বরাক উপত্যকা

আসাম রাজ্যের দক্ষিণাংশে অবস্থিত

বরাক উপত্যকা (সিলেটি: ꠛꠞꠣꠇ, সিলেটি উচ্চারণ: bɔɽax) (দক্ষিণ আসাম নামেও পরিচিত)[১] ভারতের আসাম রাজ্যের দক্ষিণাংশে অবস্থিত। বরাক উপত্যকার মোট আয়তন ৬৯২২ বর্গকিলোমিটার । এই উপত্যকার প্রধান শহর হল শিলচরবরাক নদীর নাম থেকেই এই অঞ্চলের নাম হয়েছে। বরাক উপত্যকা আসামের তিনটি প্রশাসনিক জেলা নিয়ে গঠিত - কাছাড়, করিমগঞ্জ, এবং হাইলাকান্দি। এই তিন জেলার মধ্যে, ব্রিটিশ ভারত হওয়ার আগে, কাছাড় ছিল কাছাড়ি রাজ্যের মধ্যে, এবং করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি আসাম প্রদেশের সিলেট জেলার মধ্যে ছিল। ১৯৪৭ সালের বিতর্কিত গণভোটের পর উভয় অঞ্চলকে সিলেট থেকে আলাদা করা হয়; সিলেটের বাকি অংশ পূর্ব পাকিস্তানের (এখন বাংলাদেশ) এবং ভারতের করিমগঞ্জের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে।

বরাক উপত্যকা
আসামের বিভাগ
ডাকনাম: "শান্তির দ্বীপ"
আসামের পাঁচটি বিভাগ
আসামের পাঁচটি বিভাগ
দেশ ভারত
অঞ্চলউত্তর-পূর্ব অঞ্চল (এনইআর)
রাজ্যআসাম
রাজধানীশিলচর
আয়তন
 • মোট৬,৯২২ বর্গকিমি (২,৬৭৩ বর্গমাইল)
জনসংখ্যা (২০১১ আদমশুমারি)
 • মোট৩৬,২৪,৫৯৯
 • জনঘনত্ব৫২০/বর্গকিমি (১,৪০০/বর্গমাইল)
বিশেষণবরকি
বরাক উপত্যকা
বরাক উপত্যকা

নামকরণ সম্পাদনা

বরাকের প্রাচীন নাম ছিল ‘বরবক্র'। তীর্থ চিন্তামণিতে রয়েছে--

‘‘ রূপেশ্বরস্য দিগভাগে দক্ষিণে মুনি সত্তমঃ

বরবক্র ইতিখ্যাত সর্বপাপ প্রনাশনঃ

যত্র তেপে তপঃ পূর্ব সুমহৎ কপিলমুনি।”

অর্থাৎ রূপেশ্বর থেকে দক্ষিণ দিকে বরবক্র নামে খ্যাত সর্বপাপনাশী একটি তীর্থ আছে, সেইস্থানে পুরাকালে মুনিশ্রেষ্ঠ কপিল মুনি তপস্যা করতেন। সুরমা নামের উৎপত্তি নিয়ে প্রচলিত কিংবদন্তি আছে যে, রাজা ক্ষেত্রপাল বারো শতকে একটি খাল খনন করে বরাক নদীর সাথে যোগ করেন। এ থেকে একটি নতুন নদীর সৃষ্টি হয়। রাজা ক্ষেত্রপালের স্ত্রীর নাম ছিল সুরম্যা। রাণী সুরম্যার নামানুসারে রাজা নদীটির নাম রাখেন সুরমা। কারো কারো মতে প্রাচীন পুরাণে পুণ্যতোয়া নামে খ্যাত শরাবতী নদীই বর্তমানের সুরমা। অমর কোষ অভিধানে লেখা আছে, ‘‘এই ভারতবর্ষে শরাবতী নামে এক নদী আছে, যাহা ভারতের ঈশাণ কোণ হতে উৎপন্ন হয়ে নৈঋত কোণাভিমুখে গমন করে পশ্চিম দিকে সমুদ্রে পতিত হয়েছে। সেই নদীর পূর্ব-দক্ষিণ দিকের দেশ প্রাচ্যদেশ। ভারতবর্ষের সাহচর্য্য হেতু প্রতিগত অন্ত, অর্থাৎ শিষ্টাচার রহিত কামরূপবঙ্গাদিদেশ ম্লেচ্ছদেশ। কারণ যেদেশে চতুর্বর্ণ নাই সেদেশ ম্লেচ্ছদেশ। তদ্ব্যতীত স্থান আর্যাবর্ত।”

"বরাক" নামটি 'ব্রা' ও 'ক্রো' শব্দদুটি থেকে এসেছে। ব্রা অর্থ বিভক্ত হওয়া এবং ক্রো অর্থ উপরের অংশ/শাখা। বরাক নদীটি করিমগঞ্জ জেলার হরিতিকরের কাছে সুরমা নদী এবং কুশিয়ারা নদীতে বিভক্ত হয়েছে। এই বিভাজিত নদীর শাখাস্রোতকে স্থানীয় মানুষেরা 'ব্রাক্রো' নামে উচ্চারণ করত। বহুবছর ধরে উচ্চারণ বিকৃতির ফলে ব্রাক্রো নামটি বরাকে পরিণত হয়েছে।[২]

জনসংখ্যা সম্পাদনা

জাতি ও ধর্ম সম্পাদনা

বাংলা বরাক উপত্যকার সরকারী ভাষা, তবে জাতিগত অধিবাসীদের ৯০% এরও বেশি সিলেটিতে কথা বলেন এবং সেখানে । বরাক উপত্যকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্ম হল ইসলাম ধর্ম। ২০১১র গণনা অনুযায়ী, উপত্যকার জনসংখ্যার ধর্মীয় গঠন এইরকম: মুসলিম ৫০.১% (১,৮১২,১৪১), হিন্দু ৪৮.১% (১,৭৪৪,৯৫৮), খ্রিষ্টান ১.৬% (৫৮,৬৭৫), এবং অন্যান্য ০.২%। কাছাড় জেলায় হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫৯.৮৩%), মুসলমানেরা হাইলাকান্দি জেলা (৬০.৩১%) এবং করিমগঞ্জ জেলার (৫৬.২৬%) মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ।[৩]

ইতিহাস সম্পাদনা

অঞ্চলটি মূলত ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ ছিল। ১৫৬২ সালে চিলারাই কাছাড় অঞ্চলকে কচ রাজত্বের সঙ্গে সংযুক্ত করেন এবং তার সৎভাই কমলনারায়ণ এই অংশের শাসনভার নেন।।[৪] নর নারায়ণেরমৃত্যুর পর, খাসপুর রাজ্য বলে পরিচিত রাজ্যটি স্বাধীন হয়ে ওঠে এবং কমলনারায়নের বংশধরেরা এর শাসন ভার নেন। সপ্তদশ শতকে, শেষ কচ শাসকের কন্যা কাছাড়ি রাজ্যের রাজাকে বিবাহ করেন, এবং খাসপুরের শাসন কচ শাসকদের হাতে চলে যায়। তারা শেষ পর্যন্ত মাইবং থেকে খাসপুরে তাদের রাজধানী সরিয়ে আনেন। [৫]

কাছাড়ি রাজ্য ১৮৩২ সালে ব্রিটিশ-ভারতে যুক্ত হয়। জেলা সদর দপ্তর ছিল শিলচর। ব্রিটিশ কোম্পানি এই এলাকায় প্রচুর সংখ্যায় (মোট ১৫৭) চা বাগান প্রতিষ্ঠা করে এবং শিলচর দেশের এই অংশে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই এখানে সমস্ত আধুনিক ব্যবস্থা চালু হয়।

১৯৪৭ সালে, যখন সিলেটে সিলেট গণভোটের পর, এই জেলাকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়; সিলেটের পূর্ব অংশটি করিমগঞ্জ নামে ভারতে থেকে যায় অন্য অংশটি পূর্ব পাকিস্তানে চলে যায়। ভৌগোলিকভাবে, বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমের সমভূমির সীমানা ব্যতীত, এই অঞ্চলটি তিনটি দিক থেকে পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত। বাঙালীর ইতিহাস এর লেখক নীহার রঞ্জন রায় দাবি করেন যে, "দক্ষিণ আসাম/উত্তর-পূর্ব বাংলা বা বরাক ভ্যালি, সংস্কৃতি থেকে ভূগোল প্রতিটি দিকেই, বঙ্গের এর বৃহত্তর সুরমা/মেঘনা উপত্যকার সম্প্রসারণ"।[৬]

আসামের সুরমা উপত্যকায় (এখন আংশিকভাবে বাংলাদেশে) মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা ছিল। দেশভাগের প্রাক্কালে, মুসলিম লীগের পাশাপাশি কংগ্রেসেরও হিংসাত্মক কার্যক্রম তীব্র আকার ধারণ করে, যদিও মুসলিম লীগ কিছুটা ভালো অবস্থায় ছিল। সিলেট জেলার জন্য একটি গণভোট প্রস্তাব করা হয়। হাইলাকান্দির আব্দুল মতলিব মজুমদার এবং বসন্ত কুমার দাস (তখন আসামের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) উপত্যকা জুড়ে ভ্রমণ করে কংগ্রেসকে সংগঠিত করেন এবং ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ হলে তার ফলাফল কি হতে পারে, সে বিষয়ে সমাবেশ করে জনগনকে শিক্ষিত করতে থাকেন।[৭] ১৯৪৭ সালে মৌলভি আব্দুল মতলিব মজুমদার শিলচরে আসাম জাতীয়তাবাদী মুসলিম কনভেনশনের উদ্বোধন করেন। এর পর, ৮ই জুন ১৯৪৭এ আরেকটি বড় সভা শিলচরে অনুষ্ঠিত হয়।[৮] উভয় সভাতেই, মুসলমানদের একটি বড় অংশ উপস্থিত ছিলেন,যারা তাহার কথায় গুরুত্ব দেন এবং তাদের একটি সুবিধাজনক অবস্থান দেয়। আসামের বরাক উপত্যকাকে, বিশেষ করে করিমগঞ্জকে, ভারতের সঙ্গে রেখে দেবার জন্য যাঁরা উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তিনি মুসলিম হয়ে ও তাদের মধ্যে একজন ছিলেন।[৯] [১০] আব্দুল মতলিব মজুমদার সেই প্রতিনিধি দলের নেতা ছিলেন, যাঁরা রাডক্লিফ কমিশনের সামনে এই দাবি জানিয়েছিলেন যে, সিলেটের (বর্তমানে বাংলাদেশে) একটি অংশ (বর্তমানে করিমগঞ্জ জেলা), মুসলমান অধ্যুষিত হওয়া সত্বেও যেন ভারতে থাকে।[১১][১২] [১৩]

বন্য জীবন সম্পাদনা

এশিয়ান হাতি উপত্যকার বেশিরভাগ অংশ থেকেই লুপ্ত হয়ে গেছে।[১৪][১৫] দক্ষিণ অংশটিও 'ধলেশ্বরী' বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসাবে সুপারিশ করা হয়েছিল।[১৬] বরাক উপত্যকায় একমাত্র বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হল বারাইল। এটির সূচনা করেছিলেন প্রখ্যাত প্রকৃতিবিদ ড. আনোয়ারউদ্দীন চৌধুরী, যিনি মূলত ১৯৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে এই অঞ্চলেই জন্মেছিলেন। [১৭] এই অভয়ারণ্যের জন্য শেষ পর্যন্ত ২০০৪ সালে অবহিত করা হয়। হাইলাকান্দিতে অভ্যন্তরীণ রেখা সংরক্ষিত অরণ্য ও কাটাখাল সংরক্ষিত অরণ্য রয়েছে।[১৮]

লোকসভা নির্বাচনী এলাকা সম্পাদনা

বরাক ভ্যালির দুটি লোকসভা আসন রয়েছে।

জেলার তালিকা সম্পাদনা

উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Tunga 1995, p. 1
  2. Barman Saroj Kr.(1995):Reminiscence Of The Past.Silchar:Kasturi Barman
  3. Indian Census[যাচাইকরণ ব্যর্থ হয়েছে] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৪ মে ২০০৭ তারিখে
  4. (Bhattacharjee 1994:71)
  5. (Bhattacharjee 1994:72)
  6. Ray, Niharranjan (১৯৮০-০১-০১)। Bangalir itihas। Paschimbanga Samiti। 
  7. দেওয়ান নূরুল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী (২০১২)। "সিলেট গণভোট, ১৯৪৭"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  8. Bhattacharjee, J. B. (1977). Cachar under British Rule in North East India. Radiant Publishers, New Delhi.
  9. Barua, D. C. (1990). Moulvi Matlib Mazumdar- as I knew him. Abdul Matlib Mazumdar – birth centenary tributes, pp. 8–9.
  10. Purkayashta, M. (1990). Tyagi jananeta Abdul Matlib Mazumdar. The Prantiya Samachar (in Bengali). Silchar, India.
  11. Roy, S. K. (1990). Jananeta Abdul Matlib Mazumdar (in Bengali). Abdul Matlib Mazumdar – birth centenary tributes, pp. 24–27.
  12. "Assam Election Results - What does it mean for Bangladesh?"thedailystar.net। The Daily Star। ২১ মে ২০১৬। সংগ্রহের তারিখ ২০ নভেম্বর ২০১৬ 
  13. {{বই উদ্ধৃতি|শিরোনাম=তথ্যের আলোকে ম‌ইনুল হক|প্রকাশক=আনন্দ প্রকাশন সি-৮, কলেজ স্ট্রিট মার্কেট (দ্বিতল) কলকাতা - ৭০০০৭|আইএসবিএন=9788195016860} বছর=জানুয়ারি ২০২২ । লেখক=নাজমুল হোসাইন লস্কর
  14. Choudhury, A.U. (1999). Status and Conservation of the Asian elephant Elephas maximus in north-eastern India. Mammal Review 29(3): 141-173.
  15. Choudhury, A.U. (2004). Vanishing habitat threatens Phayre’s leaf monkey. The Rhino Found. NE India Newsletter 6:32-33.
  16. Choudhury, A.U. (1983). Plea for a new wildlife refuge in eastern India. Tigerpaper 10(4):12-15.
  17. Choudhury, A.U. (1989). Campaign for wildlife protection:national park in the Barails. WWF-Quarterly No. 69,10(2): 4-5.
  18. Choudhury, A.U. (2005). Amchang, Barail and Dihing-Patkai – Assam’s new wildlife sanctuaries. Oryx 39(2): 124-125.

আরও পড়ুন সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা