সাঁওতাল

দক্ষিণ এশিয়ার আদিবাসী জনগন

সাঁওতাল হলো দক্ষিণ এশিয়ার একটি অস্ট্রোএশিয়াটিক ভাষী জাতিগোষ্ঠী ।[৬] সাঁওতালরা জনসংখ্যার দিক থেকে ভারতের ঝাড়খণ্ডপশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বৃহত্তম উপজাতি এবং তাদের উপস্থিতি আসাম, ত্রিপুরা, বিহারওড়িশা রাজ্যেও রয়েছে। তারা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের রাজশাহী বিভাগরংপুর বিভাগের বৃহত্তম জাতিগত সংখ্যালঘু। নেপালে তাদের বিশাল জনসংখ্যা রয়েছে। সাঁওতালরা সাঁওতালি ভাষায় কথা বলে, এটি অস্ট্রো-এশীয় পরিবারের তৃতীয় বৃহত্তম ভাষা।[৭]

সাঁওতাল
ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সাঁওতালরা বাহা পরব উদযাপন করছে
মোট জনসংখ্যা
আনু. ৭০ লাখ (২০১১)
উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল
 ভারত •  বাংলাদেশ •    নেপাল
 ভারত:
       ঝাড়খণ্ড

২৭,৫২,৭২৩[১]
       পশ্চিমবঙ্গ২৫,১২,৩৩১[১]
       ওড়িশা৮,৯৪,৭৬৪[১]
       বিহার৪,০৬,০৭৬[১]
       আসাম২,১৩,১৩৯[২]
 বাংলাদেশ১,২৯,০৪৯ (২০২১)[৩]
   নেপাল৫১,৭৩৫[৪]
ভাষা
সাঁওতালি, হিন্দি, ওড়িশা, বাংলা, নেপালি
ধর্ম
সংখ্যাগরিষ্ঠ
হিন্দুধর্ম (৬৩%)[৫]
সংখ্যালঘু
লোকধর্ম (সরনা ধর্ম) (৩১%)
খ্রিস্টধর্ম (৫%)
ইসলাম ও অন্যান্য (১%)[৫]
সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী
মুন্ডা • ভূমিজ

ব্যুৎপত্তি

সাঁওতাল সম্ভবত একটি বহিরাগত শব্দ থেকে উদ্ভূত। শব্দটি পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর অঞ্চলের পূর্ববর্তী সিলদায় সাওন্টের বাসিন্দাদের বোঝায় ।[৮][৯] সংস্কৃত শব্দ সামন্ত বা বা বাংলা সাঁওত মানে সমতল ভূমি।[১০] তাদের জাতি নাম হর হোপন ("মানবজাতির সন্তান")।[১১]

ভাষা ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়

ভাষা এবং নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যে সাঁওতালরা বাংলাদেশের অন্য অনেক নৃগোষ্ঠীর মত মঙ্গোলীয় গোত্রের নয়। এরা সাঁওতালি ভাষায় কথা বলে যে ভাষাটি অস্ট্রো-এশীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত। এদের মধ্যম গড়নের আকৃতির শরীর, ত্বকের গাঢ় রঙ, চ্যাপ্টা নাক, পুরু ঠোঁট এবং কোঁকড়ানো চুল তাদের অস্ট্রেশীয় নৃতাত্ত্বিক উৎস নির্দেশ করে যে গোষ্ঠির মানুষ ভারতীয় উপমহাদেশে এসেছিল দ্রাবিড়দেরও আগে অস্ট্রেলিয়া এবং সন্নিহিত প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপমালা থেকে। দেহ কাঠামোর বৈশিষ্ট্যগত দিক থেকে সাঁওতালদেরকে বিশুদ্ধ প্রাক-দ্রাবিড়ীয় গোষ্ঠীর প্রতিনিধি বলে মনে করা হয়। তবে অস্ট্রেলীয় কৌমগুলোর সাথে সাঁওতালদের বেশ মিল লক্ষ করা যায় বলে তাদেরকে আদি অস্ট্রেলীয় বলা হয়। ধারণা করা হয় সুঁতার (Soontar) কথাটি থেকে সাঁওতাল শব্দের উদ্ভব।[সন্দেহপূর্ণ ][স্পষ্টকরণ প্রয়োজন]

ইতিহাস

উৎপত্তি

উল্লেখযোগ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নথির অভাবের কারণে, সাঁওতালদের আদি জন্মভূমি নিশ্চিতভাবে জানা যায় না। তবে ভাষাবিদ পল সিডওয়েলের মতে , অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষাভাষীরা সম্ভবত প্রায় ৪,০০০-৩,৫০০ বছর আগে ইন্দোচীন থেকে ওড়িশার উপকূলে এসেছিলেন ।[১২] অস্ট্রোএশিয়াটিক ভাষাভাষীরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে ছড়িয়ে পড়ে এবং স্থানীয় ভারতীয় জনসংখ্যার সাথে ব্যাপকভাবে মিশে যায়।[১৩] ভারতে আসার পর, মুন্ডা জনগণ ব্যাপকভাবে দ্রাবিড় উপজাতি গোষ্ঠীর সাথে মিশে যায়।[১৪]

ব্রিটিশ আমল

 
১৮৬৮ সালে ব্রিটিশ ভারতে সাঁওতাল

স্বাধীনতা-পরবর্তী

সমাজ

পরিবার

সাঁওতাল সমাজ পিতৃতান্ত্রিক। সম্পত্তিতে পুত্রদের অধিকার সমান, কিন্তু মেয়েদের কোন অধিকার নেই। তবে পিতা ইচ্ছা করলে মেয়েকে কিছু দিয়ে যেতে পারেন। তবে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে পিতা প্রত্যেক মেয়েকে একটি করে গাভী প্রদান করে। পুত্রহীন ব্যক্তির যাবতীয় সম্পত্তির মালিকানা তার সহোদর ভাইয়েরা পেয়ে থাকে।

গোত্র

সাঁওতালরা বিশ্বাস করে যে, আদি মানব ও মানবী পিলচু হাড়াম(আদম)পিলচু বুডহির(হবা) সাত জোড়া সন্তান থেকেই তাদের উদ্ভব। এজন্যই সাঁওতালরা সাতটি গোত্রে বিভক্ত। সাঁওতালি ভাষায় এ গোত্র গুলো ‘পারিস‘ নামে অভিহিত । গোত্র (পারিস) গুলো হলো-

হাঁসদা, সরেন, টুডু, কিসকু, মুর্মু, মাণ্ডি, বাস্কে, বেসরা, হেম্বরম, পাউরিয়া, চঁড়েবেদেয়া

প্রথমে সাতটি গোত্র ও পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে আরও পাঁচটি গোত্রের উদ্ভব ঘটে মোট বারটি গোত্র হয় । সাঁওতালদের মধ্যে টোটেম বিশ্বাস প্রচলিত আছে। প্রতিটি গোত্র তাদের পূর্বপুরুষ কিংবা গাছপালা, জীবজন্তু ও পশুপাখী ইত্যাদি নামে পরিচিত। হাঁসদা গোত্রের লোকের বিশ্বাস তাদের উদ্ভব ঘটেছে হাঁস থেকে। তাই হাঁসদা গোত্রের সাঁওতালদের হাঁস ভক্ষণ নিষিদ্ধ। আবার সরেন গোত্রের উৎপত্তি হরিণ থেকে তাই তাদের হরিণের মাংস খাওয়া নিষেধ।

সংস্কৃতি

উৎসব

সোহরাই সাঁওতাল সম্প্রদায়ের প্রধান উৎসব। এছাড়া বাহা , করম , দশইন , সক্রাত, মাহমোর, রুন্দো এবং ম্যাগসিম গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। তারা ঐতিহ্যগতভাবে এই উত্সবগুলির সময় তাদের অনেক নাচের সাথে 'তমক এবং তুমডাক' নামে দুটি ড্রামের সাথে থাকে।

 
পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী দশাই নৃত্য
 
তমক (r.) এবং তুমডাক (l.) - সাঁওতাল জনগণের সাধারণ ড্রাম , বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলার একটি গ্রামে ছবি তোলা ।
 
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে সাঁওতালদের লুঙ্গি পাঁচি নাচ।

পুতুল নাচের একটি রূপ 'চাদর বদর' যা সাঁওতাল পুতুলনাট্য নামেও পরিচিত, একটি লোক শো যা একটি ছোট খাঁচায় রাখা কাঠের পুতুলকে জড়িত করে যা মঞ্চ হিসেবে কাজ করে।[১৫]

সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়গুলি একটি গ্রাম পরিষদের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয় যার নেতৃত্বে মাঝি (সমাজের স্থানীয় প্রধান) নামে একজন ব্যক্তি । মাঝি অন্যান্য কাউন্সিল সদস্যদের দ্বারা স্থানীয় বিষয়গুলি পরিচালনা ও মোকাবেলা করতে সহায়তা করে।[১৬]

সাঁওতাল শিল্প তার জটিল খোদাই শৈলীর জন্য প্রশংসিত। ঐতিহ্যবাহী সাঁওতাল বাড়ির দেয়ালগুলি খোদাই করা নকশা, শিকারের দৃশ্য, নাচের দৃশ্য, জ্যামিতিক নিদর্শন এবং আরও অনেক কিছু দিয়ে অলঙ্কৃত থাকে । সাঁওতাল-শৈলীর পালকি সূক্ষ্মভাবে খোদাই এবং নকশা করে থাকে।[১৬]

 
২০২০ সালে ওড়িশা উপজাতি মেলা, ভুবনেশ্বরে সাঁওতাল বাড়ি

আচার অনুষ্ঠান

এরা নিজস্ব সামাজিক রীতিনীতি মেনে চলে। এদের জীবনযাপন সহজ ও সরল। বর্তমানে সাঁওতালিদের ওপর বাঙালি সমাজের প্রভাব পড়েছে। এদের অনেকে শিক্ষালাভ করে আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হচ্ছে। সাঁওতালদের পালিত অনুষ্ঠানগুলো বেশ আকর্ষনিয়। এরা জাকজমকভাবে নিজেদের অনুষ্ঠানগুলো পালন করে। অনুষ্ঠানগুলো সাঁওতালি ভাষায় প্রকাশ করা হলো-

  1. বাপলা (ববাহ),
  2. ভান্ডান (ফতে অনুষ্ঠান)
  3. সরহায় (হিন্দুদের পুশনার সময় সাধারমত এই অনুষ্ঠানটা করা হয়)
  4. বাহা পরব
  5. বারনি (বারুনি মেলা)

বিবাহ

সাঁওতাল সমাজে বহিঃগোত্র বিবাহ প্রচলিত। এমনকি উপগোত্রের মধ্যেও বিবাহ হয় না। সাঁওতাল সমাজে যেকোন রকম পণপ্রথা পূর্ব কাল থেকেই নিষিদ্ধ । তাদের সমাজে ছয় প্রকার বিবাহ রীতির প্রচলন থাকলেও বর্তমানে তিন ধরনের বিবাহের প্রচলন দেখা যায়। যথা-

  • আসলি
  • রাজারাজি
  • হুর কাটারা বা ইতুঃবিবাহ

সাধারণত ছেলের বয়স ১৯ ও মেয়ের বয়স ১৫-১৬ হলে বিবাহের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া নিরবোলক নামক বিয়ের প্রচলন সাঁওতাল সমাজে লক্ষণীয়।

  • আসলি বিবাহ: আসলি বিবাহ সম্ভ্রান্ত পরিবার ও শিক্ষিত সমাজের মধ্যেই প্রচলিত। এ ধরনের বিবাহ কন্যার পিতা-মাতা ও আত্মীয় স্বজনের সম্মতিতেই সম্পন্ন হয়।
  • রাজারাজি: রাজারাজি বিবাহ হল প্রেম করে বিবাহ। সাঁওতালদের প্রত্যেক গ্রামেই হাট বসে। বস্তুত কেনাবেচার উদ্দেশ্য হলেও সাঁওতাল যুবক যুবতীরা তাদের পছন্দমত প্রিয়জনদের সেখানে খোঁজ করে। মেয়েরা যখন হাটে যায়, তখন তাদের সাথে একজন গণ্যমান্য ব্যক্তি থাকে। সাঁওতালি ভাষায় তাদের যোগমাঝি বলা হয়। কোন সাঁওতাল মেয়ের যদি কোন ছেলেকে পছন্দ করে তখন সে যুবতী যোগমাঝির কাছে তা প্রকাশ করে। তারপর যোগমাঝি সে যুবককে সন্ধান করে বের করে এবং তার নিকট সব কিছু খুলে বলে। যুবকটি যদি এ ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে, তখন যোগমাঝি ছেলে ও মেয়ের অভিভাবকের সাথে আলাপ-আলোচনা করে বিয়ের দিন ধার্য করে।
  • হুর কাটারা: হুর কাটারা বিবাহ হচ্ছে জোর করে বিবাহ। কোন যুবক যদি কোন যুবতীকে ভালোবেসে ফেলে এবং সেই যুবতী যদি তাকে অপছন্দ করে ও বিয়েতে অসম্মতি জানায় এক্ষেত্রে যুবক তাকে পাবার জন্য হাটে যায়। সেখানে সে যুবতীর খোঁজ করতে থাকে। যুবতীর সাক্ষাৎ পেলে যুবক সুযোগ মত যদি যুবতীর কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিতে পারে তাহলে সে যুবতীর অন্যত্র বিয়ে হতে পারে না। সাঁওতালদের মধ্যে প্রচলিত সংস্কার হল অবিবাহিত যুবতীর কপালে সিঁদুর পরিয়ে দিলে সে যুবতীর আর অন্যত্র বিয়ে হতে পারে না। তার গ্রামের মাতব্বরদের মাধ্যমে যুবককে অর্থদন্ডে দণ্ডিত করা হয় এবং তা আদায় হলে যুবক যুবতীর বিবাহ কার্য সমাধা করা হয়।

ধর্ম

সাঁওতালদের মধ্যে ধর্ম

  অন্যান্য (১%)

২০১১ সালের ভারতীয় আদমশুমারি অনুসারে, ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা এবং বিহারের সম্মিলিত ৬৩% হিন্দুধর্ম পালন করে। ৩১% হিন্দুধর্মের পাশাপাশি সারনা ধর্ম ও পালন করে এবং ৫% খ্রিস্টধর্ম পালন করে । ইসলাম , শিখধর্ম , বৌদ্ধ এবং জৈনধর্ম ১%-এরও কম অনুসরণ করে।[১৭]

ধর্মাচার

সাঁওতালদের পালন করা রীতিনীতি বিভিন্নতা আছে। সাঁওতালি ভাষায় দেবতাকে বলে ‘বোংগা‘। এদের প্রধান দেবতা হচ্ছে চান্দোবোংগা(সূর্যদেব)। অন্ দেবতাকে বলে ‘মারাং বুরু‘। এর প্রভাব সাঁওতালদের জীবনে সবচেয়ে বেশি। এ দেবতাকে তারা জন্ম-মৃত্যুরও কারণ বলে মনে করে থাকে। সাঁওতালদের গৃহদেবতার নাম ‘আবগে বোংগা‘। সাঁওতালরা খুব আনন্দ প্রিয় মানুষ। বিভিন্ন পূজাপার্বণ ও সামাজিক উৎসবে এরা নাচ গানে মেতে ওঠে। প্রকৃতির সাথে এদের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এরা বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করে থাকে। সাঁওতালদের বার্ষিক উৎসবের নাম সোহরাই। এই উৎসবে মেয়েরা দলবদ্ধভাবে নাচে। শীতের শেষে যখন বনে ফুল ফোটে তখন এরা বাহা উৎসব উদ্‌যাপন করে। দুর্গাপূজার সময় সাঁওতালরা একটি বিশেষ নাচের উৎসবে মেতে ওঠে,যা সাঁওতালি ভাষায় দাসাই নামে পরিচিত। এছাড়াও এরঃ, মাঃ মড়ে, সাকরাত প্রভৃতি উৎসব প্রকৃতির পালা বদলে সাথে সাথে পালন করে থাকে। ফাল্গুন এবং আশ্বিন মাসে, সাঁওতালিদের অসুর সম্প্রদায় দ্বারা "হুদুর দুর্গা" নামে মহিষাসুরের বার্ষিকভাবে দুইবার পূজা করা হয়।[১৮]

আবাস

সাঁওতালরা ভারতের ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা, আসাম ছাড়াও বাংলাদেশের দিনাজপুররংপুর অঞ্চলে বাস করে। দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ, নবাবগঞ্জ, বিরামপুর, ঘোড়াঘাট, ফুলবাড়ি, চিরিরবন্দর, কাহারোল এবং রংপুর জেলার পীরগঞ্জে সাঁওতালরা অধিক সংখ্যায় বাস করে। রাজশাহী, নওগাঁ এবং বগুড়া অঞ্চলে কিছু সংখ্যক সাঁওতাল আছে। প্রাচীনকাল থেকেই সাঁওতালরা এদেশে বসবাস করে আসছে।

বাসস্থান ও পোশাক

এদের ঘরগুলো ছোট এবং মাটির তৈরি। সাঁওতালরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকতে ভালোবাসে। সাঁওতাল পুরুষরা আগে সাদা থান কাপড়ের ধুতি পরতেন। বর্তমানে পাঁঞ্চি, ধুতি, পায়ঞ্জামা, গামছা ব্যবহার করে। নারীরা ‘ফতা‘ নামের দুই খন্ডের কাপড় পরে থাকে। বর্তমানে 'আরা পাঁঞ্চি'ও ব্যবহার করতে দেখা যায়। পুরুষ সকলে হাতে উল্কির ছাপ দেয়। মেয়েরা রূপার তৈরি গহনা যেমন- বালা, ঝুমকা, আংটি, মল, হাঁসুলি ইত্যাদি ব্যবহার করে এবং খোঁপায় ফুল গুঁজতে ভালোবাসে। অভিভাবকদের পছন্দ অনুযায়ী সাঁওতালি সমাজে যে বিয়ে হয় তাকে সাঁওতালি ভাষায় ‘বাপলা‘ বলে। আগের দিনে মৃতদেহ দাহ করার নিয়ম ছিল। বর্তমানে অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশের সকল এলাকায় সাঁওতালরা মরদেহের কবর দেয়। তবে ভারতের সাঁওতালরা মরদেহ কবর ও চিতায় আগুনও দেয়।

খাদ্যাভ্যাস

ভাত সাঁওতালদের প্রধান খাদ্য। মাছ, কাঁকড়া, শুকর, মোরগ, মুরগি, খরগোশের মাংস এদের খুবই প্রিয় খাবার।

পেশা

আদিকাল থেকেই কৃষিকে এরা প্রধান পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। নারী পুরুষ সবাই জমিতে কাজ করে। পুরুষেরা হাল চাষ এবং নারীরা বীজ বোনা ও ফসল তোলার কাজ করে। সাঁওতালরা কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি নিজেরা তৈরি করে। শিকার করার ব্যাপারে এদের উৎসাহ খুব বেশি। বাংলাদেশে বন জঙ্গল কমে যাওয়ার কারণে তাদের এই পেশায় সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে অনেক সাঁওতাল নারী-পুরুষ কুলি, মজুর, মাটি কাটার শ্রমিক ও অন্যান্য কাজ করে।

শিল্পকলা

শিল্পকলার প্রতি সাঁওতালিদের আগ্রহ রয়েছে। এরা ঢোল, দোতারা, বাঁশি, মেগো প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র তৈরি করে ও বাজায়। ঘরবাড়ির দেয়ালে ছবি আঁকে। হাঁড়ি কলসির গায়ে চুনকালি দিয়ে ছবি আঁকে।

প্রতিপালিত দিবস

সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস

৩০ জুন সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবস।[১৯] আজ থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগে, ৩০শে জুন ১৮৫৫, অত্যাচারী ব্রিটিশ শাসক এবং শোষক জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে সাঁওতালরা গণআন্দোলন শুরু করে। নিরীহ ও শান্তিপ্রিয় সাঁওতাল আদিবাসিরা ভারতবর্ষে জ্বালিয়ে দেয় প্রতিবাদের দাবানল। আদিবাসিদের অধিকার ও মযার্দা প্রতিষ্ঠায় করা সে রক্তঝরা সাঁওতাল বিদ্রোহ দিবসটি বিশেষ র‌্যালি এবং সাঁওতাল কৃষ্টিতে নৃত্যের মাধ্যমে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিপালিত হয়ে থাকে।

সাঁওতালি ভাষা দিবস

২২ ডিসেম্বর, ২০০৩ সাল ভারতের সংবিধানের ৯২তম সংশোধনীর দ্বারা সাঁওতালি ভাষাসহ চারটি ভাষা সংবিধানের অষ্টম তফসিলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে, ভারতের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। এই চারটি ভাষা হল – বোড়ো, ডোগরি, মৈথিলি ও সাঁওতালি। সারা পৃথিবীর সাঁওতালি ভাষী মানুষের জন্য এটা আনন্দের ও স্মরণীয় দিন।

তখন থেকেই ভারতের সাঁওতালরা ২২ ডিসেম্বরকে সাঁওতালি ভাষা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। ভারত ছাড়াও বাংলাদেশ ও নেপালে বহু সংখ্যক সাঁওতাল বসবাস করে। তারাও সাঁওতালি ভাষার চর্চা করে যাচ্ছে।

সাঁওতাল কৃতী ব্যক্তিত্ব

আরো দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. "A-11 Individual Scheduled Tribe Primary Census Abstract Data and its Appendix"censusindia.gov.in। Office of the Registrar General & Census Commissioner, India। সংগ্রহের তারিখ ১৮ নভেম্বর ২০১৭ 
  2. "C-16 Population By Mother Tongue"censusindia.gov.in। Office of the Registrar General & Census Commissioner, India। সংগ্রহের তারিখ ৩ নভেম্বর ২০১৯ 
  3. "Table 1.4 Ethnic Population by Group and Sex" (পিডিএফ)। Bangladesh Bureau of Statistics। ২০২১। পৃষ্ঠা 34। 
  4. "National Population and Housing Census 2011: Social Characteristics Tables" (পিডিএফ)Nepal Census। ১৪ মার্চ ২০২৩ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৮ নভেম্বর ২০২২ – Government of Nepal-এর মাধ্যমে। 
  5. "ST-14 Scheduled Tribe Population By Religious Community - Jharkhand"census.gov.in। সংগ্রহের তারিখ ৩ নভেম্বর ২০১৯ 
  6. Cavallaro, Francesco; Rahman, Tania। "The Santals of Bangladesh" (পিডিএফ)ntu.edu.sg। Nayang Technical University। ৯ নভেম্বর ২০১৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ নভেম্বর ২০১৭ 
  7. "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি"। ২৭ নভেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ মার্চ ২০১৪ 
  8. Schulte-Droesch 2018, পৃ. 3।
  9. Census 1961, west bengal-district handbook, Midnapore (পিডিএফ)। The superintendent, government printing, West Bengal। ১৯৬৬। পৃষ্ঠা 58। 
  10. Encyclopaedia of Scheduled Tribes in Jharkhand। Gyan Publishing House। ২০১০। পৃষ্ঠা 213। আইএসবিএন 9788178351216 
  11. Somers 1979, পৃ. 5।
  12. Sidwell, Paul. 2018. Austroasiatic Studies: state of the art in 2018 ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩ মে ২০১৯ তারিখে. Presentation at the Graduate Institute of Linguistics, National Tsing Hua University, Taiwan, 22 May 2018.
  13. Schliesinger, Joachim (২০১৬)। Origin of the Tai People 3: Genetic and Archaeological Approaches (ইংরেজি ভাষায়)। Booksmango। পৃষ্ঠা 71। আইএসবিএন 9781633239623। সংগ্রহের তারিখ ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ 
  14. "Scientists solve genetic puzzle surrounding Mundas"। down-to-earth.org। ১২ মার্চ ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০২২ 
  15. "Chadar Badar"The Telegraph। ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ২২ মার্চ ২০১৫ 
  16. Winston, Robert, সম্পাদক (২০০৪)। Human: The Definitive Visual Guide। New York: Dorling Kindersley। পৃষ্ঠা 440। আইএসবিএন 0-7566-0520-2 
  17. "ST-14 Scheduled Tribe Population By Religious Community"census.gov.in। সংগ্রহের তারিখ ৩ নভেম্বর ২০১৯ 
  18. "Not Durga Puja! It's Mahishasura's martyrdom that these tribals observe"The New Indian Express। ৮ অক্টোবর ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ৯ মার্চ ২০২১ 
  19. "সাঁওতাল বিদ্রোহ,সমকাল"। ২০ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ মার্চ ২০১৩ 
  20. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ৫৬৪, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  21. "Pandit Raghunath Murmu"anagrasarkalyan.gov.in (ইংরেজি ভাষায়)। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ০১ অক্টোবর ২০১৬  এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |সংগ্রহের-তারিখ= (সাহায্য)
  22. Published Book ALANG GAR
  23. http://orissa.gov.in/e-magazine/Orissareview/2010/August/engpdf/47-49.pdf
  24. http://orissa.gov.in/e-magazine/Orissareview/2011/aug/engpdf/51-52.pdf

গ্রন্থপঞ্জি

বহিঃসংযোগ