উপরিচর বসু
উপরিচর বসু, পুরুবংশজাত রাজা অজমীঢ়ের পুত্র ঋক্ষের বংশধারায় চেদি দেশের রাজা কৃতি বা কৃতকের পুত্র। এর নাম ছিল বসু ।ইনি সমস্ত শত্রু দমন করে কঠোর তপস্যা আরম্ভ করলে দেবতারা ভীত হয়ে শান্ত বাক্যে একে নিবৃত্ত করেন । তখন ইন্দ্রের সঙ্গে এর সখ্য হয় । ইন্দ্রের সঙ্গে এর বন্ধুত্ব হওয়াতে ইন্দ্র এঁকে স্ফটিকময় বিমান, বৈজয়ন্তীমালা এবং যষ্টি উপহার দিয়েছিলেন । ইনি ইন্দ্রদত্ত বিমানে আকাশে বিচরণ করতেন বলে এর নাম উপরিচর। উপরিচর অগ্রহায়ণ মাসে উৎসব করে ইন্দ্রদত্ত যষ্টি রাজপুরীতে এনে ইন্দ্রপূজা করতেন ও পরেরদিন ইন্দ্ৰধ্বজ উত্তোলন করতেন । সেই থেকে এই অনুষ্ঠান প্রচলিত হয়।
উপরিচর বসু | |
---|---|
তথ্য | |
পরিবার | পুরুবংশীয়(রাজা অজমীঢ়ের বংশধারায়), কৃতি বা কৃতক(পিতা) |
দাম্পত্য সঙ্গী | গিরিকা |
সন্তান | বৃহদ্রথ (মহারথ),প্রত্যগ্রহ, কুশাস্ব(মণিবাহন),মাবেল্ল, মৎস্য,যদু,মৎস্যগন্ধা(সত্যবতী) |
এর রাজধানী চেদীর কাছে শক্তিমতী নামে একটি নদী ছিল । কোলাহল নামে এক সচেতন পর্বত কামান্ধ হয়ে শক্তিমতীকে আক্রমণ করে । বসুরাজ পর্বতের এই অন্যায় ব্যবহারে ক্রুদ্ধ হয়ে পদাঘাতে সেই পর্বত বিদীর্ণ করলে শক্তিমতী সেই বিদীর্ণ পথ দিয়ে বহির্গত হন । কোলাহল পর্বতের সঙ্গমে এই নদীর পর্ভে এক পুত্র ও এক কন্যা জন্ম গ্রহণ করে। শক্তিমতী পুত্র-কন্যাকে বসুরাজের হস্তে অর্পণ করেন ।বসুরাজ সেই পুত্রকে সেনাপতি ও কন্যা গিরিকাকে মহিষী করেন । একদা গিরিকা ঋতুস্নাতা হয়ে স্বামীর সহবাস প্রার্থনা করেন,কিন্তু পিতৃগণের আদেশে রাজা মৃগয়ায বাহির হতে বাধ্য হন। মৃগয়াকালে তিনি ঋতুস্নাতা সুন্দরী মহিষী গিরিকার স্মরণে কামাবিষ্ট হন এবং তার স্খলিত - শুক্র এক শ্যেনপক্ষীর দ্বারা রানীর কাছে প্রেরণ করেন । পথে অন্য এক শ্যেনের আক্রমণে সেই শুক্র যমুনার জলে পতত হয় । ব্রহ্মশাপে মৎসী - রূপিণী অদ্রিকা নামে এক অপ্সরা সেই শুক্র গ্রহণ করে গর্ভিণী হয়, এবং দশ মাস পরে ধীবরের জালে ধৃত হয়।মৎসীর উদরে এক পুত্র ও কন্যা পেয়ে ধীবর রাজার কাছে যায় এবং অপ্সরাও শাপমুক্ত হয় । উপরিচর পুত্রকে গ্রহণ করেন ও কন্যাকে ধীবরের হাতেই দান করেন । পুত্রের নাম হয় মৎস্যরাজ । তিনি পরে এক ধার্মিক রাজা হয়েছিলেন । কন্যার নাম সত্যবতী, কিন্তু মৎস্যজীবীদের কাছে থাকার জন্য তার নাম হয় মৎস্যগন্ধা ।[১][২]
রাজা উপরিচরবসুর মােট সাতটি পুত্র ছিল । বসু রাজা তাঁর পুত্রদের ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে অভিষিক্ত করেন এবং এই কীর্তিমান পুত্রেরা নিজ নিজ নাম অনুসারে দেশ ও নগর স্থাপন করেন এবং তাঁদের দ্বারা সে সকল রাজবংশের সৃষ্টি হয় তার প্রত্যেকটিই ভারতবর্ষে বিখ্যাত ছিল । বসু রাজার পুত্র বৃহদ্রথ মগধ দেশে প্রতিষ্ঠিত হন । ইনি বিখ্যাত মগধরাজ জরাসন্ধের পিতা । অন্যান্য পুত্রদের মধ্যে প্রত্যগ্ৰহ ( বা পত্যগ্র ), কুশাস্ব বা মণিবাহন, মাবেল্ল, মৎস্য এবং যদুই প্রধান ।[১][৩]
রাজা উপরিচরবসু শ্রীহরি বিষ্ণুর পরমভক্ত ছিলেন বলে মহাভারতে উল্লেখ আছে । তিনি একসময় অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন এবং সেই যজ্ঞে বৃহস্পতি স্বয়ং তাঁর পুরােহিত ছিলেন । উপরিচরবসুর ভক্তিপূর্ণ আরাধনায় প্রসন্ন হয়ে নারায়ণ স্বয়ং যজ্ঞভাগ গ্রহণ করার জন্য উপস্থিত হন এবং সকলের কাছে অদৃশ্য থাকলেও পরমভক্ত উপরিচরবসুকে দর্শন দেন। [১]
একবার দেবরাজ ইন্দ্র মর্ত্যলােকে উপস্থিত হয়ে এক মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন । সেখানে রাজা উপরিচরও উপস্থিত ছিলেন । কিন্তু যজ্ঞে পশুবলি প্রসঙ্গে দেবতা ও দেবগুরু বৃহস্পতির মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দিল । দেবতারা পশুবলির পক্ষে এবং বৃহস্পতি প্রমুখ পুরােহিতেরা বিপক্ষে তর্ক করতে লাগলেন । শেষ পর্যন্ত তাঁরা ন্যায়পরায়ণ রাজা উপরিচরকে এই সমস্যার সমাধান করার জন্য অনুরােধ করলেন । রাজা দেবগণের পক্ষে মতপ্রকাশ করলে ব্রাহ্মণরা ক্রুদ্ধ হয়ে তাঁকে এই অভিশাপ দিলেন যে, তুমি যখন দেবতাদের পক্ষ নিয়ে অহিংসা - পােষক বেদবাক্যের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করলে, এখন তুমি আর আকাশমার্গে ভ্রমণের অধিকারী থাকবে না । তুমি এখন থেকে পাতালে বাস করবে । রাজা উপরিচর এই | অভিশাপের ফলে পাতালবাসী হলেন । কিন্তু পাতালে বসেই তিনি নিরন্তর ভগবান বিষ্ণুর আরাধনা করতে লাগলেন । তাঁর তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে নারায়ণ গরুড়কে বললেন — তুমি এখনই গিয়ে আমার ভক্ত এই রাজাকে পুনরায় আকাশে উঠিয়ে আনন । গরুড় সেই কাজ সম্পন্ন করলে রাজা উপরিচর শাপমুক্ত হলেন এবং সশরীরে ব্রহ্মলােক প্রাপ্ত হলেন । মৎস্যপুরাণেও যজ্ঞে পশুবলির ঔচিত্য বিষয়ক এই কাহিনীর উল্লেখ আছে । সেখানে রাজা উপরিচরবসুকে 'খচরবসু' বলে উল্লেখ করা হয়েছে ।[৪][৫]
মহাভারতের সভাপর্ব থেকে জানা যায় — যেসব রাজর্ষি যমের সভায় পারিষদরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে রাজা উপরিচরবসু অন্যতম।[১][৬]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত মহাভারত। বিশ্ববানী।
- ↑ সুধীরচন্দ্র সরকার সংকলিত 'পৌরাণিক অভিধান'। এম.সি. সরকার এণ্ড সন্স প্রাঃ লিঃ।
- ↑ বিষ্ণু পুরাণ।
- ↑ Mahabharatm,Pandit Ramchandrashastri।
- ↑ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ ভট্টাচার্য অনুদিত মহাভারত।
- ↑ রামায়ণ-মহাভারত-মুখ্যপুরাণ, পুরাণকোষ। নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী সম্পাদিত অভিধান। সাহিত্য সংসদ। আইএসবিএন 978-81-7955-275-9।