হরিবংশ

একটি ভারতীয় ইতিহাস গ্রন্থ

হরিবংশ (हरिवंश; অর্থাৎ, হরি বা বিষ্ণুর পরম্পরা) সংস্কৃত সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এই গ্রন্থে অনুষ্টুপ ছন্দে মোট ১৬,৩৭৪টি শ্লোক আছে। গ্রন্থটি হরিবংশ পুরাণ নামেও পরিচিত। এটিকে মহাভারতের “খিল” বা পরিশিষ্ট মনে করা হয়,[৩] এবং ঐতিহ্যগতভাবে বেদব্যাসকেই এই গ্রন্থের রচয়িতা মনে করা হয়। মহাভারতের বিখ্যাত টীকাকার নীলকণ্ঠ চতুর্ধর তাঁর টীকা ভারতভাবদীপ-এ হরিবংশকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। মহাভারতের একটি ঐতিহ্যগত সংস্করণ অনুসারে, হরিবংশ দুটি পর্বে বিভক্ত এবং এর মোট শ্লোকসংখ্যা ১২,০০০।[৪] এগুলো মহাভারতের আঠারোটি পর্বের সাথে অন্তর্ভুক্ত।[৫] সমালোচনামূলক সংস্করণে তিনটি পর্ব এবং ৫,৯৬৫টি শ্লোক রয়েছে।[৬] ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পাওয়া ঊনবিংশ শতাব্দীর পাণ্ডুলিপিতে তিনটি পর্বের উল্লেখ পাওয়া যায়-হরিবংশপর্ব, বিষ্ণুপর্ব ও ভবিষ্যপর্ব। এই পর্বগুলো মহাভারতের অষ্টাদশ পুরাণ তালিকার অন্তর্ভুক্ত।

হরিবংশের তিনটি পর্বের প্রথম দুটিতে কৃষ্ণের কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। এই গ্রন্থ মতে কৃষ্ণ হলেন বিষ্ণুর অষ্টম অবতার। এই দুটি স্কন্দে কৃষ্ণের জন্ম থেকে যৌবনকালের বর্ণনা আছে। হিন্দু বৈষ্ণবরা এই কাহিনিগুলি মান্য করেন।[১][২]
পরশুরাম কৃষ্ণবলরামকে গোমন্ত পর্বতের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। হরিবংশ সিরিজের ক্ষুদ্রাকৃতি কাংড়ার পুরখুতে উল্লেখ করা হয়েছে। কাংড়া, গ. ১৮০০-১৮১৫। সরকারী যাদুঘর এবং আর্ট গ্যালারি, চণ্ডীগড়

হরিবংশের আদিপর্ব মহাবিশ্বের সৃষ্টি এবং কৃষ্ণের জন্ম পর্যন্ত পৌরাণিক সূর্য ও চন্দ্র রাজবংশের রাজাদের কিংবদন্তি ইতিহাস বর্ণনা করে। বিষ্ণুপর্ব মহাভারতের পূর্বের ঘটনা পর্যন্ত কৃষ্ণের ইতিহাস বর্ণনা করে।[৭] তৃতীয় গ্রন্থ ভবিষ্য পর্বে, দুটি বিকল্প ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি তত্ত্ব, শিব ও বিষ্ণুর স্তোত্রাদি এবং কলিযুগের একটি বর্ণনা প্রদান করে।[৮] যদিও হরিবংশকে বিষ্ণুর অবতার কৃষ্ণের উৎস সম্পর্কে তথ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে, এই পাঠ্যটি পূর্ববর্তী পাঠ থেকে নেওয়া হয়েছিল কিনা এবং ব্রহ্ম পুরাণের সাথে এর সম্পর্ক নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে, অন্য একটি পাঠ কৃষ্ণের উৎপত্তি নিয়ে আলোচনা করে।[৯]

কালপঞ্জি সম্পাদনা

 
 
দ্বারকা
 
দ্বারকা হল হরিবংশের একাধিক অধ্যায়ের প্রেক্ষাপট।[১০] শহরটি সমুদ্রতীরবর্তী বলে বর্ণিত। এটি অধুনা গুজরাত রাজ্যের অন্তর্গত; ঊনবিংশ শতাব্দীর একটি ছবিতে দ্বারকা (নিচে)।

পুরাণের "পঞ্চলক্ষণ" প্রথার দুটি হরিবংশে দেখা যায়। একটি হল "বংশ" বা রাজাবলি প্রথা। অপরটিতে রাখাল বালক হিসেবে কৃষ্ণের জীবন বর্ণিত হয়েছে।

হরিবংশের আখ্যানভাগ বেশ জটিল। এর কিছু কিছু অংশ খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় বা প্রথম শতাব্দীতে রচিত হয় বলে অনুমান করা হয়। হরিবংশের উৎস জানা যায় না। তবে খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর আগেই হরিবংশ মহাভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। কারণ, “কবি অশ্বঘোষ মহাভারতের শ্লোক বলে কয়েকটি শ্লোক উদ্ধৃত করেছেন। এই শ্লোকগুলি শুধু হরিবংশেই পাওয়া যায়।” (দত্ত, ১৮৫৮)

শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্যও বিবেচনা করেন যে অশ্বঘোষ হরিবংশকে উল্লেখ করেছেন এবং অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক প্রমাণ পেয়েছেন যে এটি খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীর একটি প্রামাণিক পাঠ্য ছিল এবং এর পরবর্তী সংশোধনটি খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর শেষের দিকে বা তৃতীয় শতাব্দীর শুরুতে হয়েছিল।[১১]

হপকিনসের মতে, হরিবংশ মহাভারতের সর্বশেষ পর্ব। এডওয়ার্ড ওয়াশবার্ন হপকিন্স মহাভারতকে হরিবংশের সংযোজন দ্বারা বৃদ্ধি বলে মনে করেন আনু. ২০০ খ্রি.,[১২] কিন্তু মহাভারতের মধ্যে প্রায় লক্ষাধিক শ্লোকের অংশ হিসাবে হরিবংশের সম্ভাব্য অস্তিত্বও কারণ এটি পরবর্তীকালের দক্ষিণী পুনঃপ্রত্যয়িত হতে পারে।[১৩]

আরসি হাজরা পুরাণকে খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে রাসলীলার বর্ণনার ভিত্তিতে নির্ধারণ করেছেন, কারণ তাঁর মতে, বিষ্ণু পুরাণ এবং ভাগবত পুরাণ যথাক্রমে খ্রিস্টীয় ৫ম এবং ৬ষ্ঠ শতাব্দীর অন্তর্গত।[১৪] দীক্ষিতের মতে, মৎস্যপুরাণের তারিখটি খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দী। যখন আমরা কৃষ্ণের জীবনী, রাজীর বিবরণ, এবং হরিবংশ এ চিত্রিত অন্যান্য কিছু পর্বের তুলনা করি, তখন এটি প্রথমটি থেকে আগের বলে মনে হয়। অতএব, বিষ্ণুপর্ব এবং ভবিষ্যপর্বের তারিখ অন্তত খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীতে বলা যেতে পারে।

জেএল ম্যাসন এবং ডিএইচএইচ ইঙ্গলস হরিবংসার ভাষাকে খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতাব্দীর পরে এবং সম্ভবত খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দী থেকে বলে মনে করেন; এবং আন্দ্রে কউচার বলেন যে হরিবংশে মথুরার বর্ণনা কুষাণ যুগের (খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে তৃতীয় শতাব্দীর মাঝামাঝি) শহরের মতো।[১৫]

হরিবংশ পর্বের রচনাশৈলী ও বিষয়বস্তু বিষ্ণুপর্ব ও ভবিষ্য পর্বের পূর্ববর্তী সময়ে রচিত। অশ্বঘোষ এই পর্ব থেকেই শ্লোক উদ্ধৃত করেছিলেন। সেই হিসেবে হরিবংশ পর্বটিকে খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রচিত বলা চলে।

সংস্করণ সম্পাদনা

হরিবংশের দুটি সংস্করণ পাওয়া যায়। প্রথাগত সংস্করণে তিনটি পর্বে বিন্যস্ত মোট ২৭১টি অধ্যায় রয়েছে। এর মধ্যে হরিবংশ পর্বে ৫৫টি অধ্যায়, বিষ্ণু পর্বে ৮১টি অধ্যায় এবং ভবিষ্য পর্বে ১৩৫টি অধ্যায় রয়েছে। সটীক সংস্করণটি (১৯৬৯-৭১, পি. এল. বৈদ্য সম্পাদিত) প্রথাগত সংস্করণের এক-তৃতীয়াংশ। এই সংকরণে ১১৮টি অধ্যায় ও ৬০৭৩টি শ্লোক পাওয়া যায়। এর মধ্যে হরিবংশ পর্বে ১-৪৫ অধ্যায়, বিষ্ণু পর্বে ৪৬-১১৩ অধ্যায় এবং ভবিষ্য পর্বে ১১৪-১১৮ অধ্যায় দেখা যায়। বৈদ্যের মতে সটীক সংস্করণটি বিস্তারিত পাঠান্তর। তাঁর মতে মূল হরিবংশ এই সংস্করণের ২০শ অধ্যায়ে শুরু এবং ৯৮তম অধ্যায়ে শেষ হয়েছে।[১৬]

অনুবাদ সম্পাদনা

 
মুঘল সম্রাট আকবরের জন্য আঁকা হরিবংশের দ্বারকা শহর

হরিবংশ বহু ভারতীয় স্থানীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে; ৩টি বই এবং ২৭১টি অধ্যায় সম্বলিত ভালগেট সংস্করণ এখনও ইংরেজিতে অনূদিত হয়নি। ২টি উপ-পর্ব (হরিবংশ পর্ব - ১৮৭টি অধ্যায় এবং ভবিষ্য পর্ব - ৪৮টি অধ্যায়, মোট ২৩৫টি অধ্যায়) সম্বলিত ঐতিহ্যবাহী সংস্করণের একমাত্র ইংরেজি অনুবাদ ১৮৯৭ সালে মন্মথ নাথ দত্তের করা এবং এটি পাবলিক ডোমেনে রয়েছে। সমালোচনামূলক সংস্করণটি এ পর্যন্ত দুবার ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে, একবার ২০১৬ সালে বিবেক দেবরয় এবং ২০১৯ সালে সাইমন ব্রডবেক দ্বারা।

এটি ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেছেন MA Langlois, ১৮৩৪-৩৫।[১৭]

আরও দেখুন সম্পাদনা

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. Maurice Winternitz (1981), History of Indian Literature, Vol. 1, Delhi, Motilal Banarsidass, আইএসবিএন ৯৭৮-০৮৩৬৪০৮০১০, pages 426-431
  2. Edwin Francis Bryant (2007), Krishna: A Sourcebook, Oxford University Press, আইএসবিএন ৯৭৮-০১৯৫১৪৮৯২৩, Chapters 4-21
  3. The Mahabharata in Sanskrit: Book I: Chapter 2 in sacred-texts.com website
  4. The Mahabharata, Book 1, Chapter 2, Verses 377-378; M.N. Dutt Adi Parva, page 21
  5. The Mahabharata in Sanskrit: Book I: Chapter 2 in sacred-texts.com website, (MBh.1.2.69): "hari vaṃśas tataḥ parva purāṇaṃ khila saṃjñitam bhaviṣyat parva cāpy uktaṃ khileṣv evādbhutaṃ mahat." ["Hari Vamsa Purana known as Khila (supplement) and Bhavishya Parva also spoken as Khila are wonderful and great"].
  6. Debroy, Bibeck, (2016). Harivamsha, Penguin Books India, Gurgaon, "Introduction": "There are thus 5,965 shlokas in all of Harivamsha. Non-Critical versions will often have doubled this number, reflective of the slashing."
  7. Maurice Winternitz (1981), History of Indian Literature, Vol. 1, Delhi, Motilal Banarsidass, আইএসবিএন ৯৭৮-০৮৩৬৪০৮০১০, pages 426-431
  8. Maurice Winternitz (1981), History of Indian Literature, Vol. 1, Delhi, Motilal Banarsidass, আইএসবিএন ৯৭৮-০৮৩৬৪০৮০১০, pages 432-435
  9. Ruben, Walter, (1941). "The Kṛṣṇacarita in the Harivaṃśa and Certain Purāṇas", Journal of the American Oriental Society, Vol. 61, No. 3, p.115.
  10. Manmatha Nath Dutt, Vishnu Purana, Harivamsa (1896), pages 283-286
  11. Lorenz, Ekkehard, (2007). "The Harivamsa: The Dynasty of Krishna", in: Edwin F. Bryant (ed.), Krishna: A Sourcebook, Oxford University Press, p. 97.
  12. Hopkins, Washburn E., (2020) [1915]. "Date of Epic Poetry", in: E. Washburn Hopkins, Epic Mythology, p. 1: "The Mahabharata has been increased by the late addition of the Harivamsha (perhaps 200 A. D.) [...]"
  13. Hopkins, Washburn E., (2020) [1915]. "Date of Epic Poetry", in: E. Washburn Hopkins, Epic Mythology, p. 2: "Northern version [of the Mahabharata] contains 84,126 verses, which, with the 16,375(526) verses of the Harivamsha, make 100,501(651) verses [...] It is therefore doubtful whether the attribution of a lakh of verses [in the Mahabharata] necessarily implies the existence, as part of the lakh, of the Harivamsha. Yet on the whole this is probable, owing to the fact that the expansion in [the Southern recension] appears for the most part to be due rather to the inclusion of new material than to the retention of old passages."
  14. Hazra, Rajendra Chandra, (1975)[1940]. Studies in the Purāṇic Records on Hindu Rites and Customs, Motilal Banarsidass, p. 55: "[V]isnu-p. is earlier than the Bhagavata [...] Harivamsa also [...] being dated about 400 A. D. [...] Thus the date of composition of the Bhagavata falls in the sixth century A. D."
  15. Bhattacharya, Pradip, (May 27, 2017). "Review of André Couture: Krsna in the Harivamsha, Vol. 1, 2015": "[C]outure conclude[s] that the Mathura described in the HV is evocative of cities of the Kushana era (1st to mid-3rd century CE) and not of the end of the Dvapara Yuga [...]"
  16. [Harivaṃśa 1969-71: 785, XXX and 795]
  17. Translations of the Harivamsa

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  • Bowker, John, The Oxford Dictionary of World Religions, New York, Oxford University Press, 1997, p. 410
  • Winternitz, Maurice (1981) History of Indian Literature Vol. I. Delhi: Motilal Banarsidass.
  • Ruben, Walter (1941) "The Krsnacarita in the Harivamsa and Certain Puranas.” Journal of American Oriental Society. Vol. 61, No.3. pp. 115–127.
  • Lorenz, Ekkehard (2007) The Harivamsa: The Dynasty of Krishna, in Edwin F. Bryant (ed.), Krishna, A Source Book, Oxford University Press.
  • Shastri, Rajendra Muni, Jaina Sahitya mein Sri Krishna Charita, Jaipur, Prakrit Bharati Akademi, 1991.

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা