বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা

একটি ইসলামি সংগঠন

বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা বাংলাদেশের আলেমদের একটি জাতীয় ইসলামি সংগঠন।[১] সংগঠনটির বর্তমান সভাপতি ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ এবং মহাসচিব আব্দুর রহিম কাসেমী। ব্রিটিশ ভারতে গঠিত হয় জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ, যা অখণ্ড ভারতের পক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে তার থেকে পৃথক হয় জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম। পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন দিয়ে পৃথক হয় জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সাথে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের কারণে ২০১৪ সালে ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা গঠন করেন।[২] সংগঠনটি ২০১৬ সালে মানবকল্যাণে শান্তির ফতওয়া প্রদান করে। কওমি মাদ্রাসার সরকারি স্বীকৃতি আদায়ে সংগঠনটির অবদান আছে। রাজনৈতিকভাবে এটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সমর্থক।[৩]

বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা
গঠিত২০১৪; ১০ বছর আগে (2014)
আইনি অবস্থাধর্মীয় সংগঠন
যে অঞ্চলে কাজ করে
বাংলাদেশ
মহাসচিব
আব্দুর রহিম কাসেমী
সভাপতি
ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ
প্রকাশনামাসিক পাথেয়

ইতিহাস সম্পাদনা

জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ থেকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ সম্পাদনা

 
মাহমুদ হাসান দেওবন্দি (১৮৫১–১৯২০)

ব্রিটিশদের শাসন থেকে ভারতকে স্বাধীন করার জন্য ভারতীয় মুসলমানরা ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ সংগঠিত করে। সিপাহি বিদ্রোহের ধারাবাহিকতায় শামলীর যুদ্ধ সহ এই বিদ্রোহে পরাজয়ের পর তার ক্ষতি মিটানোর জন্য কাসেম নানুতুবির নেতৃত্বে কয়েকজন আলেম ১৮৬৬ সালের ৩০ মে দেওবন্দের সাত্তা মসজিদের ডালিম গাছের নিচে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করে।[৪] এই মাদ্রাসার প্রথম শিক্ষক মাহমুদ দেওবন্দি ও প্রথম ছাত্র ছিলেন মাহমুদ হাসান দেওবন্দি৷ পরবর্তীতে মাহমুদ হাসান দেওবন্দি দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান শিক্ষকের পদে অধিষ্ঠিত হন এবং তার ছাত্রদের মাধ্যমে তিনি সশস্ত্র বিপ্লব গড়ে তুলতে স্বচেষ্ট হন। তিনি পর্যায়ক্রমে সামরাতুত তারবিয়াত, জমিয়তুল আনসার, নাযারাতুল মাআরিফ আল কুরআনিয়া গঠন করেন।[৫] তার রেশমি রুমাল আন্দোলন ফাঁস হয়ে গেলে তিনি মাল্টায় নির্বাসিত হন। এরই মধ্যে তার ছাত্ররা ভারতে জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ গঠন করেন। কারামুক্ত হয়ে ভারতে প্রত্যাবর্তন করে তিনি জমিয়তের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের একমাসের মাথায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন৷ জমিয়ত খিলাফত আন্দোলনভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সাথে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। পরবর্তীতে জমিয়তের নেতৃত্বে আসেন দারুল উলুম দেওবন্দের অধ্যক্ষ হুসাইন আহমদ মাদানি। তিনি অখণ্ড ভারতের দাবিতে কংগ্রেসের সাথে মিলে স্বাধীনতা সংগ্রাম চালিয়ে যান।[৬] ১৯৪৫ সালের ১১ জুলাই দারুল উলুম দেওবন্দের সদরে মুহতামিম শাব্বির আহমদ উসমানির নেতৃত্বে আরেকটি দল জমিয়ত থেকে বের হয়ে জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম গঠন করে পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করেন, যাদের তাত্ত্বিক গুরু ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের আরেক ছাত্র আশরাফ আলী থানভী[৭] ১৯৪৫ সালের ১১ জুলাই পাকিস্তান আন্দোলনের সমর্থক আলেমদের আহ্বানে শাব্বির আহমদ উসমানির অনুপস্থিতিতে তাকে সভাপতি করে কলকাতার মোহাম্মদ আলী পার্কে জমিয়ত উলামায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা লাভ করে।[৮] জমিয়ত উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মুফতি মাহমুদের নির্দেশমত ১৯৭১ সালের ২২ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান জমিয়ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান নিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করে পশ্চিম পাকিস্তান জমিয়ত থেকে পৃথক হয়ে যায়।[৯] ১৯৭৪ সালের জানুয়ারিতে স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ঢাকার যাত্রাবাড়ীস্থ জামিয়া ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদানিয়ায় অনুষ্ঠিত এক উলামা সম্মেলনে তাজাম্মুল আলী জালালাবাদীকে সভাপতি ও শাহ আহরারুজ্জামান হবিগঞ্জীকে সাধারণ সম্পাদক করে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ গঠন করা হয়।[১০] ২০০১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে চার দলীয় ঐক্যজোটে যোগদান নিয়ে দলের অভ্যন্তরে মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ বের হয়ে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা গঠন করেন।[১১] ২০১৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ৪ শতাধিক আলেমদের একটি সভায় ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ সভাপতি নির্বাচিত হন।[১২]

মানবকল্যাণে শান্তির ফতওয়া সম্পাদনা

বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামার উদ্যোগে ফরীদ উদ্দিন মাসঊদের নেতৃত্বে ২০১৬ সালের ১৭ জুন একলক্ষ মুফতি, উলামা ও আইম্মার দস্তখতসম্বলিত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদবিরোধী মানবকল্যাণে শান্তির ফতওয়া ঘোষিত হয়। এই ফতোয়ায় সর্বসম্মতভাবে এক লক্ষাধিক আলেম ও মুফতিরা ইসলামের নামে জঙ্গিবাদ ও আত্মঘাতী হামলাকে হারাম বলে আখ্যা দিয়েছেন। বাংলাদেশ ও বিশ্বে সৃষ্ট জঙ্গিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে এই ফতোয়া প্রদান করা হয়। মূল ফতোয়াটি ৩২ পৃষ্ঠার।[১৩] এই ফতোয়ায় মোট দশটি প্রশ্ন ও তার উত্তর প্রদান করা হয়েছে। আর এইসব উত্তরের সাথে সহমত প্রকাশকারী আলেমদের স্বাক্ষর মোট ৩০ খণ্ডে গ্রন্থবদ্ধ করা হয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী আলেমও রয়েছেন। বাংলাদেশের জাতীয় মিডিয়ায় এটি ব্যাপক গুরুত্ব পেয়েছে। অনেক আন্তর্জাতিক মিডিয়াও এটি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে।[১৪] এটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, জাতিসংঘ, ওআইসি সহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থায় পাঠানো হয়। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ দমনে এটির ব্র্যান্ডিং করা হয়।[১৫]

উদ্দেশ্য ও কর্মসূচি সম্পাদনা

জমিয়তুল উলামার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো সমাজের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে ঈমান, ইবাদাত, মুআমালাত, মুআশারাত, আখলাকের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন করা। এর জন্য এটি ৩টি কর্মসূচি নির্ধারণ করেছে। যথা:[১৬]

  1. দাওয়াত
  2. তালীম
  3. ইনফাক ফি সাবীলিল্লাহ।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "Islamic Scholars Condemn Killing of Hostages in Bangladesh"ভয়েস অফ আমেরিকা। ২ জুলাই ২০১৭। 
  2. ইসলাম, মু. নজরুল (২০১৭)। গড ইন পলিটিক্স : ইসলামিজম এন্ড ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ (পিএইচডি) (ইংরেজি ভাষায়)। নানইয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি। পৃষ্ঠা ২৭০–২৭১। ২ জুন ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ মে ২০২১ 
  3. জাহিদ, সেলিম (২৮ অক্টোবর ২০১৮)। "ক্ষমতার অংশীদার হতে নতুন নতুন ইসলামি জোট"দৈনিক প্রথম আলো 
  4. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া ১৯৯৮, পৃ. ১৫৪–১৫৮।
  5. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া, আবুল ফাতাহ (১৯৯৮)। দেওবন্দ আন্দোলন: ইতিহাস ঐতিহ্য অবদান (পিডিএফ)। ঢাকা: আল-আমীন রিসার্চ একাডেমী বাংলাদেশ। পৃষ্ঠা ১৯৭, ১৯৯। 
  6. নগরী, মুহাম্মদ রুহুল আমীন (২২ নভেম্বর ২০১০)। "আল্লামা সৈয়দ আব্দুল করিম শায়খে কৌড়িয়া (র:)"দৈনিক সংগ্রাম। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ জুন ২০২২ 
  7. আহমদ সাঈদ, অধ্যাপক (২০১৩)। আশরাফ আলী থানভীর রাজনৈতিক চিন্তাধারা। ইসলাম, শহীদুল কর্তৃক অনূদিত। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাট কম্প্রিন্ট এন্ড পাবলিকেশন্স। পৃষ্ঠা ১০। আইএসবিএন 98483906511 
  8. পরিচিতি ও কর্মসূচি (পিডিএফ)। পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০: জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। ২০১৬। পৃষ্ঠা ২১–২৫। ১৯ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ জুন ২০২২ 
  9. গাজীপুরী ২০১৯, পৃ. ১২।
  10. পরিচিতি ও কর্মসূচি (পিডিএফ)। পুরানা পল্টন, ঢাকা-১০০০: জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ। ২০১৬। পৃষ্ঠা ২৮–৩০। ১৯ জানুয়ারি ২০২২ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ জুন ২০২২ 
  11. আবদুল্লাহ, সৈয়দ আনোয়ার (১৯ জানুয়ারি ২০১৬)। "বাংলাদেশে ইসলামি রাজনীতি ও ভাঙ্গনের ইতিহাসঃ একটি পর্যালোচনা"কমাশিসা। ৪ জুন ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ জুন ২০২২ 
  12. "জমিয়তুল উলামার নতুন কমিটির চেয়ারম্যান ফরিদ উদ্দিন মাসউদ"দৈনিক কালের কণ্ঠ। ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪। 
  13. শাকিল, সালমান তারেক (১৭ জুন ২০১৬)। "লাখো আলেমের ফতোয়া: জঙ্গিবাদ ও আত্মঘাতী হামলা হারাম"বাংলা ট্রিবিউন। ১৭ জুলাই ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুন ২০২২ 
  14. Ālamagīra, Ānisa (২০২০)। Dharma niẏe byabasā। Ḍhākā। পৃষ্ঠা ২৯–৩৩। আইএসবিএন 978-984-92660-3-7ওসিএলসি 989862554 
  15. খান, আসাদুজ্জামান (১৪ নভেম্বর ২০২১)। "সন্ত্রাস ও জঙ্গি দমনে শেখ হাসিনা সরকার"দৈনিক যুগান্তর 
  16. "বাংলাদেশ জমিয়তুল উলামা কী ও কেন!"মাসিক পাথেয়। ১৪ মে ২০১৮।