বই
বই লিখিত বা চিত্রাকারে তথ্য সংরক্ষণের একটি মাধ্যম যা সাধারণত প্যাপিরাস, পার্চমেন্ট বা কাগজের অনেকগুলো পৃষ্ঠা একত্রে বাঁধাই করে তৈরি করা হয় এবং একটি প্রচ্ছদ দিয়ে সুরক্ষিত থাকে। বই বিভিন্ন আকৃতিতে বিভিন্ন উপায়ে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনে তৈরী করা হয়। বই এমন একটি মাধ্যম যা যে কোনো দেশের যে কোনো ভাষাভাষী মানুষের ব্যবহারের জন্য সমাদৃত। নিজ নিজ মাতৃভাষায় লিখিত রূপের অর্থবহ লেখা বই, মানুষকে সমাজবদ্ধ জীবনের যাপিত জীবন ব্যবস্থার উৎকর্ষ অবস্থায় পৌছে দিতে পারে। সকল বইয়ের ক্ষেত্রেই অক্ষর,সংখ্যা, শব্দ, ব্যাকরণ, বিরাম চিহ্ন, বাক্য, ছবি ইত্যাদি সমন্বয়ে লেখক তার মনের ভাব বইতে লেখা দ্বারাই প্রকাশ করে।
যে কোন উন্নত সমাজের শিক্ষাব্যবস্থায় সকলের জন্য বয়স ভেদে প্রয়োজনীয় বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যসূচী অনুযায়ী শিক্ষাদান ব্যাবস্থা চালু থাকে। দক্ষ কর্মতৎপর হতে গেলেও উচ্চতর শিক্ষায় পুস্তকের জ্ঞান সমতুল্য কিছুই নেই ; সেজন্য ধর্মীয়, প্রাকৃতিক, সামাজিক সকল জ্ঞানের অর্জন, বিতরণ, প্রকাশ সর্বোচ্চটাই বইয়ের মাধ্যমেই সম্ভব।
বইয়ের আকৃতির মলাটের সামনের অংশে ও পেছনের অংশে বইয়ের নাম, প্রচ্ছদ, লেখকের নাম, প্রকাশনার পরিচিত ও লেখকের পরিচিতি ইত্যাদি উল্লেখ থাকে। ৩২,৪৮ পৃষ্ঠার ফর্মা বা স্তর গুলোর সমন্বয়ে ছাপানো বইয়ের ভিতর অংশের পূর্ণরূপ প্রকাশ পায়। ক্ষেত্রবিশেষে লেখক, প্রকাশনা,বইয়ের লেখনী সহ অন্যান্য বিষয়ের গুরুত্ব অনুযায়ী সাধারণত বইয়ের দাম,ছাপা কাগজের মানের উপর অধিকাংশ সময় নির্ভর করে।
বইয়ের সমার্থক শব্দ গ্রন্থ, কিতাব, পুস্তক। বই প্রকাশের পূর্বে প্রকাশনার অনুমতি (সরকারি) নিয়ম, স্বত্ত্বাধিকার, গঠনমূলক রীতি ও নীতিমালা মেনে বই প্রকাশ হয়।
মানুষ জ্ঞান পিপাসু, ছাপাখানার বইয়ের সহজলভ্যতা ও স্বল্প মূল্যের কারণে সকল প্রকারের তত্ত্ব ও তথ্যের জ্ঞান অর্জন, ব্যবহার, ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ সহজ, যা বইয়ের মাধ্যমেই কেবল সম্ভব।
ই-বুক বা পিডিএফ নামে বইয়ের এক ধরনের (সফট কপি) ফাইল আছে, যা কম্পিউটার, ট্যাবলেট কম্পিউটার ইত্যাদি ব্যবহার করে পড়তে হয় এবং সহজে বহনযোগ্য। বই জ্ঞানার্জনের প্রধানতম মাধ্যম।
বই মানবজীবনের একটি অতি মূল্যবান সম্পদ যা থেকে জ্ঞান অর্জন করা যায়। মানুষের জীবনে অনেক কিছু জানার আছে শেখার আছে যা বাস্তব জীবনে এই বই পড়ে শিখতে পারে।
ব্যুৎপত্তি
সম্পাদনাবাংলায় বই শব্দটি আরবি শব্দ 'বহি' থেকে এসেছে।[১] ইংরেজি ভাষায় এর নাম 'book'। 'Book' শব্দটি প্রাচীন ইংরেজি ভাষা থেকে এসেছে যা উদ্ভূত হয়েছে আদি জার্মানীয় মূল *bōk-থেকে।[২] স্লাভীয় ভাষায়, (যেমন রুশ, বুলগেরীয়, ম্যাসেডোনীয়) বুকভা (буква) অর্থ ‘অক্ষর’ যা ‘বীচ’ গাছের সাথে সম্পর্কিত। রুশ, সার্বীয় এবং ম্যাসেডোনীয় ভাষায়, বুকভার (букварь) বা বুকভার (буквар) শব্দটি প্রাথমিক স্কুলের পাঠ্যপুস্তক বোঝায়, যা ছোট শিশুদের পড়া ও লেখা শেখার কৌশল শিখতে সাহায্য করে। একারণে অনুমান করা হয় যে প্রাচীনতম ইন্দো-ইউরোপীয় লেখাগুলো বীচ কাঠে খোদাই করা হতে পারে।[৩] ল্যাটিন শব্দ কোডেক্স (codex) বলতে মূলত ‘কাঠের ব্লক’ বোঝাত। আধুনিক অর্থে এটি বাঁধাই করা এবং পৃথক পাতাসহ একটি বই বোঝায়।[৪]
একজন উৎসাহী পাঠক বা বই সংগ্রাহককে বইপ্রেমী বা আলংকারিকভাবে “বইপোকা” বলা হয়।[৫]
ইতিহাস
সম্পাদনাপ্রাচীন যুগ
সম্পাদনাপ্রাচীন সভ্যতায় যখন লেখার পদ্ধতি তৈরি করা হয়, তখন লেখার জন্য পাথর, কাদামাটি, গাছের ছাল, ধাতুর পাত এবং হাড়ের মতো বিভিন্ন বস্তু ব্যবহার করা হয়েছিল; এগুলো এপিগ্রাফিতে অধ্যয়ন করা হয়।
ট্যাবলেট
সম্পাদনাট্যাবলেট বা ফলক প্রাকৃতিকভাবে শক্তিশালী একটি লিখন মাধ্যম যা সাময়িক পরিবহন এবং লেখার উপযোগী। কাদামাটির ট্যাবলেটগুলো চ্যাপ্টা এবং বেশিরভাগই শুকনো মাটির টুকরো যা সহজেই বহন করা যায়। এর উপর স্টাইলাস দিয়ে লেখা হতো। এগুলো একটি লিখন মাধ্যম হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল, বিশেষত ব্রোঞ্জ এবং লৌহ যুগে কিউনিফর্মে লেখার জন্য। মোমের ট্যাবলেটগুলো ছিল যথেষ্ট পুরু মোমের আবরণে আচ্ছাদিত কাঠের টুকরো যা লেখার ছাপ রেকর্ড করার জন্য যথেষ্ট। এগুলোকে সাধারণত স্কুলে লেখা, হিসাবরক্ষণ এবং নোট নেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হতো। মোম গলিয়ে এটিকে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য ট্যাবলেটে রুপান্তর করা যেত।
একাধিক মোমের ট্যাবলেট একত্রে বাঁধার প্রথা (রোমান পুগিলারেস) সম্ভবত আধুনিক বাঁধাই করা বইয়ের (কোডেক্স) সম্ভাব্য অগ্রদূত।[৬] কোডেক্স (কাঠের ব্লক) শব্দের ব্যুৎপত্তিও ইঙ্গিত করে যে হয়তো এটি কাঠ-মোমের ট্যাবলেট থেকে তৈরি হয়েছিল[৭]
স্ক্রল
সম্পাদনাস্ক্রল প্যাপিরাস থেকে তৈরি করা যায়। এটি একটি পুরু কাগজের মতো উপাদান যা প্যাপিরাস গাছের ডালপালা বুনে তৈরি করা হয়। তারপর বোনা শীটটিকে একটি হাতুড়ির মতো টুল দিয়ে চ্যাপ্টা না হওয়া পর্যন্ত মাড়াই করা হয়। প্রাচীন মিশরে সম্ভবত প্রথম রাজবংশের সময়কালেই লেখার জন্য প্যাপিরাস ব্যবহার করা হতো। যদিও প্রথম প্রমাণ মিশরের পঞ্চম রাজবংশের রাজা নেফেরিকারে কাকাইয়ের হিসাবের বই থেকে পাওয়া যায় (প্রায় ২৪০০ খ্রিস্টপূর্ব)।[৮] প্যাপিরাস শীটগুলো একসাথে আঠালো করে জোড়া দিয়ে স্ক্রল তৈরি করা হয়েছিল। পাশাপাশি গাছের বাকল এবং অন্যান্য উপকরণও ব্যবহার করা হত।[৯]
হিরোডোটাসের (হিস্টোরি ৫:৫৮) মতানুসারে ফিনিশিয়ানরা খ্রিস্টপূর্ব ১০ম বা ৯ম শতাব্দীর দিকে গ্রীসে লিখন পদ্ধতি এবং প্যাপিরাস নিয়ে আসে। প্যাপিরাসের জন্য গ্রীক শব্দ লেখার উপাদান (বাইব্লিয়ন) এবং বই (বাইবলস) এসেছে ফিনিকীয় বন্দর নগর বাইব্লোস থেকে, যেখান থেকে প্যাপিরাস গ্রীসে রপ্তানি করা হয়েছিল।[১০] গ্রীক থেকে টোম (গ্রিক: τόμος) শব্দটিও পাওয়া যায়, যা মূলত একটি টুকরো বা খন্ড বোঝায় এবং এখান থেকেই "প্যাপিরাসের রোল" বোঝানো শুরু হয়। ল্যাটিনরা টমাস কে ভলিউমেন এর মতো একই অর্থে ব্যবহার করেছিল।
প্যাপিরাস, পার্চমেন্ট বা কাগজ যা থেকেই তৈরি করা হোক না কেন; হেলেনিস্টিক, রোমান, চাইনিজ, হিব্রু এবং মেসিডোনিয়ান সংস্কৃতিতে বইয়ের প্রধান রূপ ছিল স্ক্রল। আরও আধুনিক কোডেক্স রীতির বই প্রাচীনকালের শেষের দিকে রোমান বিশ্বকে দখল করে নেয়, কিন্তু স্ক্রলের রীতি এশিয়াতে অনেক বেশি সময় ধরে টিকে ছিল।
কোডেক্স
সম্পাদনাসেভিলের ইসিডোর (মৃত্যু ৬৩৬ খ্রিস্টাব্দ) তার বিশ্বকোষ ইটিমোলোজিয়াতে (৬.১৩) একটি কোডেক্স, বই এবং স্ক্রলের মধ্যকার সম্পর্ক এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন: "একটি কোডেক্স অনেক বইয়ের সমন্বয়ে গঠিত; একটি বই একটি স্ক্রল দিয়ে গঠিত। গাছ বা লতাগুলোর কাণ্ড (কোডেক্স) থেকে প্রাপ্ত রূপকের মাধ্যমে একে কোডেক্স বলা হয়। এটি যেন একটি কাঠের গুড়ি, কারণ এর মধ্যে শাখার মতো অনেকগুলো বই আছে।" যদিও এর আধুনিক ব্যবহার অন্যরকম।
আধুনিক ব্যবহারে কোডেক্স হলো প্রথম তথ্য ভান্ডার যাকে আধুনিক মানুষ একটি "বই" হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। একই আকারের অনেকগুলো পাতাকে এক প্রান্তে কোনো উপায়ে আবদ্ধ রেখে সাধারণত আরও শক্তিশালী উপাদানে তৈরি দুটি প্রচ্ছদে বাধাই করে কোডেক্স তৈরি করা হয়। বইয়ের একটি রূপ হিসেবে কোডেক্সের কথা প্রথম লিখেছিলেন মার্শাল (মৃত্যু ১০২-১০৪ খ্রিস্টাব্দ)। প্রথম শতাব্দীর শেষের দিকে তার অ্যাপোফোরেটাCLXXXIV-এ তিনি কোডেক্সের ঘনবিন্যাসের প্রশংসা করেন।
যদিও পৌত্তলিক হেলেনিস্টিক বিশ্বে কোডেক্স কখনোই খুব বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। কেবল খ্রিস্টান সম্প্রদায়ই একে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতো।[১১] ৩য় এবং ৪র্থ শতাব্দীতে ধীরে ধীরে এই পরিবর্তনটি ঘটেছিল। বইয়ের কোডেক্স ফর্ম গ্রহণ করার বেশ কয়েকটি কারণ ছিল যেমন : বিন্যাসটি সাশ্রয়ী, লেখার উপাদানের উভয় দিক ব্যবহার করা যায়, এটি বহনযোগ্য, অনুসন্ধানযোগ্য এবং গোপন করা সহজ। একটি বই পড়া তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ, সহজেই কাঙ্ক্ষিত একটি পৃষ্ঠা খুঁজে বের করা এবং উল্টানো যায়। সে তুলনায় একটি স্ক্রল ব্যবহার করা আরও অসুবিধাজনক। খ্রিস্টান লেখকেরাও হয়তো তাদের লেখাগুলোকে স্ক্রলে লেখা পৌত্তলিক ও জুডাইক গ্রন্থ থেকে আলাদা করতে চেয়েছিলেন। এছাড়াও কিছু ধাতব বই তৈরি করা হয়েছিল যার জন্য ধাতুর একটি অসম্ভব দীর্ঘ অনমনীয় স্ক্রলের পরিবর্তে ধাতুর ছোট ছোট পৃষ্ঠার প্রয়োজন ছিল। একটি বই আরও আঁটসাঁট জায়গায় বা পাশাপাশি একটি আঁটসাঁট লাইব্রেরি বা তাকে সহজেই সংরক্ষণ করা যায়।
পাণ্ডুলিপি
সম্পাদনাখ্রিস্টীয় ৫ম শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের ফলে প্রাচীন রোমের সংস্কৃতির পতন ঘটে। মিশরের সাথে যোগাযোগের অভাবের কারণে প্যাপিরাস পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে বহু শতাব্দী ধরে ব্যবহৃত পার্চমেন্ট লেখার প্রধান উপাদান হয়ে ওঠে। পার্চমেন্ট হলো প্রক্রিয়াজাত প্রাণীর চামড়া থেকে তৈরি একটি উপাদান যা অতীতে প্রধানত লেখার জন্য ব্যবহৃত হতো।পার্চমেন্ট সাধারণত বাছুর, ভেড়া বা ছাগলের চামড়া দিয়ে তৈরি করা হয়। একে ঐতিহাসিকভাবে নথিপত্র, নোট বা বইয়ের পৃষ্ঠা লেখার জন্য ব্যবহার করা হতো। পার্চমেন্ট সাধারণ চুনযুক্ত, চাঁছা এবং চেপে শুকানো হয়। এটি তামাটে নয় এবং চামড়া থেকে আলাদা। ফলে এটি লেখার জন্য অধিক উপযুক্ত হলেও আপেক্ষিক আর্দ্রতার পরিবর্তনে এটি প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ করে। অতিরিক্ত ভিজে গেলে এটি কাঁচা চামড়ার মতো হয়ে যায়।
মঠগুলো পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের ল্যাটিন লেখার ঐতিহ্য বহন করে। ক্যাসিওডোরাস, ভিভারিয়ামের মঠে (প্রতিষ্ঠিত প্রায় ৫৪০), পাঠ অনুলিপি করার উপর জোর দিয়েছিলেন।[১২] দ্য রুল অব সেন্ট বেনেডিক্ট (Ch.XLVIII), পড়ার জন্য নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করেছিল এবং মধ্যযুগের সন্ন্যাসী সংস্কৃতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। এটি পাদরিদের বইয়ের অন্যতম প্রধান পাঠক হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহ্য এবং শৈলী তখনও আধিপত্য ধরে রেখেছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে অসাধারণ মধ্যযুগীয় বইয়ের সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটে।
প্রিন্টিং প্রেস উদ্ভাবন ও প্রচলনের আগে প্রায় সব বই হাতে কপি করা হতো, যা বইকে ব্যয়বহুল এবং তুলনামূলকভাবে দুর্লভ করে তুলেছিল। সাধারণত ছোট মঠগুলোতে মাত্র কয়েক ডজন এবং মাঝারি আকারের মঠে সম্ভবত কয়েকশো বই থাকতো। ৯ম শতাব্দীর মধ্যে, বৃহত্তর সংগ্রহশালায় প্রায় ৫০০ খন্ড এবং মধ্যযুগের শেষের দিকে, অ্যাভিগননের পোপ লাইব্রেরি এবং সোরবনের(প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়) প্যারিস লাইব্রেরিতে প্রায় ২০০০ খন্ড বই ছিল।[১৩]
মঠের স্ক্রিপ্টোরিয়াম(লেখার ঘর) গুলো সাধারণত সভাকক্ষের উপরে ছিল। পাণ্ডুলিপির ক্ষতি হওয়ার ভয় থেকে কৃত্রিম আলো নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সেসময় পাঁচ প্রকার লেখক ছিল :
- ক্যালিগ্রাফার, যারা সুন্দর বই তৈরির করে
- নকলকারী, যারা প্রাথমিক উৎপাদনকারী এবং চিঠিপত্র লেখক
- সংশোধক, যারা একটি প্রস্তুত বইকে যে পাণ্ডুলিপি থেকে তৈরি করা হয়েছিল তার সাথে তুলনা করে
- অলংকারক, যারা ছবি আঁকে
- রুব্রিকেটর, যারা লাল অক্ষরে আঁকে
বই তৈরির প্রক্রিয়াটি ছিল দীর্ঘ এবং শ্রমসাধ্য। প্রথমে পার্চমেন্ট (চামড়ার তৈরি কাগজ) প্রস্তুত করা হতো। তারপর আলগা পৃষ্ঠাগুলো একত্রিত করে একটি ভোঁতা হাতিয়ার বা সীসা দিয়ে বাঁধা হতো। তারপর লিপিকার মূলপাঠ লেখে এবং সাধারণত ছবি ও রুব্রিকেশনের (লাল কালিতে লেখা) জন্য ফাঁকা জায়গা রাখে। তারপর বুকবাইন্ডার বইটি বাঁধাই করে।[১৪]
প্রাচীনকালে বিভিন্ন ধরনের কালির ব্যবহার প্রচলিত ছিল। সাধারণত ঝুল ও আঠা থেকে এবং পরে গল নাট (মাজুফল) এবং আয়রন ভিট্রিওল থেকে এসব কালি তৈরি করা হত। এটি লেখাকে একটি বাদামী-কালো রঙ দেয়, তবে কালো বা বাদামীই একমাত্র ব্যবহৃত রং ছিলনা। লাল বা এমনকি সোনালী রঙের লেখাও পাওয়া যায়।আলোকসজ্জার জন্য বিভিন্ন রঙ ব্যবহার করা হয়েছিল। খুব বিলাসবহুল পাণ্ডুলিপির জন্য পুরো পার্চমেন্টটি ছিল বেগুনি রঙের এবং পাঠটি এর উপর সোনা বা রূপা দিয়ে লেখা হয়েছিল (উদাহরণস্বরূপ, কোডেক্স আর্জেন্টিয়াস)।[১৫]
আইরিশ সন্ন্যাসীরা ৭ম শতাব্দীতে শব্দের মধ্যে ব্যবধানের রীতি চালু করেছিল। এটি পাঠকে সহজতর করে, কারণ এই সন্ন্যাসীরা ল্যাটিনের সাথে কম পরিচিত ছিল। কিন্ত দ্বাদশ শতাব্দীর আগে শব্দের মধ্যে ফাঁকা স্থানের ব্যবহার সাধারণ হয়ে ওঠেনি। শব্দগুলোর মধ্যে ব্যবধানের কারণে অর্ধ-স্বরযুক্ত পাঠ নীরব পাঠে রূপান্তরিত হয় বলে ধারণা করা হয়।[১৬]
প্রথমদিকের বইগুলোর পৃষ্ঠা হিসেবে জন্য পার্চমেন্ট বা ভেলাম (বাছুরের চামড়া) ব্যবহৃত হয়েছিল। বইয়ের প্রচ্ছদ কাঠ দিয়ে তৈরি করা হতো এবং চামড়া দিয়ে আবৃত থাকত। যেহেতু শুকনো পার্চমেন্ট প্রক্রিয়াজাত করার আগেই একটি আকার ধারণ করে, তাই বইগুলোকে কিলক বা সরু ফালি দিয়ে লাগানো হতো। পরবর্তীতে মধ্যযুগে গণ গ্রন্থাগারের আবির্ভাব হওয়ার পর চুরি রোধ করার জন্য ১৮ শতক পর্যন্ত বইগুলোকে প্রায়শই একটি বুকশেলফ বা ডেস্কে বেঁধে রাখা হত। এই আবদ্ধ বইগুলোকে লাইব্রি ক্যাটেনটি বলা হয়।
প্রথমদিকে বেশিরভাগ বইকেই মঠগুলোতে একটি একটি করে অনুলিপি করা হতো। ১৩ শতকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্থানের সাথে সাথে সেই সময়ের পাণ্ডুলিপি সংস্কৃতি বইয়ের চাহিদা বৃদ্ধি করে। ফলে বই অনুলিপি করার জন্য একটি নতুন পদ্ধতির জন্ম হয়। বইগুলো বাঁধাইহীন পাতায় বিভক্ত ছিল (পেসিয়া) যা বিভিন্ন অনুলিপিকরদের ধার দেওয়া হয়। ফলে বই তৈরির গতি যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ধর্মনিরপেক্ষ স্টেশনার সংস্থা এই ব্যবস্থাটি রক্ষণাবেক্ষণ করেছিল, যারা ধর্মীয় ও অধর্মীয় উভয় ধরনের পণ্য তৈরি করেছিল।[১৭]
ইহুদি ধর্ম লিপিকারের শিল্পকে এখন পর্যন্ত জীবিত রেখেছে। ইহুদি ঐতিহ্য অনুসারে, বেইথ নেসেটে স্থাপিত তাওরাত স্ক্রলটি পার্চমেন্টে হাতে লিখতে হবে এবং এটি মুদ্রণ করা যাবে না। যদিও ধর্মসভা মুদ্রিত প্রার্থনা বই ব্যবহার করতে পারে। সাধারণত ধর্মগ্রন্থের মুদ্রিত কপিগুলো বেইথ নেসেটের বাইরে অধ্যয়নের জন্য ব্যবহার করা হয়। একজন সোফার "লিপিকার" যে কোনো পর্যবেক্ষক ইহুদি সম্প্রদায়ের একজন অত্যন্ত সম্মানিত সদস্য।
মধ্যপ্রাচ্য
সম্পাদনামধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন ধর্ম (ইহুদি, খ্রিস্টান, জরথুস্ট্রিয়ান, মুসলিম) এবং জাতির (সিরিয়াক, কপটিক, পারসিয়ান, আরব ইত্যাদি) মানুষও ইসলামী স্বর্ণযুগে (৮ম শতকের মাঝামাঝি থেকে ১২৫৮ সালের মাঝামাঝি) বই তৈরি এবং বাঁধাই করেছিল। তারা ইসলামী ক্যালিগ্রাফি, মিনিয়েচার এবং বই বাঁধাইয়ের উন্নত কৌশল উদ্ভাবন করেছিল। মধ্যযুগীয় ইসলামী বিশ্বের বেশ কয়েকটি শহরে বই উৎপাদন কেন্দ্র এবং বইয়ের বাজার ছিল। ইয়াকুবী (মৃত্যু ৮৯৭) বলেছিলেন তার সময়ে বাগদাদে শতাধিক বই বিক্রেতা ছিল।[১৮] বইয়ের দোকানগুলো প্রায়ই শহরের প্রধান মসজিদের পাশে অবস্থিত ছিল।[১৯] মরক্কোর মারাকেশে একটি রাস্তা আছে যার নাম কুতুবিয়্যিন, ইংরেজিতে বই বিক্রেতা। এই রাস্তায় অবস্থানের কারণে বিখ্যাত কাউতুবিয়া মসজিদের এইরূপ নামকরণ করা হয়েছে।
মধ্যযুগীয় মুসলিম বিশ্বে একটি বইয়ের অনেকগুলো নির্ভরযোগ্য কপি পুনরুৎপাদনে একটি পদ্ধতি ব্যবহৃত হতো যা প্রুফ রিডিং নামে পরিচিত। এটি ছিল একজন লেখকের একটি পাণ্ডুলিপির কেবল একটি কপি তৈরি করার প্রচলিত পদ্ধতির বিপরীতে নতুন এক পদ্ধতি। প্রুফ রিডিং পদ্ধতিতে, কেবল "লেখকরা অনুলিপি অনুমোদন করতে পারে। এটি প্রকাশ্যে সর্বসাধারণের সামনে করা হতো যেখানে লিপিকর লেখকের উপস্থিতিতে কপিটি উচ্চস্বরে পড়েন, তারপর লেখক সেটিকে সঠিক বলে বিবেচনা করেন।"[২০] এই প্রুফ-রিডিং সিস্টেমের সাহায্যে, "একজন লেখক একটি একক পাঠ থেকে হয়তো এক ডজন বা তার চেয়েও বেশি কপি তৈরি করতে পারেন। দুই বা ততোধিক পাঠের মাধ্যমে, "একটি বইয়ের শতাধিক কপি সহজেই তৈরি করা যায়।"[২১] পেডারসেনের ভাষায় মুসলমানরা পার্চমেন্ট বা প্যাপিরাসের পরিবর্তে তুলনামূলকভাবে সস্তা কাগজকে লেখার উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছিল যা, "শুধু ইসলামী বইয়ের ইতিহাসে নয় বরং সমগ্র বইয়ের জগতেই একটি তাৎপর্যপূর্ণ কৃতিত্ব অর্জন করেছে"।[২২]
কাঠের ব্লক প্রিন্টিং
সম্পাদনাকাঠের ব্লকের ছাপায় একটি কাঠের ব্লকে সম্পূর্ণ পৃষ্ঠার একটি মুক্ত চিত্র খোদাই করা হয়, কালি দেওয়া হয় এবং সেই পৃষ্ঠার অনুলিপি মুদ্রণ করতে ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতির উৎপত্তি চীনের হান সাম্রাজ্যে (২২০ খ্রিস্টপূর্ব) কাপড় এবং পরবর্তীতে কাগজে মুদ্রণের একটি কৌশল হিসাবে যা পূর্ব এশিয়া জুড়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। এই পদ্ধতিতে মুদ্রিত প্রাচীনতম বইটি হলো হীরক সূত্র (৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ)। এই পদ্ধতিটি (শিল্পে ব্যবহৃত হলে উডকাট বলা হয়) ১৪ শতকের শুরুর দিকে ইউরোপে এসেছিল। বই (ব্লক বুক নামেও পরিচিত), পাশাপাশি তাস এবং ধর্মীয় ছবিও এই পদ্ধতিতে তৈরি হতে শুরু করে। একটি সম্পূর্ণ বই তৈরি করা ছিল শ্রমসাধ্য প্রক্রিয়া। প্রতিটি পৃষ্ঠার জন্য একটি হাতে খোদাই করা ব্লক প্রয়োজন এবং কাঠের ব্লকগুলো দীর্ঘক্ষণ সংরক্ষণ করলে ফেটে যাওয়ার প্রবণতা ছিল। যেসব সন্ন্যাসী বা মানুষ এগুলো লিখেছিলেন তাদের উচ্চ পারিশ্রমিক দেওয়া হয়েছিল।
চলমান প্রকৃতির এবং ইনকুনাবুলা
