কার্তিক (দেবতা)

হিন্দু দেবতা

কার্তিকেয় বা কার্তিক (সংস্কৃত: कार्त्तिकेय, প্রতিবর্ণীকৃত: Kārttikeya), অন্য নাম স্কন্দ[১], সুব্রাহ্মণ্য, শণমুখা (প্রতিবর্ণীকৃত:Ṣaṇmukha) এবং Murugan (তামিল: முருகன்)। তাকে যুদ্ধের দেবতা ও দেব সেনাপতিও বলা হয়।[২][৩][৪] তিনি শিবপার্বতীর সন্তান এবং গণেশের সহোদর। কার্তিক পৌরাণিক দেবতাপ্রাচীন ভারতে সর্বত্র কার্তিক পূজা প্রচলিত। ভারতে ইনি এক প্রাচীন দেবতা রূপে পরিগণিত হন। কার্তিক প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় উপমহাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ দেবতা, উত্তর ভারতে মহাসেন এবং কুমার হিসাবে উপাসনা করা হয় এবং প্রধানত তামিলনাড়ু রাজ্য এবং দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য অংশ, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং মরিশাসে মুরুগান হিসাবে পূজা করা হয়। তার অন্যান্য নামগুলো হলো কৃত্তিকাসুত, আম্বিকেয়, নমুচি, মুরুগান, শিখিধ্বজ, অগ্নিজ, বাহুলেয়, ক্রৌঞ্চারতি, শর্জ, তারকারি বা তারকাসুরমর্দী, শক্তিপাণি, বিশাখ, ষড়ানন, গুহ, ষান্মাতুর, কুমার, সৌরসেনা, দেবসেনাপতি গৌরীসুত, আগ্নিক, ভৌরবসূতানুজ, মহাকুমাররাজ, গণেশানুজ ইত্যাদি।

কার্তিক
দেব সেনাপতি এবং বিজয়ের দেবতা
বাটু গুহা মন্দিরে কার্তিকের মূর্তি
অন্যান্য নামমুরুগান, মহাসেন, সুব্রমণ্য, কুমার, স্কন্দ, সারাবণ, অরুমুগান, দেবসেনাপতি, শণমুখা, কাথিরভেলান, গুহ, স্বামীনাথ, ভেলাউদা, ভেল
দেবনাগরীकार्त्तिकेय
কন্নড় লিপিಸುಬ್ರಹ್ಮಣ್ಯ
অন্তর্ভুক্তিদেব, সিদ্ধর
আবাসকৈলাশ পর্বত
গ্রহমঙ্গল
মন্ত্রওম কার্তিকেয়ায় বিদ্মহে গৌরীপুত্রায় ধিমহি তন্নো স্কন্দ প্রচোদয়াৎ॥
অস্ত্রধনুক, বাণ ও শক্তি (বেলাস্ত্র)
দিবসমঙ্গলবার
বাহনময়ূর
লিঙ্গপুরুষ
উৎসব
ব্যক্তিগত তথ্য
মাতাপিতা
সহোদরগণেশ (ভাই)
অশোকসুন্দরী (বোন)
সঙ্গীদেবসেনাবল্লী


কার্তিকের মূর্তীতে বিস্তর বিভিন্নতা দেখা যায়; তাকে সাধারণত চিরযৌবনপ্রাপ্ত যুবক হিসেবে চিত্রিত করা হয়, পারবনি[৫] নামের একটি ময়ূর বাহনে আসীন অথবা তার পাশে দেখা যায়, হাতে একটি শক্তিশূল (যা তার মা পার্বতী তাকে দিয়েছিল) কখনো মস্তক বা ব্যানারের উপর একটি মোরগের চিহ্নযুক্ত থাকে। বেশিরভাগ মূর্তী বা চিত্রে থাকে এক মাথার দেখা গেলেও কিছু ক্ষেত্রে তাকে ৬টি মাথার দেখানো হয়, যা তার জন্মকে ঘিরে কিংবদন্তীরই প্রতিফলন।[২][৩][৬]

ছয় মাথার কার্তিক বা মুরুগান তার বাহন ময়ূরে আসীন, সঙ্গে তার স্ত্রী বল্লী এবং দেবসেনা, ময়ূরটি একটি সাপকে মাড়িয়ে যাচ্ছে। শ্রী শণমুখা সুব্রাহ্মণ্য —স্বামী রাজা রবিবর্মা অঙ্কিত

ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় দক্ষিণ ভারতে কার্তিকের পূজা অধিক জনপ্রিয়। তামিলমালয়ালম ভাষায় কার্তিক মুরুগান বা ময়ূরী স্কন্দস্বামী (তামিল:முருகன், মালয়ালম:മുരുകന്‍) নামে এবং কন্নড়তেলুগু ভাষায় তিনি সুব্রহ্মণ্যম (কন্নড়:ಸುಬ್ರಹ್ಮಣ್ಯ, তেলুগু:సుబ్రమణ్య స్వామి‍) নামে পরিচিত। তামিল বিশ্বাস অনুযায়ী মুরুগান তামিলদেশের (তামিলনাড়ু) রক্ষাকর্তা।[৭] দক্ষিণ ভারত, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়ামরিশাস – যেখানে যেখানে তামিল জাতিগোষ্ঠীর প্রভাব বিদ্যমান সেখানেই মুরুগানের পূজা প্রচলিত। শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাংশে কার্তিকেয়ের উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত কথারাগম (সিংহলি ভাষায় "কথারাগম দেবালয়") মন্দিরে হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয় সম্প্রদায়ের মানুষই শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি ভারতে সর্বাধিক পূজিত দেবতাদের মধ্যে অন্যতম।

ব্যুৎপত্তি এবং নামকরণ সম্পাদনা

পুরাণ অনুযায়ী তারকাসুরকে বধের জন্য তার জন্ম হয়েছিল। পরমেশ্বর শিব ও পরমেশ্বরী পার্বতীর যোগের মাধ্যমে আত্ম মিলন হয়। ফলে এক অগ্নিপিণ্ডের সৃষ্টি হয়। রতির অভিশাপের সম্মান রক্ষার্থে গর্ভে সন্তান ধারণ করেননি মাতা পার্বতী। অগ্নিদেব সেই উৎপন্ন হওয়া নব্য তেজময় জ্যোতিপিণ্ড নিয়ে পালিয়ে যান। ফলে মাতা পার্বতী যোগ ধ্যান সমাপ্তি হতেই ক্রুদ্ধ হন। অগ্নিদেব ঐ অগ্নিপিণ্ডের তাপ সহ্য করতে না পেরে গঙ্গায় তা নিক্ষেপ করে। সেই তেজ গঙ্গা দ্বারা বাহিত হয় ও শরবনে গিয়ে এক রূপবান শিশুর জন্ম দেয়। জন্মের পর কুমারকে কৃত্তিকাগণ ও অরুণাসুরের বোন বজ্রজ্বালার স্তন্য পান করালে তিনি কার্তিক নামে অভিহিত হন। পরে দেবী পার্বতী শিশু স্কন্দকে কৈলাসে নিয়ে আসেন।[৮]

বিবাহ সম্পাদনা

ভগবান কার্তিকের স্ত্রী হলেন দেবসেনা ও বালি (বল্লী)।[৯] সুরাপদ্মনকে বধ করার পর দেবরাজ ইন্দ্র নিজ কন‍্যা দেবসেনার সঙ্গে কার্তিকের বিয়ে দেন। পরে নম্বিরাজের কন্যা বালি-র সঙ্গে কার্তিকের বিবাহ হয়।

পশ্চিমবঙ্গে কার্তিক পূজা সম্পাদনা

 
কালীঘাট পটচিত্র এ কার্তিক ঠাকুর

বাংলায় কার্তিক সংক্রান্তির সাংবাৎসরিক কার্তিক পূজার আয়োজন করা হয়।[১০] পূর্বের তুলনায় এখন কার্তিক জনপ্রিয়তা কিছুটা কমেছে। পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়া-বাঁশবেড়িয়া কাটোয়া অঞ্চলের কার্তিক পূজা বিশেষ প্রসিদ্ধ। এছাড়া বাংলার গণিকা সমাজে কার্তিক পূজা বিশেষ জনপ্রিয়।[১১][১২][১৩] দুর্গাপূজা সময়ও কার্তিকের পূজা করা হয়। কলকাতায় কার্তিকের মন্দির রয়েছে।[১৪]

কার্তিক ঠাকুরের সাথে ছয় সংখ্যা জড়িয়ে আছে। সেজন্য হয়ত স্ত্রী ষষ্ঠীর সাথে তার মিল। তিনি বাচ্চা বড় না হওয়া অব্দি তাদের বিপদ থেকে রক্ষা করেন। তার কৃপা পেলে পুত্রলাভ, ধনলাভ হয়। সেজন্য বিয়ে হয়েছে কিন্তু এখনও সন্তান আসেনি এমন দম্পতির বাড়ির সামনে কার্তিক ঠাকুরের মূর্তি ফেলা হয়।[১৫] সুঠাম গড়নের ল্যাংটো কাটোয়ার কার্তিক লড়াই খুব বিখ্যাত।[১৬] কাটোয়ার কার্তিক পুজো বিখ্যাত বলেই এখানে এক পুজোর সঙ্গে অন্য পুজোর প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কার্তিক লড়াই বলে।

কার্তিক পুজোর দিন পথে কাটোয়ায় এক বড়সড় মিছিল নামে। সব পুজো-মণ্ডপের দলবল তাদের ঠাকুর নিযে বেরোয় শোভাযাত্রায়। চলে লড়াই কার ঠাকুর আগে যাবে।এ যুদ্ধ রীতিমতো লাঠিসোটা, এমনকী তরবারি নিয়েও চলে। হালিশহরের 'জ্যাংড়া কার্তিক' ও 'ধুমো কার্তিক' পূজা ও খুব বিখ্যাত।[১৭] এভাবেই যুদ্ধ আর সন্তান উৎপাদন- দুইয়ের অনুষঙ্গেই কার্তিককে স্মরণ করে বাঙালি। তাকে নিয়ে আছে ছড়া -

"কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা, 
একবার আসেন মায়ের সাথে, 
একবার আসেন একলা।"[১৮]
 
পশ্চিমবঙ্গে কার্তিক পূজা

পাল বাড়ির ঐতিহাসিক তিন কার্তিক সম্পাদনা

প্রাচীন বর্ধমান (বর্তমান পশ্চিম বর্ধমান) জেলার গৌরবাজার গ্রামে বিগত ১৬৬ বছর ধরে এই পুজো হচ্ছে। এই পুজোর বিশেষত্ব হল তিনটি কার্তিক- বড় কার্তিক, মেজো কার্তিক, ছোটো কার্তিক। বর্ধমানে পালদের জমিদারি খুব বিখ্যাত ছিল। কথিত আছে, জমিদার জয়নারায়ণ পাল, শ্যাম পাল ও লক্ষ্মীনারায়ণ পাল নিঃসন্তান ছিলেন। ১৮৫৩ সালের দিকে একদিন রাত্রে স্বপ্নে জয়নারায়ণ পাল আদেশ পান তাদের তিন ভাই কার্তিক পুজো করলে তাদের সন্তান হবে। তাই তাঁরা তিন ভাই মিলে ঘটা করে কার্ত্তিক মন্দির তৈরি করে একসাথে তিন কার্তিকের পূজা করতে লাগলেন। তারপরে ১৮৫৭ সালে লক্ষ্মীনারায়ণ পালের ধ্বজাধারী পাল নামে এক পুত্র সন্তান হয়। বাকি দুই ভাইয়ের একটি করে কন্যা সন্তান লাভ হয়। সেই থেকে এখানে পালদের বংশধরেরা আজও পুজো করে আসছেন।[১৯]

দক্ষিণ ভারত সম্পাদনা

 
মুরুগান রুপে দেবতা কার্তিক

দক্ষিণ ভারতে কার্তিক খুবই জনপ্রিয় দেবতা। সেখানে তাঁর অসংখ্য মন্দির আছে। তবে তামিলনাড়ুর ৬টি কার্তিক মন্দির খুব প্রসিদ্ধ।[২০] সেগুলো হলো-

  1. স্বামীমালাই মুরুগান মন্দির
  2. পালানী মুরুগান মন্দির
  3. থিরুচেন্দুর মুরুগান মন্দির
  4. থিরুপ্পারামকুমারাম মুরুগান মন্দির
  5. থিরুথানি মুরুগান মন্দির
  6. পাঝামুদিরচোলাই মুরুগান মন্দির।

কৌমারম্ সম্প্রদায় সম্পাদনা

কৌমারাম একটি সম্প্রদায়। যাদের বিশেষ করে দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় তামিল, কন্নড়, বেদ্দাদের মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়।[২১] তাদের কাছে কার্তিকেয় হলেন ইষ্টদেবতা। কৌমার উৎসবে তারা প্রমত্ত নাচ করে।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Lochtefeld 2002, পৃ. 377।
  2. Parpola 2015, পৃ. 285।
  3. Lochtefeld 2002, পৃ. 655-656।
  4. Clothey 1978, পৃ. 1-2।
  5. "::: ENVIS :::"ecoheritage.cpreec.org। ২০২১-০৬-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৬-১৯ 
  6. Jones ও Ryan 2006, পৃ. 228।
  7. Cage of Freedom By Andrew C. Willford
  8. AppsDreamers। "যে কারণে আমরা কার্তিক পূজা করি! বিবাহিত না চিরকুমার? ধ্যান ও প্রণাম মন্ত্র"বাংলা পঞ্জিকা (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-০২ 
  9. "চিরকুমার নন, দুই স্ত্রী নিয়ে সুখেই থাকেন কার্তিক!"sangbadpratidin (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-০২ 
  10. "যুদ্ধের দেবতা হিসেবে পরিচিত, জেনে নিন এই বছরের কার্তিক পুজোর নির্দিষ্ট দিন ও সময়"Asianet News Network Pvt Ltd। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-০২ 
  11. "ঐতিহ্যের ধারা"www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-০২ 
  12. "বারবনিতাদের হাতেই কার্তিক পুজোর সূচনা কাটোয়ায়"sangbadpratidin (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-০২ 
  13. "কেন আজও ন্যাংটো কার্তিকের পুজো হয় কাটোয়ায়?"sangbadpratidin (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-০২ 
  14. "Temple ties in culture cauldron"www.telegraphindia.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৪-২৪ 
  15. "কার্তিক পুজোর কড়চা"Chalo Kolkata (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৮-০৮-২৫। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৪-২৪ 
  16. সংবাদদাতা, নিজস্ব। "রাত বাড়তেই কিছুটা ভিড় 'কার্তিক লড়াই'-এর শহরে"www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-০২ 
  17. ঘোষ, বিনয়, "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি", তৃতীয় খন্ড, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশ ভবন, পৃষ্ঠা:১৯৩-১৯৬
  18. "কার্তিক বৃত্তান্ত"Ichchhamoti (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৪-২৪ 
  19. "কার্তিক পুজো বিস্তারিত তথ্যাদি"bongquotes.com। ২০২১-০৭-০২। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-০২ 
  20. Clothey, Fred W. (১৯৭২-০৬-০১)। "Pilgrimage Centers in the Tamil Cultus of Murukan"Journal of the American Academy of Religion (ইংরেজি ভাষায়)। XL (1): 79–95। আইএসএসএন 0002-7189ডিওআই:10.1093/jaarel/XL.1.79 
  21. Roshen Dalal (২০১০)। Hinduism: An Alphabetical Guide। New Delhi: Penguin Books India। পৃষ্ঠা 417–418, 137, 198–199, 241, 425। আইএসবিএন 978-0-14-341421-6 

পাদটীকা সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা