সত্যবতী

কুরুরাজ শান্তনুর পত্নী

সত্যবতী (দেবনাগরী: सत्यवती ) হলেন মহাভারতে বর্ণিত হস্তিনাপুরের কুরুরাজ শান্তনুর মহিষী। তিনি কৌরবপাণ্ডবদের প্রপিতামহী এবং তিনি বেদব্যাসের জননী । তার উপাখ্যান মহাভারত, হরিবংশদেবীভাগবদ্পুরাণে বর্ণিত হয়েছে।

সত্যবতী
কুরু রাণী
Ravi Varma-Shantanu and Satyavati.jpg
রাজা শান্তনু ও সত্যবতী
কুরু রাণী
পূর্বসূরিগঙ্গা
উত্তরসূরিঅম্বিকা
দাম্পত্য সঙ্গীশান্তনু
বংশধরচিত্রাঙ্গদা
বিচিত্রবীর্য
রাজবংশহস্তিনাপুর

সত্যবতী চেদীরাজ উপরিচর বসু এবং শাপগ্রস্তা মৎস্যরূপিণী অপ্সরা অদ্রিকার কন্যা। ধীবরদের রাজা দাশ তাকে তার যমজ ভাইয়ের সাথে অদ্রিকার উদরে পান। রাজা বসু পুত্র সন্তানটিকে নিজের কাছে রেখে সত্যবতীকে দাশের কাছে পরিপালন করতে দেন। তার ভাই মৎস্যরাজ নামে এক ধার্মিক রাজা হন। তার গায়ে তীব্র মাছের গন্ধ থাকায় তার আরেক নাম 'মৎস্যগন্ধা'। এজন্য কেউ তার কাছে আসতে চাইত না। তাই পালকপিতার নির্দেশে তিনি যমুনার বুকে নৌকা চালানো আর জেলেনী হিসেবে কাজ করতেন। পরবর্তীতে রাজা শান্তনু তার সৌন্দর্য ও গায়ের সৌরভে মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়েন এবং দাশরাজের কাছে বিবাহের প্রস্তাব করলে দাশ বলেন যদি তার কন্যার সন্তানেরা রাজা হন তবেই তিনি কন্যাদান করবেন। এজন্য শান্তনুর জ্যেষ্ঠপুত্র ভীষ্ম রাজা হননি। সত্যবতী শান্তনুর মাধ্যমে চিত্রাঙ্গদবিচিত্রবীর্যের জন্ম দেন। তিনি পাণ্ডুর মৃত্যুর পর তার পুত্র ব্যাসের আশ্রমে তপস্যারত অবস্থায় মারা যান।

সাহিত্যিক উৎস ও নামসমূহসম্পাদনা

সত্যবতী সম্পর্কে মহাভারতে খুব কমই বলা হয়েছে। তবে হরিবংশ ও দেবীভাগবত পুরাণে তার উপাখ্যান বিস্তারিতভাবে আছে।[১] সত্যবতী মহাভারতে বিভিন্ন নামে পরিচিতা। তাকে দাশেয়ী, গন্ধকালী, গন্ধবতী, কালী, মৎস্যগন্ধা, সত্যা, বাসবী, যোজনগন্ধা ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়েছে। তার সপত্নীপুত্র ভীষ্ম তাকে দাশেয়ী নামেও সম্বোধন করতেন যেহেতু তিনি দাশরাজের কন্যা।[১][২] বাসবী অর্থ বসুরাজের কন্যা। তার কালী নাম থেকে বোঝা যায় তিনি শ্যামাঙ্গী ছিলেন।

জন্ম ও বাল্যকালসম্পাদনা

হরিবংশ অনুসারে সত্যবতী তার পূর্বজন্মে অচ্ছোদা নামে পিতৃগণের কন্যা ছিলেন যিনি শাপগ্রস্তা হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নেন।[১] মহাভারত, হরিবংশদেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে সত্যবতী শাপগ্রস্তা অপ্সরা অদ্রিকার কন্যা। অভিশাপের কারণে অদ্রিকা মৎস্যে পরিণত হয়ে যমুনায় বাস করত। একদা দাশ নামক ধীবরের জালে ধরা পরে যে তার গর্ভ থেকে দুটি সন্তান পায়। সে শিশুদুটিকে রাজার কাছে নিয়ে গেলে রাজা পুত্র সন্তানটিকে গ্রহণ করেন এবং কন্যা সন্তানটিকে দাশকে পালন করতে দেন। সত্যবতীর যমজ ভাই মৎস্যরাজ নামে মৎস্যরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এক ধার্মিক রাজা হন। সত্যবতী বড় হয়ে তার বাবার আদেশে ধর্মার্থে নৌকা বাইতে লাগলেন।[৩]

মহাভারতে সত্যবতীসম্পাদনা

ব্যাসদেব কর্তৃক লিখিত মহাভারতে সত্যবতীর নাম আছে।

শান্তনু - সত্যবতীসম্পাদনা

 
দেবব্রতের ব্রহ্মচার্যের ভীষণ প্রতিজ্ঞা

একদিন হস্তিনাপুরের কুরুরাজ শান্তনু মৃগয়া করতে যমুনার তীরে গিয়েছিলেন এমন সময় মৃগনাভির সৌরভে তিনি বিমোহিত হন। গন্ধের উৎস অনুসন্ধান করে তিনি সত্যবতীর গৃহে উপস্থিত হন এবং সেখানে সত্যবতীকে দেখে তার প্রেমে পড়েন। তিনি সত্যবতীর পিতা ধীবরনেতা দাশরাজের কাছে সত্যবতীর পাণিপ্রার্থনা করেন কিন্তু দাশ বলে যদি তার কন্যার গর্ভজাত পুত্রেরাই রাজা হয় তবেই সে কন্যা সম্প্রদান করবে।[১][৪][৫]

রাজা মর্মাহত ও বিমর্ষ হয়ে ফেরে এলেন কারণ এর পূর্বেই তিনি তার পুত্র দেবব্রতকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করেছিলেন। পিতার পীড়া দেবব্রতকে কষ্ট দিচ্ছিল। তিনি এক মন্ত্রীর কাছ থেকে সেই ধীবরের শর্তের কথা শুনেন। তৎক্ষণাত তিনি সেই ধীবরের কাছে উপস্থিত হন এবং দাশরাজের কাছে তার পিতার পক্ষ থেকে সত্যবতীকে প্রার্থনা করেন কিন্তু ধীবর পুনরায় তার শর্তের কথা জানায় এবং বলে শান্তনুই তার জন্য উপযুক্ত ছিলেন যেজন্য ব্রহ্মর্ষি অসিতের প্রস্তাবও ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।[১][৪][৫]

দেবব্রত সত্যবতীর পুত্রদের জন্য সিংহাসনের দাবী ত্যাগ করলেন। কিন্তু দাশ বলল যদি তার অনুপস্থিতিতে তার পুত্রেরা সিংহাসন নিয়ে বিবাদ করে। এতে শান্তনু আজীবন ব্রহ্মচর্য পালনের ভীষণ প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন। দাশরাজ তখনই তাকে কন্যা দান করে। এমন ভীষণ প্রতিজ্ঞা করার জন্য দেবব্রতের নাম হয় ভীষ্ম। ভীষ্ম সত্যবতীকে শান্তনুর কাছে উপস্থিত করলেন। রাজা খুশি হয়ে ভীষ্মকে ইচ্ছামৃত্যু হওয়ার বর প্রদান করলেন।[১][৪][৫] দেবী ভাগবত পুরাণে সত্যবতীর কানীন পুত্র বেদব্যাস এই বলে আক্ষেপ করেন যে তার মাতা তাকে শিশু অবস্থায় ত্যাগ করেছেন। তিনি তার জন্মস্থানে মায়ের খোঁজে আসেন কিন্তু লোকমুখে শুনেন তার মাতা এখন হস্তিনাপুরের রাণী।[১]

পুত্র ও পৌত্রের জন্মসম্পাদনা

 
জাভানিজ ওয়াং কুলিত ছায়া পুতুল নাচে সত্যবতী

বিবাহের পর শান্তনু ও সত্যবতীর দাম্পত্য জীবন সুখে কাটতে থাকে। রাজা শান্তনু বৃদ্ধ বয়সে পৌছে গেছেন ততদিনে। তারা দৈহিক মিলনে আবদ্ধ হলে চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য নামে দুই পুত্রের জন্ম হয়। হরিবংশে শান্তনুর মৃত্যুর পরবর্তী ঘটনাবলী বর্ণিত হয়েছে। শান্তনুর মৃত্যুর পর উগ্রায়ুধ পৌরব (পাঞ্চালের সিংহাসন দখল কারী) ধনের বদলে সত্যবতীকে দাবী করেছিলেন। ভীষ্ম উগ্রায়ুধকে বধ করেন। অপরের স্ত্রীকে কামভাবে প্রার্থনা করায় তার শক্তি লোপ পেয়েছিল। তবে মহাভারতে এসব উল্লেখ নেই সেখানে শান্তনুর মৃত্যুর পর ভীষ্ম চিত্রাঙ্গদকে রাজ্যে অভিষিক্ত করেন। পরবর্তীতে চিত্রাঙ্গদ তার নামেরই এক গন্ধর্বের হাতে যুদ্ধে নিহত হন।[৬]

চিত্র:Vyasa with his mother.jpg
সত্যবতী ও বেদব্যাস

চিত্রাঙ্গদের মৃত্যুর পর ভীষ্ম বিচিত্রবীর্যকে রাজ্যে অভিষিক্ত করলেন এবং সে বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তার পক্ষে রাজ্য পরিচালনা করলেন। বিচিত্রবীর্যের সাথে কাশীরাজের কন্যা অম্বিকাঅম্বালিকার বিবাহ হয় যাঁরা ভীষ্ম কর্তৃক স্বয়ম্বর থেকে বিজিত হয়েছিলেন। বিবাহের মাত্র সাত বছর পর বিচিত্রবীর্য যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। যথাকালে অম্বিকা একটি অন্ধপুত্র ও অম্বালিকা পাণ্ডুবর্ণ পুত্র প্রসব করলেন, তাদের নাম ধৃতরাষ্ট্রপাণ্ডু

মৃত্যুসম্পাদনা

সত্যবতীর পৌত্র পাণ্ডু রাজ্যে অভিষিক্ত হলেন। কিন্তু পাণ্ডু কিমিন্দম ঋষি কর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে রাজ্য ত্যাগ করেন এবং তার দুই স্ত্রী কুন্তীমাদ্রীকে নিয়ে বনে বাস করতে থাকেন। সেখানে তার স্ত্রীরা পঞ্চপাণ্ডবের জন্ম দেন। পাণ্ডু ঋষির অভিশাপের ফলে মৃত্যুবরণ করলে মাদ্রী শোকার্ত হয়ে মারা যান। কুন্তী পঞ্চপাণ্ডবকে নিয়ে হস্তিনাপুরে ফিরে আসেন। পাণ্ডুর মৃত্যুসংবাদ শুুুনে সত্যবতী খুব শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং বেঁচে থাকার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেন। পাণ্ডুর সৎকারের পর ব্যাস সত্যবতীকে বলেন খুব শীঘ্রই তার পরিজনেরা ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে যা তিনি বৃদ্ধ বয়সে সইতে পারবেন না। এতে সত্যবতী তার পুত্রবধূ অম্বিকা ও অম্বালিকাকে নিয়ে বনে গিয়ে তপস্যা শুরু করেন এবং দেহত্যাগ করে স্বর্গারোহণ করেন।

তথ্যসূত্রসম্পাদনা

  1. Bhattacharya, Pradip (মে–জুন ২০০৪)। "Of Kunti and Satyawati: Sexually Assertive Women of the Mahabharata" (পিডিএফ)Manushi (142): 21–25। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ 
  2. Pargiter, F.E. (1972). Ancient Indian Historical Tradition, Delhi: Motilal Banarsidass, p.69.
  3. Ganguli, Kisari Mohan (১৮৮৩–১৮৯৬)। "SECTION LXIII"। The Mahabharata: Book 1: Adi Parva। Sacred texts archive। 
  4. For Bhishma: Mani pp. 135-6
  5. Ganguli, Kisari Mohan (১৮৮৩–১৮৯৬)। "SECTION C"। The Mahabharata: Book 1: Adi Parva। Sacred texts archive। 
  6. Ganguli, Kisari Mohan (১৮৮৩–১৮৯৬)। "SECTION CI"। The Mahabharata: Book 1: Adi Parva। Sacred texts archive। 

৭|https://www.agniveerbangla.org/2020/05/blog-post_30.html?m=1