ত্রিশূল

দেবতা শিব কর্তৃক ব্যবহৃত প্রধাণ অস্ত্র।

ত্রিশূল (সংস্কৃত ভাষা: त्रिशूल) হলো ধারালো তিনটি বর্শার ফলাযুক্ত একটি অস্ত্রবিশেষ, যা সাধারণভাবে হিন্দুধর্মবৌদ্ধধর্মে শুভ চিহ্ন হিসাবে পরিগণিত হয়৷

ত্রিশূল

দিল্লির রংপুরীতে ত্রিশূল হাতে ভগবান শিবের মূর্তি
প্রকার তিনটি শূল যুক্ত
উদ্ভাবনকারী দক্ষিণ এশিয়ার দেশ: ভারত, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল , আফগানিস্তান, মালদ্বীপ, পাকিস্তান (বৌদ্ধ এবং হিন্দুদের জন্য), বাংলাদেশ
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশ: থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া

ভারতীয় উপদ্বীপ এবং থাইল্যান্ডে ত্রিশূল ছোটো আকারে কোনো লাঠি বা দণ্ডের চূড়ায় লাগানো থাকা অবস্থায় দেখা যায়৷ কিন্তু ওকিনাওয়ার সাই অস্ত্রের মতো এটি ভোঁতা নয় বরং প্রতিটি ফলাই ধারালো৷ মালয় উপদ্বীপ এবং ইন্দোনেশিয়াতে ত্রিশূল সবসময়ই লম্বা হাতলযুক্ত হয়ে থাকে এবং এটির ছোট আকিরের একই রকম দেখতে অস্ত্রটিকে স্থানীয় ভাবে ত্রিশূল না বলে বরং "চবঙ" বা "তেকপি" বলা হয়ে থাকে৷

নামকরণ

সম্পাদনা

ত্রিশূল শব্দের আক্ষরিক অর্থ তিনটি শূলের সমষ্টি৷ শূল বলতে সূঁচালো মাথাযুক্ত এবং ধারালো ফলাযুক্ত একটি ধাতব অস্ত্র৷ ত্রিশূলে তিনটি শূল একটি দণ্ডে গোড়ায় যুক্ত থাকে৷

বিভিন্ন ভাষায় ত্রিশূলের নামগুলি হলো,

প্রতীকতা

সম্পাদনা

ত্রিশূল হলো বহুযোজীতা এবং সমৃৃদ্ধির প্রতীক৷ এটি মূলক ভগবান শিবের চিহ্নরূপে তার হাতে বিরাজমান থাকে৷ পুরাণ মতে নিজপুত্র গণেশএর অহংকার এবং ঔদ্ধত্য দেখে ক্রোধের বশে তিনি এই ত্রিশূল দিয়েই গণেশের শিরোচ্ছেদ করেছিলেন৷ দেবী দূর্গাও তার অন্যান্য অস্ত্রের সাথে ত্রিশূল ধারণ করেন৷ ত্রিশূলের তিনটি ফলার একাধিক অর্থ ও গূরুত্ব রয়েছে৷ এটি হিন্দূ ধর্মাবলম্বীদের খুব সাধারণ একটি বিষয় এবং এর তাৎপর্যের পেছনে একাধিক পুস্তকে বিভিন্ন ব্যাখ্যা রয়েছে৷ ত্রিশূলের তিনটি ফলা জীবনের বিভিন্ন ত্রিত্বগুণকে উপস্থাপন করে৷ ত্রিত্ব বৈশিষ্ট্যগুলি হলো, সৃষ্টি-স্থিতি-বিনাশ, অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত, দেহ-মন-আত্মা, ধর্ম-সিদ্ধি-উদ্গম দিয়ে তৈরী ত্রিকায়া, সমবেদনা-আনন্দ-ভালোবাসা, আধ্যাত্মিকতা-মনস্তত্ত্ব-আপেক্ষিকতা, সুখ-স্বস্তি-বিষণ্ণতা, গর্ব-খ্যাতি-আমিত্ব, স্পষ্টতা-জ্ঞান-পাণ্ডিত্য, স্বর্গ-মন-পৃৃথিবী, অহং-অগ্নি-ভূ, আত্মা-আবেগ-জীব, যুক্তি-আসক্তি-বিশ্বাস, প্রার্থনা-প্রকাশ-মহিমা, প্রজ্ঞা-ধ্যান-বোধিসত্ত্ব, অধ্যয়ন-বোধগম্যতা-জ্ঞান, মৃত্যু-উত্তরণ-পুনরুজ্জীবন, সৃৃষ্টি-আদেশ-বিনাশ৷ এরকম তিনটি গুণের প্রকাশকে একত্রে ত্রিশূলের রূপ হিসাবে মনে করা হয়৷ ত্রিশূলকে যখন ভগবান শিবের শিবের অস্ত্র হিসাবে ধরা হয় তখন ত্রিশূল তিনটি বস্তুকে ধ্বংস করতে উদ্যত হয় যথা, ভৌতিক বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, পিতৃৃপুরুষগণের বিশ্ব এবং মনোজগৎ৷ শিবের একটি হুংকারে তিনি ত্রিভূবন ধ্বংস করতে পারেন বলে ধারণা করা হয়৷

মানবদেহে যেই অঞ্চলে তিনটি যোগ নাড়ী তথা ইড়া, পিঙ্গল এবং সুষুম্না একত্রে মিলিত হয় তাকেও ত্রিশূল বলে ধরা হয়ে থাকে৷ এটি সাধারণত ভ্রূমধ্যস্থল৷ সুষুম্না হলো মধ্যস্থ নাড়ী এবং এটি আরো ঊর্ধ্বে উত্থিত হয়ে ব্রহ্মতালু স্থলে সপ্তম চক্র বা শক্তিকেন্দ্রটি সম্পন্ন করেছে৷ অপর দুটি উভয় ভ্রূ বরাবর শেষ হয়েছে যেখানে ষষ্ট চক্রটি রয়েছে৷ ত্রিশূলের মধ্যাক্ষটি এই সুষুম্নার প্রতিভূ, ফলে এটি বাকী দুটির থেকে অধিক দীর্ঘ৷

অন্যান্য উল্লেখ

সম্পাদনা

১) শিবপুরাণ অনুসারে শিব হলেন স্বয়ম্ভু যিনি নিজের চেতনায় নিজ ইচ্ছায় সৃৃষ্ট হন৷ তিনি সদাশিবের সরাসরি অবতার রূপে উত্থিত হন এবং সৃষ্টির প্রথম থেকে ত্রিশূল তার সঙ্গী৷

২) বিষ্ণুপুরাণ অনুসারে সূর্যের তেজ ও রশ্মির ব্যবহার করে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা ত্রিশূল নির্মাণ করেন এবং তা শিবকে প্রদান করেন৷ সূর্যদেব বিশ্বকর্মার কন্যা সংজ্ঞাকে বিবাহ করলে তার স্ত্রী এই বিষয়ে বেশ অসন্তুষ্ট হন৷ তার মতে তার কন্যার পক্ষে সূর্যের তেজ সহন করা সম্ভব না৷ তিনি তার স্বামী বিশ্বকর্মাকে এ নিয়ে অভিযোগ করেন ও এর নিষ্পত্তি চান৷ উভয়ের আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সংজ্ঞাকে পাওয়ার জন্য সূর্যদেব নিজ তেজ হ্রাস করতে ইচ্ছুক হন৷ সৌরবস্তু পৃথিবীতে পতিত হয় ও সূর্যতেজ হ্রাস পায়৷ এক অষ্টমাংশ ঐ সৌরবস্তু ব্যবহার করেই তিনি পৃথিবীকে তাপ হতে নিস্তার দিতে ত্রিশূল তৈরী করেন৷

৩) অনেকক্ষেত্রে ত্রিশূলকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ত্রিরত্নের সাথেও তুলনা করা হয়ে থাকে৷

৪) দেবী দুর্গা তার অন্যান্য হাতে একাধিক অস্ত্রের সাথে ত্রিশূলও ধারণ করেন৷ দেবজ্যোতির পুঞ্জীভবনে উৎপন্ন হওয়ার পর মহিষাসুর বধের জন্য বিভিন্ন দেবতা তাকে বিভিন্ন অস্ত্রদান করেন৷ ভগবান শিব তাকে এই ত্রিশূলটি দান করেছিলেন৷ শ্বেতবরাহ কল্পে দেবী মহিষাসুরকে ত্রিশূল দিয়েই বধ করেন৷ পরবর্তীকালে শিব; দেবী তথা পার্বতীতে পত্নীরূপে গ্রহণ করেন৷

৫) নেপালের সাম্যবাদী দল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির নির্বাচনী চিহ্নটি হলো ত্রিশূল৷[]

৬) রোমানি ভাষায় ত্রিশূলের সমোচ্চারিত শব্দ ত্রিশেল শব্দটির অর্থ ক্রস বা ক্রুশ৷

চিত্রাবলী

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "पार्टीको सूची — Election Commission of Nepal"। ২০১৩-১১-০২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-১৪ 
  2. Wat Arun The trident of Shiv extends from the top of each tower. ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০০৭-০৬-২৮ তারিখে