বিদ্রোহী (কবিতা)
বিদ্রোহী কবিতা কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত কবিতাসমূহের মধ্যে একটি। ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি, বিজলী পত্রিকায় কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। [২] এরপর কবিতাটি মাসিক প্রবাসী পত্রিকার মাঘ ১৩২৮ সংখ্যায়, মাসিক সাধনা বৈশাখ ১৩২৯ সংখ্যায় ও ধূমকেতুতে (২২ আগস্ট ১৯২২) ছাপা হয়। প্রকাশিত হওয়া মাত্রই এটি ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি করে। দৃপ্ত বিদ্রোহী মানসিকতা এবং অসাধারণ শব্দবিন্যাস ও ছন্দের জন্য আজও বাঙালি মানসে কবিতাটি "চির উন্নত শির" বিরাজমান। [৩]
কাজী নজরুল ইসলাম কর্তৃক রচিত | |
লিখেছেন | ডিসেম্বর, ১৯২১[১] |
---|---|
প্রথম প্রকাশিত | ৬ই জানুয়ারী, ১৯২২ |
দেশ | ব্রিটিশ ভারত |
ভাষা | বাংলা |
বিষয় | বিদ্রোহ, প্রতিবাদ |
প্রকাশক | বিজলী |
লাইন | ১৩৯[১] |
কবিতাটির প্রথম প্রকাশ নিয়ে মতভেদ রয়েছে।প্রাণতোষ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, 'বিদ্রোহী কবিতা বিজলীতে প্রকাশেরও আগে মোসলেম ভারতে প্রকাশিত হয়।[৪]
ইতিহাস ও পটভূমি
সম্পাদনা১৯১৯ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে কাজী নজরুল ইসলাম তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুজাফফর আহমেদের সাথে কলকাতায় বসবাস শুরু করেন। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে, যখন তারা কলকাতার ৩/৪ সি তালতলা লেনে বসবাস করছিলেন, নজরুল কবিতাটি পেনসিলে লেখেন। মুজাফফর আহমেদের মতে, কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ৬ জানুয়ারি ১৯২২ সালে সাপ্তাহিক বিজলী পত্রিকায়। প্রকাশের পর, কবিতাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং দ্য মোসলেম ভারত , প্রবাসী , মধুমতি এবং সাধনা ম্যাগাজিন সহ অন্যান্য কিছু পত্রিকাও কবিতাটি প্রকাশ করে।[১][৫] ‘বিদ্রোহী’ সমিল মুক্তক মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত। বাংলা ভাষায় নজরুলই এই ছন্দের প্রবর্তক। এটি ৮টি স্তবক, ১৪৯টি পঙ্ক্তির একটি দীর্ঘ কবিতা।[৬]
কবিতাটি প্রথম ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসে আর্য পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশিত অগ্নিবীণা বইয়ে অন্যান্য ১১টি কবিতার সাথে সংগ্রহ করা হয়েছিল।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন
“ | প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব, ভারতে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলন, তুরস্কে কামাল পাশার আবির্ভাব, বাংলা সাহিত্যের এসব পটভূমি নজরুলকে বিদ্রোহীর মতো কবিতা লেখার জন্য প্রভাবিত করেছে। | ” |
অভ্যর্থনা
সম্পাদনাপাঠক জনপ্রিয়তা
সম্পাদনাবিজলী পত্রিকায় ১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি, ২২ পৌষ ১৩২৮ বঙ্গাব্দ শুক্রবারে প্রথম কাজী নজরুল ইসলামের "বিদ্রোহী" কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতাটি প্রকাশের পর হতেই নজরুল সকলের কাছে পরিচিত হতে থাকেন এবং নানানভাবে সমাদৃত হন। নলিনীকান্ত সরকার সেসময় বিজলী পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন।[৭] বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশনার দিন বিজলী পত্রিকা পরপর দুই বার ছাপতে হয়েছিল, যার সংখ্যা ছিলো ২৯ হাজার।[৮] মুজাফফর আহমদের কাছ থেকে জানা যায়, সেদিন কমপক্ষে দুই লাখ মানুষ বিদ্রোহী পড়েছিল।[৯]
বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সমাদর
সম্পাদনাকাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রশংসা করে বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন,
মনে হলো এমন কিছু আগে কখনো পড়িনি
[১] এরপর তিনি আরো এক স্থানে বলেন
“ | বাংলা সাহিত্য বিশ শতকে রবীন্দ্র প্রভাব এতো সর্বগ্রাসী হয়েছিল, মনে হচ্ছিল, এর বাইরে যাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না বিদ্রোহী কবিতার নিশান উড়িয়ে হইহই করে নজরুল এসে হাজির হলেন। | ” |
বিদ্রোহী স্মরণে
সম্পাদনা২০২১ সালের ২৫ ডিসেম্বর 'বিদ্রোহী' কবিতার শতবর্ষ উপলক্ষে জাতীয় কবির সমাধিস্থলে অনুষ্ঠিত হয়েছে শত কন্ঠে বিদ্রোহী কবিতা পাঠ। এ পাঠের আয়োজন করে নজরুল চর্চা কেন্দ্র বাঁশরী।[১০]
সমালোচনা এবং প্রতিক্রিয়া
সম্পাদনাভাব চুরির অভিযোগ
সম্পাদনামুজফফর আহমদ -এর বই হতে জানা যায়, 'বিদ্রোহী' ছাপা হওয়ার পর কবি মোহিতলাল মজুমদার দাবী করেছিলেন যে, তার 'আমি' শীর্ষক একটি লেখার ভাব নিয়ে নজরুল কবিতাটি লিখেছে, কিন্তু কোন ঋণ স্বীকার করেনি। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ গুপ্ত ও 'বিংশ শতাব্দী'-তে লিখেছিলেন, মোহিতলাল মজুমদারের 'আমি' প্রবন্ধের ভাববস্তুর সঙ্গে নজরুলের বিখ্যাত 'বিদ্রোহী' কবিতাটির সাদৃশ্য অত্যন্ত স্পষ্ট। তবে অন্যান্য সাহিত্যিকগণ এবং মুজফফর আহমদ নিজেও তাদের সেই দাবিকে সম্পূর্ণরূপে নাকোচ করে দেন।[১]
বিদ্রূপ
সম্পাদনানজরুলের বিদ্রোহী প্রকাশিত হবার পর কয়েকজন কবি একে কোনো কবিতার আওতাতেই ফেলতে রাজি ছিলেন না। আর তারই পরিপ্রেক্ষিতে তারা এর ব্যঙ্গাত্মক রূপ প্রকাশ করতে থাকেন। বিদ্রোহী কবিতার ব্যাঙ্গ করে সজনীকান্ত দাস 'ব্যাঙ' নামে একটি কবিতাও লিখেছিলেন, যা শনিবারের চিঠি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।[১] সেখানে তিনি প্যারোডি করে লিখেছিলেন,
আমি ব্যাঙ!
লম্বা আমার ঠ্যাং ।
আমি ব্যাঙ!
আমি সাপ!
আমি ব্যাঙেরে গিলিয়া খাই,
আমি বুক দিয়ে হাঁটি ইঁদুর ছুঁচোর গর্তে ঢুকিয়া যাই।
ব্রিটিশদের প্রতিক্রিয়া
সম্পাদনাএই কবিতা সেই সময় নিষিদ্ধ করা হবে কিনা, সেটা নিয়ে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের মধ্যে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল।
অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলছেন,
“ | আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা না করলেও যেখানেই এসব পত্রিকা পেতো, সেগুলো জব্দ করতো। আনুষ্ঠানিকভাবে না হলেও অনানুষ্ঠানিকভাবে একপ্রকার নিষিদ্ধ ছিল | ” |
অভিযোজন
সম্পাদনারূপান্তর (বিদ্রোহী গান)
সম্পাদনা১৯৪৯, মতান্তরে ১৯৫২ সালে সংক্ষিপ্তাকারে ‘বিদ্রোহী’র সুর করেছিলেন প্রবাদপ্রতিম সংগীতগুরু, লোক ও নজরুলসংগীতশিল্পী এবং সুরকার গিরীন চক্রবর্তী।[১২] আর এতে কন্ঠ দিয়েছিলেন সংগীতশিল্পী শেখ লুৎফর রহমান এবং অভিনেতা ও গায়ক আরিফুল হক। ১৯৬৫ সালে বিদ্রোহী’ কবিতায় সম্পূর্ণ নতুন এবং আধুনিক জোড়ালো একটি সুরারোপ করেছিলেন বাংলাদেশের শহীদ গায়ক ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ।[১২]
জনপ্রিয় মাধ্যমে ব্যবহার
সম্পাদনাভারতীয় চিত্রনায়ক জিৎ অভিনীত এবং ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্র 'দ্য রয়েল বেঙ্গল টাইগার'[১৩] এবং ২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় বাংলা ভাষার নাট্যধর্মী চলচ্চিত্র 'কণ্ঠ'-তে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতাটি ব্যবহৃত হয়েছে।[১৪][১৫]
আরো দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ "নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতাটি একশো বছর আগে যেভাবে লেখা হয়েছিল"। BBC News বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-১৬।
- ↑ "কাজী নজরুল ইসলাম: 'বিদ্রোহী' কবিতার একশো বছর, ১৯২১ সালের ডিসেম্বর মাসে যেভাবে লেখা হয়েছিল"। বিবিসি বাংলা।
- ↑ প্রথম আলো পত্রিকা ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০১২-০৭-১৩ তারিখে
- ↑ ":: যায় যায় দিন ::"। web.archive.org। ২০১৫-০৩-১৫। Archived from the original on ২০১৫-০৩-১৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-১৬।
- ↑ আচার্য, সুব্রত; কলকাতা (২০১৭-০৫-২৫)। "'বিদ্রোহী' কবিতার আঁতুড়ঘর"। The Daily Star Bangla (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-১৬।
- ↑ কাজী, অনিন্দিতা (২০২১-১২-২২)। "শতবর্ষেও চির উন্নত তব শির"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-১৬।
- ↑ "Daily Amardesh -ঢাকা, বৃহস্পতিবার ২৭ ডিসেম্বর ২০১২, ১৩ পৌষ ১৪১৯, ১৩ সফর ১৪৩৪ হিজরী"। web.archive.org। ২০১৫-০৩-১৫। Archived from the original on ২০১৫-০৩-১৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-১৬।
- ↑ "চির-উন্নত মম শির :: শেষের পাতা :: কালের কণ্ঠ"। web.archive.org। ২০১৫-০৩-১৫। Archived from the original on ২০১৫-০৩-১৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-১৬।
- ↑ "Daily Amardesh -ঢাকা, রোববার ২৩ ডিসেম্বর ২০১২, ৯ পৌষ ১৪১৯, ৯ সফর ১৪৩৪ হিজরী"। web.archive.org। ২০১৫-০৩-১৫। Archived from the original on ২০১৫-০৩-১৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-১৬।
- ↑ "শতকণ্ঠে 'বিদ্রোহী' কবিতা পাঠ | কালের কণ্ঠ"। Kalerkantho। ২০২১-১২-২৬। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-১৭।
- ↑ ডেস্ক, অনলাইন। "যেভাবে লেখা হয়েছিল নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতা"। DailyInqilabOnline (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-০২।
- ↑ ক খ রহমান, মতিউর। "বিদ্রোহী গান"। Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-১৮।
- ↑ "Bidrohi (বিদ্রোহী)- Jeet (জিৎ) The Royal Bengal Tiger (2014)"।
- ↑ "কাজী নজরুল ইসলামকে কন্ঠ'র ট্রিবিউট - জিয়ো বাংলা"। JiyoBangla (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-১৭।
- ↑ "BIDROHEE | KAJI NAJRUL ISLAM | KONTTHO | NANDITA | SHIBOPROSAD | PAOLI | JAYA"।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- বাংলা কবিতা ওয়েবসাইটে বিদ্রোহী কবিতা
- যেভাবে লেখা হয়েছিল নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা
- ইউটিউবে বিদ্রোহী কবিতার আবৃত্তি