নহুষ

হিন্দু পৌরাণিক চরিত্র

হিন্দু পুরাণ অনুসারে, নহুষ (সংস্কৃত: नहुष) ছিলেন চন্দ্রবংশের একজন রাজা এবং ৩,৬৯৮,২৫৬তম ইন্দ্র(দেবতাদের রাজা)। তিনি ছিলেন রাজা পুরূরবার জেষ্ঠতম সন্তান আয়ু ও শ্বারভানুর কন্যা প্রভার পুত্র ও মহাভারতের অন্যতম একজন চরিত্র। তিনি বিরজাকে বিবাহ করেন। তাদের ছয় কি সাতজন পুত্র ছিলেন, ভিন্ন ভিন্ন পুরাণ অনুসারে,তার জ্যেষ্ঠতম পুত্র যাতি একজন ঋষি হওয়ায় তার আরেক পুত্র যযাতি পরবর্তীকালে সিংহাসনে আরোহণ করেন।[১] নহুষের জীবন সম্পর্কে আরো জানা যায় যে তিনি অশোকাসুন্দরীকে বিবাহ করেন যিনি ছিলেন ভগবান শিব ও পার্বতীর কন্যা এবং অশোকাসুন্দরী ছিলেন যযাতি ও একশত কন্যার মাতা।[২][৩][৪]

নহুষ
অন্তর্ভুক্তিমহাভারতের চরিত্র, স্বর্গের রাজা
গ্রন্থসমূহমহাভারত
ব্যক্তিগত তথ্য
মাতাপিতাআয়ু (পিতা) , প্রভা (মাতা)
দম্পত্য সঙ্গীঅশোকাসুন্দরী
সন্তানযাতি,যযাতি (পুত্র),
একশত কন্যা যেমন-আয়াতি,সাম্যতি,কৃতি ও ব্যাতি

ভগিনী নিবেদিতা ,ঋষি ভরদ্বাজের জীবনী সম্পর্কিত গাভীর মূল্য নামক পৌরাণিক কাহিনীতে রাজা নহুষের কথা উল্লেখ করেছেন। একবার ভরদ্বাজ মুনি একজন ধীবরের জালে মাছসহ আটকা পড়ে যান। তখন সেই ধীবর রাজা নহুষের কাছে তাকে নিয়ে যান এবং ঋষি ও মাছটির জন্য তাকে প্রাপ্য অর্থ দেওয়ার কথা বললে,রাজা নহুষ ঋষির পরিবর্তে একটি গাভী সেই ধীবরকে দেন।[৫]

পৌরাণিক কাহিনী সম্পাদনা

জন্ম ও শৈশব সম্পাদনা

একদা শিবপার্বতী নন্দনকাননে গিয়েছিলেন। পার্বতী, কল্পতরু(ইচ্ছা-পূরণ করা গাছ) দেখার পর মানত করলেন যে তার যেন একটি কন্যাসন্তান হয়। সঙ্গে সঙ্গে, অশোকাসুন্দরী নামক একজন কুমারীর জন্ম হয়। পার্বতী বললেন যে এটি পূর্বনির্ধারিত হয়ে রয়েছে যে, অশোকাসুন্দরীর সাথে আয়ুর পুত্রের বিবাহ হবে। একদা,অসুর হুন্ড সেই কল্পতরুতে প্রবেশ করেন ও তিনি কামুক হয়ে পড়ায় অশোকাসুন্দরীকে অপহরণ করে কারণ এর পূর্বে অশোকাসুন্দরী তাকে বলেছিল যে সে শুধু আয়ুর পুত্রকেই বিবাহ করবে। অপহরণের সময় সে তাকে অভিশম্পাত করে যে আয়ুর পুত্রের দ্বারা তার মৃত্যু হবে। তারপর অশোকাসুন্দরী তীব্র কান্নায় ভেঙে পড়ে।

ইতিমধ্যে,পুরূরবা ছিলেন চন্দ্রবংশের উত্তরসূরী ও তিনি প্রয়াগরাজ শাসন করছিলেন এবং এই প্রয়াগরাজের রাজধানী ছিল প্রতিষ্ঠান। যখন তিনি রাজ্যশাসন থেকে অবসর নিয়ে স্বর্গারোহণ করলেন,তখন তার পুত্র আয়ু রাজা হলেন। আয়ুর বিবাহ হয়েছিল প্রভার সাথে,যিনি ছিলেন রাহুর কন্যা। যদিও তারা সন্তানহীন দম্পতি ছিলেন।

আয়ু ঋষি-দ্রষ্টা দত্তাত্রেয়ের কাছে গেলেন ও সেবার মাধ্যমে সন্তুষ্ট করার পর তার কাছে মিনতি করলেন যে তার যেন একটি পুত্র হয় ও সেই পুত্রটি হবে একজন অপরাজেয় যোদ্ধা ও তার মধ্যে থাকবে সেই সমস্ত ন্যায়পরায়ণ ও ধর্মীয় মনোভাব যা একজন রাজার পক্ষে উপযুক্ত। তখন মহর্ষি দত্তাত্রেয় তাকে করুণা করলেন ও আয়ুর স্ত্রী প্রভার গর্ভে একটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করল। হুন্ড আয়ুর পুত্র জন্মানোর আগে পর্যন্ত প্রতীক্ষায় ছিলেন কারণ তিনি ভীত হয়ে পড়েছিলেন রে হয়তো অশোকাসুন্দরীর অভিশাপ সত্যি হয়ে যাবে। এরপর সে সেই শিশুটিকে অপহরণ করে ও তার অনুগামীদের আদেশ দেয় যে তারা যেন শিশুটিকে হত্যা করে। যাইহোক,তার অনুগামীরা শিশুটিকে মহামুনি বশিষ্ঠের আশ্রমে দিয়ে আসে। বশিষ্ঠ, শিশুটিকে দেখতে পান ও তাকে গ্রহণ করে তার নামকরণ করেন নহুষ যার অর্থ নির্ভীক। নহুষ,বশিষ্ঠের একজন শিষ্য হিসেবে বড়ো হতে থাকেন। কিন্তু অবশেষে বশিষ্ঠ নহুষের প্রকৃত পিতামাতার সম্পর্কে অবগত হন। নহুষ দেবতাদের কাছ থেকে অস্ত্রাদি সংগ্রহ করেন ও হুন্ডের সাথে প্রখর যুদ্ধে তাকে পরাজিত ও নিহত করে তার প্রকৃত পিতামাতার নিকট ফিরে যান। পরবর্তীকালে তিনি অশোকাসুন্দরী কে বিবাহ করেন।

স্বর্গ শাসন সম্পাদনা

দেবরাজ ইন্দ্রের অনুপস্থিতিতে নহুষকে স্বর্গের রাজা করা হয়েছিল। কিন্তু নহুষ শীঘ্রই খুব অহংকারী হয়ে যাওয়ায় অভিশাপগ্রস্ত হয়ে মর্ত্যে পতিত হন।

দ্বাপরযুগে, যখন পাণ্ডবগণ তাদের অন্তিম যাত্রায় হিমালয় পর্বতে অবস্থান করছিলেন, তখন নহুষ দৈত্যাকার সর্পের রূপে মহামতি ভীমকে ধরে ফেলেন ও ভক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ভীম প্রচন্ড শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও নহুষও প্রচুর শক্তির অধিকারী ছিল কারণ তিনি অগস্ত্য মুনির থেকে বর পেয়েছিলেন যে নহুষের চেয়ে শক্তিশালী সবকিছুই তার শক্তির কাছে হার মানবে।

ইতিমধ্যে, যুধিষ্ঠির ভীমের সন্ধান করতে থাকেন ও অবশেষে তাকে খুঁজে পেয়ে তার সঙ্কটাপন্ন অবস্থা দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কিন্তু নহুষ বুঝতে পারলেন যে তিনি যুধিষ্ঠিরের উত্তরসূরী এবং তার পাপের জন্য অনুশোচিত হয়ে তার অভিশাপের কথা যুধিষ্ঠিরকে বলেন। তারপর যুধিষ্ঠির ও নহুষ, ধর্ম সম্বন্ধে তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন। নহুষ তার ভুল সম্পর্কে যুধিষ্ঠিরকে জানান ও বলেন যে নহুষ তাদের জীবন থেকে অনেককিছু শিখেছেন। অনুশোচনার পর নহুষ তার অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে যান ও স্বর্গে আরোহণ করেন। ভীমও তার পূর্বের মহাশক্তি পুনরুদ্ধার করেন।[৬]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Pargiter, F.E. (1972). Ancient Indian Historical Tradition, Delhi: Motilal Banarsidass, p.85-6.
  2. Bibek Debroy, Dipavali Debroy (2002). The holy Puranas. p. 152. "Nahusha and Ashokasundari had a son named Yayati.”
  3. George M. Williams (২৭ মার্চ ২০০৮)। Handbook of Hindu Mythology। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 217–8, 230। আইএসবিএন 978-0-19-533261-2 
  4. Gaṅgā Rām Garg (১৯৯২)। Encyclopaedia of the Hindu World Vol. 3। Concept Publishing Company। পৃষ্ঠা 712। আইএসবিএন 978-81-7022-376-4 
  5. Margaret Elizabeth Noble; Ananda Kentish Coomaraswamy; Sister Nivedita (১৯৬৭)। Myths of the Hindus and Buddhists । Courier Corporation। পৃষ্ঠা 371–372। আইএসবিএন 978-0-48-621759-8 
  6. "Yudhishthira releases Nahusha from a curse – Vyasa Mahabharata" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৮-১৮ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা

  উইকিমিডিয়া কমন্সে নহুষ সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।