মরিশাস

ভারত মহাসাগরে আফ্রিকার দ্বীপের সার্বভৌম রাষ্ট্র

মরিশাস (/məˈrɪʃ(i)əs, mɔː-/ (শুনুন) mər-ISH-(ee-)əs, mor-; ইংরেজি: Mauritius, ফরাসি: Maurice [mɔʁis, moʁis] (শুনুন); টেমপ্লেট:Lang-mfe টেমপ্লেট:IPA-mfe), আনুষ্ঠানিকভাবে মরিশাস প্রজাতন্ত্র (ইংরেজি: Republic of Mauritius, ফরাসি: République de Maurice; টেমপ্লেট:Lang-mfe), আফ্রিকার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের সন্নিকটে ভারত মহাসাগরের অবস্থিত একটি দ্বীপ দেশ। দেশটির রাজধানীর নাম পোর্ট লুইস, যা দেশটির প্রধান সমুদ্র বন্দর। দ্বীপটি আফ্রিকার মূল ভূখণ্ড থেকে ২০০০ কিলোমিটার পূর্বে এবং মাদাগাস্কার দ্বীপরাষ্ট্র থেকে ৮০০ কিলোমিটার পূর্বে, ভারত মহাসাগরের পশ্চিমভাগে অবস্থিত। দেশটি ইংরেজি ভাষায় মরিশাস (শুনুন) বা মরিশিয়াস, ফরাসি ভাষায় মোরিস (Maurice, শুনুন) এবং স্থানীয় ক্রেওল ভাষায় মরিস নামে পরিচিত।

যুক্ত মরিশাস দিনপঞ্জি

  • Gonoprojatic Maurice ( Bangla )
মরিশাসের জাতীয় পতাকা
পতাকা
মরিশাসের জাতীয় মর্যাদাবাহী নকশা
জাতীয় মর্যাদাবাহী নকশা
নীতিবাক্য: "Stella Clavisque Maris Indici" (লাতিন)[১]
"Star and Key of the Indian Ocean"
জাতীয় সঙ্গীত: মাদারল্যান্ড
মরিশাস প্রজাতন্ত্রের দ্বীপপুঞ্জ (চাগোস দ্বীপপুঞ্জ এবং ট্রোমেলিন দ্বীপ বাদে)
মরিশাস প্রজাতন্ত্রের দ্বীপপুঞ্জ (চাগোস দ্বীপপুঞ্জ এবং ট্রোমেলিন দ্বীপ বাদে)
কালো লেবেলযুক্ত মরিশাস প্রজাতন্ত্রের দ্বীপপুঞ্জ; Chagos Archipelago এবং Tromelin মরিশাস দ্বারা দাবি করা হয়
কালো লেবেলযুক্ত মরিশাস প্রজাতন্ত্রের দ্বীপপুঞ্জ; Chagos Archipelago এবং Tromelin মরিশাস দ্বারা দাবি করা হয়
রাজধানী
ও বৃহত্তম নগরী বা বসতি
পোর্ট লুইস
২০°১২′ দক্ষিণ ৫৭°৩০′ পূর্ব / ২০.২° দক্ষিণ ৫৭.৫° পূর্ব / -20.2; 57.5
সরকারি ভাষানেই (de jure)
ইংরেজি (de facto)
ফরাসি (de facto)[Note ১][২]
কথ্য ভাষা[Note ২][৩]
নৃগোষ্ঠী
ধর্ম
(২০১১ আদমশুমারী)[৫]
জাতীয়তাসূচক বিশেষণমরিশিয়ান
সরকারএকক সংসদীয় প্রজাতন্ত্র
পৃথ্বীরাজসিংহ রূপন
এডি বোইসেজন
প্রবিন্দ জগন্নাথ
সুরুজদেব ফকির
আইন-সভাজাতীয় পরিষদ
স্বাধীন 
১২ই মার্চ ১৯৬৮
• প্রজাতন্ত্র
১২ই মার্চ ১৯৯২
আয়তন
• মোট
২,০৪০ কিমি (৭৯০ মা) (১৭০ তম)
• পানি (%)
০.০৭
জনসংখ্যা
• ২০১৯ আনুমানিক
১,২৬৫,৪৭৫[৬] (১৫৮ তম)
• ২০১১ আদমশুমারি
১,২৩৭,০৯১[৩]
• ঘনত্ব
৬১৮.২৪/কিমি (১,৬০১.২/বর্গমাইল) (১০ম)
জিডিপি (পিপিপি)২০১৯ আনুমানিক
• মোট
$৩১.৭০৫ বিলিয়ন[৭] (১৩৩ তম)
• মাথাপিছু
$২৫,০২৯[৭] (৬১ তম)
জিডিপি (মনোনীত)২০১৯ আনুমানিক
• মোট
$১৪.৮১২ বিলিয়ন[৭] (১২৯ তম)
• মাথাপিছু
$১১,৬৯৩[৭] (৬৪ তম)
জিনি (২০১৭)৩৬.৮[৮]
মাধ্যম
মানব উন্নয়ন সূচক (২০২০)বৃদ্ধি ০.৮০৪[৯]
অতি উচ্চ · ৬৬ তম
মুদ্রামরিশিয়ান রুপি (MUR)
সময় অঞ্চলইউটিসি+৪ (MUT)
তারিখ বিন্যাসদিন/মাস/বছর (AD)
গাড়ী চালনার দিকবাম
কলিং কোড+230
ইন্টারনেট টিএলডি.mu

দেশটিতে মরিশাস নামের একটি বৃহৎ দ্বীপ (আয়তন ১৮৬৫ বর্গকিলোমিটার) আছে, যার পূর্বে রোদ্রিগেস নামের আরেকটি দ্বীপ (১০৪ বর্গকিলোমিটার), উত্তর-পূর্বে কার্গাদোস কারাজোস (সেন্ট ব্র্যান্ডন) নামের কিছু চড়া এবং ৫০০ কিলোমিটার উত্তরে আগালেগা নামের ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জ আছে।[১০][১১] সব মিলিয়ে দেশটির আয়তন প্রায় ২০৪০ বর্গকিলোমিটার (ঢাকা নগরীর প্রায় ৭ গুণ বা কলকাতা নগরীর প্রায় ১০ গুণ)। এছাড়া দ্বীপটি ২৩ লক্ষ বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট একটি একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলের অধিকারী।[১২] এছাড়া মরিশাস উত্তর-পূর্বের চাগোস দ্বীপপুঞ্জ ও পূর্বের ত্রোমলাঁ দ্বীপটিকে নিজের বলে দাবী করে।

মূল মরিশাস দ্বীপটি একটি আগ্নেয় দ্বীপ যেটি চারপাশে প্রবালপ্রাচীর দিয়ে বেষ্টিত। রাজধানী পোর্ট লুইসে একটি চমৎকার প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় আছে যাতে মহাসমুদ্রগামী জাহাজগুলি নোঙর ফেলতে পারে। ভৌগোলিকভাবে এটি মাসাকারিন দ্বীপপুঞ্জের অন্তর্গত একটি দ্বীপ, যাতে রদ্রিগেস দ্বীপ ও ফরাসি রেউনিওঁ দ্বীপটি অন্তর্ভুক্ত। উত্তর-দক্ষিণে ৬১ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৪৭ কিলোমিটার প্রশস্ত এই দ্বীপটির উত্তরভাগে একটি সরু সমতল নিম্নভূমি আছে যেখানে দ্বীপের অধিবাসীদের সিংহভাগ বাস করে। দ্বীপের মধ্যভাগে একটি উঁচুভূমি ও দক্ষিণে একটি পার্বত্য অঞ্চল অবস্থিত। দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমে এর সর্বোচ্চ পর্বতটি অবস্থিত, যার নাম পিতোঁ দ্য লা প্যতিত রিভিয়ের নোয়ার (উচ্চতা ৮২৮ মিটার)। দ্বীপের মধ্যভাগে বেশকিছু হ্রদ রয়েছে, যাদের মধ্যে ভাকোয়াস হ্রদ দ্বীপটির স্বাদু পানির প্রধান উৎস। এখানকার জলবায়ু উপক্রান্তীয় ধরনের এবং আবহাওয়া সারাবছর সুষমভাবে উষ্ণ (গড়ে ২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ও আর্দ্র থাকে, তবে মধ্যভাগে উচ্চভূমিতে তাপমাত্রা কিছুটা কম। বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ উপকূলে প্রায় ১০০০ মিলিমিটার এবং মালভূমি অঞ্চলে ৫০০০ মিলিমিটার। ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাসে তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বেশি থাকে এবং এই মৌসুমে প্রায়ই শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় ঘটে। মধ্যভাগের উচ্চভূমি থেকে বেশ কিছু পাহাড়ি নদী উপকূলের দিকে প্রসারিত হয়েছে। দ্বীপটির প্রধান নদীটির নাম গ্র্যান্ড রিভার, যেটি দ্বীপের জলবিদ্যুতের সিংহভাগ যোগান দেয়। মরিশাস দ্বীপটির অভ্যন্তরভাগ অতীতে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বৃক্ষের অরণ্যে আবৃত ছিল; এর পর এই বনগুলির সিংহভাগই কেটে ফেলা হয় এবং এগুলিকে চিনি উৎপাদনকারী আখের খামার দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়। এছাড়া এখানে বাঁশের ঝাড়, নারকেল গাছ ও আবলুস গাছ দেখা যায়। মরিশাসের অনন্য কিছু প্রাণীর মধ্যে লম্বা লেজবিশিষ্ট সম্বর হরিণ ও তেনরেক নামের একটি কাঁটালো স্তন্যপ্রায়ী প্রাণী উল্লেখযোগ্য। এখানে ডোডো নামের একটি উড়তে অক্ষম ও বৃহৎ পাখির বাস ছিল, কিন্তু ১৬৮১ সালের আগেই শেষ ডোডোটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।

জনসংখ্যা সম্পাদনা

মরিশাসে সব মিলিয়ে প্রায় ১৩ লক্ষ লোকের বাস। এখানকার জনঘনত্ব (প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৬৩৮ জন) বিশ্বের সর্বোচ্চগুলির একটি। এখানকার জাতিগত বৈচিত্র্য উচ্চ। বর্তমানে দেশটির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ (৬৮%) লোক ১৯শ শতকে দক্ষিণ এশিয়া থেকে আগত আখচাষীদের বংশধর। প্রায় এক-চতুর্থাংশ (২৭%) লোক "ক্রেওল" নামক শ্বেতাঙ্গ, এশীয় ও আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ নরগোষ্ঠীর লোকের সংমিশ্রণে গঠিত একটি নরগোষ্ঠী। এছাড়া চীনা (৩%) ও ইউরোপীয় (২%, মূলত ফরাসি) বংশোদ্ভূত ক্ষুদ্র সম্প্রদায় আছে। ফরাসি বংশোদ্ভূত সম্প্রদায়টি ধনী শ্রেণী গঠন করেছে। ইংরেজি প্রশাসনিক ভাষা, তবে প্রায় সবাই স্থানীয় ক্রেওল ভাষায় (এক ধরনের ফরাসি পাতোয়া ভাষা) কথা বলে; এছাড়া ফরাসি ভাষা ও অন্যান্য নৃগোষ্ঠীগত ভাষাও (হিন্দি ভাষা, উর্দু ভাষা, ভোজপুরি ভাষা, তামিল ভাষা, চীনা ভাষা) প্রচলিত। এখানকার লোকেদের অর্ধেকের (৪৮%) ধর্ম হিন্দুধর্ম; খ্রিস্টধর্ম (রোমান ক্যাথলিক মণ্ডলীর) ও ইসলাম ধর্ম যথাক্রমে দ্বিতীয় (২৬%) ও তৃতীয় (১৭%) প্রধান ধর্ম। ভারতীয় বংশোদ্ভুত লোকেরা হিন্দু ও ইসলাম ধর্মাবলম্বী এবং বেশির ভাগ ক্রেওল নরগোষ্ঠীর লোক খ্রিস্টান। এটি আফ্রিকার একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।[১৩][১৪] দেশের অর্ধেকের বেশি জনগণ শহরে বাস করে। প্রায় ৮৫% লোক সাক্ষরতা অর্জন করেছে। এখানে দুইটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আছে।

অর্থনীতি সম্পাদনা

মরিশাসের প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ এর আপেক্ষিকভাবে উর্বর মাটি। দেশের প্রায় অর্ধেক জমিতে কৃষিকাজ করা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে মরিশাসের অর্থনীতিতে একটিমাত্র অর্থকরী শস্য আধিপত্য বিস্তার করে আসছে, যা হল আখ। দেশের আবাদী জমিগুলির অর্ধেকেরও বেশীতে আখ চাষ করা হয় এবং আখ থেকে প্রস্তুতকৃত চিনি ও ঝোলাগুড় মরিশাসের প্রধান দুইটি রপ্তানি দ্রব্য। অন্যান্য কৃষিদ্রব্যের মধ্যে চা, চীনাবাদাম, আলু, টমেটো, তামাক, কলা ও শাকসবজি উল্লেখ্য। তবে দেশটি খাদ্যের জন্য, বিশেষত চাল আমদানির জন্য বহির্বিশ্বের উপরে গভীরভাবে নির্ভরশীল। ১৯৭০-এর দশকে মরিশাসের সরকার কৃষির উপরে নির্ভরশীলতা কমিয়ে অর্থনীতির আধুনিকায়নের উদ্যোগ হাতে নেয় এবং নতুন নতুন শিল্প স্থাপন করে। বর্তমানে মরিশাসের অর্থনীতির উৎপাদনের এক-পঞ্চমাংশ শিল্পখাত থেকে আসে। এখানকার কারখানাগুলিতে আখের রস থেকে পরিশোধিত চিনি ও চিনিজাত দ্রব্য প্রক্রিয়াজাতকরণের পাশাপাশি বস্ত্র, ধাতু, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ধাতব দ্রব্য, রাসায়নিক সার ও রাসায়নিক দ্রব্য, পানীয়, চামড়াজাত দ্রব্য, ইলেকট্রনীয় যন্ত্রাংশ, ইত্যাদি উৎপাদন করা হয়। ১৯৮০-র দশকে বস্ত্র ও পোশাক শিল্পে ব্যাপক উন্নতি হয়। পর্যটন ও ব্যাংকিংয়ের মতো সেবাখাতগুলি মরিশাসের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির শ্রমশক্তির প্রায় দুই-পঞ্চমাংশেরও বেশি লোক এই দুই খাতে চাকুরি করে। ১৯৭০-এর দশকে থেকে দেশের পর্যটন খাত ব্যাপক বৃদ্ধিলাভ করে। ২১শ শতকে এসে দেশটি ব্যাংকিং ও অর্থসংস্থান সেবার একটি সমৃদ্ধ কেন্দ্রে পরিণত হয়। মরিশাসের মুদ্রার নাম মরিশীয় রুপি, যেটি ১০০ সেন্টে বিভক্ত। ২০২১ সালে এসে ১ মার্কিন ডলার প্রায় ৪০ মরিশীয় রুপির সমান ছিল। মরিশাস অর্থনৈতিক স্বাধীনতার তালিকায় উচ্চস্থান অর্জন করেছে। বিশ্বব্যাংক দেশটিকে একটি উচ্চ-আয়ের অর্থনীতি হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেছে।[১৫] দেশটিকে আফ্রিকার সবচেয়ে প্রতিযোগিতামূলক ও সবচেয়ে উন্নত অর্থনীতিগুলির একটি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।[১৬]

ইতিহাস সম্পাদনা

আরব নাবিকেরা ১০ম শতক (আনুমানিক ৯৭৫ খ্রিস্টাব্দ) বা তার আগেই এবং ১৫শ শতকে সম্ভবত মালয় জাতির লোকেরা দ্বীপটি সম্পর্কে অবগত ছিল। ১৬শ শতকের শুরুতে (১৫০৭ সালে) এখানে ইউরোপ থেকে পতুর্গিজদের আগমন ঘটেছিল বলে নথিতে নিশ্চিত প্রমাণ আছে, কিন্তু তারা দ্বীপটিতে বসতি স্থাপন করেনি। ১৫৯৮ সালে ওলন্দাজরা দ্বীপটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেয়। তারা এটিকে নেদারল্যান্ডসের প্রশাসক নাসাউয়ে মরিসের নামে মরিশাস নামকরণ করে। ওলন্দাজরা দুইবার দ্বীপটিতে বসতি স্থাপনের চেষ্টা করে; প্রথমবার ১৬৩৮-৫৮ সময়কালে ও দ্বিতীয়বার ১৬৬৪-১৭১০ সালে। কিন্তু তাদের বসতি স্থাপনের চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং তারা জলদস্যুদের হাতে দ্বীপটি ছেড়ে দিয়ে ১৭১০ সালে চলে যায়। ১৭১৫ সালে ফরাসি পূর্ব ভারতীয় কোম্পানি দ্বীপটি নিজের নিয়ন্ত্রণে নেয়। তারা ১৭২১ সালে এটিকে ইল দ্য ফ্রঁস নামকরণ করে। ১৭৬৭ সালে ফ্রান্স সরকারের সমুদ্র মন্ত্রণালয় দ্বীপটির দায়িত্ব নেয়। ফরাসিরা আখের খামারে কাজ করার জন্য আফ্রিকান ক্রীতদাসদেরকে ধরে নিয়ে আসে এবং উপনিবেশটির অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটে। ১৮১০ সালে নেপোলিয়নীয় যুদ্ধগুলির সময় যুক্তরাজ্যে দ্বীপটি দখল করে এবং ১৮১৪ সালের প্যারিস চুক্তির অধীনে তাদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বীপটির নিয়ন্ত্রণ অর্পণ করা হয়। মরিশাসের পাশাপাশি রোদ্রিগেস, আগালেগা, সেন্ট ব্র্যান্ডন, ট্রোমেলিন দ্বীপ এবং চাগোস দ্বীপপুঞ্জগুলিকেও ব্রিটিশদের কাছে দিয়ে দেওয়া হয় এবং ১৯০৬ সাল পর্যন্ত সেশেলস দ্বীপপুঞ্জটিও ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।[১০][১৭] ট্রোমেলিনের উপরে মরিশাস ও ফ্রান্স উভয়ে সার্বভৌমত্ব দাবী করে আসছে, কেননা ১৮১৪ সালের প্যারিস চুক্তিতে এর উল্লেখ ছিল না।[১৮]দ্বীপটির নাম বদলে পুনরায় মরিশাস রাখা হয় এবং ১৮৩৫ সালে ক্রীতদাস প্রথার অবসান ঘটলে যে শ্রমঘাটতি সমস্যা উদ্ভূত হয়, তা সমাধানের জন্য ব্রিটিশরা আখার খামারগুলির কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদেরকে ভারতীয় উপমহাদেশীয় চুক্তিবদ্ধ শ্রমিকদের দ্বারা প্রতিস্থাপন করে। এ কারণে ১৮৬১ সাল থেকে দ্বীপটির অধিবাসীদের সিংহভাগ ভারতীয় বংশোদ্ভূত। ১৯শ শতকের বীট থেকে উৎপন্ন থেকে চিনির প্রতিযোগিতার কারণে দ্বীপটির অর্থনীতিতে মন্দার সৃষ্টি হয়। ১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে এখানকার সামুদ্রিক নৌপরিবহন-সংক্রান্ত গুরুত্বও হ্রাস পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এখানে বেশ কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার সাধন করা হয়। ১৯৬৫ সালে মরিশাসের স্বাধীনতালাভের কিছু আগে যুক্তরাজ্য চাগোস দ্বীপপুঞ্জকে মরিশাস উপনিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদেরকে উৎপাটন করে মরিশাসে পুনর্বাসন করে এবং সেখানে (বিশেষ করে দিয়েগো গার্সিয়া দ্বীপে) একটি যৌথ ব্রিটিশ-মার্কিন ভারতীয় মহাসামুদ্রিক সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে।[১৯] ১৯৬৮ সালের ১২ই মে তারিখে এসে মরিশাস ব্রিটিশ কমনওয়েলথের অধীনে থেকে যুক্তরাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৬৮ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত মরিশাস একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ছিল এবং দ্বীপটির নির্বাহী ক্ষমতা নামে ব্রিটিশ রাণী ও সেই সূত্রে তার প্রতিনিধি গর্ভনর জেনারেলের হাতে অর্পিত ছিল।। ১৯৯২ সালের মার্চ মাসে মরিশাস একটি রাষ্ট্রপতি শাসিত স্বতন্ত্র প্রজাতন্ত্র পরিণত হয়। এরপর দেশটির সরকার সফলভাবে অর্থনীতির বৈচিত্র্যায়ন সাধন করেছেন। দেশটি ব্রিটিশ কমনওয়েলথ, আফ্রিকীয়-মালাগাসি মরিশীয় অভিন্ন সংস্থা ও আফ্রিকান ঐক্য সংস্থার সদস্য। এছাড়া লোমে চুক্তির অধীনের মরিশাসের সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশেষ সম্পর্ক বিদ্যমান।

রাজনীতি ও সরকার সম্পাদনা

মরিশাসের রাষ্ট্রপতি আইনসভা কর্তৃক ৫ বছর মেয়াদের জন্য রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ঐতিহ্যগতভাবে আইনসভার সংখ্যাগুরু দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন, যিনি সরকার তথা নির্বাহী বিভাগের প্রধান। আইনসভা বা জাতীয় সংসদটি সরাসরি নির্বাচিত ৬২ জন সদস্য নিয়ে গঠিত। এছাড়া সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে আরও ৪ জন সংসদ সদস্যকে নিয়োগদান করেন। জাতীয় সংসদের সদস্যদের মেয়াদ ৫ বছর হয়ে থাকে। মরিশাসের স্বাধীনতালাভের পরে প্রথম ১৪ বছর সিউসাগার রামগুলামের নেতৃত্বাধীন মরিশাস শ্রমিক দল (এমএলপি, মরিশাস লেবার পার্টি) দেশটি শাসন করে। ১৯৭০-এর দশকে বিরোধী দল মরিশিয়ান মিলিট্যান্ট মুভমেন্ট (এমএমএম) শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং ১৯৮২ সালে এসে অনিরুধ জগনাথের নেতৃত্বে বিপুল ব্যবধানে জয়ী হয়। কিন্তু জগনাথকে এমএমএম থেকে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের জের ধরে বহিস্কার করা হলে তিনি নতুন একটি দল গঠন করেন, যার নাম মরিশীয় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন (এমএসম, মরিশিয়ান সোশ্যালিস্ট মুভমেন্ট)। এই দলটি মরিশাস শ্রমিক দলের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে ১৯৮৩ সালে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন। ১৯৮৭ ও ১৯৯১ সালে জগনাথের কোয়ালিশন পুনর্নির্বাচিত হয়। ১৯৯২ সালে মরিশাস প্রজাতন্ত্রে পরিণত হবার পরে কাসাম উতিমকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৯৫ সালের ডিসেম্বরে মরিশাস শ্রমিক দল ও মরিশিয়ান মিলিট্যান্ট মুভমেন্ট জোটবদ্ধ হয়ে মরিশীয় সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন দলকে ক্ষমতাচ্যুত করে। সিউসাগার রামগুলামের সন্তান ও মরিশাস শ্রমিক দলের প্রধান নাভিনচন্দ্র রামগুলাম, জগনাথকে প্রতিস্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বলাভ করেন। ১৯৯৭ সালে এমএলপি-এমএসএম কোয়ালিশনের পতন ঘটে। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বর এমএসএম-এমএমএম আবার জোটবদ্ধ হয়ে সংসদ নির্বাচনে বিপুল জয়লাভ করে এবং জগনাথ আবারও প্রধানমন্ত্রী হন। ২০০৩ সালে জগনাথ পদত্যাগ করেন এবং প্রবীণ রাজনীতিবিদ পোল বেরঁজে প্রধানমন্ত্রী হন। জাতীয় সংসদ পরবর্তীতে জগনাথকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ২০০৫ সালে নাভিন রামগুলাম আবার প্রধানমন্ত্রী হন ও ২০১৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকেন। ২০১৫ সালে আনিরুধ জগনাথ নির্বাচনে জয়লাভ করে আবার প্রধানমন্ত্রী হন। ২০১৯ সালের নভেম্বরে সর্বশেষ সংসদ নির্বাচনে এমএসএম একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে এবং প্রাভিন্দ কুমার জগনাথ (অনিরুধ জগনাথের পুত্র) প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।[২০] বর্তমানে মরিশাসের প্রশাসন ওয়েস্টমিনস্টার সংসদীয় ব্যবস্থাকে অনুকরণ করে নির্মিত এবং গণতন্ত্র সূচক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার মর্যাদাক্রমে দেশটি উচ্চস্থান অর্জন করেছে।

মরিশাস একটি সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্র। সরকার সমস্ত নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা স্তর পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদান করে। এছাড়া ছাত্রছাত্রী, বৃদ্ধ নাগরিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিনামূল্যে পরিবহনের সুব্যবস্থা আছে।[২১] ২০১৯ সালে বিশ্ব শান্তি সূচক অনুযায়ী মরিশাস আফ্রিকার সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ দেশের স্বীকৃতি লাভ করে।[২২] মরিশাস একমাত্র আফ্রিকান রাষ্ট্র যেটি মানব উন্নয়ন সূচকে "অত্যন্ত উচ্চ" শ্রেণীতে স্থান করে নিয়েছে। অপেক্ষাকৃত অনুন্নত রোদ্রিগেস দ্বীপটি ২০০১ সাল থেকে স্বশাসিত।

ভূগোল সম্পাদনা

জলবায়ু সম্পাদনা

মরিশাসের জলবায়ু ক্রান্তীয় জলবায়ু। তিনটি প্রধান ঋতু হলো: গ্রীষ্ম, বর্ষাশরৎ

ভাষাসমূহ সম্পাদনা

ইংরেজি, ফরাসি, ক্রেওল, ভোজপুরি, তামিল, হিন্দি, মারাঠি, উর্দু, তেলুগু, ওড়িয়া, চীনা,বাংলা ইত্যাদি।

সংস্কৃতি সম্পাদনা

রাখিবন্ধন, দোলযাত্রা, পূজা, গণেশ চতুর্থী, মহাশিবরাত্রি, স্বাধীনতা দিবস (১২ই মার্চ), শুভ নববর্ষ, উগাদি, রথযাত্রা, দীপাবলি, বড়দিনঈদ ইত্যাদি।

ধর্মবিশ্বাস সম্পাদনা

হিন্দুধর্ম, খ্রিস্ট ধর্মইসলাম

ইতিহাস সম্পাদনা

 
দ্বিতীয় এলিজাবেথ ১৯৬৮ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত মরিশাসের রানী ছিলেন

২০২০ সম্পাদনা

২০২০ সালের ২৫শে জুলাই তারিখে জাপানি মালিকানাধীন মালবাহী জাহাজ এমভি ওয়াকাশিও গতিপথ পরিবর্তন করে মরিশাসের কাছে একটি প্রবাল দ্বীপের চড়ায় আটকা পড়ে এবং সেটি থেকে প্রায় ১০০০ টন ওজনের ভারী তেল একটি পরিষ্কার উপহ্রদে নিঃসৃত হয়। [২৩] দুর্ঘটনাস্থলটি অনেকগুলি সুরক্ষিত সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র অঞ্চল ও একটি আন্তর্জাতিক গুরুত্ববিশিষ্ট জলাভূমির প্রান্তসীমায় অবস্থিত। ফলে এমভি ওয়াকাশিও তেল উপচে পড়ার ঘটনাটি পশ্চিম ভারতীয় মহাসাগরের ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্ট পরিবেশগত বিপর্যয়গুলির একটি হিসেবে গণ্য করা হয়।[২৪]

টীকা সম্পাদনা

  1. The Mauritian constitution makes no mention of an official language. The Constitution only mentions that the official language of the National Assembly is English; however, any member can also address the chair in French.
  2. Language most often spoken at home, as per 2011 Census.

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Government Information Service – Coat of Arms"। www.govmu.org। ১২ জুন ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৯ জুলাই ২০১৯ 
  2. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; language নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  3. Statistics Mauritius"2011 Population Census – Main Results" (পিডিএফ)। Government Portal of Mauritius। সংগ্রহের তারিখ ১১ নভেম্বর ২০১৭ 
  4. https://www.cia.gov/the-world-factbook/countries/mauritius/
  5. "Archived copy" (পিডিএফ)। ২০১৪-০৫-১৪ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৪-২৬ 
  6. "Population and Vital Statistics – Year 2019"। Statistics Mauritius। মার্চ ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ৬ মে ২০২০ 
  7. "World Economic Outlook Database, April 2019"IMF.orgInternational Monetary Fund। সংগ্রহের তারিখ ৮ জুন ২০১৯ 
  8. "GINI index (World Bank estimate) – Mauritius"data.worldbank.orgWorld Bank। সংগ্রহের তারিখ ১ জুলাই ২০২০ 
  9. Human Development Report 2020 The Next Frontier: Human Development and the Anthropocene (পিডিএফ)। United Nations Development Programme। ১৫ ডিসেম্বর ২০২০। পৃষ্ঠা 343–346। আইএসবিএন 978-92-1-126442-5। সংগ্রহের তারিখ ১৬ ডিসেম্বর ২০২০ 
  10. "Written Statement of the Republic of Mauritius" (পিডিএফ)1International Court of Justice। ১ মার্চ ২০১৮: 23–24। ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ এপ্রিল ২০২১ 
  11. "Memorial of the Republic of Mauritius"1Permanent Court of Arbitration। ১ আগস্ট ২০১২: 9। 
  12. "Memorial of Mauritius: Charts" (পিডিএফ)Permanent Court of Arbitration। ২০১২। পৃষ্ঠা 7। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-১২ 
  13. "Religions in Africa | African Religions | PEW-GRF"www.globalreligiousfutures.org। ২০১৫-০৯-১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-২৮ 
  14. "The Global Religious Landscape"Pew Research Center's Religion & Public Life Project (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১২-১২-১৮। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-২৮ 
  15. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; WB GROUP নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  16. World Economic Forum"The Global Competitiveness Report 2017–2018" (পিডিএফ)। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১২-২৪ 
  17. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; PCA Memorial Vol 1 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  18. Hervé, Gaymard (২০ মার্চ ২০১৩)। "A. Un Différend Ancien Avec Maurice Quant À La Souveraineté Sur Tromelin"National Assembly (France) 
  19. "Colonial Office Telegram No. 199 to Mauritius, No. 222 to Seychelles, 21 July 1965, FO 371/184524" (পিডিএফ)Permanent Court of Arbitration 
  20. https://www.reuters.com/article/us-mauritius-election-idUSKBN1XI177
  21. Stiglitz, Joseph (২০১১-০৩-০৭)। "The Mauritius miracle, or how to make a big success of a small economy"The Guardian 
  22. "GLOBAL PEACE INDEX MEASURING PEACE IN A COMPLEX WORLD GLOBAL PEACE INDEX 2019" (পিডিএফ)Institute for Economics and Peace। ২০১৯। ২০১৯-০৮-২৭ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১০-১৩ 
  23. "Mauritius takes stock of oil spill two months later"France 24। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০। 
  24. https://www.climatechangenews.com/2020/08/28/mauritius-oil-spill-compensation-limited-maritime-law-technicality/

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা