ইসলামের নবি ও রাসুল

আল্লাহর বার্তাবাহক
(ইসলামের নবী থেকে পুনর্নির্দেশিত)

ইসলামে নবি (আরবি: ٱلْأَنْبِيَاء فِي ٱلْإِسْلَام) হলেন সেই ব্যক্তিরা, যাঁরা ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী পৃথিবীতে আল্লাহর বার্তা প্রচার করেন এবং আদর্শ মানব আচরণের দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ রসূল (আরবি: رُسُل; একবচনে رَسُول, রাসূল) হিসেবে পরিচিত, অর্থাৎ যাঁরা ওহি বা ঐশী বার্তা পৌঁছে দেন, সাধারণত কোনো ফেরেশতার মাধ্যমে। মুসলমানদের বিশ্বাস, বহু নবি পৃথিবীতে এসেছেন, যাঁদের অনেকের নাম কুরআনে উল্লেখ নেই। কুরআনে বলা হয়েছে: “প্রত্যেক জাতির জন্যই একজন বার্তাবাহক রয়েছে।”[][] ইসলামে নবি ও রসূলদের প্রতি বিশ্বাস হল ঈমানের ছয়টি মূল বিশ্বাসের অন্যতম।[]

মুসলমানদের মতে, প্রথম নবি ছিলেন আদম (আদম আলাইহিস সালাম), যিনি একইসঙ্গে মানবজাতির প্রথম ব্যক্তি। ইহুদি ধর্মখ্রিষ্টধর্মের ৪৮ জন নবির অনেকেই কুরআনে তাদের আরবি নামসহ উল্লেখিত আছেন। যেমন, ইহুদি নবি এলিশা কুরআনে আলইয়াসা, আয়ূব (Job), ঈসা (Jesus), এভাবে উল্লেখিত। মূসার (Moses) প্রতি নাজিল হওয়া তোরাহ কুরআনে তাওরাত নামে, দাঊদ (David) এর প্রতি প্রাপ্ত গীতসংহিতা (Psalms) কুরআনে যাবুর নামে, এবং ঈসার প্রতি আগত ইঞ্জিল (Gospel) ইনজিল নামে পরিচিত।[]

ইসলামে শেষ নবি হলেন মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ (সা.), যাঁকে মুসলমানরা "নবীদের সীল" (খাতামান-নাবিয়্যীন) হিসেবে বিশ্বাস করেন। তাঁর ওপর কুরআন নাজিল হয়েছে একাধিক ওহির মাধ্যমে, যা তাঁর সাহাবীরা লিখে সংরক্ষণ করেন।[] মুসলমানদের বিশ্বাস, কুরআন আল্লাহর কালাম, এটি অপরিবর্তনীয় ও বিকৃতির হাত থেকে সংরক্ষিত,[] এবং এটি শেষ দিবস পর্যন্ত তার আসল রূপেই থাকবে।[] যদিও মুহাম্মাদ (সা.)-ই শেষ নবি, কিছু মুসলিম পরম্পরায় আউলিয়াদের ও শ্রদ্ধা করা হয় (যদিও সালাফিওয়াহাবি মতবাদে তা অস্বীকৃত)।[]

ইসলামে বিশ্বাস করা হয়, প্রতিটি নবি একই মৌলিক বার্তা প্রচার করেছেন: এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস, শুধুমাত্র তাঁর ইবাদত করা, শিরকপাপ থেকে বিরত থাকা, এবং পুনরুত্থানের দিন, হিসাবের দিনপরকালীন জীবনে বিশ্বাস স্থাপন করা। প্রতিটি জাতির জন্য নির্দিষ্ট সময়ে একজন করে নবি বা রসূল প্রেরণ করা হয়েছে।

পরিভাষা

সম্পাদনা

কুরআনের পূর্ববর্তী পরিভাষা

সম্পাদনা

রাসূলুল্লাহ (আক্ষ.'আল্লাহর রাসূল') শব্দটির সিরিয়াক ভাষার রূপ শেলীহে দ-আল্লাহা প্রায়শই নবনিয়মের অপোক্রিফাল গ্রন্থ অ্যাক্টস অব সেন্ট থমাস-এ ব্যবহৃত হয়েছে। এই “শেলীহে” শব্দের জন্য মূল ক্রিয়া শালাহ্ (প্রেরণ করা), হিব্রু বাইবেলে নবিদের প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে।[]

কুরআনে ব্যবহৃত পরিভাষা

সম্পাদনা

আরবিতে, নবি (বহুবচনে: أنبياء, আনবিয়াঃ) শব্দটির অর্থ "প্রবক্তা" বা "নবি"। এই শব্দটি কুরআনে ৭৫ বার এসেছে। নবুয়্যত (আরবি: نبوة অর্থাৎ “নবুয়্যতের অধিকার”) শব্দটি কুরআনে ৫ বার ব্যবহৃত হয়েছে। রাসূল (বহুবচনে: رسل, রুসুল) এবং মুরসাল (مرسل, মুরসাল, বহুবচনে: مرسلون, মুরসালুন) শব্দগুলো এমন বার্তাবাহককে বোঝায় যাঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে বিধান নিয়ে আসেন। এই শব্দগুলো কুরআনে ৩০০ বারেরও বেশি ব্যবহৃত হয়েছে। একজন নবির বার্তার জন্য ব্যবহৃত শব্দ রিসালাহ (رسالة, রিসালাহ, বহুবচনে: رسالات, রিসালাত) কুরআনে ১০ বার ব্যবহৃত হয়েছে।[১০]

নিচের ছকে বিভিন্ন ভাষায় “নবি” ও “রাসূল” শব্দগুলোর রূপ তুলে ধরা হয়েছে:[১১]

বাইবেল ও কুরআনে নবি ও রাসূল শব্দের রূপ
আরবি ইংরেজি গ্রিক হিব্রু
نَبِيّnabī, উচ্চারণ [ˈnæbiː] নবি (Prophet) προφήτης [prophētēs] ত্রুটি: {{Transliteration}}: unrecognized language / script code: grc-x-biblical (সাহায্য) נָבִיא (nāḇî') উচ্চারণ [naˈvi]
رَسُولrasūl, উচ্চারণ [rɑˈsuːl]

مُرْسَلmursal, উচ্চারণ [ˈmʊrsæl]

বার্তাবাহক (Messenger)
নবি (Prophet)
প্রেরিত ব্যক্তি (Apostle)
ἄγγελος, [angelos] ত্রুটি: {{Transliteration}}: unrecognized language / script code: grc-x-biblical (সাহায্য)
ἀπόστολος, apostolos
מַלְאָךְ mal'āḵ, উচ্চারণ [malˈ(ʔ)aχ]
שְׁלַח, šᵊlaḥ উচ্চারণ [ʃeˈlaχ]

ফেরেশতাদের প্রেরণ

সম্পাদনা

তাফসিরবিদরা সাধারণত ফেরেশতাদের মধ্যে পার্থক্য করেন—একদল ফেরেশতা যাঁরা “রাসূল” হিসেবে স্বর্গ ও পৃথিবীর মধ্যে আল্লাহর আদেশ পৌঁছে দেন, এবং অন্যরা যাঁরা আসমানে অবস্থান করেন (কারুবিয়িন)।[১২][১৩] কুরআন ও তাফসিরে, রাসূল শব্দটি কখনো ফেরেশতাদের জন্যও ব্যবহৃত হয়েছে। এই রূপে শব্দটি কুরআন ৮১:১৯, কুরআন ১১:৬৯–১১, এবং কুরআন ৫১:২৬–১১ আয়াতে পাওয়া যায়। এছাড়া, এটি মৃত্যুর ফেরেশতার অধীনস্থ ফেরেশতাদের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়েছে।[১৪]

বৈশিষ্ট্যসমূহ

সম্পাদনা

ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, কুরআন হল ইব্রাহিমি ধারার সর্বশেষ নবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রতি নাজিল হওয়া এক ঐশী বার্তা। এই কুরআনের বিষয়বস্তু মুসলমানদের ভাষায় সরাসরি পথ নির্দেশ করে।[১৫] ইসলামে বিশ্বাস করা হয়, প্রত্যেক নবি মানুষকে আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের শিক্ষা দিয়েছেন, যা ইসলাম নামে পরিচিত। নবিদের বার্তায় দান সদকা, নামাজ, হজ, রোজার গুরুত্ব থাকলেও, সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হয়েছে এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও তাঁর একমাত্র ইবাদতের ওপর।[১৬] কুরআন নিজেই ইসলামকে ইব্রাহিম (আ.)-এর ধর্ম হিসেবে উল্লেখ করে,[১৭] এবং ইয়াকুব (আ.) ও ইসরাইলের বারো গোত্র-কে মুসলিম বলে অভিহিত করে।[১৮]

কুরআনে বলা হয়েছে:

তিনিই তোমাদের জন্য সেই দ্বীনের বিধান দিয়েছেন, যা নূহকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, এবং যা আমি (হে নবী) তোমার প্রতি ওহি পাঠিয়েছি, আর যা ইব্রাহিম, মূসা ও ঈসাকে দিয়েছিলাম, (এই মর্মে): “তোমরা দ্বীন কায়েম করো এবং তাতে বিভেদ করো না।”

ইসলামে নবিরা সাধারণ মানুষের জন্য আদর্শ হিসেবে বিবেচিত। তাঁরা সৎচারিত্রিক ও নৈতিক গুণাবলির মূর্তপ্রতীক। প্রত্যেক নবির কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে—যেমন, নবুয়্যতের ধারাবাহিকতা, একত্ববাদের প্রচার, আল্লাহর বার্তা পৌঁছে দেওয়া, এবং আল্লাহকে অস্বীকার করার পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা। নবিদের প্রতি ওহি বা বার্তা সাধারণত নিদর্শন ও অলৌকিক প্রমাণের মাধ্যমে আসে।

সব নবি একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত এবং শেষ নবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর বার্তার পূর্ণতা দান করেন। নবিদের এসব গুণাবলি মানুষকে সঠিক পথের দিকে導িত করার জন্য।

একটি হাদীসে বলা হয়েছে: “মানুষের মধ্যে নবিরাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট ভোগ করেন।”[১৯]

নিদর্শন ও আলৌকিক প্রমাণ

সম্পাদনা

কুরআনের বিভিন্ন অংশে দেখা যায়, যেমন মূসা (আ.)ঈসা (আ.)-এর মতো নবিরা বিভিন্ন অলৌকিক কাজ করেছেন বা অলৌকিক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এসব ঘটনা নবিদের ইচ্ছায় নয়; বরং সবই আল্লাহর ইচ্ছায় সংঘটিত হয়েছে।

মক্কী সূরাগুলোতে এমন অনেক ঘটনা আছে যেখানে মক্কার লোকেরা মুহাম্মাদ (সা.)-এর আল্লাহর সঙ্গে সংযোগের প্রমাণ দেখতে চাইত। এ প্রসঙ্গে মুহাম্মাদ (সা.) বলেন, “নিদর্শন তো আল্লাহর কাছেই রয়েছে, আর আমি তো কেবল একজন স্পষ্ট সতর্ককারী।” (২৯:৫০) এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, নবিরা আল্লাহর শক্তির সাক্ষ্যদাতা মাত্র, এবং আল্লাহ যেই সময়ে ইচ্ছা করেন, তখনই তাঁদের মাধ্যমে নিদর্শন প্রদান করেন।[২০]

আরও বলা হয়েছে, আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত দৃষ্টান্তমূলক নিদর্শন ও বাণীগুলো অবিশ্বাসীরা প্রায়শই সিহর (سحر, অর্থাৎ "জাদু") বলে অস্বীকার করত। কুরআনে বলা হয়েছে: “তারা বলে—সে তো আমাদেরকে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলতে চায় এবং আমাদেরকে বিশ্বাস করাতে চায় যে, সে আল্লাহর বাণী বলছে, অথচ সে তো আমাদেরই মতো একজন সাধারণ মানুষ।” (৭৪:২৪-২৫)

পাপ ও সুরক্ষা

সম্পাদনা

ইসলামের প্রাথমিক যুগে নবিদের নির্ভুল বা নিষ্পাপ (মাসূম) হিসেবে দেখা হতো না।[২১] ঈসা (আ.) ব্যতীত প্রায় সকল প্রধান নবিকেই কোনো না কোনো সময়ে পাপ করার অভিযোগের মুখে পড়তে হয়েছে।[২১] শুধু তাই নয়, নবিদের এসব পাপকে কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাত্ত্বিকভাবে মুক্তির (সোটেরিওলজিক্যাল) শিক্ষার অংশ হিসেবেও দেখা হয়েছে।[২১][২২] যেমন, মূসা (আ.) একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করার পর ক্ষমা প্রার্থনা করেন।[২৩] আদম (আ.) জান্নাতে পাপ করে অনুতপ্ত হন, যা মানুষকে তাওবার শিক্ষা দেয়।[২৪]

খ্রিস্টীয় নবম শতাব্দীতে এসে সুন্নি ইসলামে নবিদের নিষ্পাপতা একটি গ্রহণযোগ্য মত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।[২৫] এই মতবাদ মূলত ওহির নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।[২৬] এটি সম্ভবত শিয়া মতবাদের ইমামদের নিষ্পাপতার (ইসমাহ) মতবাদ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল।[২৭][২৮]

পরবর্তীতে মু’তাযিলী মতাবলম্বীরাও এই দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করে এবং নবিদের বড় ও ছোট উভয় ধরণের পাপ থেকে সুরক্ষিত মনে করেন।[২৯] আশআরীদের কেউ কেউ বলেন, নবিরা শুধু তাঁদের বার্তা প্রদানের কাজের মধ্যে পাপ থেকে রক্ষা পান। আল-বাকিল্লানি বলেন, নবিরা প্রতারণা ও মিথ্যাচার থেকে এবং বড় পাপ থেকে সংরক্ষিত থাকেন, তবে সামগ্রিকভাবে তাঁরা অপরাধবিমুক্ত (নিষ্পাপ) নন।[২৯] বেশিরভাগ ইসলামী আলেম এই মতেই একমত ছিলেন।[৩০]

পরবর্তীকালে বিশেষ করে সুফি চিন্তায় মুহাম্মাদ (সা.)-কে নির্ভুল ও নিষ্পাপ রূপে চিত্রিত করা হয়। যখন মুহাম্মাদ (সা.) শয়তানের প্রভাব থেকে কীভাবে বাঁচলেন—এই প্রশ্ন করা হয়, তখন রুমি এক উপমা দেন: শয়তান কুকুরের লালা এবং মুহাম্মাদ (সা.) একটি বিশাল সাগরের মতো। অন্যান্য মানুষ যেন এক গ্লাস পানির মতো। কুকুরের লালা সাগরকে প্রভাবিত করতে পারে না, কিন্তু এক গ্লাস পানিকে প্রভাবিত করতে পারে।[৩১]

হিকমাহ (প্রজ্ঞা)

সম্পাদনা

মুহাম্মাদ (সা.)-কে ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে ওহির এক বিশেষ উপহার প্রদান করা হয়। এই প্রত্যক্ষ ঐশী যোগাযোগ নবুওয়তের অভিজ্ঞতাকে মানবজীবনের অংশ হিসেবে তুলে ধরে। কুরআনের বার্তা এই বেছে নেওয়া ব্যক্তিদের মাধ্যমে মানব ইতিহাসে এক মহান ঐশী ধারার ভিত্তি স্থাপন করে।

কুরআনে বিভিন্ন নবির প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত বিশেষ উপহার বা জ্ঞান উল্লেখ করা হয়েছে। এই উপহারগুলো কখনো কিতাব (গ্রন্থ) হিসেবে, আবার কখনো আকাশীয় জ্ঞানের রূপে বোঝানো হয়। যদিও ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী সকল নবিই অসাধারণভাবে জ্ঞানী ও গুণে গুণান্বিত ছিলেন, তবে যাঁদের জন্য আলাদাভাবে “হিকমাহ” বা “জ্ঞান” শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, তা বোঝায় যে তাঁদের প্রতি বিশেষ গোপন জ্ঞান প্রকাশিত হয়েছে।

কুরআনে বলা হয়েছে, ইব্রাহিম (আ.) প্রজ্ঞার জন্য প্রার্থনা করেন এবং পরে তা লাভ করেন।[৩২] ইউসুফ (আ.)[৩৩]মূসা (আ.)[৩৪] প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর প্রজ্ঞা লাভ করেন। দাঊদ (আ.) জালুতকে পরাজিত করার পর রাজত্বের সাথে প্রজ্ঞাও লাভ করেন।[৩৫] লূত (আ.) সদূম ও আমোরাহ নগরীতে নবুয়ত প্রদানের সময় প্রজ্ঞা লাভ করেন।[৩৬] ইয়াহইয়া (আ.) (জন দ্য ব্যাপটিস্ট) শিশু অবস্থায়ই প্রজ্ঞা লাভ করেন।[৩৭] এবং ঈসা (আ.)-কে প্রজ্ঞা সহ ইনজিল (গসপেল) প্রদান করা হয়।[৩৮]

নবুয়তের বংশধারা

সম্পাদনা
 
ইসমাইলকে কুরবানি করতে প্রস্তুত ইব্রাহিম (আ.); এবং নিমরুদ কর্তৃক আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার দৃশ্য। ১৬শ শতাব্দীর ওসমানীয় তুর্কি পাণ্ডুলিপি যুবদাত আত-তাওয়ারীখ থেকে।

ইব্রাহিম (আ.)-কে ইব্রাহিমি ধর্মগুলিতে একত্ববাদের জনক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কুরআনে তাঁকে একজন রাসূল, মানবজাতির জন্য এক আত্মিক আদর্শ[৩৯] এবং মুসলিম নবিদের ধারাবাহিকতায় এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোগরূপে চিত্রিত করা হয়েছে। মুহাম্মাদ (সা.), যিনি আল্লাহর চূড়ান্ত রাসূল ও কুরআনের গ্রহীতা, তিনি ইব্রাহিম (আ.)-এর বংশধর, এবং তিনিই ইব্রাহিমি নবুয়তের ধারার পরিসমাপ্তি ঘটান।

এই সম্পর্কের ইঙ্গিত সূরা ৬-এ দেখা যায়:

এই ছিল আমাদের দলিল, যা আমরা ইব্রাহিমকে তার জাতির বিরুদ্ধে দান করেছিলাম। আমি যাকে ইচ্ছা, মর্যাদায় উন্নীত করি। তোমার প্রতিপালক প্রজ্ঞাময়, সর্বজ্ঞ। আর আমি তাকে দান করেছিলাম ইসহাক ও ইয়াকুব এবং প্রত্যেককেই পথনির্দেশ দিয়েছিলাম। তার পূর্বে আমি নূহকে পথ দেখিয়েছিলাম, আর তার বংশধরদের মধ্য থেকে—দাউদ, সুলায়মান, আইয়ুব, ইউসুফ, মূসা ও হারুন—আমরা সবার প্রতিদান দিয়েছি সৎকর্মপরায়ণতার জন্য। এবং জাকারিয়া, ইয়াহইয়া, ঈসা ও ইলিয়াস—প্রত্যেকেই ছিলেন ধার্মিক। আর ইসমাইল, আল ইয়াসা, ইউনুস ও লূত; আমি তাদের সবাইকে বিশ্ববাসীর উপর মর্যাদায় উন্নীত করেছি। আমি তাদের পূর্বপুরুষ, সন্তান-সন্ততি ও ভাইদের মধ্য থেকেও অনেককে মর্যাদা দিয়েছি এবং সোজা পথে পরিচালিত করেছি।৬:৮৩-৮৭

কুরআন দুনিয়াকে একে অপরের সঙ্গে জড়িত নাটক ও সংঘাতপূর্ণ দৃশ্যরূপে উপস্থাপন করে। ঐশী নাটকটি সৃষ্টি ও জান্নাত থেকে বহিষ্কারের কাহিনী নিয়ে, আর মানব নাটকটি মানুষের জীবন ও ইতিহাস, বিশেষ করে নবিদের জীবনের ঘটনাবলীকে অন্তর্ভুক্ত করে।[১৫]

ইসলামী নৈতিকতা এই ঈশ্বরনির্ধারিত জীবনে বিশ্বাস ও সৎ জীবন যাপনের ওপর ভিত্তি করে গঠিত। এই দায়িত্ব পালন করা হলো মুমিনদের জন্য একটি আল্লাহপ্রদত্ত কাজ, যার সাথে নবিদের মতো ওহি ও আয়াতের উপলব্ধিও জড়িত।[১৫] নবিদের কাজ হলো এই “সিরাতুল মুস্তাকিম”-এর বার্তা প্রচার করা ও তা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। এটি তাঁদের বার্তার গ্রহণযোগ্যতার একটি মূল বৈশিষ্ট্য, যা ইব্রাহিমি ঐতিহ্যের মধ্যেই স্থান পায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে মুহাম্মাদের প্রতি কুরআনের ওহিও তাওরাতইনজিল-এর সমপর্যায়ে গণ্য হয়।[৪০]

মুহাম্মাদের সঙ্গে নবুয়তের সম্পর্ক ও উপস্থাপনা

সম্পাদনা

কুরআনের নবুয়ত-সম্পর্কিত আলোচনায় এমন কিছু প্যাটার্ন দেখা যায়, যা মুহাম্মাদ (সা.)-এর নবুয়তের প্রমাণকে সমর্থন করে। যেহেতু তিনি ইব্রাহিম (আ.)-এর নবুয়তধারার অন্তর্ভুক্ত, তাই তাঁদের নবুয়তের মধ্যে বেশ কিছু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মুহাম্মাদ (সা.) তাঁর সময়ের মুশরিকদের মূর্তিপূজা থেকে বিরত রাখতে চেয়েছিলেন, যেমনটি করেছিলেন ইব্রাহিম (আ.)। এর ফলে মানুষ তাঁর বার্তা প্রত্যাখ্যান করে এবং তিনি মক্কা থেকে মদিনা হিজরত করতে বাধ্য হন।

Carl Ernst তাঁর How to Read the Qur’an: A New Guide, with Select Translations গ্রন্থে লিখেছেন, “কুরআন প্রায়ই মুহাম্মাদকে সান্ত্বনা দেয় এবং তাঁর বিরোধীদের বিরুদ্ধে তাঁকে সমর্থন করে।”[৪১] এই সান্ত্বনা আল্লাহর পক্ষ থেকে ইব্রাহিমকে দেওয়া সাহসের মতোই তুলনীয়।

মুহাম্মাদ (সা.)-এর কিছু অলৌকিক ঘটনার কথাও উল্লেখ আছে, যেমন মিরাজ—যেখানে তিনি শারীরিকভাবে আসমানে গমন করেন এবং আগের নবিদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই আধ্যাত্মিক যাত্রা ইসলামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ, যেখান থেকে দৈনিক নামাজের বিধানসহ বহু ধর্মীয় রীতিনীতি প্রবর্তিত হয়। (১৭:৭৮-৮৪)

মুহাম্মাদ (সা.) যেহেতু ইব্রাহিম (আ.)-এর বংশধর, তাই তিনি শুধুমাত্র নবুয়তের ধারার অন্তর্ভুক্তই নন, বরং ইব্রাহিমি ধারার শেষ নবি, যিনি মানবজাতিকে “সিরাতুল মুস্তাকিম” বা সোজা পথে পরিচালনার জন্য প্রেরিত। সূরা ৩৩-এ বলা হয়েছে:

মুহাম্মাদ তোমাদের পুরুষদের কারও পিতা নন, বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং নবীদের সীলমোহর। আর আল্লাহ সবকিছু জানেন।৩৩:৪০

নারী নবি

সম্পাদনা

মারিয়াম (আ.) নবি ছিলেন কি না, এ নিয়ে মুসলিম ধর্মতত্ত্ববিদদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। জাহিরি মতবাদের কিছু আলেমের মতে, মারিয়াম ছাড়াও ইসহাক (আ.)-এর মাতা সারা (আ.) এবং মূসা (আ.)-এর পালিতা মাতা আসিয়া (আ.)-ও নবি ছিলেন। তাঁদের এই মতের ভিত্তি কুরআনের সেই অংশগুলো যেখানে ফেরেশতারা এই নারীদের সঙ্গে কথা বলেন এবং আল্লাহ তাঁদের কাজ পরিচালনা করেন।[৪২]

জাহিরি আলেম ইবন হাযম (মৃ. ১০৬৪) এর মতে, নারীরা নবুয়্যত (আরবি: نبوة) অর্জন করতে পারেন, তবে রিসালাত (আরবি: رسالة)—অর্থাৎ রাসূল হওয়া—শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত।[৪২] ইবন হাযম তাঁর এই মতের পক্ষে সূরা ৫:৭৫-এর উদ্ধৃতি দেন, যেখানে মারিয়ামকে “সিদ্দীকা” (সত্যনিষ্ঠ নারী) বলা হয়েছে, যেমন ইউসুফ (আ.)-কে সূরা ১২:৪৬-এ “সিদ্দীক” (সত্যনিষ্ঠ পুরুষ) বলা হয়েছে।

মারিয়ামের অবস্থান সম্পর্কিত ভাষাতাত্ত্বিক দৃষ্টান্তও এই আলোচনা সমর্থন করে। যেমন, সূরা ৪:৩৪-এ মারিয়ামকে “কানেতিন” (আরবি: قَانِتِين)—অর্থাৎ অতীব আনুগত্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, যা সাধারণত পুরুষ নবিদের ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হয়।[৪৩]

তবে মারিয়ামের নবুয়্যত স্বীকারের বিরোধিতা সাধারণত সূরা ১২:১০৯-এর ভিত্তিতে করা হয়, যেখানে বলা হয়েছে: “আমি তো তোমার পূর্বে কেবল পুরুষদেরই প্রেরণ করেছি।” এই আয়াতে ব্যবহৃত “রিজাল” (পুরুষ) শব্দটিকে অনেকে ফেরেশতা বনাম মানুষ প্রসঙ্গে দেখলেও, অধিকাংশ সুন্নি আলেম এটিকে নারীদের নবুয়্যত অস্বীকারের ভিত্তি হিসেবে দেখেছেন এবং এই মতটিকে বিদআত (আরবি: بدعة) বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন।[৪২]

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. কুরআন ১০:৪৭
  2. "Qur'an: The Word of God | Religious Literacy Project"Harvard Divinity School। ২০১৮-১০-০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১০-০৬ 
  3. "BBC - Religions - Islam: Basic articles of faith" (ইংরেজি ভাষায়)। ১৩ আগস্ট ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১০-০৫ 
  4. Campo, Juan Eduardo (২০০৯)। Encyclopedia of Islam। Infobase Publishing। পৃষ্ঠা 559–560। আইএসবিএন 9780816054541। সংগ্রহের তারিখ ২২ জুন ২০১৫ 
  5. Denffer, Ahmad von (১৯৮৫)। Ulum al-Qur'an : an introduction to the sciences of the Qur an (Repr. সংস্করণ)। Islamic Foundation। পৃষ্ঠা 37। আইএসবিএন 978-0860371328 
  6. Understanding the Qurán - Page xii, Ahmad Hussein Sakr - 2000
  7. কুরআন ১৫:৯
  8. Radtke, B., Lory, P., Zarcone, Th., DeWeese, D., Gaborieau, M., F. M. Denny, Françoise Aubin, J. O. Hunwick and N. Mchugh, "Walī", in: Encyclopaedia of Islam, Second Edition, Edited by: P. Bearman, Th. Bianquis, C. E. Bosworth, E. van Donzel, W. P. Heinrichs.
  9. A. J. Wensinck, "Rasul", Encyclopaedia of Islam
  10. Uri Rubin, "Prophets and Prophethood", Encyclopedia of the Qur'an
  11. Strong's Concordance
  12. Wensinck, A. J. (2013). The Muslim Creed: Its Genesis and Historical Development. Vereinigtes Königreich: Taylor & Francis. p. 200
  13. Imam Abu Hanifa’s Al Fiqh Al Akbar Explained By أبو حنيفة النعمان بن ثابت Abu ’l Muntaha Ahmad Al Maghnisawi Abdur Rahman Ibn Yusuf"
  14. Mehdi Azaiez, Gabriel Said Reynolds, Tommaso Tesei, Hamza M. Zafer The Qur'an Seminar Commentary / Le Qur'an Seminar: A Collaborative Study of 50 Qur'anic Passages / Commentaire collaboratif de 50 passages coraniques Walter de Gruyter GmbH & Co KG, 07.11.2016
  15. Kazmi, Yadullah (১৯৯৮)। "The notion of history in the Qur'ān and human destiny"। Islamic Studies37: 183–200। 
  16. Wheeler, Historical Dictionary of Prophets in Islam and Judaism, "Prophets"
  17. কুরআন ৩:৬৭
  18. কুরআন ২:১২৩-১৩৩
  19. The Origin and the Overcoming of Evil and Suffering in the World Religions। Springer Netherlands। ২০১৩। আইএসবিএন 9789401597890 
  20. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Cambridge University Press নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  21. Schöck, C. (2021). Adam im Islam (Vol. 168). Walter de Gruyter GmbH & Co KG. p. 90 (German)
  22. Abu l-Lait as-Samarqandi's Commentary on Abu Hanifa al-Fiqh al-absat Introduction, Text and Commentary by Hans Daiber Islamic concept of Belief in the 4th/10th Century Institute for the Study of Languages and Cultures of Asia and Africa p. 243-245
  23. Schöck, C. (2021). Adam im Islam (Vol. 168). Walter de Gruyter GmbH & Co KG. p. 141 (German)
  24. Stieglecker, H. (1962). Die Glaubenslehren des Islam. Deutschland: F. Schöningh. p. 194 (German)
  25. Brown, Daniel W. (১৯৯৯)। Rethinking tradition in modern Islamic thought (1. paperback সংস্করণ)। Cambridge: Cambridge Univ. Press। পৃষ্ঠা 61। আইএসবিএন 978-0521653947 
  26. Brown 1999, পৃ. 60।
  27. al-Shaykh al-Saduq (১৯৮২)। A Shiite Creed। Fyzee (3rd সংস্করণ)। WOFIS। ওসিএলসি 37509593 
  28. Schimmel, And Muhammad is His Messenger, 56-60.
  29. Schimmel, And Muhammad is His Messenger, 60.
  30. Brown 1999, পৃ. 62।
  31. Schimmel, And Muhammad is His Messenger, 61.
  32. কুরআন ২৬:৮৩
  33. কুরআন ১০:২২
  34. কুরআন ২৮:১৪
  35. কুরআন ২:২৫১
  36. কুরআন ২১:৭৪
  37. কুরআন ১৯:১৪
  38. কুরআন ৩:৪৮
  39. কুরআন ২:২৪
  40. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; :4 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  41. Ernst, Carl (২০১১)। How to Read the Qur'an: A New Guide, with Select Translations। The University of North Carolina Press। পৃষ্ঠা 35। আইএসবিএন 9781469609768 
  42. Stowasser, Barbara Freyer, 1935-2012. (১৯৯৪)। Women in the Quran, traditions, and interpretation। New York: Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0195084801ওসিএলসি 29844006 
  43. Ali, Kecia (২০১৭)। "Destabilizing Gender, Reproducing Maternity: Mary in the Qurʾān"। Journal of the International Qur'anic Studies Association2: 89–109। আইএসএসএন 2474-8390জেস্টোর 10.5913/jiqsa.2.2017.a005ডিওআই:10.5913/jiqsa.2.2017.a005 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা