বিষ্ণুপুর ঘরানা
বিষ্ণুপুর ঘরানা হল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের হিন্দুস্তানি ধারার ধ্রুপদ সংগীতের একটি ঘরানা।[১] অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই ঘরানা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল।[২] বিষ্ণুপুর শহরটি অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার সদর শহর। মধ্যযুগে এই শহরটি ছিল মল্লভূম রাজ্যের রাজধানী। ঐতিহাসিকদের মতে, মল্লভূম ছিল পূর্বভারতের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।[৩] মল্ল রাজারা ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার পৃষ্ঠপোষক। ১৩৭০ খ্রিষ্টাব্দে মল্ল রাজদরবারে বিষ্ণুপুর ঘরানার সূত্রপাত ঘটেছিল।[৪] বিষ্ণুপুর ঘরানা ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের একমাত্র ঘরানা যেটির কেন্দ্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য।
ইতিহাস
সম্পাদনাকথিত আছে, বিষ্ণুপুর ঘরানার উৎপত্তি ঘটেছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। যদিও এই মতের সমর্থনে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। সপ্তদশ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনকালে ইসলামি কট্টরপন্থা চূড়ান্ত রূপ নেয়। সেই সময় অনেক অনেক সংগীতজ্ঞ শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক মল্ল রাজদরবারে চলে আসেন।[৫] তানসেনের বংশধর তথা সেনিয়া ঘরানার বিশিষ্ট দ্রুপদ গায়ক বাহাদুর খান সেই সময় বিষ্ণুপুরে চলে আসেন। তিনি কেবলমাত্র কণ্ঠসংগীত শিল্পীই ছিলেন না, বীণা, রবাব ও সুরশৃঙ্গারের মতো বাদ্যযন্ত্রও দক্ষতার সঙ্গে বাজাতে পারতেন। রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহদেব তাকে সভাগায়ক নিযুক্ত করেন। রাজা আরও ঘোষণা করেন, যে কোনো সুকণ্ঠ গায়ক বিনামূল্যে বাহাদুর খানের কাছে সংগীত শিক্ষা করতে পারবেন। তিনি দরিদ্র ছাত্রদের ব্যয়ভার বহন করতেন। বহু সুকণ্ঠ ছাত্র বাহাদুর খানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
ঐতিহাসিকরা তানসেনের বংশধর উস্তাদ বাহাদুর খানের শিষ্য পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্যকে বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা মনে করেন।[৬] এই সূত্রে বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গে বেতিয়া ঘরানার একটি দৃঢ় যোগসূত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।[৭]
১৮শ শতাব্দীর শেষভাগে ও ১৯শ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যখন বিভিন্ন ঘরানা খেয়াল সংগীতকে কেন্দ্র করে একত্রিত হচ্ছিল, সেই সময়ও বিষ্ণুপুরে ধ্রুপদ ঘরানা নিজস্বতা বজায় রাখে। বিষ্ণু নারায়ণ ভাতখন্ডে রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীকে বিষ্ণুপুর ঘরানার শ্রেষ্ঠ শিল্পী মনে করতেন। তাই তিনি রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করার ইচ্ছা প্রকাশ অরেছিলেন। ১৯২১ সালে যখন যুবরাজ এডওয়ার্ড ভারতে আসেন, তখন বিভিন্ন ঘরানার ছয় শিল্পীকে নির্বাচিত করা হয়েছিল তার সামনে ছয়টি ঋতুভিত্তিক রাগ উপস্থাপন করার জন্য। এঁদের মধ্যে তিন জন ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার: গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী। বিষ্ণুপুর ঘরানার রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধীনে লালচাঁদ বড়াল’তারা পরমেশ্বরী’ খেয়ালটি শিখে প্রথম ১৯০২ সালে সেটি গ্রামাফোনে রেকর্ড করেন। এটি প্রকাশ করেছিল গ্রামাফোন কনসার্ট অ্যান্ড নিকোল। একই কোম্পানি প্রথম দ্রুপদ রেকর্ড করে ১৯০২ সালে। গানটি ছিল সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘নাদ বিদ্যা সবসে সেরা’ (রাগ দরবারি, তাল চৌতাল)। রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের সময় থেকে বিষ্ণুপুর ঘরানায় খেয়াল গাওয়া শুরু হয়। ১৯২৮ সাল পর্যন্ত রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের প্রথম সারির সুরবাহার ও সেতার শিল্পী।
১৯২১-২২ সাল নাগাদ বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে বারাণসীর একটি সম্মেলনে বিষ্ণুপুর ঘরানার শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হন। রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও সত্যকিংকর বন্দ্যোপাধ্যায় এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। সেই সময় দ্রুপদ শিল্পীরা দ্বৈতকণ্ঠে গাইলেও, এঁরা তিনজন একত্রে সেই সম্মেলনে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। পরে তারা একক সংগীতও পরিবেশন করেন।
সংগীত
সম্পাদনাবিষ্ণুপুর ঘরানার সংগীতে গায়ক আলাপের মাধ্যমে রাগের সৌন্দর্য মেলে ধরেন। এই কাজটি সহজভাবে এবং কোনো রকম অতিরিক্ত অলংকরণ ব্যতিরেকে করা হয়। তালের জটিল বাদ্যও পরিহার করা হয়। যদিও ধামারে লয়কারী অনুমোদন করা হয়। বিষ্ণুপুর ঘরানার খেয়াল মিষ্টি সুরেলা সংগীতের জন্য খ্যাত। এতে সাধারণ অলংকরণ প্রয়োগ করা হয় এবং এর মাধ্যমে রাগের বিভিন্ন ধরনের সুরেলা উপস্থাপনা দেখা যায়।
বিষ্ণুপুর ঘরানার দ্রুপদে বসন্ত রাগে শুদ্ধ ধৈবত ব্যবহার করা হয় ভৈরব রাগের কোমল নিষাদের স্পর্শ দিয়ে। রাগ রামকেলিতে কড়ি মধ্যম পরিহার করা হয় এবং পুরবী ও ললিত রাগে শুদ্ধ ধৈবত এবং বেহাগ রাএ কোমল নিষাদ ব্যবহার করা হয়। তালের ক্ষেত্রেও এই ঘরানার নিজস্বতা আছে। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতে এই ঘরানাই সওয়াল-জবাব প্রথার আবিষ্কারক।
এই ঘরানার উৎস ও বিকাশ ঘরানার মধ্যে বিবর্তন ও শিক্ষাব্যবস্থায় বিরাট মুক্তচিন্তার জন্ম দেয়।[৮]
বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ
সম্পাদনাবিষ্ণুপুর ঘরানার বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞরা হলেন: উস্তাদ বাহাদুর খান, পণ্ডিত গদাধর চক্রবর্তী (কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীত), পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য, পণ্ডিত যদুভট্ট, পণ্ডিত অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, মান্না দে, পণ্ডিত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, সংগীতাচার্য রাজেন্দ্রনাথ কর্মকার, পণ্ডিত গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী, আচার্য যোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আচার্য সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সংগীতাচার্য রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সংগীতাচার্য অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়,পণ্ডিত নীহাররঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়,পণ্ডিত শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, দেবব্রত সিংহ ঠাকুর, পণ্ডিত গোকুল নাগ, পণ্ডিত মণিলাল নাগ, বিদুষী মিতা নাগ, শ্রী পূর্বাচল বেরা, বাংলাদেশে সুরেন্দ্র নারায়ণ দাশ প্রমুখেরা।
আরও পড়ুন
সম্পাদনা- Capwell C., 1993. The interpretation of history and foundations of authority in Visnupur Gharana of Bengal., in Ethnomusicology and modern music history, By Stephen Blum, Daniel M. Neuman Ed., University of Illinois Press, 1993., আইএসবিএন ০-২৫২-০৬৩৪৩-০, আইএসবিএন ৯৭৮-০-২৫২-০৬৩৪৩-৫, pp 95–102
- Sengupta, P. K. 1991. "Foundations of Indian musicology: perspectives in the philosophy of art and culture", Abhinav Publications, Calcutta, আইএসবিএন ৮১-৭০১৭-২৭৩-X.
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ M. Ganguly (৭ মে ২০০৮)। "Sweet tributes to music"। The Telegraph। ২ মে ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুলাই ২০১৩।
- ↑ Samira Dasgupta; Rabiranjan Biswas; Gautam Kumar Mallik (২০০৯)। Heritage Tourism: An Anthropological Journey to Bishnupur। Mittal Publications। পৃষ্ঠা 110–। আইএসবিএন 978-81-8324-294-3। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জুলাই ২০১৩।
- ↑ Ghoash, P (২০০২)। "Tales, Tanks, and Temples: The Creation of a Sacred Center in Seventeenth-Century Bengal"। Asian Folklore Studies। 61 (1): 193–222। জেস্টোর 1178971। ডিওআই:10.2307/1178971।
- ↑ "Bishnupur"। ২৫ অক্টোবর ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩১ মে ২০০৮।
- ↑ SinhaThakur, Debabrata (১৯৭০)। Bishnupur Gharanar Utpatti Itihas। Bharabi, Bankura। পৃষ্ঠা 88।
- ↑ Capwell Charles (১৯৯৩)। "The interpretation of history and foundations of authority in Visnupur Gharana of Bengal"। Ethnomusicology and modern music history (Ed.) Stephen Blum, Daniel M. Neuman। University of Illinois Press: 95–102।
- ↑ "Dhrupad Gharanas in North Indian Classical Music"। ITC Sangeeth Research Academy। ১০ জানুয়ারি ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ জুন ২০০৯।
- ↑ Owens, Naomi (১৯৬৯)। "Two North Indian Musical Gharanas"। M. A. Thesis। University of Chicago।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা