শচী
ইন্দ্রাণী (সংস্কৃত: इन्द्राणी), শচী (সংস্কৃত: शची) নামেও পরিচিত, হলেন অসুর পুলোমনের কন্যা এবং দেবরাজ ইন্দ্রের সহধর্মিণী। বিভিন্ন গ্রন্থে তাকে সুন্দরী, গৌরবান্বিত এবং দয়ালু হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ইন্দ্রের অজ্ঞাতবাসের সময় রাজা নহুষ তার অবমাননা করতে উদ্যত হলে দেবগুরু বৃহস্পতির সহায়তায় তিনি আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হন। কালিকা পুরাণ মতে, শচী হলেন দুর্গার অষ্টমাতৃকার অন্যতম দেবী ঐন্দ্রী। তাকে গজবাহনা, বজ্রহস্তা এবং সহস্রনয়নাও বলা হয়।
শচী | |
---|---|
দেবতাদের রানি | |
অন্যান্য নাম | ইন্দ্রা, ইন্দ্রাণী, ঐন্দ্রাণী, দেবরানি, পুলোমজা, পৌলমী, বাসবী |
অন্তর্ভুক্তি | দেবী, মাতৃকা, শক্তি |
আবাস | অমরাবতী, ইন্দ্রলোক, স্বর্গ |
মন্ত্র | ওঁ ঐন্দ্রী নমঃ |
অস্ত্র | বজ্র, অস্ত্র, ত্রিশূল |
দিবস | রবিবার |
বাহন | ঐরাবত |
লিঙ্গ | নারী |
উৎসব | নবরাত্রি |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
মাতাপিতা | পুলোমান (পিতা) |
সঙ্গী | ইন্দ্র |
সন্তান | জয়ন্ত, ঋষভ, মীঢুষ, জয়ন্তী, দেবসেনা (ষষ্ঠী) |
ইন্দ্রাণী (বা ঐন্দ্রী) ও সপ্ত মাতৃকা - সপ্তম দিব্য মাতার একজন । তিনি হিন্দুধর্মের একটি প্রধান সম্প্রদায় শাক্তধর্মের একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবী।[১] ইন্দ্রাণীকে স্বতন্ত্র দেবতা হিসেবে খুব কমই পূজা করা হয় এবং প্রায়শই ভারত জুড়ে ইন্দ্রের সাথে পূজা করা হয়। তিনি জৈন ও বৌদ্ধধর্মেরও একজন দেবী এবং তার জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থে উল্লেখ আছে।
ব্যুৎপত্তি এবং উপাধি
সম্পাদনাঅনেক বৈদিক দেবী-পত্নীর নাম তাদের স্বামীর নাম থেকে স্ত্রীলিঙ্গের সমাপ্তি যোগ করে উদ্ভূত হয়েছে। ইন্দ্রাণী শব্দটি তেমনি ইন্দ্র থেকে এসেছে, যার অর্থ 'ইন্দ্রের স্ত্রী'।[২][৩] তবে গুরুত্বপূর্ণভাবে ইন্দ্রও তার স্ত্রীর নামে পরিচিত; তাকে প্রায়শই শচীপতি (শচীর স্বামী), শচীন্দ্র (শচীর ইন্দ্র) বা শচীবত (শচীর অধিকারী) হিসাবে উল্লেখ করা হয়।[৪][৫]
শচী ইন্দ্রাণীর একটি বিশিষ্ট নাম। স্যার মোনিয়ার মোনিয়ার-উইলিয়ামসের মতে, এর অর্থ বক্তৃতা, বাকশক্তি বা বাকপটুতা। এটি সংস্কৃত শব্দ √ শচ্ + অ + ই, ঈ থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ বলা। শচী শক্ শব্দের সাথেও যুক্ত যার অর্থ 'শক্তি' বা 'সামর্থ'।[৪] হিন্দু দেবদেবীদের উপর গবেষণার জন্য পরিচিত অধ্যাপক ডেভিড কিন্সল বিশ্বাস করতেন যে শচী শব্দটি শক্তির মূর্ত রূপের পরবর্তী ধারণার ইঙ্গিত দেয় ।[২] অন্যান্য পণ্ডিতরা শচীর অনুবাদ হিসেবে 'দিব্য কৃপা' শব্দ ব্যবহার করেছেন।[৬] অন্যান্য নামের মধ্যে রয়েছে:
হিন্দু সাহিত্যে
সম্পাদনাবৈদিক
সম্পাদনাখ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দিকে রচিত ঋগ্বেদে ইন্দ্রাণী প্রথম আবির্ভূত হয়েছিলেন। সুবোধ কাপুরের মতে, অনেক বৈদিক দেবতা প্রাকৃতিক ঘটনাকে মূর্ত করলেও ইন্দ্রাণীর সম্পর্কে এমন কোন পৌরাণিক কাহিনী নেই যা প্রকৃতির সঙ্গে তার অস্তিত্বকে ব্যাখ্যা করে এবং ইন্দ্রের স্ত্রী হিসাবেই তিনি উদ্ভূত হতে পারেন।[১১] ভারতবিদ্যা বিশারদ জন মুইর বলেছেন যে, ঋগ্বেদে তাকে একাধিকবার আহ্বান করা হয়েছে এবং একটি অনুচ্ছেদের প্রথম তিনটিতে অন্যান্য দেবীর সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। আরেকটি স্তোত্র তাকে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান নারী বলে মনে করে, কারণ তার স্বামী ইন্দ্র বার্ধক্যের কারণে মারা যেতে পারেন না।[১২] ডেভিড কিন্সলে বলেছেন যে, প্রাথমিক গ্রন্থে অনেক দেবীর নাম তাদের স্বামীর নামে রাখা হয়েছে এবং তাদের নিজস্ব কোনো স্বতন্ত্র চরিত্র নেই। যদিও ইন্দ্রাণীকে অন্য যেকোন বৈদিক দেবী-পত্নীদের তুলনায় প্রায়শই উল্লেখ করা হয়েছে এবং তিনি তার স্বামীর আশ্রয়ে থাকেন।[২]
ঋগ্বেদের ১০.৬৮ স্তোত্রে তাকে খুব সুন্দর বলে প্রশংসা করা হয়েছে এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতি তার ঈর্ষার কথা উল্লেখ করা আছে। আরেকটি স্তোত্রে (১০.১৫৯) ইন্দ্রাণীকে গর্বিত হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং দাবি করা হয়েছে যে তিনি তার স্বামীকে জয় করেছেন, স্বামী তার ইচ্ছার বশ্যতা স্বীকার করেন। তা সত্ত্বেও, একই স্তোত্রে, ইন্দ্রাণী দেবতাদের ইন্দ্রের পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বীদের হাত থেকে মুক্তি দিতে বলেন।[২] ঋগ্বেদের একটি স্তোত্র ইন্দ্রাণী এবং ইন্দ্রের মধ্যে ঝগড়ার জন্য উৎসর্গীকৃত, যেখানে তিনি বৃষকাপি-ইন্দ্রের পোষা বনমানুষের ঠাট্টায় বিরক্ত হন এবং এটি সম্পর্কে অভিযোগ করেন।[১১]
শতপথ ব্রাহ্মণ ইন্দ্রাণীকে ইন্দ্রের প্রিয়তমা বলে উল্লেখ করেছেন। তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণের মতানুসারে ইন্দ্র সৌন্দর্য এবং কামুকতার কারণে ইন্দ্রাণীকে অন্যান্য দেবীর মধ্যে বেছে নিয়েছিলেন।[৬] পণ্ডিতরা উল্লেখ করেছেন যে ঐতরেয় ব্রাহ্মণ প্রসাহ এবং সেনকে ইন্দ্রের স্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং তাদের দুজনকেই ইন্দ্রাণী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।[৫]
মহাকাব্য ও পুরাণ
সম্পাদনারামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণ সহ পরবর্তী হিন্দু গ্রন্থগুলিতে, ইন্দ্রাণীকে সাধারণত শচী হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তিনি ঋষি কশ্যপ এবং তাঁর স্ত্রী দানুর পুত্র অসুর (দানবীয় ব্যক্তিত্ব) পুলোমনের কন্যা। তিনি ইন্দ্রকে বিয়ে করেন এবং দেবতাদের রানী হন।[১৩] ভাগবত পুরাণে উল্লেখ আছে যে ইন্দ্র ও শচীর জয়ন্ত, ঋষভ ও মধুষ নামে তিন পুত্র ছিল।[৬] আরও কিছু গ্রন্থে নীলাম্বরা এবং রিভু নামে সন্তানের উল্লেখ পাওয়া যায়।[১৪] ইন্দ্র এবং শচীর জয়ন্তী নামে একটি কন্যা ছিল, যিনি ইন্দ্রের প্রতিদ্বন্দ্বী শুক্রকে বিয়ে করেছিলেন। কিছু শাস্ত্রে, ইন্দ্র এবং শচী তাদের কন্যা দেবসেনার কার্তিকের সাথে বিয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।[১০]
লেখক জেমস জি লোচটেফেল্ড মন্তব্য করেছেন যে শচী একজন প্রধান ব্যক্তিত্ব নন এবং এটি পরবর্তী হিন্দু পুরাণে ইন্দ্রের হ্রাসপ্রাপ্ত মর্যাদা প্রতিফলিত করতে পারে। তিনি দাবি করেন, একমাত্র নহুষের গল্পে শচীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।[১৫] মহাভারত অনুসারে, ইন্দ্র বৃত্রকে হত্যা করে ব্রাহ্মণ হত্যার পাপ করেছিলেন। তারপর তিনি তপস্যা করার জন্য ছদ্মবেশে যাত্রা করেছিলেন। এই সময়কালে, দেবতারা চন্দ্র রাজবংশের একজন শক্তিশালী নশ্বর শাসক নহুষকে স্বর্গের রাজা নিযুক্ত করেছিলেন।[১৬] তিনি শীঘ্রই তার ক্ষমতার জন্য অহংকার পূর্ণ হয়েছিলেন এবং শচীকে কামনা করেছিলেন। কিন্তু শ্চী তার প্রেমময় অগ্রগতি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং ইন্দ্রের শিক্ষক বৃহস্পতির কাছে সুরক্ষা চেয়েছিলেন।[১৭] নহুষের অবৈধ আচরণে ক্রুদ্ধ হয়ে দেবতারা শচীকে পরামর্শ দেন ইন্দ্রকে ফিরিয়ে আনার জন্য এবং একটি পরিকল্পনা তৈরি করে শচী নহুষের কাছে যান। তিনি নহুষকে বলেছিলেন যে, ইন্দ্রকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত তাকে অপেক্ষা করতে হবে। নহুষ সম্মতি জানাল। অন্যদিকে ইন্দ্রকে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল এবং তিনি নিজের পাপ থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। নহুষ রাজা হওয়ায় কারণে তিনি ফিরে আসতে অস্বীকার করেছিলেন এবং আবার আত্মগোপন করেছিলেন। দেবী উপশ্রুতির সাহায্যে শচী ইন্দ্রকে মানসরোবর হ্রদে খুঁজে পান।[১৮] ইন্দ্র শচীকে পরামর্শ দেন দেবরাজ পদ থেকে নহুষকে অপসারণের পরিকল্পনা করার জন্য। তিনি নহুষের কাছে ফিরে আসেন এবং তাকে ঋষিদের দ্বারা চালিত একটি পালকিতে তার কাছে আসতে বলেন। নহুষ তার অধৈর্যতা ও অহংকারের কারণে পালকিতে চড়ে অগস্ত্য ঋষিকে লাথি মেরেছিলেন। অগস্ত্য নহুষকে স্বর্গ থেকে পতনের অভিশাপ দেন এবং তাকে সাপে রূপান্তরিত করেন। এরপর ইন্দ্র স্বর্গের রাজা হিসাবে ফিরে আসেন এবং শচীর সাথে পুনরায় মিলিত হন।[১৯][২০][২১][১৫]
রামায়ণের আরেকটি গল্প অনুসারে, দৈত্য হিরণ্যকশিপুর পুত্র অনুহ্লাদা শচীকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি রাজি হননি। ফলস্বরূপ, তিনি পুলোমনের কাছ থেকে জোর করে তাকে অপহরণ করে বিয়ে করার অনুমতি নেন। ইন্দ্র অপহরণের সময় অনুহ্লাদা ও শচীকে দেখতে পান এবং অনুহ্লাদা ও পুলোমনকে হত্যা করে স্ত্রীকে রক্ষা করেন।[১৩][২২][ক] দক্ষিণ ভারতীয় গ্রন্থ কাণ্ড পুরাণ বর্ণনা করে যে যখন অসুর সুরপদ্মন শচীকে কামনা করেছিলেন, তখন ইন্দ্র দেবতা শাস্তকে তার রক্ষক নিযুক্ত করেছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে, সুরপদ্মনের বোন শচীর কাছে আসেন এবং অসফলভাবে তাকে অসুরকে বিয়ে করার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করেন।[২৩][২৪] মহাকাব্যগুলিতে, শচীর সৌন্দর্য এবং ভক্তি রোহিণী, অরুন্ধতী, সীতা এবং দ্রৌপদী সাথে তুলনা করা হয়েছে।[২৫][২৬] মহাভারতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে যে দ্রৌপদী ছিলেন শচীর অবতার, যদিও দ্রৌপদীকে পাঠ্যের পূর্ববর্তী অন্যান্য অধ্যায়ে শ্রীর অবতার হিসেবে প্রশংসা করা হয়েছে।[২৭]
পুরাণগুলি প্রমাণ করে যে শচী পারিজাত গাছের মালিক ছিলেন। এই গাছটি ছিল সমুদ্র মন্থন থেকে আগত রত্নগুলির মধ্যে একটি। বিষ্ণু পুরাণ এবং ভাগবত পুরাণে, দেবতা কৃষ্ণ এবং তাঁর স্ত্রী সত্যভামা ইন্দ্রের মা অদিতির কানের দুল ফেরত দিতে অমরাবতীতে গিয়েছিলেন, যেগুলি নরকাসুর রাক্ষস চুরি করেছিল। শচী সত্যভামাকে তার নশ্বর পটভূমির কারণে নিকৃষ্ট মনে করতেন এবং অদিতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় তিনি তার সাথে সঠিক আচরণ করেননি।[২৩] পরে, ইন্দ্রের বাগানে ভ্রমণের সময়, সত্যভামা পারিজাত গাছটি দেখেন এবং এটি দ্বারকায় প্রতিস্থাপন করার সিদ্ধান্ত নেন। শচীর রক্ষীরা যখন সত্যভামাকে সতর্ক করে, তখন তিনি শচীর কাছে স্পর্ধা করে বলেন ইন্দ্র যদি সত্যিই তার ইচ্ছার প্রতি বশীভূত হন তাহলে যেন গাছটিকে রক্ষা করেন। একজন প্রহরীর কাছ থেকে সত্যভামার কথা শোনার পর, শচী তার স্বামীকে তার অধিকার ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য জোর দিয়েছিলেন। ইন্দ্র ও কৃষ্ণের মধ্যে একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যাতে ইন্দ্র বিজয়ী হন এবং গাছটিকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন।[২৮][২৯]
মাতৃকার সাথে সংযোগ
সম্পাদনাহিন্দুধর্মের দেবী-ভিত্তিক সম্প্রদায় শাক্তধর্মে, ইন্দ্রাণী (বা ঐন্দ্রী) হলেন সপ্ত মাতৃকা - সাতটি ঐশ্বরিক মাতার একটির নাম। কখনও কখনও, ইন্দ্রের স্ত্রী এবং মাতৃকাকে এক দেবীতে সমান করা হয়।[১]
মাতৃকাদের কিংবদন্তি বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। দেবীমাহাত্ম্যম্ মতে, যখন দেবতারা শক্তিশালী রাক্ষস শুম্ভ ও নিশুম্ভ কে পরাজিত করতে পারেননি, তখন তাদের শক্তি রাক্ষসকে পরাজিত করার জন্য নিজেদের রুপায়িত করে তুলেছিল। ইন্দ্রাণীকে ইন্দ্র থেকে উদ্ভূত বলে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তার অনুরূপ বৈশিষ্ট্য রয়েছে।[৩০][৩১] দেবী মাহাত্ম্যমের পরবর্তী অধ্যায় অনুসারে, যখনই রক্তের একটি ফোঁটা মাটিতে পৌঁছেছিল তখনই নিজেকে বৃদ্ধি করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি রাক্ষস রক্তবীজকে পরাজিত করার জন্য মাতৃকারা আবার আবির্ভূত হয়েছিল। এই যুদ্ধে পরম দেবীর বিভিন্ন অংশ থেকে মাতৃকাদের আবির্ভাব ঘটে।[৩২][৩৩]
বরাহ পুরাণ ইন্দ্রাণীকে ঈর্ষার সাথে এবং প্রতিটি মাতৃকাকে একটি আবেগের সাথে যুক্ত করেছে।[৩৩]
মূর্তিতত্ত্ব ও পূজা
সম্পাদনাহিন্দু মন্দিরে ইন্দ্রাণী ও ইন্দ্রের ভাস্কর্যে সাধারণত তাদের সাদা হাতির ঐরাবতের উপর বসে চিত্রিত করা হয়। বিষ্ণুধর্মোত্তরে বর্ণিত মূর্তিতত্ত্ব ব্যাখ্যা করার সময়, প্রত্নতত্ত্ববিদ টি.এ. গোপীনাথ রাও লিখেছেন যে ইন্দ্রাণী দ্বি-ভুজা এবং তাকে তার স্বামীর কোলে উপবিষ্ট অবস্থায় চিত্রিত করা হয়। তিনি সোনালী গাত্রবর্ণের অধিকারী এবং নীল বস্ত্র পরিহিত। তার একটি হাত ইন্দ্রকে আলিঙ্গন করে এবং অন্যটি একটি সান্তনা-মঞ্জরী বহন করে।[৩৪]
রোয়া বর্ণনা করেছেন মাতৃকা ইন্দ্রাণীর গায়ের রং লাল, তিনটি চোখ ও চার হাত বিশিষ্ট বলে। তার দুটি হাত বরদা ও অভয় মুদ্রায় থাকে এবং অন্য দুটি হাতে একটি বজ্র ও একটি বর্শা রাখা হয়। তিনি তার মাথায় একটি কিরীট পরেন এবং বিভিন্ন অলঙ্কারে সজ্জিত থাকেন। তার বাহন ও প্রতীক একটি হাতি।[৩৫] বিষ্ণুধর্মোত্তর মতে ইন্দ্রের মতো ইন্দ্রাণীরও গাত্রবর্ণ হলুদ এবং তার এক হাজার চোখ আছে। তার ছয়টি বাহু রয়েছে, যার মধ্যে চারটিতে সূত্র, বজ্র, ঘট এবং পাত্র রয়েছে। বাকি দুটি অভয় এবং বরদা মুদ্রায় রয়েছে। দেবী ভাগবত পুরাণে বলা হয়েছে যে শচীর দুটি বাহু রয়েছে। যাতে একটি অঙ্কুশ এবং বজ্র লক্ষ্য করা যায় । অন্যদিকে পূর্বা করঙ্গমা তাকে দুই চোখযুক্ত এবং এক হাতে একটি পদ্ম বহনকারী হিসাবে চিত্রিত করেছে।[৩৫][১০] কিছু জায়গায় কল্পতরুর সাথে ইন্দ্রাণীর সংযোগ পাওয়া যায় এবং কখনও কখনও একটি সিংহকে তার বাহন হিসাবে উল্লেখ করা হয়।[৩৬]
ইন্দ্রাণীকে সাধারণত ইন্দ্রের সাথে পূজা করা হয় এবং খুব কমই স্বাধীন দেবতা হিসেবে পূজা করা হয়। লেখক রোশেন দালাল বলেছেন যে ইন্দ্র এবং ইন্দ্রাণী হলেন বিদর্ভের রাজপরিবারের কুল দেবতা। ভাগবত পুরাণে, কৃষ্ণের প্রধান স্ত্রী রুক্মিণী ইন্দ্র ও শচীর উদ্দেশ্যে তৈরি একটি মন্দির পরিদর্শন করেছিলেন।[৩৭] হিন্দু জ্যোতিষশাস্ত্রে, ইন্দ্রাণীকে শুক্রের শাসক এবং রজঃ গুণের প্রতীক হিসেবে উল্লেখ করা হয়।[৩৮] ৭ম শতাব্দীর হর্ষচরিত দেবী ইন্দ্রাণীর মন্দিরে চারণদের সমবেত হওয়ার কথা উল্লেখ আছে।[৩৯] আধুনিক সময়ে, ইন্দ্রাণীকে কখনও কখনও সম নামের মাতৃকার সাথে সমতুল্য করা হয় এবং অন্যান্য মাতৃকাদের সাথে পূজা করা হয়। আষাঢ় মাসে নবরাত্রির সময় ইন্দ্রাণীকে উৎসর্গ করে একটি পূজা করা হয়।[৪০]
অন্যান্য ধর্মে
সম্পাদনাঅন্যান্য ধর্মেও ইন্দ্রাণীর স্বল্প ভূমিকার উল্লেখ পাওয়া যায়। জৈন ঐতিহ্যে, ইন্দ্রাণী ইন্দ্রের একটি প্রতিফলিত রূপ এবং তারা আদর্শ দম্পতির প্রতিনিধিত্ব করেন।[৪১] পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, যখন একজন তীর্থংকর জন্মগ্রহণ করেন, তখন ইন্দ্র তার সহধর্মিণী ইন্দ্রাণীর সাথে মহান হাতি ঐরাবতে চড়ে ঘটনাটি উদযাপন করতে নেমে আসেন।[৪২]
বৌদ্ধ পালি ত্রিপিটকে, ইন্দ্রাণীকে শক্রের স্ত্রী সুজা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।[৪১] অসুর বেমচিত্রিন (সংস্কৃত: वेमचित्रिन्)-এর কন্যা সুজা নিজেকে শুদ্ধ করতে এবং শক্রের স্ত্রী হওয়ার জন্য একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন এবং বহুবার পুনর্জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। ভেমচিত্রিনকে উপযুক্ত দণ্ড দেওয়ার জন্য শক্র একজন বৃদ্ধ অসুরের ছদ্মবেশে সুজার কাছে এসে তাকে নিয়ে যান। বেমচিত্রিনকে পরাজিত করার পর সুজা ও শক্র বিয়ে করেন এবং সুজা তার প্রধান সহধর্মিণী হন।[৪৩]
মন্তব্য
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনাউদ্ধৃতি
সম্পাদনা- ↑ ক খ Chandra 1998।
- ↑ ক খ গ ঘ Kinsley 1988, পৃ. 17।
- ↑ Monier-Williams 1872, পৃ. 141।
- ↑ ক খ Monier-Williams 1872, পৃ. 989।
- ↑ ক খ Dalal 2014, পৃ. 164।
- ↑ ক খ গ ঘ Daniélou 1991, পৃ. 109।
- ↑ Gandhi 1993, পৃ. 158।
- ↑ ক খ Dalal 2014, পৃ. 165–166।
- ↑ Gandhi 1993, পৃ. 89।
- ↑ ক খ গ ঘ Dalal 2014।
- ↑ ক খ Kapoor 2002, পৃ. 969।
- ↑ Muir 1870।
- ↑ ক খ Dalal 2014, পৃ. 166।
- ↑ Jordan 2014।
- ↑ ক খ Lochtefeld 2001, পৃ. 297।
- ↑ Mani 1975, পৃ. 516।
- ↑ Mani 1975, পৃ. 660।
- ↑ Sarkar 1989, পৃ. 126।
- ↑ Debroy 2015।
- ↑ Mani 1975, পৃ. 6।
- ↑ Sinha 2020।
- ↑ Debroy 2017a।
- ↑ ক খ Mani 1975, পৃ. 330।
- ↑ Dalal 2014, পৃ. 399।
- ↑ Mukherjee 1999, পৃ. 29, 39।
- ↑ Debroy 2017b।
- ↑ Brodbeck ও Black 2007, পৃ. 136।
- ↑ Bhattacharya 1996।
- ↑ Cush, Robinson এবং York 2012, পৃ. 775।
- ↑ Kinsley 1988, পৃ. 156।
- ↑ Cush, Robinson এবং York 2012, পৃ. 739।
- ↑ Kinsley 1988, পৃ. 159।
- ↑ ক খ Leeming ও Fee 2016।
- ↑ Gopinatha Rao 1916, পৃ. 520।
- ↑ ক খ Rao 1997, পৃ. 385।
- ↑ Stutley 2019।
- ↑ Dalal 2014, পৃ. 165।
- ↑ Kalomiris 2019।
- ↑ Datta, Amaresh (১৯৮৮)। Encyclopaedia of Indian Literature: Devraj to Jyoti (ইংরেজি ভাষায়)। Sahitya Akademi। আইএসবিএন 978-81-260-1194-0। ২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ অক্টোবর ২০২৩।
In his Harshacharita Bana informs that Charanas of various branches had come from far off places and assembled in a small room where the goddess Indrani was worshipped.
- ↑ Banerjee, Nikita (এপ্রিল ৮, ২০১৯)। "Ashtami – Why is Ashtami the most important day during Navratri?"। The Times of India (ইংরেজি ভাষায়)। ৩ জুন ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ জুন ২০২১।
- ↑ ক খ Appleton 2016।
- ↑ Goswamy 2014, পৃ. 245।
- ↑ "Suja, Sujā: 6 definitions"। www.wisdomlib.org। ১২ এপ্রিল ২০০৯। ২৯ এপ্রিল ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ এপ্রিল ২০২১।
সূত্র
সম্পাদনা- Kinsley, David (১৯৮৮)। Hindu Goddesses: Visions of the Divine Feminine in the Hindu Religious Tradition। University of California Press। পৃষ্ঠা 17–18; 156–158। আইএসবিএন 978-0-520-90883-3।
- Monier-Williams, Monier (১৮৭২)। A Sanskrit-English Dictionary (ইংরেজি ভাষায়)। Clarendon।
- Dalal, Roshen (১৮ এপ্রিল ২০১৪)। Hinduism: An Alphabetical Guide (ইংরেজি ভাষায়)। Penguin UK। আইএসবিএন 978-81-8475-277-9।
- Leeming, David; Fee, Christopher (১৫ মার্চ ২০১৬)। The Goddess: Myths of the Great Mother (ইংরেজি ভাষায়)। Reaktion Books। আইএসবিএন 978-1-78023-538-7।
- Mani, Vettam (১৯৭৫)। Puranic encyclopaedia : a comprehensive dictionary with special reference to the epic and Puranic literature। Robarts – University of Toronto। Delhi : Motilal Banarsidass। পৃষ্ঠা 330, 660।
- Sinha, Purnendu Narayana (২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)। A Study of the Bhagavata Purana: Or, Esoteric Hinduism (ইংরেজি ভাষায়)। Library of Alexandria। আইএসবিএন 978-1-4655-2506-2।
- Daniélou, Alain (ডিসেম্বর ১৯৯১)। The Myths and Gods of India: The Classic Work on Hindu Polytheism from the Princeton Bollingen Series (ইংরেজি ভাষায়)। Inner Traditions / Bear & Co। আইএসবিএন 978-0-89281-354-4।
- Bhattacharya, Sunil Kumar (১৯৯৬)। Krishna-cult in Indian Art (ইংরেজি ভাষায়)। M.D. Publications Pvt. Ltd.। আইএসবিএন 978-81-7533-001-6।
- Mukherjee, Prabhati (১৯৯৯)। Hindu Women: Normative Models। Calcutta: Orient Blackswan। আইএসবিএন 81-250-1699-6।
- Gandhi, Maneka (১৯৯৩)। The Penguin Book of Hindu Names (ইংরেজি ভাষায়)। Penguin Books India। আইএসবিএন 978-0-14-012841-3।
- Lochtefeld, James G. (১৫ ডিসেম্বর ২০০১)। The Illustrated Encyclopedia of Hinduism, Volume 1 (ইংরেজি ভাষায়)। The Rosen Publishing Group, Inc। আইএসবিএন 978-0-8239-3179-8।
- Brodbeck, Simon; Black, Brian (৯ আগস্ট ২০০৭)। Gender and Narrative in the Mahabharata (ইংরেজি ভাষায়)। Routledge। আইএসবিএন 978-1-134-11995-0।
- Debroy, Bibek (২০১৭a)। The Valmiki Ramayana: Vol. 2 (ইংরেজি ভাষায়)। Penguin Random House India Private Limited। আইএসবিএন 978-93-87326-27-9।
- Debroy, Bibek (২০১৭b)। The Valmiki Ramayana: Vol. 3 (ইংরেজি ভাষায়)। Penguin Random House India Private Limited। আইএসবিএন 978-93-87326-28-6।
- Jordan, Michael (১৪ মে ২০১৪)। Dictionary of Gods and Goddesses (ইংরেজি ভাষায়)। Infobase Publishing। আইএসবিএন 978-1-4381-0985-5।
- Stutley, Margaret (৯ এপ্রিল ২০১৯)। The Illustrated Dictionary of Hindu Iconography (ইংরেজি ভাষায়)। Routledge। আইএসবিএন 978-0-429-62425-4।
- Muir, John (১৮৭০)। Original Sanskrit Texts on the Origin and History of the People of India, Their Religion and Institutions: Contributions to a knowledge of the cosmogony, mythology, religious ideas, life and manners, of the Indians in the Vedic age. Volume fifth (ইংরেজি ভাষায়)। Trübner & Company।
- Rao, T. A. Gopinatha (১৯৯৭)। Elements of Hindu Iconography (ইংরেজি ভাষায়)। Motilal Banarsidass Publishe। আইএসবিএন 978-81-208-0876-8।
- Gopinatha Rao, T. A. (১৯১৬)। Elements Of Hindu Iconography, Vol. II Part II।
- Kapoor, Subodh (২০০২)। Encyclopaedia of Vedic Philosophy: The Age, Religion, Literature, Pantheon, Philosophy, Traditions, and Teachers of the Vedas (ইংরেজি ভাষায়)। Cosmo। আইএসবিএন 978-81-7755-357-4।
- Cush, Denise; Robinson, Catherine; York, Michael (২১ আগস্ট ২০১২)। Encyclopedia of Hinduism (ইংরেজি ভাষায়)। Routledge। আইএসবিএন 978-1-135-18978-5।
- Chandra, Suresh (১৯৯৮)। Encyclopaedia of Hindu Gods and Goddesses (ইংরেজি ভাষায়)। Sarup & Sons। আইএসবিএন 978-81-7625-039-9।
- Kalomiris, James (৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯)। The Vedic Astrologer: The Spiritual Legacy of the Nakshatras (ইংরেজি ভাষায়)। Balboa Press। আইএসবিএন 978-1-9822-2638-1।
- Debroy, Bibek (১ জুন ২০১৫)। The Mahabharata: Volume 4 (ইংরেজি ভাষায়)। Penguin UK। আইএসবিএন 978-81-8475-534-3।
- Sarkar, Rabindra Nath (১৯৮৯)। An Episodic Interpretation of the Mahabharata (ইংরেজি ভাষায়)। Atlantic Publishers & Distri।
- Goswamy, B. N. (২০১৪)। The Spirit of Indian Painting: Close Encounters with 100 Great Works 1100–1900। Penguin Books। আইএসবিএন 978-0-670-08657-3।
- Appleton, Naomi (২৫ নভেম্বর ২০১৬)। Shared Characters in Jain, Buddhist and Hindu Narrative: Gods, Kings and Other Heroes (ইংরেজি ভাষায়)। Routledge। আইএসবিএন 978-1-317-05574-7।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- উইকিমিডিয়া কমন্সে শচী সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।