দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত হওয়া বৈশ্বিক যুদ্ধ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ যাবৎকাল পর্যন্ত সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল, এই ছয় বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়সীমা ধরা হলেও ১৯৩৯ সালের আগে এশিয়ায় সংগঠিত কয়েকটি সংঘর্ষকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অংশ হিসেবে গণ্য করা হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

ঘড়ির কাঁটা ধরে উপর থেকে বামদিকে: ওয়েনজিয়ালিঙের যুদ্ধে চীনা সেনাবাহিনী, প্রথম আল আলামাইনের যুদ্ধে অস্ট্রেলীয় ২৫ পাউন্ডার কামানের ব্যবহার, ১৯৪৩-৪৪ শীতকালীন মৌসুমে পূর্ব রণাঙ্গনে জার্মান স্টুকা বোমারু বিমান, লিঙ্গাইন উপসাগরে মার্কিন রণতরী, ভিলহেল্ম কাইটেল আত্মসমর্পন-চুক্তিতে সাক্ষর করছেন, স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে সোভিয়েত সেনা
তারিখ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ (1939-09-01) – ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ (1945-09-02) (৬ বছর, ১ দিন)
অবস্থান
ফলাফল

মিত্রশক্তির বিজয়

বিবাদমান পক্ষ
মিত্রশক্তি

চার পুলিশ:
সোভিয়েত ইউনিয়ন[ক]
 মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
 যুক্তরাজ্য
চীন প্রজাতন্ত্র (১৯১২-১৯৪৯)চীন প্রজাতন্ত্র[খ]


অধিকৃত দেশসমূহ:
 তৃতীয় ফরাসি প্রজাতন্ত্র[গ]
পোল্যান্ড
গ্রিস
নেদারল্যান্ডস
বেলজিয়াম
ইয়ুগোস্লাভিয়া
দক্ষিণ আফ্রিকা
 নিউজিল্যান্ড
নরওয়ে
চেকোস্লোভাকিয়া [ঘ]
ইথিওপিয়া [ঙ]
ব্রাজিল
ডেনমার্ক[চ]
লুক্সেমবুর্গ
কুবা
মেক্সিকো


অন্যান্য মিত্র রাষ্ট্র:
 ব্রিটিশ ভারত
 কানাডা
 অস্ট্রেলিয়া
ফিলিপাইন
মঙ্গোলিয়া


প্রাক্তন অক্ষ সহযুদ্ধকারী:

 ফিনল্যান্ড(1944 থেকে)
অক্ষশক্তি

 জার্মানি
 জাপান[ছ]
 ইতালি[জ]
হাঙ্গেরি
রোমানিয়া
বুলগেরিয়া


সহযোগী শক্তি:
 ফিনল্যান্ড
থাইল্যান্ড
ইরাক


খাতক ও তল্পীবাহক রাষ্ট্র:
 ক্রোয়েশিয়া
স্লোভাকিয়া
আলবেনিয়া


জাপানের বৃহত্তর পূর্ব এশিয়া
সহ-সমৃদ্ধি বলয়
পুতুল


মাঞ্চুকুয়ো
চীন-নানজিং
মেংজিয়াং
ফিলিপাইন
বার্মা

আজাদ হিন্দ
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী

মিত্রশক্তির নেতৃবৃন্দ সোভিয়েত ইউনিয়ন ইওসিফ স্তালিন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রাঙ্কলিন ডি. রুজভেল্ট
যুক্তরাজ্য উইনস্টন চার্চিল

চীন প্রজাতন্ত্র (১৯১২-১৯৪৯) চিয়াং কাই-শেক

অক্ষশক্তির নেতৃবৃন্দ নাৎসি জার্মানি আডলফ হিটলার
জাপানের সাম্রাজ্য হিরোহিতো
জাপানের সাম্রাজ্য হিদেকি তোজো

ইতালির রাজত্ব (১৮৬১–১৯৪৬) বেনিতো মুসোলিনি
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
সামরিক প্রাণহানি:
১,৬০,০০,০০০-এর বেশি
বেসামরিক প্রাণহানি:
৪,৫০,০০,০০০-এর বেশি
সর্বমোট প্রাণহানি:
৬,১০,০০,০০০-এর বেশি (১৯৩৭–৪৫)
...আরও দেখুন
সামরিক প্রাণহানি:
৮০,০০,০০-এর বেশি
বেসামরিক প্রাণহানি:
৪০,০০,০০০-এর বেশি
সর্বমোট প্রাণহানি:
১,২০,০০,০০০-এর বেশি (১৯৩৭–৪৫)
...আরও দেখুন

তৎকালীন বিশ্বে সকল পরাশক্তি এবং বেশিরভাগ রাষ্ট্রই এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং দুইটি বিপরীত সামরিক জোটের সৃষ্টি হয়; মিত্রশক্তি আর অক্ষশক্তি। এই মহাসমরকে ইতিহাসের সবচেয়ে বিস্তৃত যুদ্ধ বলে ধরা হয়, যাতে ৩০টি দেশের সব মিলিয়ে ১০ কোটিরও বেশি সামরিক সদস্য অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ খুব দ্রুত একটি সামগ্রিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে এবং সামরিক ও বেসামরিক সম্পদের মধ্যে কোনরকম পার্থক্য না করে তাদের পূর্ণ অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা প্রয়োগ করা শুরু করে।

এছাড়া বেসামরিক জনগণের উপর চালানো নির্বিচার গণহত্যা, হলোকস্ট (হিটলার কর্তৃক ইহুদীদের উপর চালানো গণহত্যা), পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োগ প্রভৃতি ঘটনায় কুখ্যাত এই যুদ্ধে প্রায় ৫ কোটি থেকে সাড়ে ৮ কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এসব পরিসংখ্যান এটাই প্রমাণ করে যে এটাই পৃথিবীর ইতিহাসে নৃশংসতম যুদ্ধ।[১]

পূর্ব এশিয়ায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের লক্ষে জাপান ইতোমধ্যেই ১৯৩৭ সালে প্রজাতন্ত্রী চীনে আক্রমণ করে।[২] পরবর্তীতে ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে এবং তার ফলশ্রুতিতে ফ্রান্সযুক্তরাজ্য জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। দ্বিতীয় ঘটনাটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা বলে গণ্য করা হয়।

১৯৩৯ থেকে ১৯৪১ পর্যন্ত একনাগাড়ে বেশ কয়েকটি যুদ্ধ অভিযান পরিচালনা আর চুক্তি সম্পাদনার মাধ্যমে জার্মানি ইতালির সাথে একটি মিত্রজোট গঠন করে এবং ইউরোপ মহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল নিজের দখলে বা নিয়ন্ত্রণে আনতে সমর্থ হয়। মলোটভ- রিবেনট্রপ চুক্তি অনুসারে জার্মানি আর সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের দখলিকৃত পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ডবাল্টিক রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। এই সময় শুধু যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত দেশসমূহ অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছিল (যেমন 'উত্তর আফ্ৰিকার যুদ্ধসমূহ’ আর বহুদিন ধরে চলা ‘আটলান্টিকের যুদ্ধ’)।

১৯৪১ সালের জুন মাসে ইউরোপীয় অক্ষশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে যার ফলশ্রুতিতে সমর ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ রণাঙ্গনের অবতারণা ঘটে। এই আক্রমণ অক্ষশক্তির সামরিক বাহিনীর একটা বড় অংশকে মূল যুদ্ধ থেকে আলাদা করে রাখে। ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপান অক্ষশক্তিতে যোগদান করে এবং প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের পার্ল হারবার আক্রমণ ও ইউরোপীয় উপনিবেশগুলো আক্রমণ করে অত্যন্ত দ্রুততার সাথে পশ্চিম প্ৰশান্ত মহাসাগরের অধিকাংশ অঞ্চল জয় করতে সক্ষম হয়।

১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তির সাথে যোগ দেয়। মূলত জার্মানি এবং জাপান দুই অক্ষশক্তিই যুক্তরাষ্ট্রে আক্রমণ করার মাধ্যমে একে যুদ্ধে ডেকে আনে। অপরদিকে চীনের সাথে জাপানের ছিল পুরাতন শত্রুতা; ১৯৩০ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই এই দুই দেশের মধ্যে দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ চলছিল। এর ফলে চীনও মিত্রপক্ষে যোগদান করে। ১৯৪৫ সালে জার্মানি এবং জাপান উভয় দেশের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

এই যুদ্ধে নব্য আবিষ্কৃত অনেক প্রযুক্তির ধ্বংসাত্মক প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ প্রয়োগ ছিল পারমাণবিক অস্ত্রেরমহাযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যেই এই মারণাস্ত্র উদ্ভাবিত হয় এবং এর ধ্বংসলীলার মধ্য দিয়েই যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে। সকল পুণর্গঠন কাজ বাদ দিলে কেবল ১৯৪৫ সালেই মোট ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। এই যুদ্ধের পরপরই সমগ্র ইউরোপ দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়; এক অংশ হয় পশ্চিম ইউরোপ আর অন্য অংশে অন্তর্ভুক্ত হয় সোভিয়েত রাশিয়া। পরবর্তীতে এই রুশ ইউনিয়নই ভেঙে অনেকগুলো ছোট ছোট রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপের দেশসমূহের সমন্বয়ে গঠিত হয় ন্যাটো আর সমগ্র ইউরোপের দেশসমূহের সীমান্তরেখা নির্ধারিত হতে শুরু করে। ওয়ারস প্যাক্টের মাঝে অন্তর্ভুক্ত দেশসমূহ নিয়ে দানা বেঁধে উঠে স্নায়ুযুদ্ধ। এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বিশ্বমঞ্চে অভিনব এক নাটকের অবতারণা করে।

যুদ্ধের কারণ সম্পাদনা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ নিয়ে যথেষ্ট বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। তবে এ নিয়ে একটি সাধারণ ধারণা রয়েছে যা অনেকাংশে গ্রহণযোগ্য। এই কারণটি যুদ্ধোত্তর সময়ে মিত্রশক্তির দেশসমূহের মধ্যে তোষণ নীতির মাধ্যমে সমঝোতার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায় যা নির্দেশক শক্তির ভূমিকা পালন করে যুক্তরাষ্ট্র এবং ফ্রান্সপ্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি এবং জাপানের আধিপত্য ও সাম্রাজ্যবাদকে দায়ী করে এই কারণটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে যার বিস্তারিত এখানে উল্লেখিত হচ্ছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি তার সম্পদ, সম্মান এবং ক্ষমতার প্রায় সবটুকুই হারিয়ে বসে। এর সাম্রাজ্যবাদী চিন্তাধারার মূল কারণ ছিল জার্মানির হৃত অর্থনৈতিক, সামরিক এবং ভূমিকেন্দ্রিক সম্পদ পুনরুদ্ধার করা এবং পুনরায় একটি বিশ্বশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করা। এর পাশাপাশি পোল্যান্ড এবং ইউক্রেনের সম্পদসমৃদ্ধ ভূমি নিয়ন্ত্রণে আনাও একটি উদ্দেশ্য হিসেবে কাজ করেছে। জার্মানির একটি জাতীয় আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপর সম্পাদিত ভার্সাই চুক্তি হতে বেরিয়ে আসার। এরই প্রেক্ষাপটে হিটলার এবং তার নাৎসি বাহিনীর ধারণা ছিল যে একটি জাতীয় বিপ্লবের মাধ্যমে দেশকে সংগঠিত করা সম্ভব হবে।

যুদ্ধের মূল কারণ ছিল মিত্র শক্তির এক পক্ষ চুক্তি। মিত্র শক্তির এই এক পক্ষ চুক্তি জার্মানিরা মেনে নিতে পারেনি তারা ভাবে যে তাদের সাথে পক্ষপাতিত্ত করা হয়েছে। তাই তাদের মনে একটা ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।

যুদ্ধ শুরু সম্পাদনা

পোল্যান্ড যুদ্ধ সম্পাদনা

 
কোবরিনের যুদ্ধ (সেপ্টেম্বর ১৭, ১৯৩৯) - মানচিত্রে জার্মান দ্বিতীয় মোটোরাইজড ডিভিশনের অগ্রযাত্রা এবং পোলিশ বাহিনীর পিছু হটা

নাৎসি বাহিনীর পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিষ্ক্রিয় রাখার জন্য জার্মানি অনাক্রমণ চুক্তি করে। অন্যদিকে ব্রিটেন ও ফ্রান্স পোল্যান্ডের সাথে সহায়তা চুক্তি করে। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর পোল্যান্ড অভিযান শুরু হয়। ৩ সেপ্টেম্বর মিত্রবাহিনী জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।

প্রথম দিনই জার্মান ঝটিকা বাহিনী পোল্যান্ডকে ছিন্ন-বিছিন্ন করে দেয়। ফরাসি ও ব্রিটিশ বাহিনী সাহায্য করারও সুযোগ পায়নি। এটি পশ্চিমের বিশ্বাসভঙ্গতা হিসেবে পরিচিত। ১৭ই সেপ্টেম্বর গোপন সমঝোতা অনুসারে সোভিয়েত বাহিনীও যুদ্ধে যোগ দেয়। পরদিনই পোলিশ কর্তাব্যক্তিরা দেশ ছাড়েন। ওয়ারস পতন হয় ২৭শে সেপ্টেম্বর। শেষ সেনাদল কক্ দুর্গে যুদ্ধ করে ৬ই অক্টোবর পর্যন্ত।

সোভিয়েত-ফিন শীতকালীন যুদ্ধ সম্পাদনা

জার্মানি ও মিত্রপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ চলাকালীন সময় সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে শীতকালীন যুদ্ধের সূচনা করে। ১৯৩৯ সালের ৩০ নভেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে। ফিনদের লোকবল খুবই কম হলেও তাদের দেশরক্ষার ইচ্ছা ছিল প্রবল। স্তালিন একটি নিজস্ব ঝটিকা যুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। কিন্ত প্রতিটি ফ্রন্টে তার বাহিনী প্রতিহত হয়। ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে বহিষ্কার করা হয়।

নতুন বছরের ২ ফেব্রুয়ারি থেকে সোভিয়েত বিমান, ট্যাঙ্ক ও স্লেজবাহিত সেনাবাহিনী একযোগে ফিনদের প্রতিরক্ষা রেখায় আক্রমণ চালাতে শুরু করে। ১৫ দিন পর অবশেষে তারা একটি ফাঁক তৈরি করতে সক্ষম হয়। ফলে যুদ্ধের ভাগ্য পরিষ্কার হয়ে গেল। ১৯৪০ সালের ৬ মার্চ ফিনল্যান্ড শান্তির জন্য আবেদন করল। সার্বভৌমত্ব রক্ষা পেলেও সোভিয়েত ইউনিয়নের আগের দাবি অনুযায়ী লেনিনগ্রাদের কাছাকাছি বেশকিছু এলাকার মালিকানা ছেড়ে দিতে হয় ফিনল্যান্ডকে। এ যুদ্ধে ২ লক্ষ ফিন সৈন্যের মধ্যে ৭০ হাজার সৈন্য মারা যায়। যুদ্ধ থেকে স্তালিনের সেনাদল গুরুত্বপূর্ণ সামরিক শিক্ষা লাভ করলো। অন্যদিকে সোভিয়েত শক্তি সম্পর্কে হিটলারের ভ্রান্ত নিম্ন-ধারণা তৈরি হয় - যা পরবর্তীতে জার্মানির রাশিয়া আক্রমণে প্রভাব ফেলে।

নরওয়ে ও ডেনমার্ক সম্পাদনা

নরওয়ে বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে তার ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য। সুইডেনের কিরুনা খনি থেকে গরমকালে বাল্টিক সাগর দিয়ে এবং শীতকালে নরওয়ের বরফমুক্ত নারভিক বন্দর ও নরওয়ের রেলপথ দিয়ে লোহা চালান যেত জার্মানিতে। প্রথমে হিটলার নরওয়েকে নিরপেক্ষ থাকতে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ওদিকে মিত্রপক্ষ নারভিকের ঠিক বাইরের সমুদ্রে মাইন পেতে রাখার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনাটি ফাঁস হয়ে গেলে হিটলার ফ্রান্স আক্রমণের ইচ্ছা স্থগিত রেখে নরওয়ে অভিযানের নির্দেশ দিল। ১৯৪০ সালের ৯ই এপ্রিল একই সাথে নরওয়ে ও ডেনমার্কে আগ্রাসন শুরু হল সুইডেনের সাথে যোগাযোগের সুবিধার্থে ।

একদিকে নারভিকসহ গুরুত্বপূর্ণ বন্দরগুলি দখল করে নিল জার্মান বাহিনী। অন্যদিকে বিমানবন্দরগুলিতে অবতরণ করলো প্যারাশ্যুট বাহিনী। এরপর বিমানবন্দর দখল করে সেখান থেকে অতর্কিতে শহরে প্রবেশ করলো জার্মান সেনা। ডেনমার্ক বিনাবাধায় আত্মসমর্পণ করলেও নরওয়ে লড়াই করতে লাগলো। ১৪ই এপ্রিল মিত্রবাহিনী নামলো নরওয়েতে। কিন্ত মে মাসেই পিছু হটলো তারা। নারভিকে জার্মানরা পাঁচগুণ বেশি শত্রুর সাথে লড়াই চালিযে যাচ্ছিল ২৭শে মে পর্যন্ত। কিন্ত ততদিনে ফ্রান্সের পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠায় মিত্রসৈন্যদের ফিরিয়ে নিতে হল নরওয়ে থেকে। নরওয়ে বাহিনী আত্মসমর্পণ করলো এবং রাজা সপ্তম হাকোন ব্রিটেনে আশ্রয় নিলেন। জার্মানির জন্য নরওয়ে আর্কটিক সাগর এবং ব্রিটেনের নিকটবর্তী একটি দরকারি নৌ ও বিমান ঘাঁটি হিসেবে কাজে দিল।

ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ সম্পাদনা

১০ই মে ১৯৪০ একসাথে চারটি দেশ আক্রমণ করে জার্মানি। ফরাসিরা ভেবেছিল আক্রমণ আসবে ফ্রান্স জার্মানি সীমান্তের রণরেখা ম্যাগিনোট লাইনের ওপর। অথবা বেলজিয়ামের ভিতর দিয়ে আরদেন হয়ে। তারা ভেবেছিল জার্মানির প্যানজার বাহিনী আরদেনের জঙ্গল ভেদ করে আসতে পারবে না। ১৪ই মে নেদারল্যান্ডের পতন ঘটলো। ১৪ই মে আরদেন থেকে জার্মান বাহিনী বেরিয়ে এসে দিশেহারা মিত্র সেনাদের ছিন্নবিছিন্ন করে প্রবল বেগে এগোতে থাকল। ডানকার্ক বন্দর দিয়ে তড়িঘড়ি ফরাসি ও ব্রিটিশ অভিযানবাহিনীর সেনা পশ্চাদপসরণ শুরু হলো। ২৬শে মে থেকে ৪ঠা জুন ইতিহাসের বৃহত্তম সেনা অপসারণের কাজ শেষ হলো। তবে ফেলে আসতে হলো বেশিরভাগ যন্ত্রাদি। এরমাঝে ২৭শে মে বেলজিয়ামের পতন হলো।

১০ই জুন ইতালিও যুদ্ধ ঘোষণা করল। তবে তারা আক্রমণ শুরু করে ২০শে জুন থেকে। ফরাসি সরকার প্রথমে তুর ও পরে বোর্দোতে সরে গেল। ১৪ই জুন প্যারিসের পতন ঘটল। ১৬ই জুন প্রধানমন্ত্রী রেনো পদত্যাগ করলেন ও তার বদলে এলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নায়ক পেত্যাঁ। ২২শে জুন জার্মান-ফরাসি এবং ২৪শে জুন জার্মান-ইতালীয় শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফ্রান্সের বেশিরভাগ এলাকা জার্মানি নিয়ে নেয়। অল্প কিছু জায়গা জুড়ে পেঁত্যা একটি নিরপেক্ষ কিন্তু জার্মানির প্রভাবাধীন সরকার গঠন করেন। এটি ভিশি ফ্রান্স নামে পরিচিত হয়।

বলকান অঞ্চল সম্পাদনা

পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের জন্য রুমানিয়ার প্লোইস্তি তেলের খনি হিটলারের প্রয়োজন ছিল। ১৯৪০ সালে জার্মানি-রুমানিয়া তেল-অস্ত্র চুক্তি হল। হাঙ্গেরি ও রুমানিয়ার মতবিরোধ ঘটায় জার্মানি মধ্যস্থতা করে। রুমানিয়ার জনগণ এতে আন্দোলন শুরু করায় রাজা দ্বিতীয় ক্যারল ছেলে মাইকেলের কাছে মুকুট হস্তান্তর করলেন ও সেনাপ্রধান আন্তনেস্কু জার্মান সেনা আহ্বান করলেন। ১২ই অক্টোবর ১৯৪০ বুখারেস্টে জার্মান সৈন্য অবতরণ করে। এতে কুটনৈতিক ভুল বোঝাবুঝির কারণে বিরক্ত মুসোলিনি ১৯৪০ সালের ২৮ অক্টোবর আলবেনিয়া থেকে গ্রিস আক্রমণ করলেন। কিন্তু গ্রিকরা যে শুধু আক্রমণ প্রতিহত করল তাই না, উল্টো ডিসেম্বরের মধ্যে আলবেনিয়ার এক-তৃতীয়াংশ দখল করে ফেলল। উপরন্তু ক্রিটে ব্রিটিশ সৈন্য নামল। তুরস্কও সৈন্যসমাবেশ করে রাখল। আপাত-নিরপেক্ষ বুলগেরিয়া এবং যুগোস্লাভিয়াও বেঁকে বসল।

হিটলার দ্রুত হাঙ্গেরি, রুমানিয়া ও স্লোভাকিয়াকে অক্ষচুক্তিতে টেনে নিলেন। বুলগেরিয়ায় জার্মান সৈন্য নামল ২ মার্চ। যুগোস্লাভিয়ার যুবরাজ পল অক্ষশক্তিতে যোগ দিলেন ২৭ মার্চ। দু'দিন পর জেনারেল সিমোভিচের নেতৃত্বে রাষ্ট্রবিপ্লব ঘটে এবং সিংহাসনে আরোহণ করেন ১৭ বছর বয়সী রাজা দ্বিতীয় পিটার। রাষ্ট্রীয় নীতিরও পরিবর্তন ঘটে। ৬ এপ্রিল একই দিনে আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ এবং বুলগেরিয়া ও অস্ট্রিয়া দিয়ে সৈন্য পাঠিয়ে জার্মানি গ্রিস ও যুগোস্লাভিয়া আক্রমণ করল। ১৭ এপ্রিল যুগোস্লাভিয়া ও ২২ এপ্রিল গ্রিস আত্মসমর্পণ করে। এরপর ক্রিট দখল করা হয়।

যুগোস্লাভিয়াকে খণ্ড-বিখণ্ড করে অক্ষশক্তিরা ভাগ করে নেয়। তবে পুরো যুদ্ধ জুড়ে দ্রজা হিমাজলোচির নেতৃত্বে সেন্টিক দল এবং জোসেফ টিটো'র নেতৃত্বে কমিউনিস্ট গেরিলা দল তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালিয়ে যায়।

উত্তর আফ্রিকা এবং ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল সমূহে অভিযান সম্পাদনা

১৯৪০ এর জুন মাসের শুরুতে ইতালিয়ানরা মাল্টায় তাদের বিমান বাহিনী যোগে আক্রমণ করে এবং ব্রিটিশ উপনিবেশটিকে ঘেরাও করে। সে বছরেরই গ্রীষ্মের শেষ থেকে বসন্তের শুরুর সময়ের ভেতর ইতালিয়ানরা ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ড দখল করে নেয় এবং স্থলপথে ব্রিটিশ অধিকৃত মিশরে হামলা চালায়। অক্টবরের দিকে ইতালিয়ানরা গ্রীসে অসফল একটি অভিযান পরিচালনা করে, যেটাতে তাদের পক্ষের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয় এবং আঞ্চলিক সীমানাতেও তেমন উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তন আসেনি। ইতালিকে সাহায্যের উদ্দেশ্যে জার্মানিও বলকানে হামলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করল যেখানে তাদের মুল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজরা যাতে সেখানে শক্ত কোন অবস্থান নিতে না পারে (কারণ ইংরেজরা যদি বলকানে দখল নিতে পারত তাহলে রুমানিয়ার তৈলখনিগুলো জার্মান আওতার বাইরে চলে যেত) এবং একই সাথে ভুমধ্যসাগরে ব্রিটিশদের একাধীপত্তের ওপর আঘাত হানা।

১৯৪০ এর ডিসেম্বরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমরশক্তি মিশর ও ইতালী অধিকৃত পূর্ব আফ্রিকায় ইতালীয় ফ্যাসিস্ট বাহিনীর ওপর অত্যন্ত সফল পালটা হামলা পরিচালনা করে। এই হামলার ফলশ্রুতিতে ১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারির শুরুতেই ইতালী পূর্ব লিবিয়ার দখল হারাল এবং সেই সাথে তাদের বিপুল পরিমাণ সৈনিক বন্দি হল। স্থল শকির সাথে সাথে ইতালীয় নৌশক্তিও যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হল। তরান্তোর যুদ্ধে ব্রিটিশ রাজকীয় নৌ বহরের বিমানবাহী জাহাজের হামলায় তিনটি যুদ্ধজাহাজ অকেজো হয়ে গেল এবং কেইপ মাটাপানের যুদ্ধে আরো কিছু জাহাজ নষ্ট হল।

আফ্রিকা এবং ভূমধ্যসাগরে ইতালীয় বাহিনীর পরাজয় জার্মানিকে ওই অঞ্চলে একটি অভিযানকারী বাহিনী পাঠাতে বাধ্য করল এবং তার ফলশ্রুতিতে ১৯৪১ সালের মার্চের শেষে মার্শাল রোমেলের আফ্রিকা কর্পস আক্রমণ শুরু করে। মার্শাল রোমেলের বাহিনী কমনওয়েলথ বাহিনীকে পিছু হঠতে বাধ্য করল এবং মাসখানেকের ভেতর তারা পশ্চিম মিশর পর্যন্ত অগ্রসর হল এবং তব্রুক বন্দর ঘেরাও করল।

১৯৪১ সালের মার্চের শেষ দিকে বুলগেরিয়া এবং যুগোস্লাভিয়া ত্রিদলীয় চুক্তিতে (এটি বার্লিন চুক্তি নামেও পরিচিত) স্বাক্ষর করে, যদিও এর দুদিন পরেই ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদীদের দ্বারা যুগোস্লাভ সরকারের পতন হয়। জার্মানি সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং যুগপৎ ভাবে ১৯৪১ সালের ৬ এপ্রিল যুগোস্লাভিয়া এবং গ্রীসে হামলা চালায়। উভয় দেশই মাসখানেকের ভেতর আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মে মাসের শেষ দিকে গ্রীসের ক্রিট দ্বীপে ছত্রীসেনা অবতরণ অভিযানের ভেতর দিয়ে জার্মানির বলকান বিজয় অভিযান সম্পন্ন হয়। জার্মানি যদিও এই অঞ্চলে দ্রুত বিজয় লাভ করেছিল, কিন্তু এরপর পরই জার্মানির দখলদারিত্বের প্রতিবাদে যুগোস্লাভিয়াতে বৃহৎ আকারের প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় যেটা মহাযুদ্ধের শেষ সময় পর্যন্ত চালু ছিল।

সেই সময়, অর্থাৎ '৪১ সালের মে মাসে কমনওয়েলথ বাহিনী ইরাকে জার্মান সমর্থিত একটি অভ্যুত্থান বানচাল করে দেয়। এই অভ্যুত্থানে ভিশি ফ্রান্সের দখলে থাকা সিরিয়ার বিমান ঘাঁটি থেকে জার্মান বিমান বাহিনী প্রত্যক্ষ সহায়তা দিচ্ছিল। জুন জুলাই মাসের দিকে কমনওয়েলথ বাহিনীগুলো সিরিয়াতে ও লেবাননে সফল হামলা করে এবং উক্ত দেশদুটি দখলে নিয়ে আসে। এই অভিযানে তাদেরকে প্রত্যক্ষ সহায়তা দেয় মুক্ত ফ্রান্সের মুক্তিকামী সৈন্যরা।

অক্ষশক্তি কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ সম্পাদনা

মুল নিবন্ধঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব ফ্রন্ট

মুলতঃ পূর্ব ফ্রন্ট নামে অধিক পরিচিত। সোভিয়েতদের কাছে পরিচিত "পিতৃভূমি রক্ষার যুদ্ধ" নামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুর দিককার সমস্ত আঁচ ছিল পশ্চিম ইয়োরোপের দেশগুলোর ওপর। যেসব দখলের মাধ্যমে জার্মানি বেশ ভালো রকমের রসদ পেয়েছিল যুদ্ধ চালিয়ে যাবার। একই সাথে জার্মানির প্রধান একজন প্রতিদ্বন্দ্বীকে দমিয়ে ফেলা হয়েছিল। যেটা ছিল ফ্রান্স। ফ্রান্সকে মাত্র ১মাসের ভেতর হারিয়ে দিয়ে হিটলার জার্মান জাতির প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অপমানের প্রতিশোধ নিয়ে ফেলে, যেটা জার্মান জনগণকে নাৎসিজমের সাথে এবং হিটলারের সাথে থাকতে উদ্বুদ্ধ করে।

উদ্ভূত পরিস্থিতকে সামনে রেখে জার্মানি, জাপান এবং সোভিয়েত রাশিয়া প্রস্তুতি নিতে থাকে। জাপানের সাথে রাশিয়ার অনাক্রমণ চুক্তি সম্পাদিত হয়ে যায়। জার্মানিও রাশিয়ার সাহে একটা মতৈক্যে আসার চেষ্টায় ছিল, কারণ সেই সময়টায় হিটলারের লক্ষ্য ছিল ইংল্যান্ডকে বশে আনা।

ইংল্যান্ড যাতে করে আমেরিকা আর রাশিয়াকে যুদ্ধে টেনে আনতে না পারে সেই লক্ষ্যে হিটলার রাশিয়ার সাথে একটা চুক্তি চেয়েছিল। একই সাথে সে রাশিয়া আক্রমণের জন্য সীমান্তে বিশাল সৈন্য সমাবেশ করছিল। কারণ যদি সে রাশিয়ার সাথে চুক্তিতে ব্যর্থ হয় তবে রাশিয়ার ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা করতে হবে যুদ্ধের মাধ্যমে।

বনিবনা না হওয়ায় রাশিয়া জার্মানি চুক্তি হল না, এবং ১৯৪০ সালের ১৮ ডিসেম্বর হিটলার রাশিয়া আক্রমণের প্রস্তুতি নেওয়ার আদেশ প্রদান করে।

২২জুন, ১৯৪১ সালে জার্মানি মিত্র ইতালি এবং রোমানিয়াকে নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নে আক্রমণ করে। এই অভিযান "অপারেশন বার্বারোসা" নামে পরিচিত। এই অভিযানের মুল লক্ষ্য ছিলো ১৯৪১ এর ভেতর রাশিয়ার বিশাল উর্বর অংশের এবং শিল্পাঞ্চলসমূহের দখল নেয়া, কমিউনিজমের বিনাশ করা এবং জার্মানির পরবর্তী শত্রুদের বিপরীতে যুদ্ধ পরিচালনার পর্যাপ্ত রসদ যোগানো।


প্রধান নিবন্ধসমূহ সম্পাদনা

শরণার্থী সমস্যা সম্পাদনা

 
১৯৪২ সালে স্ট্যালিনগ্রাদের যুদ্ধে রুশ শরণার্থীদের অন্যত্র গমনের দৃশ্য।
 
মন্ট্রিল ডেইলি স্টার: "জার্মানি ছাড়", ৭ মে, ১৯৪৫

সংঘর্ষ এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে এ সময়ে অগণিতসংখ্যক লোক শরণার্থী হয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে একমাত্র ইউরোপেই ৪০ মিলিয়নেরও অধিক লোক শরণার্থী ছিল।[৩] ১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি জাতিসংঘ ত্রাণ ও পুণর্বাসন প্রশাসন (ইউএনআরআরএ) গঠন করে। যার প্রধান কাজ ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন দেশসহ ইউরোপ ও চীন থেকে আগত শরণার্থীদেরকে সহায়তা করা। তাদের নিয়ন্ত্রণে ও প্রত্যক্ষ সহায়তায় ৭ মিলিয়ন লোক নিজ বাসভূমিতে ফিরে যায়। কিন্তু উদ্বাস্তু এক মিলিয়ন লোক মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে অস্বীকৃতি জানায়।

বিশ্বযুদ্ধের শেষ মাসে প্রায় পাঁচ মিলিয়ন জার্মান বেসামরিক নাগরিক পূর্ব প্রুশিয়া, পোমারানিয়া এবং সিলেসিয়া রাজ্য থেকে রেড আর্মির প্রচণ্ড আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে ম্যাকলেনবার্গ, ব্রান্ডেনবার্গ এবং স্যাক্সনিতে উদ্বাস্তু হিসেবে আশ্রয় নেয়।

পটসড্যাম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত মিত্রশক্তি অনুমোদন না করায় যুগোস্লাভিয়া এবং রোমানিয়ায় অবস্থানরত হাজার হাজার জাতিগত জার্মানদেরকে সোভিয়েত ইউনিয়নে দাস শ্রমের জন্য ফেরত পাঠানো হয়। বিশ্বের ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে বেশি শরণার্থী স্থানান্তর প্রক্রিয়া। ১৫ মিলিয়ন জার্মানদের সবাই এতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এছাড়াও, দুই মিলিয়নেরও অধিক জার্মান বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে বিতাড়িত হয়ে প্রাণ হারান।[৪][৫][৬][৭][৮]

আরও দেখুন সম্পাদনা

টীকা সম্পাদনা

  1. ১৯৩৯ সালে মলোটভ-রিবেনট্রপ চুক্তি অনুসারে সোভিয়েত ইউনিয়ন জার্মানির সাথে একত্রে পোল্যান্ড আক্রমণ করে। ১৯৩৯-৪০-এর শীতে দেশটি আবারো নিরপেক্ষ ফিনল্যান্ড দখল করে নেয়। ঘটনা দুইটির কোনটিই তৎকালীন বিশ্বনেতৃত্বে কোনরকম সাড়া ফেলতে পারে নি।
  2. ১৯৩৭ সাল থেকেই চীন ও জাপান একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।
  3. ১৯৪০ এর জুন মাসে ফ্রান্সের পতন হলে সমগ্র ফ্রান্স দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়; একদিকে ভিশি সরকার (যেটা কাগজপত্রে নিজেদের একটি নিরপেক্ষ সরকার হিসেবে ঘোষণা করে) ও অন্যদিকে "মুক্ত ফ্রান্স" (যা অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায়)। মিত্রশক্তি মুক্ত ফ্রান্স সরকারকে আইনগত স্বীকৃতি দেয় এবং স্বাধীনতা অর্জনে সহায়তা করে।
  4. ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে জার্মান শক্তির হাতে চেকোস্লোভাকিয়ার পতন হয়। ১৯৪১ সালে লন্ডনে চেকোস্লোভাক প্রবাসী সরকার গঠিত হয় এবং যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতি লাভ করে। যুক্তরাজ্যের রণসজ্জায় এই সরকার সেনাসহায়তা প্রদান করে।
  5. ১৯৩৬ সালে ইতালি ইথিওপিয়া দখল করে। ১৯৪১ সালে মিত্রবাহিনীর সহায়তায় দেশটি মুক্ত হয় এবং এর সাম্রাজ্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
  6. ১৯৪০ সালের এপ্রিল মাসে জার্মানি ডেনমার্ক দখল করে। তৎকালীন ডেনমার্ক সরকারকে জার্মানীর আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য করা হয় এবং ১৯৪৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই ব্যবস্থা বলবৎ থাকে।
  7. ১৯৩৭ সাল থেকেই চীন ও জাপান একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল।
  8. ১৯৪৩-এর সেপ্টেম্বরে ইতালি একটি সাময়িক যুদ্ধবিরতি চুক্তি সাক্ষর করে এবং সেই চুক্তি অনুসারে রাজকীয় সরকার মিত্রশক্তির পক্ষে লড়াই করা শুরু করে। তবে উত্তরে প্রতিষ্ঠিত প্রজাতন্ত্র সরকার অক্ষশক্তির পক্ষে যুদ্ধ করা চালিয়ে যায়।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Sommerville 2008, পৃ. 5.
  2. Barrett, David P; Shyu, Lawrence N (২০০১)। China in the anti-Japanese War, 1937–1945: politics, culture and society. Volume 1 of Studies in modern Chinese history। New York: Peter Lang। পৃষ্ঠা 6আইএসবিএন 0-8204-4556-8  অজানা প্যারামিটার |unused_data= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)
  3. "Refugees: Save Us! Save Us!"। Time। ৯ জুলাই ১৯৭৯। ২৪ এপ্রিল ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ জুন ২০১২ 
  4. Statistisches Bundesamt, Die Deutschen Vertreibungsverluste। Wiesbaden। ১৯৫৮। 
  5. Forced Resettlement", "Population, Expulsion and Transfer", "Repatriation"Encyclopaedia of Public International Law (Volumes 1–5 সংস্করণ)। Amsterdam: North Holland Publishers। ১৯৯৩–২০০৩। 
  6. Norman Naimark (১৯৯৫)। The Russians in Germany। Harvard University Press। 
  7. Alfred de Zayas (১৯৭৭)। Nemesis at Potsdam। London and Boston: Routledge। 
  8. Alfred de Zayas (২০০৬)। A Terrible Revenge। Palgrave/Macmillan। 

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা