বাইবেল

খ্রিস্ট ধর্মগ্রন্থ

বাইবেল বা ধর্মপুস্তক (হিব্রু ভাষায়: ביבליה‎; প্রাচীন গ্রিকτὰ βιβλία, tà biblía, “পুস্তকসমূহ”)[১][ক] একটি ধর্মগ্রন্থ সংকলন যা খ্রীষ্টান, যিহূদী, শমরীয়, রাস্তাফারি ও অন্যান্যদের নিকট পবিত্র। এটি একটি সংহিতার আকারে আবির্ভূত হয়, বিভিন্ন ধরনের পুস্তকের সংকলন যা এই বিশ্বাসের দ্বারা সংযুক্ত যে তারা সম্মিলিতভাবে ঈশ্বরের দৈববাণী। এই পুস্তকগুলির মধ্যে রয়েছে ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিনিবদ্ধ ঐতিহাসিক বিবরণ, স্তব, প্রার্থনা, প্রবাদ-প্রবচন, নীতিগর্ভ রূপক কাহিনী, পত্র, আদিরসাত্মক গল্প, কাব্য ও ভাববাণী। বিশ্বাসীরা সাধারণত বাইবেলকে ঐশ্বরিক অনুপ্রেরণার একটি সৃষ্টিকর্ম হিসাবে বিবেচনা করে।

গুটেনবার্গ বাইবেল, প্রথম মুদ্রিত বাইবেল (মধ্য ১৫শ শতাব্দী)

একটি ঐতিহ্য বা গোষ্ঠী দ্বারা বাইবেলে অন্তর্ভুক্ত সেই পুস্তকগুলিকে ধর্মসম্মত বলা হয়, যা সূচিত করে যে সেই ঐতিহ্য বা গোষ্ঠীটি সংকলনটিকে সদাপ্রভুর বাক্য এবং ইচ্ছার প্রকৃত উপস্থাপনা হিসাবে দেখে। বাইবেলের প্রচুর ধর্মপুস্তক মণ্ডলী থেকে মণ্ডলীতে অধিক্রমণ ও অপসৃত বিষয়বস্তুর মাধ্যমে বিবর্তিত হয়েছে।[২] হিব্রু বাইবেল বা তানাখ গ্রীক সপ্ততি ও খ্রীষ্টান পুরাতন নিয়মের সাথে সমাপতিত হয়। খ্রীষ্টান নূতন নিয়ম হল প্রথম শতাব্দীর কোইনি গ্রীক ভাষায় প্রাথমিক খ্রীষ্টানদের, যাদের নাসরতীয় যীশুর যিহূদী শিষ্য বলে ধারণা করা হয়, দ্বারা রচিত গ্রন্থের সংকলন। খ্রীষ্টান মণ্ডলীগুলির মধ্যে ধর্মপুস্তকে কী অন্তর্ভুক্ত করা উচিত সে সম্পর্কে কিছুটা দ্বিমত রয়েছে, মূলত বাইবেলের অপ্রামাণিক অংশসমূহ, একটি রচনা তালিকা যা বিভিন্ন মাত্রার শ্রদ্ধার সাথে বিবেচিত হয়।

বাইবেলের প্রতি মনোভাবের ক্ষেত্রেও খ্রীষ্টীয় দলগুলির মধ্যেও ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। রোমীয় কাথোলিক, উচ্চমণ্ডলী ইঙ্গবাদী, পদ্ধতিবাদী ও পূর্বদেশীয় অর্থোডক্স খ্রীষ্টানরা বাইবেল ও পবিত্র ঐতিহ্য উভয়ের সঙ্গতি আর গুরুত্বের উপর জোর দেয়,[৩][৪] আবার অনেক প্রতিবাদী মণ্ডলী সোলা স্ক্রিপতুরা ধারণার উপর বা কেবল ধর্মগ্রন্থের উপর গুরুত্ব আরোপ করে। সংস্কারকালে এই ধারণাটি প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল এবং বর্তমানে অনেক মণ্ডলী খ্রীষ্টীয় শিক্ষার একমাত্র অভ্রান্ত উৎস হিসাবে বাইবেলের ব্যবহারকে সমর্থন করে। অন্যরা যদিও অনেক জ্ঞানী খ্রিস্টান ব্যক্তিবর্গ বাইবেলে প্রচুর ইতিহাস ও বিজ্ঞান বিষয়ক ভুল খুঁজে পেয়েছেন।

সাহিত্য এবং ইতিহাসে বাইবেলের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে, বিশেষত পশ্চিমা বিশ্বে, যেখানে গুটেনবার্গ বাইবেল প্রথম সচল মুদ্রাক্ষর ব্যবহার করে ছাপা হয়েছিল।[৫][৬] টাইম ম্যাগাজিনের মার্চ ২০০৭ সংস্করণ অনুসারে, “বাইবেল রচিত গ্রন্থসমূহের মধ্যে সাহিত্য, ইতিহাস, বিনোদন এবং সংস্কৃতি গঠনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্ব ইতিহাসে এর প্রভাব অতুলনীয় এবং এর প্রভাব হ্রাসের কোনো লক্ষণ দৃশ্যমান নয়।”[৫] আনুমানিক মোট ৫ বিলিয়নের অধিক কপি বিক্রীত।[৫][৭][৮] ২০০০ এর দশক হিসাবে বার্ষিক এটির প্রায় ১০০ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়।[৯][১০]

বাইবেল খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ। বাইবেল শব্দটি উদ্ভূত হয়েছে কইনি গ্রীক τὰ βιβλία, tà biblía, "বইগুলো"[১১] থেকে; বাইবেল অর্থাৎ ধর্ম শাস্ত্র, লিপি বা পুস্তক, ঈশ্বরের বাক্য

প্রচলিত প্রোটেস্ট্যান্ট বাইবেল ৬৬টি পুস্তকের (বা অধ্যায়ের) একটি সংকলন, যা দুটি প্রধান পর্বে বিভক্ত — ৩৯টি পুস্তক সংবলিত পুরাতন নিয়ম বা ওল্ড টেস্টামেন্ট এবং ২৭টি পুস্তক সংবলিত নতুন নিয়ম বা নিউ টেস্টামেন্ট। তবে ক্যাথলিক বাইবেলে পুস্তকসংখ্যা প্রোটেস্ট্যান্টদের চেয়ে ৭টি বেশি, অর্থাৎ ৭৩টি। খ্রিস্টধর্ম মতে ১৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ৪০জন লেখক বাইবেল লিপিবদ্ধ করেছিলেন। বাইবেলের মুখ্য বিষয়বস্তু বা কেন্দ্রমণি হলেন যীশু

পুরাতন নিয়ম মূলত হিব্রু ভাষায় লিখিত, তবে দানিয়েল ও ইষ্রা পুস্তক দুটির কিছু অংশ আরামীয় ভাষায় লিখিত। নতুন নিয়ম গ্রিক ভাষায় রচিত। বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ এই বাইবেল লিপিবদ্ধ করেছেন বলা হয়। অনেক খ্রিস্টান বিশ্বাস করেন, এই বাইবেল লিপিবদ্ধ হয়েছিল খ্রিস্টীয় ত্রিত্ববাদের অন্যতম পবিত্র আত্মার সহায়তায়। পৃথিবীর অনেক ভাষায় বাইবেল অনুদিত হয়েছে।

ঐতিহাসিক ঘটনার বিবরণের ক্ষেত্রে বাইবেল ও কুরআন-এর ভাষ্য কিছুু ক্ষেত্রে অভিন্ন।

তবে বাইবেলে কুরআনের বিপরীত কথাও পাওয়া যায়।

বাইবেলের (আল কিতাব) অনেক ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণ সমূহ আছে I ইংরেজী ভাষাতে আপনি পেতে পারেন যেমন দি কিং জেমস সংস্করণ, দি নিউ ইন্টারন্যাশনাল সংস্করণ, দি নিউ  আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড সংস্করণ, দি নিউ ইংলিশ সংস্করণ এবং ইত্যাদি ইত্যাদিজেম। যেহেতু বাইবেলের অনেক বিভিন্ন সংস্করণ আছে সেইহেতু এটি দেখায় যে বাইবেল (আল কিতাব) বিকৃত হয়েছে, বা কমপক্ষে ‘সত্য’ একটিকে জানি না I হ্যাঁ বাস্তবিকই এই বিভিন্ন সংস্করণগুলো আছে – কিন্তু এর সাথে বাইবেলের বিকৃতির কোনো সম্পর্ক নেই বা এইগুলো সত্যই      ভিন্ন ভিন্ন বাইবেল কি না I প্রকৃতপক্ষে সেখানে কেবলমাত্র একটি বাইবেল/কিতাব আছে I   

উদাহরণস্বরূপ, যখন দি নিউ ইন্টারন্যাশনাল সংস্করণের কথা বলি, তখন মূল গ্রীক (ইঞ্জিল) এবং হিব্রু (তৌরাত এবং যাবুর) থেকে ইংরেজিতে এক নির্দিষ্ট অনুবাদের কথা বলছি I দি নিউ আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড ইংরেজির আর একটি অনুবাদ কিন্তু সেই একই গ্রীক এবং হিব্রু পাঠ্য থেকে I

বিভিন্ন ধর্মের দৃষ্টিকোণ সম্পাদনা

ইহুদি ধর্ম সম্পাদনা

আব্রাহামীয় ধর্মের মধ্যে ইহুদি ধর্ম, খ্রিস্টধর্মের বাইবেলকে স্বীকার করে না, যেমনটা স্বীকার করে না 'যীশু' নামক ঈশ্বরের কোনো বাণীবাহককে। তবে খ্রিস্টানগণ যেখানে বাইবেলের পুরাতন নিয়ম বলতে ইহুদি ধর্মের ধর্মগ্রন্থগুলোকে বুঝিয়ে থাকেন, সেখানে ইহুদি ধর্মে এজাতীয় কোনো বিভাজন দেখা যায় না, বরং খ্রিস্টধর্মমতে পুরাতন নিয়মই ইহুদি ধর্মের ঐশ্বিক ধর্মগ্রন্থ তোরাহ

ইসলাম ধর্ম সম্পাদনা

ইসলাম ধর্মে পবিত্র কুরআন ও হাদিস শরিফে "বাইবেল" বলে কোনো ধর্মগ্রন্থের উল্লেখ পাওয়া যায় না। উল্লেখ পাওয়া যায়, আল্লাহর বার্তাবাহক নবি ঈসা (আ.) এর উপর অবতীর্ণ "ইঞ্জিল" নামক ধর্মগ্রন্থের। কুরআনে বলা হয়েছে,

"আর আমি তাদের পেছনে মারইয়াম পুত্র ঈসাকে পাঠিয়েছিলাম তার সম্মুখে বিদ্যমান তাওরাতের সত্যায়নকারীরূপে এবং তাকে দিয়েছিলাম "ইঞ্জিল", এতে রয়েছে হিদায়াত ও আলো এবং (তা ছিল) তার সম্মুখে অবশিষ্ট তাওরাতের সত্যায়নকারী, হিদায়াত ও মুত্তাকীদের জন্য উপদেশস্বরূপ।"[কুরআন ৫:৪৬]

খ্রিস্টানদের যীশুকেই পবিত্র কুরআনে ঈসা (আ.) বলা হয়েছে। তবে মুসলিমদের মতে খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা আল্লাহর কিতাব "ইঞ্জিল" পরিবর্তন ও বিকৃত করেছে। তাই বর্তমান বাইবেলকে তারা আল্লাহর কিতাব হিসেবে মানে না, বরং আল্লাহর কিতাবের পরিবর্তিত ও বিকৃত রূপ বলে।[১২]

বাইবেলের বিষয়ে মুসলিমরা ইযহারুল হক[১৩] সহ বিভিন্ন বই লিখেছে।

আরও দেখুন সম্পাদনা

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. See also § Etymology.

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Miller & Huber, Stephen & Robert (২০০৩)। The Bible: the making and impact on the Bible a history। England: Lion Hudson। পৃষ্ঠা 21। আইএসবিএন 978-0-7459-5176-8 
  2. Riches 2000, পৃ. 7–8।
  3. "Methodist Beliefs: In what ways are Lutherans different from United Methodists?" (ইংরেজি ভাষায়)। Wisconsin Evangelical Lutheran Synod। ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ২২ মে ২০১৪The United Methodists see Scripture as the primary source and criterion for Christian doctrine. They emphasize the importance of tradition, experience, and reason for Christian doctrine. Lutherans teach that the Bible is the sole source for Christian doctrine. They emphasize the importance of tradition, experience, and reason for Christian doctrine. Lutherans teach that the Bible is the sole source for Christian doctrine. The truths of Scripture do not need to be authenticated by tradition, human experience, or reason. Scripture is self authenticating and is true in and of itself. 
  4. Humphrey, Edith M. (১৫ এপ্রিল ২০১৩)। Scripture and Tradition (ইংরেজি ভাষায়)। Baker Books। পৃষ্ঠা 16। আইএসবিএন 978-1-4412-4048-4historically Anglicans have adopted what could be called a prima Scriptura position. 
  5. Biema, David (২২ মার্চ ২০০৭)। "The Case For Teaching The Bible"Time Magazine। সংগ্রহের তারিখ ১১ আগস্ট ২০১৮Simply put, the Bible is the most influential book of all-time... The Bible has done more to shape literature, history, entertainment, and culture than any book ever written. Its influence on world history is unparalleled, and shows no signs of abating. Even pop culture is deeply influenced by the Bible. 
  6. "The Bible tops 'most influential' book survey"BBC। ১৩ নভেম্বর ২০১৪। সংগ্রহের তারিখ ১১ আগস্ট ২০১৮ 
  7. "Best selling book of non-fiction"। Guinness World Records। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৫ 
  8. Ryken, Leland। "How We Got the Best-Selling Book of All Time"The Wall Street Journal। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৫ 
  9. "The battle of the books"The Economist। ২২ ডিসেম্বর ২০০৭। 
  10. Ash, Russell (২০০১)। Top 10 of Everything 2002। Dorling Kindersley। আইএসবিএন 978-0-7894-8043-9 
  11. Miller & Huber, Stephen & Robert (২০০৩)। The Bible: the making and impact on the Bible a history.। England: Lion Hudson। পৃষ্ঠা 21। আইএসবিএন 0-7459-5176-7 
  12. "Corruption of the Tawraat (Torah) and Injeel (Gospel)"islamqa.info 
  13. সংক্ষেপিত ইযহারুল হক

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা

টেমপ্লেট:Bible Lists