পটুয়া সঙ্গীত

বাংলার প্রাচীন লোকসঙ্গীত

পটুয়া সঙ্গীত বাংলার এক প্রাচীন লোকসঙ্গীতের ধারা। পটচিত্রকর তথা পটুয়ারা লৌকিক ও পৌরানিক কাহিনি অবলম্বন করে বিভিন্ন ধরনের পটচিত্র অঙ্কন করেন এবং পটের কাহিনিকে ঘিরে সঙ্গীত রচনা করেন। এই সকল গান তারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে পট প্রদর্শনের সঙ্গে পবিবেশন করেন। পশ্চিমবঙ্গের বীরভুম, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ ও অন্যান্য পল্লী অঞ্চলগুলিতে পটুয়া সঙ্গীতের প্রচলন দেখা যায়।[১]

প্রকারভেদ সম্পাদনা

পটুয়া সঙ্গীত বা পটগীতিকে সাধারণত তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। এগুলি হল লীলা কাহিনি, পঞ্চ বা পাঁচ কল্যাণী এবং গোপালন বিষয়ক গীতিকা।

লীলা কাহিনি সম্পাদনা

কৃষ্ণলীলা, গৌরাঙ্গলীলা, রামলীলা, শিবপার্বতীলীলা ইত্যাদি এই লীলা কাহিনি মূলক সঙ্গীত।

পঞ্চ বা পাঁচ কল্যাণী সম্পাদনা

এই পর্যায়ের সঙ্গীতগুলি কোনো বিশেষ লীলা কাহিনি বা আখ্যায়িকা অবলম্বনে রচিত হয় না। এখানে নানা দেব-দেবীর সম্ভন্ধে ছড়ার পাঁচমিশালি সমাবেশ ঘটে।

গোপালন বিষয়ক গীতিকা সম্পাদনা

গো-পালন গীতিগুলিতে কপিলার মর্তে অবতীর্ণ হতে প্রথমে অনিচ্ছা প্রকাশ ও পরবর্তিতে মনুষ্যজাতির সেবার জন্য দেবগণের সনির্বন্ধ মিনতি এখানে গীত হয়।[২]

অঞ্চল সম্পাদনা

পটুয়া সঙ্গীতের প্রচলন পূর্বে সম্পূর্ণ রাঢ় অঞ্চলে থাকলেও বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের বীরভুম, পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুরের পিঙ্গলা ব্লকের নয়াগ্রাম, বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ জেলায় এই গীত শোনা যায়। পিঙ্গলা ব্লকের নয়াগ্রাম এই প্রাচীন ঐতিহ্যকে এখনও দৃঢ়ভাবে ধরে রেখেছে। এখানকার প্রায় পঞ্চাশ থেকে পঞ্চান্নটি পরিবার পটশিল্প ও পটুয়া সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত আছে।

পটচিত্র ও পটগীতির সম্পর্ক সম্পাদনা

পটগীতির বর্ণনা সম্পূর্ণরূপে পটচিত্রের হুবহু অনুকরণে না হলেও পটচিত্র পটগীতির পরিপোষক। চিত্রে যা বর্ণিত হয়, গীতিকার তার বর্ণনা না দিয়ে চিত্রের অন্তর্নিহিত ভাব ও ভক্তিরসের অভিব্যঞ্জনা করেন। প্রকৃতপক্ষে চিত্রে যা ফুটে ওঠে, তা গীতিতে বর্ণিত হয়, আবার গীতে বণিত অভিব্যঞ্জনা চিত্রে উহ্য় থাকে।[২]

বাঙালি জীবনের নিখুঁত রূপ সম্পাদনা

কৃষ্ণলীলা, রামলীলা, শিবের শঙ্খ পরানো প্রভৃতি সঙ্গীতে বাংলার স্ত্রী-পুরুষ ও জীবনের এক নিখুঁত প্রতিকৃতি রচিত হয়েছে। ধর্ম, দর্শন ও পুরানের মূল তত্ত্বগুলি যে বাঙালি হিন্দুসমাজে খুব সহজভাবেই সঞ্চারিত হয়েছে তা পটুয়া সঙ্গীত থেকে সহজেই বোঝা যায়। রামের বিবাহে ছাদনাতলা অথবা পার্বতীর কাছে সব অলঙ্কারের চেয়ে যে শাঁখার মর্যাদা বেশি তা পটুয়া সঙ্গীতে ফুটে ওঠে।[২]

নিদর্শন সম্পাদনা

বর্তমানে পটগীতির প্রচলন কমে আসলেও কিছুকিছু জায়গায় এখনও এই গান শোনা যায়। বিভিন্ন গ্রন্থকার যে সকল গীতিগুলি সংকলিত করে রেখেছে সেগুলি থেকে পট গীতির কিছু ধারণা পাওয়া যায়।[৩]

পঞ্চকল্যাণী গীতি সম্পাদনা

কৃষ্ণ পটের গীতি সম্পাদনা

যম পটের গীতি সম্পাদনা

গাজীর পটগীতিকা সম্পাদনা

শিল্পী সম্পাদনা

  • দুখুশ্যাম: বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার নয়াগ্রামের একজন বিখ্যাত পটুয়া গীতিকার।[৪] তার আত্মকথায় আছে-

    নয়ায় বাড়ি পিংলা থানা
    পশ্চিম মেদিনীপুর এই ঠিকানা
    দুখুশ্যামের এই ভাবনা পট দেখিয়ে গান করি

    — দুখুশ্যাম, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৪ ডিসেম্বর ২০১১
    [৫]
  • পুলিন চিত্রকর
  • রানী চিত্রকর
  • গৌরী চিত্রকর[৬]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য। বঙ্গীয় লোক-সঙ্গীত রত্নাকর। কলকাতা: পশ্চিমবঙ্গ লোক সংস্কৃতি গবেষণা পরিষদ। পৃষ্ঠা ১০৪১। 
  2. গুরুসদয় দত্ত (১৯৩৯)। পটুয়া সঙ্গীত। কলকাতা: কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। পৃষ্ঠা পরিচায়িকা। 
  3. দুলাল চৌধুরী (১৯৪৮)। বাঙলার লোকসঙ্গীত। কলকাতা: পাঁচালি প্রকাশক। পৃষ্ঠা ১২৬। 
  4. http://shodhganga.inflibnet.ac.in/bitstream/10603/163547/9/09_chapter%205.pdf পটচিত্রকর ও পটুয়া সঙ্গীতশিল্পী
  5. "আনন্দবাজার পত্রিকা - পুস্তক পরিচয"। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৩-০৪ 
  6. http://shodhganga.inflibnet.ac.in/bitstream/10603/163547/4/04_acknowledgement.pdf