ভাদু গান
ভাদু গান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি প্রচীন লোকগান। এই গান রাজ্যের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা ও বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমা এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচি ও হাজারিবাগ জেলার লৌকিক উৎসব ভাদু উৎসবে এই গান গাওয়া হয়ে থাকে।
পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গীত | |
---|---|
ধারা | |
| |
নির্দিষ্ট ফর্ম | |
ধর্মীয় সঙ্গীত | |
জাতিগত সঙ্গীত | |
ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীত | |
গণমাধ্যম ও অনুষ্ঠান | |
সঙ্গীত মাধ্যম | বেতার
টেলিভিশন ইন্টারনেট |
অঞ্চলিক সঙ্গীত | |
সম্পর্কিত এলাকা | |
অন্যান্য অঞ্চল | |
ইতিহাস
সম্পাদনাকথিত আছে যে পুরুলিয়ার কাশিপুরের পঞ্চকোটের রাজা নীলমনি সিংহদেবের কন্যা ছিলেন ভাদ্রেশ্বরী। সেখান থেকেই ভদ্রেশ্বরী। তা থেকেই ভাদু। লোক মুখে প্রচলিত গল্পটা এমনই কাশীপুরের রাজকন্যা ভদ্রেশ্বরীর বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু ভদ্রেশ্বরীর বর বিয়ে করতে আসার পথে ডাকাতদের কবলে পরে মারা যান। সেই শোকে ভাদু আত্মঘাতী হন। ভাদুর স্মৃতিকে ধরে রাখতেই কাশিপুরের রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় রাজ্যবাসী এই ভাদুর শুরু করেন। আবার কেউ বলেন, ভাদ্রমাসে পঞ্চকোট ও ছাতনার রাজার মধ্যে যুদ্ধে পঞ্চকোটের রাজা বিজয়ী হন। সেই স্মৃতিতেই এই গান ও উৎসবের শুরু।[১]
পঞ্চকোট রাজপরিবারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজদরবারে হারমোনিয়াম, পাখোয়াজ, তবলা, সানাই সহযোগে মার্গধর্মী উচ্চ সাহিত্য গুণ নির্ভরএক ধরনের ভাদু গাওয়া হত হয়। এই পরিবারের ধ্রুবেশ্বরলাল সিংদেও, প্রকৃতীশ্বরলাল সিংদেও এবং রাজেন্দ্রনারায়ণ সিংদেও দরবারী ভাদু নামক এই ঘরানার সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু অন্যান্য সকল ভাদু গীত লৌকিক সঙ্গীত হিসেবেই জনপ্রিয় হয়েছে। লিখিত সাহিত্য না হওয়ায় এই গান লোকমুখেই প্রচারিত হয়ে এসেছে।
প্রকৃতি
সম্পাদনাটুসু ও ঝুমুর গানের বিপরীতে ভাদু গানগুলিতে প্রেম, হাসি কান্না,বিরহ, সামাজিক অবস্থান, রাজনীতি সবকিছুই স্থান পায়। সাধারণতঃ গৃহনারীদের জীবনের কাহিনী এই গানগুলির মূল উপজীব্য। পৌরাণিক ও সামাজিক ভাদু গানগুলি বিভিন্ন পাঁচালির সুরে গীত হয়। সাধারণতঃ রামায়ণ, মহাভারত ও কৃষ্ণ-রাধার প্রেম পৌরাণিক গানগুলির এবং বারোমাস্যার কাহিনী সামাজিক গানগুলির বিষয় হয়ে থাকে। এছাড়া চার লাইনের ছড়া বা চুটকি জাতীয় ভাদু গানগুলিতে সমাজ জীবনের বিভিন্ন অসঙ্গতির চিত্র সরস ভঙ্গীতে ফুটিয়ে তোলা হয়।
বর্তমানে সামাজিক সচেতনা মূলক প্রচারের জন্য ভাদু গান গাওয়া হয়ে থাকে। [২]
কয়েকটি ভাদু গান
সম্পাদনাভাদ্র মাসে ভাদুকে সবাই বরণ করে নেয়। মহিলাদের কন্ঠে গীত হয় এক বিশেষ সুরে-
"ওমা ভদ্রেশ্বরী।
আমরা তোমায় ডাকছি মা বিনয় করি ।।
তোমাধনে পূজব বলে গো,
মনেতে মানস করি।
বেছে বেছে ফুল এনেছি
সারাবন ঘুরি ঘুরি ।।
ফুলের মালা, ফুলের ডালা গো,
রেখেছি যতন করি।
ফুলের আসন পাতা আছে,
বসবে মা তার উপরি ।।
ফুলাসনে বসবে তুমি গো,
আমরা দেখব মা নয়ন ভরি।
ফুলের চামর দুলাইব,
আমরা যত সহচরি ।।
ভক্তিভরে করব পূজা গো,
আমরা তোমার কিঙ্করী।
তোমার চরণ- পূজার ফুল রেখেছি
এক সাজি ভর্তি করি"।।
(রচয়িতা-কালীপদ কুণ্ডু)
সারা ভাদ্রমাস ধরে পূজার পর সংক্রান্তির রাত্রে ভাদু জাগরণ অনুষ্ঠিত হয়। তার পরদিন, পয়লা আশ্বিন ভাদুর বিসর্জন হয়। ভাদু জাগরণ অনুষ্ঠানটি উল্লেখযোগ্য। প্রত্যেক পরিবারের ভাদু এক নির্দিষ্ট স্থানে রাখা হয়। বিভিন্ন দল সেই স্থানে আসেন মালা বদলের জন্য। প্রথম দল দরজা বন্ধ করে রাখেন, দরজার বাইরে থাকেন দ্বিতীয় দল। দুই দলের মধ্যে কথোপকথন চলে ভাদু গানের মাধ্যমে। সে যেন এক কবির লড়াই। বিভিন্ন ধরণের বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার উৎসবের আমেজকে মধুর করে তোলে। অবশেষে দরজা খোলা হয় এবং মালা বদল হয়ে যায়। কোন কোন সময় যে যাঁর নিজের ভাদুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন এবং অপরের ভাদুর খুব নিন্দা করতে থাকেন। কোন দল নিজেদের ভাদু সম্পর্কে হয়তো বলেন-
"ওলো নগরবাসী।
মোদের ভাদুর রূপ দেখে যা তোরা আসি।।
কিবা ভাদুর রূপের ছটা লো,
কিবা লো রূপ রাশি,
বদন দেখে মনে হয় লো,
ঠিক যেন গগন শশী।।
এমনি ভাদুর নয়ন দুটি লো,
যেন ভ্রমরা আসে বসি।
হাতে পদ্ম, পায়ে পদ্ম,
পদ্ম গন্ধে যায় ভাসি।।
মেঘের কোলে সৌদামিনী লো,
জড়িতে মিশামিশি।
দেখলে জীবন জুড়াইবি,
আনন্দে যাবি ভাসি।।
লক্ষ্মী বংশে জন্ম ভাদুর লো,
পদধূলি নে আসি।
ভাদুর বরে কোলে করে,
দেখবি চাঁদ মুখের হাসি ।।
(রচয়িতা-মীরা দেবী)
এইরূপ বর্ণনাকে ধিক্কার জানিয়ে অপর দল একই সুরে বলে ওঠেন:
"দেখছি হাতে সোনার চুড়ি।
তোদের ভাদুটা ঠিক যেমন মেথর বুড়ি ।।
চুলগুলা যে উড়ুক্ষণা লো,
ভর্তি নাকে পিচুড়ি। গায়ের গন্ধে যায় না
থাকা মনে হয় উঠে পড়ি ।।
মাথায় বজ বজ করছে উকুন
বেরাবে লো একঝুড়ি।
যা যা সবাই মিলে
মটকিই দিগা মট্ মট্ করে তাড়াতাড়ি ।।
ভাদুর মুখটা দেখে মনে হয় যে লো,
একশো বছরের বুড়ি।
একটিও দাঁত নাই যে বলি পেগলেই
পেগলেই খায় মুড়ি"।।
(রচয়িতা-কালীপদ কুণ্ডু)
যুগের পরিবর্তনের সাথে সাথে মানুষের রুচি বোধের পরিবর্তন ঘটে। ভাদুমণির অকাল মৃত্যু একদিন ঘরে ঘরে শোক বহন করে এনেছিল, কিন্তু আজকের দিনে পূজার মাধ্যমে মানুষ তাঁকে যেন পুনর্জীবিত করে তুলেছে। ভাদু আজ দুঃখের বা হতাশার প্রতীক নন। তাকে নিয়ে তামাশা হয়:
"ওলো ভাদু ডিয়ার।
মাইরি বলি রূপখানা তোর চমৎকার।।
সারা অঙ্গ ঢল ঢল লো,
উঠে যৌবনের জোয়ার।
এমন রঙ ভারত জুড়ে দেখা যায়
খুবইরেয়ার।।
মুক্তোর মত দাঁতগুলি যে লো,
মাটিতে ঠেকে হেয়ার।
তোর বাঁকা চোখের চাহনিতে,
ইচ্ছে হয় করি পেয়ার।।
রূপ দেখে তোর মজে গেছি লো
বিশেষ বলব কি আর।
মোদের মত চ্যাংড়াদের তুই
করবি কেন বল কেয়ার"।।
ভাদু গানের মধ্যে বর্তমান সমাজ, কাল ও দেশের বাস্তব রূপ কোন কোন ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ,
"বলি এ সংসারে।
বিয়ের পণ যে বাড়ছে লো তিলে তিলে।।
কলেজেতে পড়তে দিয়ে লো,
এদিকে টাকা হাঁকে।
গরু বাছুরেরই দরে ছেলেকে বিক্রি করে।।
টাকা নিয়ে আসছে বলি গো
যত কনের বাবারে।
গরু, কাড়া কিনতে যেন
আমলাগুলির বাজারে।।
দশ হাজার টাকা হেঁকে লো,
যায় যে সব খদ্দারে।
টাকার লোভে ছেলের গলে
ঘন্টা বেঁধে দেয় বাপেরে" ।।
(রচয়িতা-পরীক্ষিৎ মহান্তি)
"হায় হায় একি হ'ল।
ভুট্টো সাহেব এক চালে পড়ে গেল।।
ইয়াহিয়ার কি যে মতি লো,
সুখে খেতে ভূতে পেল।
তাই বোলতা চাকে কাঠি দিয়ে
আপনি কামড় খেল।।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে লো
দেশপ্রেমিক সব ছুটে এল।
(তারা) নরনারীর অত্যাচার যে
দু'চোখে দেখতে পেল।।
(তখন) মুক্তিসেনা নিয়ে তারা লো,
প্রাণপণে লড়তে গেল।
ইয়াহিয়ার গুন্ডা সেনার
দু'দিনে পতন হ'ল৷৷
দেশের জন্য লড়তে গিয়ে লো
কত যুবক প্রাণ দিল।
তার ফলেতে নতুন রূপে
বাংলাদেশ জন্ম নিল"।।
(রচয়িতা-রাজেন্দ্রপ্রসাদ মহান্তি)
পয়লা আশ্বিন ভাদু বিসর্জনের সুর আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হয়। গানের সুরে আগামী বছর এমনি দিনে আবার যেন ভাদুমণিকে ফিরিয়ে আনা যায় তার শপথ নিয়ে সবাই ফিরে আসেন। ভাদ্র মাসের প্রথম থেকে শেষ দিন পর্যন্ত উৎসবের আনন্দ চলে। (তথ্য সূত্র:পরমপরশ, বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি: লেখক-তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী) [৩]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "ও ভাদু নামল দ্যাশে"। আনন্দবাজার প্রত্রিকা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭।
- ↑ "বিষয় বদলেও জনপ্রিয় ভাদু গান"। আনন্দবাজার প্রত্রিকা। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ২৬ ডিসেম্বর ২০১৭।
- ↑ বই উদ্ধৃতি=পরমপরশ, লেখক=তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, শিরোনাম=বাঁকুড়া পুরুলিয়ার লোকসংস্কৃতি, প্রকাশক=শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, বছর=জানুয়ারি ২০০৯, পাতা=২৮-৩১