফার্সি সাহিত্য পরে আবার ইরানে ফেরত আসে এবং ১৬শ-১৮শ শতকে সাফাভিদ রাজবংশের অধীনে এটি ফার্সি কবিতার প্রধান মডেলে পরিণত হয়। এটি "সাব্‌কে হিন্দি" তথা "ভারতীয় শৈলী" নামে পরিচিত ছিল। ভারতীয় ধাঁচের ফার্সি কবির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলেন কবি সইব, যার কবিতাগুলি অসাধারণ চিত্রকল্পের ব্যবহারের জন্য বিখ্যাত।

ইসলাম-উত্তর ইরানের প্রথম দিককার ধর্মীয় পণ্ডিতেরা আরবি ভাষাতেই তাদের বিদগ্ধ গ্রন্থগুলি রচনা করতেন। কিন্তু ফার্সি ভাষায় লেখা গদ্যেরও একটি ঐতিহ্য আছে। ৯৭৮ সালেই ফিরদৌসী তার শাহ্‌নমে মহাকাব্যের অবতরণিকাটি গদ্যাকারে লেখেন। ৯৬০ থেকে ৯৭৭ সালের মধ্যে কয়েকজন পণ্ডিতের একটি দল আরব ইতিহাসবিদ তাবারি রচিত কুরআনের আরবি টীকা ও ব্যাখ্যাগুলি অত্যন্ত সহজসরল ফার্সিতে অনুবাদ করেন; এটিও সবচেয়ে প্রাচীন ফার্সি গদ্যের একটি। সেলজুক রাজাদের অধীনে ১১শ ও ১২শ শতকে বিভিন্ন বিষয়ের উপর পাণ্ডিত্যপূর্ণ গদ্যসাহিত্য রচিত হয়। এদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল "রাজপুত্রদের জন্য আয়না" ধারার বইগুলি, যেগুলিতে বাস্তবজীবনে বিচক্ষণতা এবং আচার আচরণের নিয়মকানুন বর্ণিত হয়েছে। এই ধারায় ১১শ শতকে গুর্গানের রাজা কেইকাভুস ইবন ইস্কান্দার ১০৮২ সালের দিকে লেখেন কাবুসনমে। পরবর্তী ফার্সি গদ্য সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র হলে স'দী। তিনি লেখেন প্রবাদ প্রবচনের বই গোলেস্তন ("ফুল বাগান", ১২১৮)।

ধ্রুপদী ফার্সি সাহিত্যে উন্নতমানের নাটক দেখতে পাওয়া যায় না। শিয়া ধর্মাবলম্বী শহীদদের জীবনের উপর ভিত্তি করে লেখা তাজিয়া-শিয়া নাটকগুলির সাহিত্যিক মূল্য কম, তবে এগুলি ইরানেরজাতীয় চেতনার গভীরে প্রোথিত। ১৯শ শতকের শেষ দিকে এগুলি জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিল।

আধুনিক প্রবণতা সম্পাদনা

১৮শ শতকে পাশ্চাতের সাথে সংযোগ এবং আরও বিভিন্ন কারণে ফার্সি সাহিত্যে পরিবর্তন আসা শুরু হয়। ১৯শ শতকের শুরুর দিকের শ্রেষ্ঠ লেখক ছিলেন কইম মাকাম, যার রচিত মোন শআত ফার্সি পত্ররচনা সাহিত্যে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির অবতারণা করে। ১২শ শতক থেকেই অলঙ্কারবহুল শৈলীতে ফার্সি গদ্য লেখা হয়ে আসছিল, কিন্তু ১৯শ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ফার্সি গদ্য সরল হতে শুরু করে। গদ্যের বিষয়বস্তুতেও পরিবর্তন ঘটে। ইরানের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে গ্রন্থ লেখা শুরু হয়। বিংশ শতাব্দীর শুরু নাগাদ ইরানে একটি ব্যস্ত প্রকাশনা শিল্প গড়ে ওঠে। এসময় স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদকে উপজীব্য করে বেশ কিছু গুরুগম্ভীর নাটক রচিত হয়, যেগুলি ছিল ফার্সি সাহিত্যের জন্য নতুন এক ঘটনা। এই সমস্ত রচনা ইরানি জাতির জাগরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, ১৯০৫ সালের সাংবিধানিক বিপ্লবে যার পরিসমাপ্তি ঘটে।

১৯১৯ সালে ফার্সি ভাষাতে প্রথম ছোট গল্পের সংকলন বের হয়। উপন্যাসের পরিবর্তে গদ্যের এই ধারাটিতেই আধুনিক ফার্সি লেখকেরা বেশি সফল হয়েছেন। এদের মধ্যে আছে এম এ জামালজাদেহ, সাদিক হিদায়াত, বুজুর্গ আলাভি, সাদিক চুবাক এবং জালাল আলে আহমাদ। এদের মধ্যে হিদায়াতের নিরাশাবাদী, ব্যধিগ্রস্ততা-ভিত্তিক সাহিত্যকর্মগুলি তরুণ প্রজন্মের লেখকদের উপর গভীর প্রভাব ফেলে এবং তাকে আধুনিক ইরানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লেখকদের একজন মনে করা হয়। ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইরানের কবিতা এক নতুন জীবন লাভ করেছে। কিছু আধুনিক কবি নিমা ইউশিজের কবিতাগুলিকে মডেল হিসেবে অনুসরণ করে ঐতিহ্য ভেঙে বেরিয়ে আসেন এবং অন্ত্যমিলবিহীন, ছন্দহীন কবিতা লেখা শুরু করেন। ১৯শ শতকেই পশ্চিমা ধারার নাটক লেখা শুরু হয়েছিল। মালকাম খান এবং সএদী নাট্যকার হিসেবে পরিচিত। সএদী বিদ্রূপাত্মক লেখক হিসেবেও পরিচিত।

আরও দেখুন সম্পাদনা