শ্রীকৃষ্ণকীর্তন
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন হল বড়ু চণ্ডীদাস রচিত একটি মধ্যযুগীয় বাংলা কাব্য। এটি আদি মধ্যযুগীয় তথা প্রাক্-চৈতন্য যুগে বাংলা ভাষায় লেখা একমাত্র আখ্যানকাব্য এবং বৌদ্ধ সহজিয়া সংগীত-সংগ্রহ চর্যাপদের পর আদি-মধ্যযুগীয় বাংলা ভাষার আবিষ্কৃত দ্বিতীয় প্রাচীনতম নিদর্শন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ বাঁকুড়া জেলার কাঁকিলা গ্রামের দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের গোয়ালঘর থেকে এই কাব্যের খণ্ডিত পুঁথিটি আবিষ্কার করেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁরই সম্পাদনায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে পুঁথিটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তিনি এই পুঁথির নামকরণ "শ্রীকৃষ্ণকীর্তন" করলেও পুঁথির মধ্যে একটি চিরকুটে লিখিত শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ নামটি[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] দৃষ্টে কোনও কোনও গবেষক পুঁথিটির নাম "শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ" রাখারই পক্ষপাতী ছিলেন; যদিও নামটি সংশয়াতীত নয় বলে বর্তমানে কাব্যটিকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামেই অভিহিত করা হয়।
বাংলা সাহিত্য | |
---|---|
বাংলা সাহিত্য (বিষয়শ্রেণী তালিকা) বাংলা ভাষা | |
সাহিত্যের ইতিহাস | |
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস | |
বাঙালি সাহিত্যিকদের তালিকা | |
কালানুক্রমিক তালিকা - বর্ণানুক্রমিক তালিকা | |
বাঙালি সাহিত্যিক | |
লেখক - ঔপন্যাসিক - কবি | |
সাহিত্যধারা | |
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় চর্যাপদ - মঙ্গলকাব্য - বৈষ্ণব পদাবলি ও সাহিত্য - নাথসাহিত্য - অনুবাদ সাহিত্য -ইসলামী সাহিত্য - শাক্তপদাবলি - বাউল গান আধুনিক সাহিত্য উপন্যাস - কবিতা - নাটক - ছোটোগল্প - প্রবন্ধ - শিশুসাহিত্য - কল্পবিজ্ঞান | |
প্রতিষ্ঠান ও পুরস্কার | |
ভাষা শিক্ষায়ন সাহিত্য পুরস্কার | |
সম্পর্কিত প্রবেশদ্বার সাহিত্য প্রবেশদ্বার বঙ্গ প্রবেশদ্বার | |
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের মূল উপজীব্য রাধা ও কৃষ্ণের প্রণয়কাহিনি। সমগ্র কাব্যটি তেরোটি খণ্ডে বিভক্ত: জন্মখণ্ড, তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড, ভারখণ্ড, ছত্রখণ্ড, বৃন্দাবনখণ্ড, কালিয়দমন খণ্ড, যমুনাখণ্ড, হারখণ্ড, বাণখণ্ড, বংশীখণ্ড ও রাধাবিরহ। রাধাবিরহ অবশ্য মূল কাব্যে প্রক্ষিপ্ত কিনা তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে।
কাব্যের প্রধান তিন চরিত্র রাধা, কৃষ্ণ ও বড়ায়ি। এই বড়ায়ি চরিত্রটি সৃষ্টি করা হয়েছে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের "কুট্টনী" জাতীয় চরিত্রটির আদলে। এই তিনটি চরিত্র চিত্রণের দক্ষতার পরিপ্রেক্ষিতে কাব্যটিকে বড়ু চণ্ডীদাসের কবি প্রতিভার সার্থক নিদর্শন মনে করা হয়। পরবর্তীকালের বৈষ্ণব পদাবলি সাহিত্যের মাথুর ও ভাবসম্মিলন পর্যায়ের পূর্বাভাস শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের রাধাবিরহ অংশের মধ্যে নিহিত।
মধ্যযুগের আদিপর্বে রচিত এই কাব্যের ভাষা আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে কিছুটা দুরূহ মনে হলেও বাংলা সাহিত্যের প্রথম যুগের ভাষা হিসেবে তা চর্যাপদের ভাষা অপেক্ষা অনেক বেশি সাবলীল, স্বাভাবিক ও স্বনির্ভর ছিল। মনে করা হয় যে, বড়ু চণ্ডীদাস সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে সুপণ্ডিত ছিলেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে যেমন একদিকে ভাগবত পুরাণ ও গীতগোবিন্দম্ কাব্যের বহু পংক্তির ভাবানুবাদ স্থান পেয়েছে, তেমনই উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা প্রভৃতি অলংকারের প্রয়োগেও কবি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। এই কাব্যের ছন্দের বৈচিত্র্যও লক্ষণীয়। সাত প্রকারের পয়ার ও তিন প্রকারের ত্রিপদী ছন্দের প্রয়োগ দেখা যায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে। বিষয়বস্তু ও ভাবের দিক থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন জয়দেবের গীতগোবিন্দম্ ও চৈতন্যোত্তর বৈষ্ণব সাহিত্যের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজটি করেছে। তাছাড়া এই কাব্যে রাধা, কৃষ্ণ ও বড়ায়ির উক্তি-প্রত্যুক্তির মাধ্যমে যে নাটকীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে নিহিত রয়েছে পরবর্তীকালের বাংলা নাট্যসাহিত্যের বীজও।
পুঁথি আবিষ্কার
সম্পাদনাশ্রীকৃষ্ণকীর্তনের একমাত্র আবিষ্কৃত পুঁথির ভিতর পাওয়া একটি চিরকুট থেকে গবেষকেরা জানতে পেরেছেন যে, পুঁথিটি ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে বনবিষ্ণুপুরের রাজার "গাঁথাঘর" অর্থাৎ রাজ-গ্রন্থাগারে ছিল। রাজগুরু শ্রীনিবাস আচার্যের দৌহিত্র-বংশীয় দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় পরে পুঁথিটির অধিকারী হন।[১] দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের অধিবাসী। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ মুখোপাধ্যায় পরিবারের গোয়ালঘরের মাচায় অযত্নে রক্ষিত কয়েকটি পুঁথির ভিতর থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের খণ্ডিত পুঁথিটি আবিষ্কার করেন। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভের সম্পাদনাতেই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে পুঁথিটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।[২] পুঁথিটির প্রথম, মধ্য ও শেষের কয়েকটি পৃষ্ঠা পাওয়া যায়নি।[৩]
পুঁথি-পরিচয়
সম্পাদনাবসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ আবিষ্কৃত পুঁথিটি ছাড়া শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের আর কোনও পুঁথি পাওয়া যায়নি। তুলোট কাগজে লেখা এই পুঁথিটির প্রারম্ভে আখ্যাপত্র, শেষের পুষ্পিকা এবং মাঝের কতকগুলি পৃষ্ঠা নষ্ট হয়ে গিয়েছে।[৩] পুঁথির মধ্যে একটি "পাত্ড়া" (টুকরো তুলোট কাগজ) পাওয়া গিয়েছে। তাতে পুরনো ছাঁদের অক্ষরে লেখা রয়েছে, "শ্রীকৃষ্ণ সন্দর্ব্বের ৯৫ পচানই পত্র একশত দশ পত্র পর্যন্ত একুনে ১৬ শোল পত্র শ্রীকৃষ্ণপঞ্চানন শ্রীশ্রী মহারাজার হুজুরকে লইয়া গেলেন পুনশ্চ আনিয়া দিবেন।" চিরকুটটিতে তারিখ হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে "সন ১০৮৯/ তাং ২১ অগ্রহায়ণ" (১৬৮২ খ্রিস্টাব্দ)। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুমান, সেই সময় বনবিষ্ণুপুরের "গাঁথাঘর" বা রাজ-গ্রন্থাগারে পুঁথিটি অক্ষত অবস্থাতেই ছিল। পুঁথিটিতে তিনি পুরনো ধাঁচের বলে মনে করেছেন। তাঁর মতে, এটি নকল করা হয়েছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে অথবা তারও আগে।[১] যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকা-র ১৩২৬ বঙ্গাব্দ প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর "শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে সংশয়" প্রবন্ধে কাব্যটির প্রাচীনতা ও প্রামাণিকতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পুঁথির কাগজ পরীক্ষা করে দেখেছিলেন যে পুঁথিটিকে যতটা প্রাচীন মনে হরা হয় আসলে তা তত প্রাচীন নয়। অবশ্য অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, চিরকুটটিই প্রমাণ করে যে পুঁথিটি সপ্তদশ শতাব্দীর পরে নকল করা হয়নি।[৪] সুকুমার সেন এই পুঁথিটি সম্পর্কে লিখেছেন:[৫]
“ | শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পুথি এক হাতের লেখা নয়, দুইটি ভিন্ন হাতের (আসলে ভিন্ন ঢঙের) লেখা আছে। একটি পুরানো গোটা গোটা অনুশাসন খোদাইয়ের রীতিতে সযত্নে লেখা। আর একটি জড়ানো জড়ানো টানা অর্বাচীন হাতের পত্র-দলিলের ছাঁদে লেখা। অর্বাচীন ছাঁদে পাতাগুলিকে পরবর্তী কালের যোজনা বলিবার উপায় নাই কেননা কালি এক কাগজও এক, এবং একই অচ্ছিন্ন ভাঁজ-করা পাতায় প্রাচীন-অর্বাচীন দুই ছাঁদের লেখাই পাওয়া গিয়াছে। …কাগজ পাতলা, মাড়ের তৈয়ারি, ঠিক যেন মিলের কাগজ। এরকম কাগজে লেখা পুথি বা দলিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের আগে দেখি নাই, ঊনবিংশ শতাব্দীতে যথেষ্ট দেখিয়াছি। পুথিটিকে ভালো করিয়া পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছি। কালি হালকা, তাহাতে প্রাচীন পুথির কালির গাঢ়তা ও উজ্জ্বলতার আভাসমাত্র নাই। আমার অভিমত শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের [আবিষ্কৃত পুঁথিটির] লিপিকাল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধের আগে হইতে পারে না, সম্ভবত ঊনবিংশ শতাব্দীর। অক্ষরের দিক দিয়াও কোন বাধা নাই। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পুরানো ছাঁদের মতো অক্ষর অষ্টাদশ শতাব্দীর পুথিতে অনেক দেখিয়াছি। | ” |
বৈশিষ্ট্য
সম্পাদনাভগবান বিষ্ণুর অবতাররূপে কৃষ্ণের জন্ম, বড়াইয়ের সহযোগিতায় বৃন্দাবনে রাধার সঙ্গে তাঁর প্রণয় এবং অন্তে বৃন্দাবন ও রাধা উভয়কে ত্যাগ করে কৃষ্ণের চিরতরে মথুরায় অভিপ্রয়াণ – এই হল ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের মূল উপজীব্য। আখ্যায়িকাটি মোট ১৩ খণ্ডে বিভক্ত। এগুলি হল; জন্ম খণ্ড, তাম্বুলখণ্ড, দানখণ্ড, নৌকাখণ্ড,ভারখণ্ড,ছত্রখণ্ড বৃন্দাবনখণ্ড কালিয়দমনখণ্ড, বস্ত্রহরণখণ্ড,হারখণ্ড, বাণখণ্ড, বংশীখণ্ড এবং রাধাবিরহ। ১২টি অংশ 'খণ্ড' নামে লেখা হলেও অন্তিম অংশটির নাম শুধুই 'রাধাবিরহ', এই অংশটির শেষের পৃষ্ঠাগুলি পাওয়া যায়নি। এই কাব্যগ্রন্থে ৪১৯ টি বাংলা পদ আছে।সংস্কৃত শ্লোক আছে ১৬১ টি।[৬]পুঁথিটি খণ্ডিত বলে কাব্য রচনার সন-তারিখও জানা যায় না। কাব্যের প্রধান তিনটি চরিত্র — রাধা, কৃষ্ণ, বড়াই। তবে আলোচ্য কাব্যটি সংস্কৃত কাব্য গীতগোবিন্দম্-এর ধরনে আখ্যানধর্মী ও সংলাপের আকারে রচিত বলে এতে প্রাচীন বাংলা নাটকের ('চিত্রনাটগীতি') একটি আভাস মেলে। মনে করা হয়, পূর্বতন লোকব্যবহারে অমার্জিত স্থূল রঙ্গরসের যে ধামালী গান প্রচলিত ছিল, তা থেকেই কবি এর আখ্যানভাগ সংগ্রহ করেছিলেন। কাব্যটিতে প্রাকৃত প্রেমের আকর্ষণ-বিকর্ষণ পালাগান বা নাটের ঠাটে উপস্থাপিত। গ্রন্থটি স্থানে স্থানে আদিরসে জারিত ও গ্রাম্য অশ্লীলতাদোষে দুষ্ট হলেও আখ্যানভাগের বর্ণনানৈপুণ্য ও চরিত্রচিত্রণে মুন্সিয়ানা আধুনিক পাঠকেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যটিতে বেশ কয়েকবার উদ্ধৃত মর্মস্পর্শী একটি পদ —
"কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কূলে।
কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি এ গোঠ গোকুলে।
আকুল শরীর মোর বেয়াকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ বান্ধন।
কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি সে না কোন জনা।
দাসী হুআঁ তার পাএ নিশিবোঁ আপনা।
কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি চিত্তের হরিষে।
তার পাএ বড়ায়ি মোঁ কৈলোঁ কোন দোষে।
আঝর ঝরএ মোর নয়নের পাণী।
বাঁশীর শবদেঁ বড়ায়ি হারায়িলোঁ পরাণী।"
গুরুত্ব
সম্পাদনাচর্যাপদের পর ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ আদি-মধ্য বাংলা ভাষার প্রাচীনতম আবিষ্কৃত নিদর্শন। বাংলা ভাষাতত্ত্বের ইতিহাসে এর গুরুত্ব তাই অপরিসীম। অপরদিকে এটিই প্রথম বাংলায় রচিত কৃষ্ণকথা বিষয়ক কাব্য। মনে করা হয়, এই গ্রন্থের পথ ধরেই পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে বৈষ্ণব পদাবলির পথ সুগম হয়; তবে এই কাব্যের ভাব বৈষ্ণব-মহান্তদের নির্দেশিত কৃষ্ণলীলার ভাবব্যঞ্জনার সঙ্গে মেলে না। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকার ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই লিখেছেন,
“ | জয়দেব ও ভারতচন্দ্রকে বাদ দিলে এ ধরনের কাব্য সমগ্র পূর্বভারতেই আর পাওয়া যাবে না।... বোধ হয় সেকালের শ্রোতারা এই পাঁচালি গানে বাস্তবতার সঙ্গে কিছু অধ্যাত্ম ব্যঞ্জনাও লাভ করত। কিন্তু আধুনিক কালের পাঠক এ কাব্যের প্রত্যক্ষ আবরণ অধিকতর আনন্দের সঙ্গে আস্বাদন করবেন। রাধাকৃষ্ণলীলায় কিছু উত্তাপ ছিল, জয়দেবের গীতগোবিন্দে সেই উত্তাপ সঞ্চারিত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে, সে উত্তাপ ‘অভিনব জয়দেব’ বিদ্যাপতির পদেও কিছু স্ফুলিঙ্গ বর্ষণ করেছে। ভারতচন্দ্র সেই উত্তাপকে কামনার পঞ্চপ্রদীপ জ্বালিয়ে নর-নারীর প্রণয়চর্চাকে আলোকিত করেছেন। দেহের এই রহস্য চৈতন্য ও উত্তর-চৈতন্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলীতে উত্তাপ হারিয়ে স্থির দীপশিখায় পরিণত হয়েছে।[৭] | ” |
নামকরণ
সম্পাদনাবিদ্বদ্বল্লভ মহাশয় ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ শিরোনামে গ্রন্থটি সম্পাদনা ও প্রকাশ করলেও, এই গ্রন্থের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামকরণ নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ আছে। প্রাচীন পুঁথিগুলিতে সচরাচর প্রথম বা শেষ পাতায় পুঁথির নাম লেখা থাকে। কিন্তু ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ পুঁথির ক্ষেত্রে এই দুটি গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠা পাওয়া যায়নি। ফলে পুঁথির নামও অজানাই থেকে যায়। এমনকি পরবর্তীকালের কোনও পুঁথিতেও বড়ু চণ্ডীদাস বা তার গ্রন্থের কোনও উল্লেখ পাওয়া যায় না। বিদ্বদ্বল্লভ মহাশয় তাই নামকরণকালে পুঁথির কাহিনি বিচার করে লোকঐতিহ্যের অনুসারে এটি ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর বক্তব্য ছিল,
“ | পুঁথির আদ্যন্তহীন খণ্ডিতাংশে কবির দেশকালাদির কথা দূরে থাকুক, পুথির নাম পর্যন্তন পাওয়া যায় নাই। কথিত হয়, চণ্ডীদাস কৃষ্ণকীর্তন কাব্য রচনা করেন। খেতরীর এক বার্ষিক উৎসবে চণ্ডীদাসের কৃষ্ণলীলা গীত হইয়াছিল, অবশ্য কীর্তনাঙ্গে। আলোচ্য পুথির প্রতিপাদ্য যে শ্রীকৃষ্ণের লীলাকীর্তন, তাহাতে তর্কের অবসর নাই। অতএব গ্রন্থের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামকরণ অসমীচীন নয়।[৮] | ” |
গ্রন্থপ্রকাশের প্রায় ১১ বছর পর সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকায় রমেশ বসু সম্ভবত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের নামকরণকেন্দ্রিক বিতর্কের সূত্রপাত ঘটান। এরপর বাংলা সাহিত্যের সারস্বত সমাজে এ-নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক উপস্থিত হয়। যাঁরা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ নামকরণের বিরোধী ছিলেন, তাদের যুক্তি ছিল দ্বিমুখী। প্রথমত, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ একটি আদিরসাত্মক অশ্লীল কাব্য – এতে শ্রী বা কীর্তন কোনওটিই উপস্থিত নেই। দ্বিতীয়ত, পুঁথির সঙ্গে যে চিরকূটটি পাওয়া যায়, তাতে ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ব্ব’ বলে একটি কথা লিখিত আছে। অনেকে মনে করেন গ্রন্থের মূল নাম ‘শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ’। প্রথম যুক্তিটি আধুনিক কাব্যবিচারের দৃষ্টিতে খুবই দুর্বল; কিন্তু আধুনিক গবেষকগণ দ্বিতীয় দাবিটি প্রসঙ্গেও যথেষ্ট সন্দিহান।[৯][১০] এই কারণে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রস্তাব করেছেন,
“ | যতদিন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের যথার্থ নাম আবিষ্কৃত না হচ্ছে ততদিন সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ প্রদত্ত এই নামটিই স্বীকার করতে হবে।[৯] | ” |
কাব্যে কৃষ্ণ শব্দের ব্যবহার নাই বললেই চলে, আছে কাহ্নাঞি শব্দ। সেই সূত্রে কাব্যের নাম "কাহ্নাঞিকীর্তন" করা যেতে পারে।
কবি
সম্পাদনা‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ কাব্যের রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস। যদিও তাঁর আত্মপরিচয় বা জীবনকথা জাতীয় কিছু পাওয়া যায় না বলে তাঁর প্রকৃত পরিচয় কিছুটা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। কাব্যে তাঁর তিনটি ভণিতা পাওয়া যায় – ‘বড়ুচণ্ডীদাস’, ‘চণ্ডীদাস’ ও ‘আনন্ত বড়ুচণ্ডীদাস’। এর মধ্যে ‘বড়ুচণ্ডীদাস’ ভণিতা মিলেছে ২৯৮টি স্থানে ও ‘চণ্ডীদাস’ ভণিতা মিলেছে ১০৭ বার।[১১] ৭টি পদে ব্যবহৃত ‘আনন্ত’ শব্দটি প্রক্ষিপ্ত বলেই মনে করা হয়।[১১] ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা মনে করেন, চণ্ডীদাস তাঁর নাম এবং বড়ু প্রকৃতপক্ষে তাঁর কৌলিক উপাধি বাঁড়ুজ্যে বা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপভ্রংশ।[১১] কবি চৈতন্য-পূর্ববর্তীকালের মানুষ। সম্ভবত পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে তিনি জীবিত ছিলেন। বাংলা সাহিত্যে চণ্ডীদাস সমস্যা এবং পদাবলির চণ্ডীদাসকে নিয়ে বাঁকুড়া ও বীরভূমের মধ্যে যত বিবাদই বিদ্যমান থাকুক না কেন, ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা ভাষাতাত্ত্বিক তথ্যপ্রমাণের সাহায্যে প্রমাণ করেছেন, ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রচয়িতা বড়ুচণ্ডীদাস বাঁকুড়া সদর মহকুমার ছাতনার অধিবাসী ছিলেন।[১২][১৩] বড়ুচণ্ডীদাস বাসুলী দেবীর উপাসক ছিলেন এবং দেবী মন্দিরের নিকটবর্তী স্থানে তাঁর 'চিত্রনাটগীতি' পরিবেশনের নাট্যশালা ছিল। এই বাসলী দেবী প্রকৃতপক্ষে শক্তিদেবী চণ্ডী অথবা মনসার অপর নাম। সম্ভবত বাসলী দেবীর বাৎসরিক পূজায় গীত হওয়ার উদ্দেশ্যে দেবীর স্বপ্নাদেশ প্রাপ্ত হয়ে কবি কর্তৃক এই কাব্য রচিত হয়েছিল।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২২৯
- ↑ ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্য পরিচয় ও সাহিত্যটীকা, পৃ. ৩০
- ↑ ক খ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২২৭
- ↑ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, পৃ. ২২৯-২৩০
- ↑ সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড, পৃ. ১২২
- ↑ কৃষ্টি কিরণ: সম্পাদক- তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী একাদশ সংখ্যা,২০১৯, শ্রীকৃষ্ণ কীর্তনের প্রাচীন পুঁথি: বাঁকুড়ার গৌরব, লেখক: ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা, পৃঃ ৩১
- ↑ বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ২৭৩
- ↑ চণ্ডীদাস বিরচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ সম্পাদিত, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, বঙ্গাব্দ ১৩৮০ (নবম সংস্করণ) দ্রষ্টব্য
- ↑ ক খ বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০৬, পৃ. ২২৯
- ↑ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ু চণ্ডীদাস বিরচিত, ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা সম্পাদিত, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (দ্বিতীয় প্রকাশ), প্রবেশক, পৃষ্ঠা ১১
- ↑ ক খ গ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস বিরচিত, ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (২য় প্রকাশ), প্রবেশক পৃষ্ঠা ৪
- ↑ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বড়ুচণ্ডীদাস বিরচিত, ডঃ মিহির চৌধুরী কামিল্যা, শিলালিপি, কলকাতা, ২০০৫ (২য় প্রকাশ), প্রবেশক পৃষ্ঠা ৫
- ↑ প্রবন্ধ বাঁকুড়ার উপভাষা ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, বাঁকুড়ার উপভাষা, ড. মিহির চৌধুরী কামিল্যা, হরষিৎ মিশন, কলকাতা, ১৯৭২
উল্লেখপঞ্জি
সম্পাদনা
আকর গ্রন্থ
|
সাহিত্যের ইতিহাস ও অন্যান্য আলোচনা
|
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনাবাংলা সাহিত্য - জ্ঞানগৃহ ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১১ ডিসেম্বর ২০২১ তারিখে