ভাদু উৎসব ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, পশ্চিম মেদিনীপুর জেলাপশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমা এবং ঝাড়খণ্ড রাজ্যের রাঁচিহাজারিবাগ জেলার লৌকিক উৎসব।

ভাদু উৎসব

লোককথা সম্পাদনা

ভাদু উৎসব নিয়ে মানভূম অঞ্চলে বেশ কিছু লোককাহিনী প্রচলিত রয়েছে। পঞ্চকোট রাজপরিবারের নীলমণি সিংদেওর তৃতীয়া কন্যা ভদ্রাবতী বিবাহ স্থির হওয়ার পর তার ভাবী স্বামীর অকালমৃত্যু হলে মানসিক আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেন, এই কাহিনী মানভূম অঞ্চলে সর্বাধিক প্রচারিত। বিয়ে করতে আসার সময় ভদ্রাবতীর হবু স্বামী ও তার বরযাত্রী ডাকাতদলের হাতে খুন হলে ভদ্রাবতী চিতার আগুনে প্রাণ বিসর্জন করেন বলে ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ওয়েস্ট বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার পুরুলিয়া গ্রন্থে প্রকাশিত হয়। ভদ্রাবতীকে জনমানসে স্মরণীয় করে রাখার জন্য নীলমণি সিংদেও ভাদু গানের প্রচলন করেন। কিন্তু এই কাহিনীগুলি ঐতিহাসিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত নয়। রাজপুরোহিত রাখালচন্দ্র চক্রবর্তী রচিত পঞ্চকোট ইতিহাস নামক গ্রন্থে এই ধরনের কোন ঘটনার উল্লেখ নেই। নীলমণি সিংদেও তিনজন পত্নীর গর্ভে দশজন পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেও তার কোন কন্যাসন্তানের ছিল কিনা সেই বিষয়েও সঠিক তথ্যের অভাব রয়েছে।[১]:১৬ বীরভূম জেলায় ভদ্রাবতীকে হেতমপুরের রাজার কন্যা হিসেবেও কল্পনা করা হয়েছে। এই জেলায় প্রচলিত রয়েছে যে, ভদ্রাবতীর সাথে বিবাহ স্থির হওয়ার পর ইলামবাজারের নিকটে অবস্থিত চৌপারির শালবনে ডাকাতদের আক্রমণে বর্ধমানের রাজপুত্রের মৃত্যু হলে ভদ্রাবতী তার সাথে সহমরণে যান।[১]:১৪

রীতি সম্পাদনা

পয়লা ভাদ্র কুমারী মেয়েরা গ্রামের কোন বাড়ীর কুলুঙ্গী বা প্রকোষ্ঠ পরিষ্কার করে ভাদু প্রতিষ্ঠা করেন। একটি পাত্রে ফুল রেখে ভাদুর বিমূর্ত রূপ কল্পনা করে তারা সমবেত কন্ঠে ভাদু গীত গেয়ে থাকেন। ভাদ্র সংক্রান্তির সাত দিন আগে ভাদুর মূর্তি ঘরে নিয়ে আসা হয়। ভাদ্র সংক্রান্তির পূর্ব রাত্রকে ভাদুর জাগরণ পালিত হয়ে থাকে। এই রাত্রে রঙিন কাপড় বা কাগজের ঘর তৈরী করে এই মূর্তি স্থাপন করে তার সামনে মিষ্টান্ন সাজিয়ে রাখা হয়। এরপর রাত নয়টা বা দশটা থেকে ভাদু গীত গাওয়া হয়। কুমারী ও বিবাহিত মহিলারা গ্রামের প্রতিটি মঞ্চে গেলে তাদের মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় ও তারা এই সব মঞ্চে ভাদু গীত পরিবেশন করে থাকেন। ভাদ্র সংক্রান্তির সকালে দলবদ্ধভাবে মহিলারা ভাদু মূর্তির বিসর্জন করা হয়।[১]:১২

ভাদু মূর্তি সম্পাদনা

পূর্বে ভাদুর কোন মূর্ত রূপ ছিল না। একটি পাত্রে ফুল রেখে বা গোবরের ওপর ধান ছড়িয়ে ভাদুর রূপ কল্পনা করে উৎসব পালন করা হত। পরবর্তীকালে বিভিন্ন রকমের মূর্তির প্রচলন হয়েছে। মূর্তিগুলি সাধারণতঃ হংস বা ময়ূর বাহিনী বা পদ্মের ওপর উপবিষ্টা মূর্তির গায়ের রঙ হলুদ, মাথায় মুকুট, হাতে পদ্মফুল, গলায় পদ্মের মালা ও হাতের তলায় আলপনা থাকে। কখনো মূর্তির কোলে কৃষ্ণ বা রাধা-কৃষ্ণের যুগল মূর্তি থাকে।[১]:১৩

ভাদু গীত সম্পাদনা

পঞ্চকোট রাজপরিবারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজদরবারে হারমোনিয়াম, পাখোয়াজ, তবলা, সানাই সহযোগে মার্গধর্মী উচ্চ সাহিত্য গুণ নির্ভরএক ধরনের ভাদু গাওয়া হত হয়। এই পরিবারের ধ্রুবেশ্বরলাল সিংদেও, প্রকৃতীশ্বরলাল সিংদেও এবং রাজেন্দ্রনারায়ণ সিংদেও দরবারী ভাদু নামক এই ঘরানার সৃষ্টিকর্তা। কিন্তু অন্যান্য সকল ভাদু গীত লৌকিক সঙ্গীত হিসেবেই জনপ্রিয় হয়েছে। লিখিত সাহিত্য না হওয়ায় এই গান লোকমুখেই প্রচারিত হয়ে এসেছে। টুসুঝুমুর গানের বিপরীতে ভাদু গানগুলিতে প্রেম এবং রাজনীতি সর্বোতভাবে বর্জিত। সাধারণতঃ গৃহনারীদের জীবনের কাহিনী এই গানগুলির মূল উপজীব্য। পৌরাণিক ও সামাজিক ভাদু গানগুলি বিভিন্ন পাঁচালির সুরে গীত হয়। সাধারণতঃ রামায়ণ, মহাভারতকৃষ্ণ-রাধার প্রেম পৌরাণিক গানগুলির এবং বারোমাস্যার কাহিনী সামাজিক গানগুলির বিষয় হয়ে থাকে। এছাড়া চার লাইনের ছড়া বা চুটকি জাতীয় ভাদু গানগুলিতে সমাজ জীবনের বিভিন্ন অসঙ্গতির চিত্র সরস ভঙ্গীতে ফুটিয়ে তোলা হয়।[১]:২৪-২৬

এরকম একটি ভাদু গান হল-

হলুদ কনের ভাদু তুমি হলুদ কেন মাখনা,
শাশুড়ি ননদের ঘরে হলুদ মাখা সাজে না।
কলগাছে চাবি ছিল, হলুদ বল্যে মেখেছি
ও শাশুড়ি গাল দিওনা পাশা খেলতে বসেছি।[২]

বীরভূম জেলার ভাদু উৎসব সম্পাদনা

অন্যান্য অঞ্চলের পালিত উৎসব থেকে বীরভূম জেলার ভাদু উৎসবের বৈশিষ্ট্য বহুলাংশে পৃথক। পয়লা ভাদ্র গ্রামের একজন ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে তার কোলে মাটির তৈরী ভাদু মূর্তি দিয়ে পুরুষদের একটি দল ভাদু গান গেয়ে ও নাচ করে বাড়ীতে বাড়ীতে ঘুরে অর্থ আদায় করেন। ভাদ্র সংক্রান্তিতে ভাদুর জাগরণ পালিত হয়। এই রাতে একটি জায়গাকে সজ্জিত করে ভাদু মূর্তি স্থাপন করা হয়। পরের দিন সকাল বেলায় মূল গায়েনকে অনুসরণে পুরুষদের দল ঢোল, হারমোনিয়াম, তবলা, কাঁসি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র সহযোগে ভাদু গীত গাইতে গাইতে মূর্তি বিসর্জন করেন। এই জেলায় মহিলারা এই গানে অংশগ্রহণ করেন না।[১]:১৪

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. দিলীপ কুমার গোস্বামী, সীমান্ত রাঢ়ের লোকসংস্কৃতি, প্রকাশক- পারিজাত প্রকাশনী, বিদ্যাসাগর পল্লী, পুরুলিয়া-৭২৩১০১, প্রথম প্রকাশ- ২৪শে ডিসেম্বর, ২০১৪
  2. পোদ্দার, হীরামন। প্রান্ত বঙ্গের ব্রাত্য সংগীত (২য় সংস্করণ)। অণিমা বিশ্বাস। পৃষ্ঠা ১৭। আইএসবিএন 978-93-88380-57-7