হারুন (আরবি: هارون, প্রতিবর্ণীকৃত: Hārūn, হিব্রু ভাষায়: אַהֲרֹן‎, ’Ahărōn) ইসলাম, ইহুদিধর্মখ্রিষ্টধর্ম অনুসারে একজন নবী। ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কুরআনহাদিসে তাঁর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বাস করা হয় যে, তিনি মুসার সহযোগী হিসেবে ফেরাউনের কাছে আল্লাহর বাণী পৌঁছে দিয়েছিলেন। জর্ডানের পেত্রার কাছে তাঁর সমাধি রয়েছে বলে মনে করা হয়।


হারুন
هارون
হারোণ

ইসলামি চারুলিপিতে লিখিত হারুনের নাম
জন্ম
মৃত্যু
সমাধিমোষেরোৎ, কনান
হারুনের সমাধি, পেত্রা, জর্ডান
অন্যান্য নামহারোণ (হিব্রু ভাষায়: אַהֲרֹן‎‎)
পিতা-মাতাইমরান (পিতা)
যোকেবদ (মাতা)
আত্মীয়মুসা (ভাই)
মরিয়ম (বোন)

পরিবার

সম্পাদনা

হারুন প্রাচীন মিশরে বনী-ইসরাইল বংশের ইমরানের গৃহে[][] জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ইয়াকুবের বংশধরদের একজন। তার ভাই মুসাও একজন নবী ছিলেন।

কুরআনে হারুন

সম্পাদনা

কুরআনে ২০ বার হারুনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।[] নাম উল্লেখ ব্যতীতও বহুবার তার কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে তিনি ইব্রাহিমের বংশধর ছিলেন।[] তিনি ও মূসা উভয়কেই আল্লাহর আযাব সম্পর্কে ফেরাউনকে সতর্ক করতে একসাথে প্রেরণ করা হয়েছিল।[] এর আগে মুসা তার হাতকে আরো শক্তিশালী করার জন্য হারুনকে তার সাথে নবুয়্যতের দায়িত্ব দিতে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন[] এবং আল্লাহ এ আবেদন মঞ্জুর করেছিলেন।[] বক্তৃতা ও আলোচনার ক্ষেত্রে হারুন বেশ বাকপটু ছিলেন।[] কুরআনে আরও বলা হয়েছে যে, মুসা এবং হারুন উভয়কেই মিশরে বনী-ইসরাইলীদের বাসস্থান স্থাপন করার এবং সেই ঘরগুলোকে আল্লাহর ইবাদতের স্থানে রূপান্তর করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।[]

কুরআনে বর্ণিত সোনালী বাছুরের ঘটনায় হারুনকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, মূসা যখন চল্লিশ দিনের জন্য সিনাই পর্বতে (আরবি: طـور سيـنـاء) অবস্থান করছিলেন, তখন হারুনকে বনী-ইসরাইলের নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।[] এতে আরো বলা হয়েছে যে, হারুন নয় বরং সামিরি নামক একজন দুষ্ট লোক সোনালী বাছুর তৈরি করেছিল এবং হারুন সোনালী বাছুরের উপাসনা বন্ধ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন।[১০] মুসা যখন সিনাই পর্বত থেকে ফিরে এসে হারুনকে এই উপাসনা করার অনুমতি দেওয়ার জন্য তিরস্কার করছিলেন, তখন হারুন তাকে এ ঘটনার জন্য দায়ী মনে না করার অনুরোধ করেন।[১১] এরপরে মূসা বনী-ইসরাইলের পাপের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে তিনি কেবল তার নিজের ও হারুনের উপর ক্ষমতাবান ছিলেন।[১২]

হারুনকে কুরআনে "স্পষ্ট কর্তৃত্ববান" ব্যক্তি[১৩] এবং "সঠিক পথে পরিচালিত" ব্যক্তি হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে।[১৪] এতে আরো বলা হয়েছে যে হারুনের স্মৃতি তার পরে আসা লোকদের জন্য আদর্শ[১৫] এবং তিনি ও তার ভাই ছিলেন আল্লাহর অনুগ্রহ প্রাপ্ত।[১৬] সূরা মারইয়ামে বলা হয়েছে যে, লোকেরা ঈসার মা মারিয়ামকে "হারুনের বোন" বলে সম্বোধন করত।[১৭] তবে, এই "হারুন" কে ছিলেন, তা নিয়ে মুসলিম পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, এখানে মুসার ভাই হারুনের কথাই বলা হয়েছে এবং "বোন" শব্দটি রূপক অর্থে অথবা তাদের মধ্যে আধ্যাত্মিক সম্পর্ক নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়েছে, যেহেতু তিনি হারুনের নবুয়্যতের উত্তরসূরি ছিলেন। আবার অনেকে মনে করেন, সে সময় "হারুন" নামে আরেকজন ধার্মিক ব্যক্তি জীবিত ছিলেন। অধিকাংশ পণ্ডিত প্রথম মতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন এবং হারুনেরর আসল বোনের সাথে মারিয়ামের আধ্যাত্মিক সংযোগ স্থাপন করেছেন, যার নাম ছিল মিরিয়াম (আরবি: مـريم, হিব্রু ভাষায়: מִרְיָם‎),[১৮] যার সাথে তিনি বহুভাবে সাদৃশ্যপূর্ণ। কয়েকশত বছর পর বনী-ইসরাইলীদের কাছে যে তালুত (আরবি: تـابـوت)-এর সিন্দুক এসেছিল, তাতে মূসা ও হারুন এবং তাদের পরিবারের স্মৃতিচিহ্ন ছিল বলে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে।[১৯]

হাদিসে হারুন

সম্পাদনা

মুহাম্মাদ তার অনেক বক্তব্যে হারুনের কথা বলেছেন। মিরাজের সময় মুহাম্মাদ পঞ্চম আসমানে হারুনের সাথে সাক্ষাত করেছিলেন বলে জানা যায়।[২০][২১] ইবনে হিশাম সহ আগেকার অনেক পণ্ডিতদের মতে, মুহাম্মদ হারুনের সাথে তার সাক্ষাতের ঘটনা বলতে গিয়ে তার সৌন্দর্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন। মার্টিন লিংগস তার জীবনীমূলক গ্রন্থ মুহাম্মাদে নবীদের স্বর্গীয় মর্যাদায় দেখে মুহাম্মদের বিস্ময়ের কথা উল্লেখ করেছেন:

ইউসুফ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন যে, তাঁর চেহারা পূর্ণিমার চাঁদের মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছিল এবং এটি বিদ্যমান সমস্ত সৌন্দর্যের অর্ধেকের চেয়ে বেশি ছিল। তবুও এটি তাঁর ভাইদের প্রতি মুহাম্মদের বিস্ময় হ্রাস করেনি এবং তিনি বিশেষত হারুনের অসাধারণ সৌন্দর্যের কথা উল্লেখ করেছিলেন।[২২][২৩]

মুহাম্মাদ তার এক বক্তব্যে আলীকে হারুনের সাথে তুলনা করেছিলেন। একবার মুহাম্মদ আলীকে তার পরিবারের দেখাশোনা করার জন্য রেখে গিয়েছিলেন; কিন্তু সেই সময়ের ভন্ডরা গুজব ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছিল যে, আলী নবীর কাছে একটি বোঝার মতো এবং তার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি স্বস্তি পেয়েছেন। এই কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য শুনে আলী দুঃখ পান এবং স্থানীয় লোকেরা যা বলছিল তা মুহাম্মদকে জানান। উত্তরে নবী বলেন: "তারা মিথ্যা বলেছে, আমি আমার পিছনে যা রেখে এসেছি তার জন্য তোমাকে থাকতে বলেছি। সুতরাং ফিরে যাও এবং আমার ও তোমার পরিবারে আমার প্রতিনিধিত্ব কর। হে আলী, তুমি কি সন্তুষ্ট নও যে— মুসার কাছে হারুন যেমন ছিল, আমার কাছে তুমি তেমন। তবে আমার পরে আর কোন নবী নেই।"[২৪]

 
জাবালে হারুনে হারুনের অনুমিত কবরের উপর স্থাপিত চতুর্দশ শতাব্দীর মাজার

ইসলামী ইতিহাস অনুযায়ী হারুনের সমাধি জর্ডানের পেত্রার নিকটবর্তী জাবালে হারুন (আরবি: جَـبـل هَـارون) নামক পাহাড়ে অবস্থিত।[২৫][২৬] সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১,৩৫০.০ মি (৪,৪২৯.১ ফুট) উপরে অবস্থিত এই স্থানটি এই অঞ্চলের উচ্চতম স্থান। সেখানকার স্থানীয় জনগণের কাছে এটি একটি পবিত্র স্থান হিসেবে পরিগণিত হয়। চতুর্দশ শতাব্দীতে মামলুকরা সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করে। মসজিদটির সাদা গম্বুজ পেত্রার আশেপাশের বেশিরভাগ অঞ্চল থেকে দৃশ্যমান।

  1. All commentators, classical and modern, hold that the Quranic House of Amran refers to Imrān's lineage, through his son Aaron. (cf. Muhammad Asad, Yusuf ‘Ali and Ibn Kathir's commentary on Q. 19:28)[]
  2. "In the second group, we have the great founders of families, apart from Abraham, viz., Noah of the time of the Flood; David and Solomon, the real establishers of the Jewish monarchy; Job, who lived 140 years, saw four generations of descendants, and was blessed at the end of his life with large pastoral wealth (Job 42:16,12); Joseph, who as Minister of State did great things in Egypt and was the progenitor of two Tribes; and Moses and Aaron, the leaders of the Exodus from Egypt. They led active lives and called 'doers of good.'"[]
  3. কুরআনের যেসব স্থানে হারুনের কথা বলা হয়েছে সেগুলো হল:
    1. Al-Baqarah (2): 248
    2. An-Nisa' (4): 163
    3. Al-An'am (6): 84
    4. Al-A'raf (7): 122, 142
    5. Yunus (10): 75
    6. Maryam (19): 28*, 53
    7. Thaha (20): 30, 70, 90, 92
    8. Al-Anbiya' (21): 48
    9. Al-Mu'minun (23): 45
    10. Al-Furqan (25): 35
    11. Asy-Syu'ara' (26): 13, 48
    12. Al-Qashash (28): 34
    13. Ash-Shaffat (37): 114, 120
    টীকা: *) অনেকের মতে, এ আয়াতে উল্লেখিত হারুন মুসার ভাই হারুন নন

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Ali 1998, পৃ. ৭৭৩ §=২৪৮১
  2. Ali 1998, পৃ. ৩১২ §=৯০৪
  3. কুরআন ৪:১৬৩
  4. কুরআন ইউনুস:৭৫
  5. কুরআন ২০:২৯–৩০
  6. কুরআন মারিয়াম:৫৩
  7. কুরআন ২৮:৩৪
  8. কুরআন ইউনুস:৮৭
  9. কুরআন ৭:১৪২
  10. কুরআন মারিয়াম:৫০
  11. কুরআন ৭:১৫০
  12. কুরআন ৫:২৫
  13. কুরআন ২৩:৪৫
  14. কুরআন ৩৭:১১৮
  15. কুরআন ৩৭:১১৯
  16. কুরআন ৩৭:১২০
  17. কুরআন মারিয়াম:২৮
  18. Unless otherwise stated, the Jewish primary sources herein were provided courtesy of Rabbi Yirmiyahu Ullman in honor of M.A.M. from his 3-part series on Miriam the Prophetess, posted on RabbiUllman.com. Part 1: "Miriam's Name"  Part 2: "Miriam in Egypt"  Part 3: "Miriam in the Wilderness" 
  19. কুরআন বাকারাহ:২৪৮
  20. সহীহ মুসলিম, ১:৩০৯ (ইংরেজি)
  21. সহীহ মুসলিম, ১:৩১৪ (ইংরেজি)
  22. Ibn Hisham 1967, পৃ. 186; §=270
  23. Lings 1983, পৃ. 102
  24. Ibn Hisham 1967, পৃ. ৬০৪; §=৮৯৭"
  25. Anon 2013
  26. Wheeler 2013

গ্রন্থপঞ্জি

সম্পাদনা
  • Ali, Abdullah Yusuf (১৯৯৮)। The Holy Qur'an: Text, Translation and Commentary (ইংরেজি and আরবি ভাষায়)। Tahrike Tarsile Qur'an। আইএসবিএন 978-0-940368-31-6 
  • Anon (১৯৯৩)। "Ethics of the Fathers: Chapter One"Chabad.org। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ১, ২০১৪1:12 Hillel and Shammai received from them. Hillel would say: Be of the disciples of Aaron--a lover of peace, a pursuer of peace, one who loves the creatures and draws them close to Torah. 
  • Anon (২০১৩)। "Aaron's Tomb, Petra"। Atlas Travel and Tourist Agency। জুলাই ২৬, ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ এপ্রিল ২০১৪ 
  • Glasse, Cyril (১৯৮৯)। "Aaron"। Concise Encyclopedia of Islam। Harper & Row। আইএসবিএন 978-0-06-063123-9 
  • Ibn Hisham, 'Abd al-Malik (১৯৬৭) [1955]। The Life of Muhammad: A Translation of Ishaq's Sirat Rasul Allah। Translated by A. Guillaume। Lahore, Pakistan: Pakistan Branch Oxford University Press। 
  • Lings, Martin (১৯৮৩)। Muhammad: His Life Based on the Earliest Sources। HarperCollins Publishers Ltd.। আইএসবিএন 978-0-04-297050-9 
  • Wheeler, Brannon (২০১৩)। "Tomb of Aaron"usna.edu। United States Naval Academy। জুন ২৪, ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ এপ্রিল ২০১৪ 

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা