সৈয়দ মুজতবা আলী
সৈয়দ মুজতবা আলী (১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪ – ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪) একজন প্রখ্যাত সাহিত্যিক। তিনি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, অনুবাদক ও রম্যরচয়িতা। তিনি তার ভ্রমণকাহিনির জন্য বিশেষভাবে জনপ্রিয়। বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলীর রচনা একই সঙ্গে পাণ্ডিত্য এবং রম্যবোধে পরিপুষ্ট।[৪]
সৈয়দ মুজতবা আলী | |
---|---|
![]() সৈয়দ মুজতবা আলী | |
জন্ম | [১] | ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯০৪
মৃত্যু | ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪[২][৩] | (বয়স ৬৯)
জাতীয়তা | ব্রিটিশ ভারতীয় (১৯০৪–১৯৪৭) পাকিস্তানি (১৯৪৭–১৯৪৯) ভারতীয় (১৯৪৯–১৯৭১) বাংলাদেশী (১৯৭১–মৃত্যু) |
শিক্ষা | পিএইচডি (তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব) |
মাতৃশিক্ষায়তন | বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় বন বিশ্ববিদ্যালয় আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় |
পেশা | সাহিত্যিক |
দাম্পত্য সঙ্গী | রাবেয়া খাতুন |
আত্মীয় | সৈয়দ মুর্তাজা আলী (ভাই) |
জন্মসম্পাদনা
সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ ভারতে আসামের অন্তর্ভুক্ত সিলেটের করিমগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা খান বাহাদুর সৈয়দ সিকান্দার আলী সাব-রেজিস্ট্রার ছিলেন।[৫][৬] তার পৈতৃক ভিটা মৌলভীবাজার, পৈতৃক নিবাস হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল উপজেলার উত্তরসূর গ্রামে। [৭]
শিক্ষাজীবনসম্পাদনা
সৈয়দ মুজতবা আলী সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। পিতার বদলির চাকরি হওয়ায় মুজতবা আলীর প্রাথমিক শিক্ষাজীবন কাটে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ১৯২১ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে ভর্তি হন।[৮] তিনি ছিলেন বিশ্বভারতীর প্রথমদিকের ছাত্র। এখান থেকে সংস্কৃত, ইংরেজি, আরবি, উর্দু, ফার্সি, হিন্দি, গুজরাটি, ফরাসি, জার্মান ও ইতালীয়সহ পনেরোটি[৯] ভাষাশিক্ষা লাভ করে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে বি.এ. ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন। অতঃপর দর্শনশাস্ত্র পড়ার জন্য বৃত্তি নিয়ে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে গবেষণার জন্য তিনি ডি.ফিল লাভ করেন ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে।[১০] ১৯৩৪-১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মিশরে কায়রোর আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।
কর্মজীবনসম্পাদনা
বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মুজতবা আলী কাবুলের শিক্ষা দপ্তরে অধ্যাপনা করেন। সেখানে তিনি ইংরেজি ও ফরাসি ভাষার শিক্ষক ছিলেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বরোদার মহারাজার আমন্ত্রণে তিনি বরোদা কলেজে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এখানে তিনি আট বছর কাটান। এরপর দিল্লির শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে যোগ দেন। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের খণ্ডকালীন প্রভাষকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পঞ্চাশের দশকে কিছুদিন আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরের দায়িত্ব পালন করেন পাটনা, কটক, কলকাতা এবং দিল্লিতে। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনে প্রত্যাবর্তন করেন। বিশ্বভারতীর ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অবসরগ্রহণ করেন। তাদের পরিবারের পরিচয় তুলে ধরতে মৌলভীবাজারে তার ও তার পিতার নামে দুটি সড়কের নাম রাখা হয়েছে। যার একটি সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী সড়ক এবং আরেকটি খান বাহাদুর সৈয়দ সিকন্দর আলী সড়ক। [১১] এছাড়াও তার স্মৃতি ধরে রাখতে তার লেখা বইয়ের নামে গ্রন্থাগারের নাম রাখা হয়েছে ‘দেশে বিদেশে’। [১২]
লেখালেখিসম্পাদনা
শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় সেখানের বিশ্বভারতী নামের হস্তলিখিত ম্যাগাজিনে মুজতবা আলী লিখতেন। পরবর্তীতে তিনি ‘সত্যপীর’, ‘ওমর খৈয়াম’, ‘টেকচাঁদ’, ‘প্রিয়দর্শী’ প্রভৃতি ছদ্মনামে বিভিন্ন পত্রিকায়, যেমন: দেশ, আনন্দবাজার, বসুমতী, সত্যযুগ, মোহাম্মদী প্রভৃতিতে কলাম লিখেন। তার বহু দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন ভ্রমণলিপি। এছাড়াও লিখেছেন ছোটগল্প, উপন্যাস, রম্যরচনা। বিবিধ ভাষা থেকে শ্লোক ও রূপকের যথার্থ ব্যবহার, হাস্যরস সৃষ্টিতে পারদর্শিতা এবং এর মধ্য দিয়ে গভীর জীবনবোধ ফুটিয়ে তোলার ক্ষমতা তাঁকে বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ মর্যাদার আসনে বসিয়েছে। অনেকের মতে, ১৯৫০-৬০ দশকে মুজতবা আলী ছিলেন বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক।[১৩] তার একটি বিখ্যাত উক্তি হলো:
“ | বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। | ” |
তুলনাত্মক ভাষাতত্ত্বের অধ্যাপক মুজতবার ধর্মদর্শন নিয়ে বড় ভাই সৈয়দ মুর্তাজা আলী মন্তব্য করেন:
তার (মুজতবা আলীর) সাহিত্যে বিন্দুমাত্র ধর্মীয় সংকীর্ণতা ছিল না। কিন্তু তার এই উদারতার জন্য গোঁড়া স্বধর্মীরা তাঁকে কোনোদিন ক্ষমা করেননি।
তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ৩০।
প্রকাশনাসম্পাদনা
উপন্যাসসম্পাদনা
- অবিশ্বাস্য (১৯৫৪)
- শবনম (১৯৬০)
- শহর-ইয়ার (১৯৬৯)
- তুলনাহীনা (২০১৫ - প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
ভ্রমণকাহিনীসম্পাদনা
- দেশে বিদেশে (১৯৪৯)
- জলে ডাঙ্গায় (১৯৬০)
- মুসাফির (২০১৫ - প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
- বিদেশে (২০১৫ - প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
ছোটগল্প / রম্যরচনাসম্পাদনা
- চাচা কাহিনী (১৯৫২)
- টুনি মেম (১৯৬৪)
- পঞ্চতন্ত্র (১৯৫২)
- ময়ূরকণ্ঠী (১৯৫৭)
- ভবঘুরে ও অন্যান্য (২০১৫ - প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
- চতুরঙ্গ (২০১৫ - প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
- বড়বাবু (২০১৫ - প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
প্রবন্ধসম্পাদনা
- ভাষা সংস্কৃতি সাহিত্য (২০১৫ - প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
- রাজা উজির (২০১৫ - প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
- বিচিত্রা (২০১৫ - প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
- পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা (২০১৫ - বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
- দ্বন্দ্বমধুর (২০১৫ - বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
- সত্যপীরের কলমে (২০১৫ - প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
- রায় পিথৌরার কলমে (২০১৫ - প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
- গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন (২০১৫ - প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
- কত না অশ্রুজল (২০১৫ - প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
- পরিবর্তনে অপরিবর্তনীয় (২০১৫ - প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
- দু-হারা (২০১৫ - প্রথম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
- বাংলাদেশ (২০১৫ - বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
ডায়েরি ও চিঠিপত্র সংকলনসম্পাদনা
- দিনলিপি (২০১৫ - বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র সংস্করণ)
গল্পমালাসম্পাদনা
- রাজা উজির
- ধূপছায়া
- বেঁচে থাক সর্দি-কাশি
- পুনশ্চ
- পাদটীকা
- তীর্থহীনা
- কর্ণেল
- রাক্ষসী
- বিধবা বিবাহ
- ক্যাফে-দে-জেনি
- মা জননী
- বেল তুলে দু-দু'বার
- স্বয়ংবরা
- শবনম
- রস-গোল্লা (ইংরেজি)
ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বসম্পাদনা
- হিটলার
পুরস্কারসম্পাদনা
- নরসিংহ দাস পুরস্কার (১৯৪৯)
- আনন্দ পুরস্কার (১৯৬১)।[৯]
- একুশে পদক (মরণোত্তর)[১৪]
মৃত্যুসম্পাদনা
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি সোমবার ঢাকা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২৭ নং কক্ষে সৈয়দ মুজতবা আলী মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ নূরুর রহমান খান (২০১২)। "আলী, সৈয়দ মুজতবা"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ "A man of many hues" (ইংরেজি ভাষায়)। দ্য ডেইলি স্টার। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
- ↑ Bangladesh। বাংলাদেশ দূতাবাস। ১৯৭৪। পৃষ্ঠা ৪।
- ↑ "সৈয়দ মুজতবা আলী"। onushilon.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০১-০৭।
- ↑ শিবলি, আব্দুল্লা (১৩ মার্চ ২০১৫)। "Syed Mujtaba Ali as a Rebel" (ইংরেজি ভাষায়)। দ্য ডেইলি স্টার।
- ↑ ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর, সম্পাদকগণ (২০১২)। "আলী, সৈয়দ মুজতবা"। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743। সংগ্রহের তারিখ ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২।
- ↑ হোসেন, সেলিনা; ইসলাম, নুরুল, সম্পাদকগণ (ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭)। বাংলা একাডেমি চরিতাভিধান। বাংলা একাডেমি। পৃষ্ঠা ৪২২।
- ↑ "সৈয়দ মুজতবা আলী: গল্পের মানুষ"। প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২।
- ↑ ক খ মুর্তাজা আলী, সৈয়দ (২০১৭). মুজতবা কথা (উৎস প্রকাশন সংস্করণ). উৎস প্রকাশন, ঢাকা
- ↑ "'বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে...'"। আনন্দবাজার পত্রিকা। সংগ্রহের তারিখ ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২।
- ↑ "মৌলভীবাজারে সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলীর নামে সড়ক"। banglanews24.com। ২০২২-১২-১১। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-২৬।
- ↑ প্রতিবেদক, নিজস্ব। "মৌলভীবাজারে এক টুকরো বইয়ের দুনিয়া 'দেশে বিদেশে'"। Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-২৬।
- ↑ ক খ আলী, সৈয়দ (২০১৭). মুজতবা কথা (উৎস প্রকাশন সংস্করণ). উৎস প্রকাশন, ঢাকা
- ↑ "14 to get Ekushey Padak"। The Daily Star। ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০০৫।
আরও পড়ুনসম্পাদনা
- মিত্র, গজেন্দ্রকুমার; ঘোষ, সুমথনাথ; ঘোষ, সবিতেন্দ্রনাথ; চক্রবর্তী, মণীশ (সম্পাদকগণ)। সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী (এগারো খণ্ডে)। কলকাতা: মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনী।
- নুরুর রহমান খান (১৯৯০)। সৈয়দ মুজতবা আলী: জীবনকথা। ঢাকা: বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।
- খান, নুরুর রহমান (১৯৯০)। মুজতবা সাহিত্যের রূপবৈচিত্র ও রচনাশৈলী। ঢাকা: বাংলা একাডেমি।
- পুরকায়স্থ, বিজনবিহারী, সম্পাদক (১৯৯৮)। প্রসঙ্গ: মুজতবা আলী। কলকাতা: নবপত্র প্রকাশ।
- মোস্তাকিম, গোলাম (১৯৯৫)। সৈয়দ মুজতবা আলী: প্রসঙ্গ অপ্রসঙ্গ। ঢাকা: স্টুডেন্ট ওয়েজ।