মানবকল্যাণে শান্তির ফতওয়া

একলক্ষ মুফতি, উলামা ও আইম্মার দস্তখতসম্বলিত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী মানবকল্যাণে শান্তির ফতওয়া হলো বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার উদ্যোগে ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের নেতৃত্বে ঘোষিত একটি ফতোয়া। এই ফতোয়ায় সর্বসম্মতভাবে এক লক্ষাধিক আলেম ও মুফতিরা ইসলাম ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ ও আত্মঘাতী হামলাকে হারাম বলে আখ্যা দিয়েছেন। বাংলাদেশ ও বিশ্বে সৃষ্ট জঙ্গিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৮ জুন এই ফতোয়া প্রদান করা হয়। মূল ফতোয়াটি ৩২ পৃষ্ঠার। এই ফতোয়ায় মোট দশটি প্রশ্ন ও তার উত্তর প্রদান করা হয়েছে। আর এইসব উত্তরের সাথে সহমত প্রকাশকারী আলেমদের স্বাক্ষর মোট ৩০ খণ্ডে গ্রন্থবদ্ধ করা হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী আলেমও রয়েছেন। বাংলাদেশের জাতীয় মিডিয়ায় এটি ব্যাপক গুরুত্ব পেয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক মিডিয়াও এটি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। এটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, জাতিসংঘ, ওআইসি সহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় পাঠানো হয়। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনে এটির ব্র্যান্ডিং করা হয়। ফতোয়া প্রদানের প্রতিক্রিয়ায় শোলাকিয়া ঈদগাহে ফরীদ উদ্দিন মাসঊদকে টার্গেট করে হামলার ঘটনা ঘটে। এতে ২ পুলিশ সহ ৩ জন নিহত ও ১৬ জন আহত হন। এই ঘটনায় ২৪ জন আসামির মধ্যে ১৯ জন ক্রসফায়ারে নিহত হন। ফতোয়াটিতে ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে হারাম ঘোষণা করে জঙ্গিদের জানাজা পড়াও হারাম ঘোষণা করা হয়। অমুসলিম, সংখ্যালঘু ও ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তিদের হত্যা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। জঙ্গিবাদে সাহায্যকারীদের জান্নাতে যাওয়ার সম্ভাবনাকে নাকচ করা হয়।

মানবকল্যাণে শান্তির ফতওয়া

ফতওয়ার প্রচ্ছদ
লেখক	ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ
মূল শিরোনাম	একলক্ষ মুফতি, উলামা ও আইম্মার দস্তখতসম্বলিত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী মানবকল্যাণে শান্তির ফতওয়া
দেশ	বাংলাদেশ
ভাষা	বাংলা
বিষয়	জঙ্গিবাদ ও ইসলাম
ধরন	ফতোয়া
পটভূমি	ইসলামি সন্ত্রাসবাদ
প্রকাশিত	১৮ জুন ২০১৬
প্রকাশক	বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা
মিডিয়া ধরন	শক্তমলাট

প্রেক্ষাপট

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট বাংলাদেশের ৬১ জেলায় জেএমবির একযোগে বোমা হামলার মাধ্যমে বাংলাদেশের ইতিহাসে সশস্ত্র জঙ্গিবাদের উত্থানের সর্ববৃহৎ আলামত দৃশ্যমান হয়। তারপর জঙ্গিবাদ বাংলাদেশের অন্যতম বড় সমস্যায় পরিণত হয়। ২০১৫ থেকে নিয়ে ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলাদেশে জঙ্গিদের মাধ্যমে ৪৬টি হামলার ঘটনা ঘটে। এতে লেখক, অধ্যাপক, প্রকাশক, হিন্দু পুরোহিত, বৌদ্ধ ভিক্ষু, খ্রিস্টান যাজক, অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, বিদেশি সহ ৪৮ জন মৃত্যুবরণ করে। এর অধিকাংশ ঘটনার দায় স্বীকার করে আইএস। জঙ্গিবাদের সমস্যাকে সামনে রেখে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে পুলিশের আইজিপি এ কে এম শহীদুল হকের সভাপতিত্বে ‘ইসলামের দৃষ্টিতে জঙ্গিবাদ: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় জঙ্গিবাদ ঠেকাতে দেশের মসজিদের ইমাম ও ওলামাদের সাহায্যের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে পুলিশ। মতবিনিময় সভায় ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে এক লাখ ইমামের স্বাক্ষরসংবলিত একটি ফতোয়া বের করে তা ছড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাবের দেন। আইজিপি এই প্রস্তাবে সম্মত হয়ে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।

ইতিহাস

মতবিনিময় সভার পর ২০১৬ সালের ২ জানুয়ারি ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের মাদ্রাসায় একটি উলামা সম্মেলন আহ্বান করা হয়। সম্মেলনে ফরীদ উদ্দীন মাসঊদের নেতৃত্বে ১১ সদস্য বিশিষ্ট ‘একলক্ষ আলিম, মুফতি, ইমামগণের ফতওয়া ও দস্তখত সংগ্রহ কমিটি’ গঠিত হয়। ১১ সদস্যের কমিটির সদস্য সচিব আব্দুর রহিম কাসেমী ও যুগ্ম সদস্য সচিব সদরুদ্দীন মাকুনুন। বাকি সদস্যরা হলেন: আলিমুদ্দীন দুর্লভপুরী, হোসাইন আহমদ, দেলোয়ার হোসাইন সাঈফী, ইমদাদুল্লাহ কাসেমী, আইয়ুব আনসারী, ইব্রাহিম শিলাস্থানী, আব্দুল কাইয়ুম খান, যাকারিয়া নোমান ফয়জী। এই কমিটির অধীনে প্রতিটি জেলায় একটা করে জেলা সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। এই জেলা কমিটির দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে ফতোয়ায় স্বাক্ষর সংগ্রহের কাজ পরিচালনা করতে তৃণমূল পর্যন্ত কমিটি গঠন করা। নাম, মোবাইল নম্বর ও স্বাক্ষর, এই তিনটি ঘর দিয়ে ইমাম, আলেম, মুফতিগণের স্বাক্ষর সংগ্রহের জন্য একটি ফরম প্রস্তুত করা হয়। গণনার সুবিধার জন্য প্রতি শিটে পঁচিশটি করে স্বাক্ষর নিয়ে সেগুলো জেলা অনুসারে বিন্যস্ত করা হয়। সম্মেলনের পর রামপুরা তাকওয়া মাদ্রাসার পরিচালক আব্দুর রহিম কাসেমী দেশের কয়েকটি বড় মাদ্রাসায় জঙ্গিবাদ বিষয়ে শরিয়া অনুসারে ব্যাখ্যা চান। এরপরই হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কার্যালয় দারুল উলুম হাটহাজারী, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ, চরমোনাই জামিয়া রশিদিয়া ইসলামিয়া, শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার ও জামিয়াতুল আসআদ আল ইসলামিয়া সহ বহু মাদ্রাসা থেকে জঙ্গিবাদ নিয়ে ফতোয়া প্রদান করা হয়। কমিটি ২০১৬ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে এই ফতোয়া স্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচি শুরু করে, যা সমাপ্ত হয় একই বছরের ৩১ মে। মোট এক লক্ষ এক হাজার আটশ পঞ্চাশ জন মুফতি, উলামা ও আইম্মা এই ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেন, যা ৩০ খণ্ডে গ্রন্থবদ্ধ করা হয়। ২০১৬ সালের ১৮ জুন একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই ফতোয়া প্রকাশ করা হয়।

২০১৬ সালের ১১ আগস্ট ‘সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ ও আমাদের করণীয়’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেওয়া হয়। ২৪ আগস্ট ১৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গণভবনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে ফতোয়াটি তুলে দেন। ২০১৭ সালের ২৬ জানুয়ারি জাতিসংঘে জমা দিতে যুক্তরাষ্ট্রে যান ফরীদ উদ্দিন মাসঊদ। ২০১৭ সালের ২০ জুলাই ফরীদ উদ্দিন মাসঊদ এটি সৌদি আরবে ওআইসির মহাসচিবের হাতে তুলে দেন।

স্বাক্ষরকারী

নারী ও পুরুষ মিলিয়ে মোট ১ লাখ ১ হাজার ৮৫০ জন আলেম ও মুফতি এই ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেন। এর মধ্যে ৯২,৫৩০ জন পুরুষ আলেম এবং ৯,৩২০ জন নারী আলেমা। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী, আশরাফ আলী, আব্দুল হালিম বুখারী, মনসুরুল হক, সুলতান যওক নদভী, আব্দুর রহমান হাফেজ্জী প্রমুখ। এক লক্ষ মুফতি, ওলামা, আইম্মার ফতোয়ার সমর্থনে ঢাকা বিভাগে ২৮,০৫৬ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ২০,৬৮১ জন, খুলনা বিভাগে ১৪,২৫০ জন, রংপুর বিভাগে ৯,৭৭০ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৮,৮৯২ জন, রাজশাহী বিভাগে ২,২০০ জন, বরিশাল বিভাগে ১,৪৫০ জন এবং সিলেট বিভাগে ১৬,২২৫ জন দস্তখত করেছেন।

বিষয়বস্তু

মোট ৩০ খণ্ডের ফতোয়াটিতে নারী আলেমদের জন্য ৪টি এবং বাংলাদেশের বিভাগীয় শহরগুলোর নামে ভাগ করে ২৬টি খণ্ড তৈরি হয়েছে। সব খণ্ডেই জঙ্গিবাদ নিয়ে মূল ফতোয়ার সঙ্গে দারুল উলুম দেওবন্দ, দারুল উলুম হাটহাজারী, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ, চরমোনাই জামিয়া রশিদিয়া ইসলামিয়া, শাইখ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার ও জামিয়াতুল আসআদ আল ইসলামিয়ার ফতোয়াও সংযুক্ত করা হয়েছে। সংযুক্ত প্রত্যেকটি ফতোয়াতেই সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদকে কুরআন ও হাদিসের আলোকে হারাম বলা হয়েছে। লক্ষাধিক আলেম-আলেমার স্বাক্ষরিত ফতোয়াটি ৩২ পৃষ্ঠার। এর মধ্যে সূচি, সহযোগী আলেমদের নামসহ ফতোয়া যুক্ত করা হয়েছে। ‘ইস্তিফতা ও এর উত্তর’ শীর্ষক অধ্যায় দিয়ে ফতোয়াটি দেওয়া হয়েছে। সূরা তাওবাহ্‌র কয়েকটি আয়াত এবং সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত একটি হাদিসকে প্রেক্ষিত ধরে ফতোয়ায় ১০টি প্রশ্ন যুক্ত করা হয়েছে। ওই প্রশ্নগুলোর উত্তরেই ইসলামের ব্যাখ্যাসম্বলিত মূল ফতোয়াটি বর্ণিত হয়েছে। এরপর কুরআন ও হাদিসের দলিলের ভিত্তিতে ১০টি প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হয়েছে। প্রশ্নগুলো হলো:

1. মহান শান্তির ধর্ম ইসলাম কি সন্ত্রাস ও আতঙ্কবাদী কর্মকাণ্ড সমর্থন করে?
2. নবী রাসুলগণ বিশেষ করে প্রিয় নবীজী (সা.) কি এই ধরনের হিংস্র ও বর্বর পথ অবলম্বন করে ইসলাম কায়েম করেছেন?
3. ইসলামে জেহাদ আর সন্ত্রাস কি একই জিনিস?
4. সন্ত্রাস সৃষ্টির পথ কী বেহেশত লাভের পথ না জাহান্নামের পথ?
5. আত্মঘাতী সন্ত্রাসীর মৃত্যু কি শহীদি মৃত্যু বলে গণ্য হবে?
6. ইসলামের দৃষ্টিতে গণহত্যা কি বৈধ?
7. শিশু, নারী, বৃদ্ধ নির্বিশেষে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড কি ইসলাম সমর্থন করে?
8. ইবাদতরত মানুষকে হত্যা করা কী ধরনের অপরাধ?
9. অমুসলিমদের উপাসনালয় যথা গির্জা, মন্দির, প্যাগোডা ইত্যাদিতে হামলা করা কি বৈধ?
10. সন্ত্রাসী ও আতঙ্কবাদীদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা ইসলামের দৃষ্টিতে সকলের কর্তব্য কীনা?

১ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে,

“ ইসলাম কখনো সন্ত্রাস সমর্থন করে না। অধিকন্তু সন্ত্রাস, হিংসা, হানাহানি নির্মূল করার জন্যই মহান ধর্ম ইসলামের আবির্ভাব। ইসলাম শান্তি ও ভালোবাসার ধর্ম। ”

২ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে,

“ নবী ও রাসূলগণ বিশেষ করে ইসলামের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কস্মিনকালেও সন্ত্রাস ও নির্মম বর্বরতার পথ অবলম্বন করেননি। ইসলাম প্রতিষ্ঠার পথ হলো দাওয়াত ও মুহব্বাতের পথ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর অনুসারী সাহাবীগণ প্রেম ও খেদমতের (সেবা) মাধ্যমে মানুষকে কল্যাণের প্রতি, হেদায়েতের প্রতি দাওয়াত জানিয়েছেন। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গোটা জীবন এর জ্বলন্ত সাক্ষী। ”

৩ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে,

“ জিহাদ ও সন্ত্রাস একই জিনিস নয়। জিহাদ হলো ইসলামের অন্যতম একটা নির্দেশ পক্ষান্তরে সন্ত্রাস হলো হারাম এবং অবৈধ। জিহাদ হলো নিজের এবং পরিবেশে ও সমাজে শান্তি, নিরাপত্তা এবং সর্বকালীন কল্যাণ প্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া। ”

৪ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে,

“ সন্ত্রাস ও আতঙ্কসৃষ্টি করা যেহেতু হারাম এবং নিষিদ্ধ সুতরাং তা কখনও বেহেশত পাওয়ার পথ হতে পারে না। এ তো জাহান্নামের পথ। যারা বেহেশত লাভের জন্য বর্তমানে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে তাদের যদি বেহেশত লাভ করতে হয় তবে সন্ত্রাসবাদের মতো জাহান্নামের পথ থেকে অবিলম্বে তওবা করে শান্তি ও হেদায়েতের পথে ফিরে আসতে হবে। ”

৫ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে,

“ আত্মহত্যা ও আত্মঘাত ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম। নিজেকে মানববোমা বানিয়ে উড়িয়ে দেয়া কখনও বৈধ নয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে জিহাদে শরীক এক ব্যক্তি যুদ্ধে আহত হয়ে আত্মহত্যা করলে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জাহান্নামী বলে ঘোষণা দেন। ”

৬ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে,

“ ইসলামে নিরপরাধ মানুষকে গণহারে হত্যা বৈধ নয়। এমন কি সন্দেহের বশবর্তী হয়েও কাউকে হত্যা করা নিষেধ। ”

৭ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে,

“ শিশু, নারী, বৃদ্ধ, দুর্বল, যারা যুদ্ধে শরীক নয়, সেই ধরনের মানুষকে হত্যা করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এমনকি যুদ্ধ চলাকালেও তা জায়েয নয়। কিতাল বা স্বশস্ত্রযুদ্ধের উদ্দেশ্যে যখন মুসলিম দল বের হতো, তখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষ করে এই বিষয়ে কঠোরভাবে সতর্ক করতেন। ”

৮ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে,

“ যেকোনো অবস্থায় খুন করা অপরাধ। ইবাদত বা উপসনারত কাউকে হত্যা করা সবচেয়ে জঘন্য এবং মারাত্মক অপরাধ। ইচ্ছাকৃত ঈমানদার কড়িকে হত্যা করলে তার বদলে শাস্তি হলো চিরকালের জাহান্নাম। ”

৯ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে,

“ মুসলিম সমাজে বসবাসকারী অমুসলিমকে যদি কেউ হত্যা করে সে বেহেশতের গন্ধও পাবে না। অমুসলিমগণের গির্জা, প্যাগোডা, মন্দির ইত্যাদি উপাসনালয়ে হামলা করা ইসলামের দৃষ্টিতে হারাম ও অবৈধ। এটি কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ”

১০ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে,

“ মুনকারাত অর্থাৎ অন্যায় ও দুষ্কর্মের বিরুদ্ধে সামাজিক ও ব্যক্তিগত প্রতিরোধ গড়ে তোলা সবার কর্তব্য। বর্তমানে সন্ত্রাস ও আতংকবাদ সারা পৃথিবীতে ইসলাম ও মুসলিমদের বিকৃতভাবে উপস্থাপন করছে, বদনাম করছে। এসব দুষ্কর্ম ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে মারাত্মক শয়তানী ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছুই নয়। সুতরাং এর বিরুদ্ধে শক্তি সামর্থের আলোকে সামাজিক ও ব্যক্তিগত প্রতিরোধ গড়ে তোলা সকলের জন্য জরুরি ধর্মীয় কর্তব্য। চুপ করে থাকার অবকাশ নেই। ” — 

প্রতিক্রিয়া

২০১৬ সালের ২০ আগস্ট এই ফতোয়া কার্যক্রমটির প্রশংসা করে বিবৃতি দেন ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার মহাসচিব ইয়াদ আমিন মাদানি। জঙ্গিবাদ নিয়ে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে আলেমদের ভূমিকার প্রশংসা করে ফতোয়াটি সারাবিশ্বে প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফতোয়াটিকে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অনেক বড় অবদান হিসেবে উল্লেখ করেন সিঙ্গাপুরের পরররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ড. মুহাম্মদ মালিকি বিন উসমান। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও কার্যক্রমটির প্রশংসা করেছেন।

সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে দাবি করা হয় যে, এর মূল পরিকল্পনা একটি সরকারি সংস্থার। ওই সংস্থার ঊধ্বর্তন এক কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করেই ফতোয়া ও প্রশ্ন তৈরি করেন ফরীদ উদ্দিন মাসঊদ। মাসউদ এটি অস্বীকার করে বলেন, ফতোয়াটিকে দুষতেই এমন কথাবার্তা চালানো হচ্ছে। আর প্রশ্নপত্র তৈরি হয়েছে উলামা সম্মেলনে। ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের নেতা মুফতি ফয়জুল্লাহ ফতোয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন। তার মতে, ইসলামী আইনে বিশেষজ্ঞ মুফতিরাই শুধু ফতোয়া ঘোষণা করতে পারেন। সেখানে এক লাখ স্বাক্ষরকারীর বড় অংশ মুফতি না হওয়ায় এই ফতোয়া গ্রহণযোগ্য হবে না। এই বিতর্কের জবাবে ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, নেহাতই রাজনৈতিক বিবেচনা থেকে জঙ্গি বিরোধী ফতোয়া নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে।

এই কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি জঙ্গিদের লক্ষ্যবস্তুতেও পরিণত হন। ফতওয়া প্রকাশের এক মাসের মাথায় শোলাকিয়ায় ঈদের নামাযে জঙ্গি হামলা হয়। তদন্তসূত্রে জানা যায়, নব্য জেএমবির সংগঠক হামলার মূল হোতা রাজীব গান্ধী স্বীকার করেন যে, উক্ত হামলা মূলত শোলাকিয়ার ইমামকে টার্গেট করেই পরিচালনা করা হয়। হলি আর্টিজান হামলার পরিকল্পনার সময়ই শোলাকিয়ায় হামলার পরিকল্পনা করা হয় বলেও তদন্তে জানা যায়। যদিও দেরিতে যাত্রা করায় অল্পের জন্য হামলা থেকে বেঁচে যান ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। এতে ২ পুলিশ সহ ৩ জন নিহত ও ১৬ জন আহত হন। এই ঘটনায় ২৪ জন আসামির মধ্যে ১৯ জন ক্রসফায়ারে নিহত হন।

আরও দেখুন

• দারুল উলুম দেওবন্দের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী ফতোয়া, ২০০৮
• শ্বেতপত্র: বাংলাদেশে মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ২০০০ দিন

বহিঃসংযোগ

• গুগল প্লে স্টোরে মানবকল্যাণে শান্তির ফতওয়া