সম্পাদনাচীনা উদ্ভাবক বি সেং ১০৪৫ খ্রিস্টাব্দে স্থানান্তর উপযোগী মাটির পাত্র তৈরি করেন। কিন্তু তার মুদ্রণের কোন পরিচিত উদাহরণ অবশিষ্ট নেই। ১৪৫০ সালের দিকে ইয়োহানেস গুটেনবার্গ ইউরোপে একটি ম্যাট্রিক্স এবং হ্যান্ড মোল্ডের উপর ভিত্তি করে টাইপ ঢালাই উদ্ভাবনের সাথে সাথে চলমান টাইপ আবিষ্কার করেছিলেন যা সাধারণত একটি স্বাধীন আবিষ্কার হিসাবে বিবেচিত হয়। এই আবিষ্কারটি ধীরে ধীরে বইয়ের উৎপাদন খরচ কমায়; ফলে বইয়ের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পায়।
ইউরোপে ১৫০১ সালের আগে তৈরি করা প্রাথমিক মুদ্রিত বই, একক শীট এবং চিত্রগুলো ইনকুনাবুলাম বা ইনকুনাবুলা নামে পরিচিত। "কনস্টান্টিনোপলের পতনের বছর, ১৪৫৩ সালে জন্মগ্রহণকারী একজন ব্যক্তি তার পঞ্চাশতম বছর থেকে একটি জীবদ্দশায় ফিরে তাকাতে পারেন যেখানে প্রায় ৮০ লক্ষ বই মুদ্রিত হয়েছিল, যা সম্ভবত ৩৩০ খ্রিস্টাব্দে কনস্টানটাইন প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইউরোপের সমস্ত লেখকের সম্মিলিত রচনার চেয়ে বেশি।"[২৩]
১৯ শতক থেকে ২১ শতক
সম্পাদনা১৯ শতকের শুরুর দিকে বাষ্পচালিত ছাপাখানা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই মেশিনগুলো প্রতি ঘণ্টায় ১,১০০ টি শীট মুদ্রণ করতে পারতো,[২৪] কিন্তু শ্রমিকরা প্রতি ঘণ্টায় মাত্র ২,০০০ টি অক্ষর স্থাপন করতে পারতো। ১৯ শতকের শেষের দিকে মনোটাইপ এবং লিনোটাইপ টাইপসেটিং মেশিন চালু করা হয়েছিল।এগুলো প্রতি ঘণ্টায় ৬,০০০ টিরও বেশি অক্ষর এবং একবারে একটি সম্পূর্ণ লাইন স্থাপন করতে পারতো। ছাপাখানার অনেক উন্নতি হয়েছে। পাশাপাশি, নিষেধাজ্ঞামূলক সেন্সরশিপ আইনগুলো ধীরে ধীরে শিথিল করার মাধ্যমে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার শর্তগুলো উন্নত করা হয়েছে (এছাড়াও মেধা সম্পত্তি, পাবলিক ডোমেইন, কপিরাইট দেখুন)। ২০ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, ইউরোপীয় বইয়ের উৎপাদন বেড়ে প্রতি বছর ২০০,০০০ শিরোনামে পৌঁছেছিল।
২০ শতক জুড়ে, গ্রন্থাগারগুলো প্রকাশনার একটি ক্রমবর্ধমান হারের সম্মুখীন হয়েছিল, যাকে কখনও কখনও তথ্য বিস্ফোরণ বলা হয়। ইলেকট্রনিক প্রকাশনা এবং ইন্টারনেটের আবির্ভাবের কারণে অনেক নতুন তথ্য কাগজের বইয়ে মুদ্রিত হয় না; তবে এগুলো ডিজিটাল লাইব্রেরির মাধ্যমে, সিডি-রমে, ইবুক বা অন্যান্য অনলাইন মিডিয়ার আকারে অনলাইনে সহজলভ্য। অনলাইন বই হল একটি ইবুক যা ইন্টারনেটের মাধ্যমে অনলাইনে পাওয়া যায়। যদিও অনেক বই ডিজিটালভাবে উৎপাদিত হয়, তবুও বেশিরভাগ ডিজিটাল সংস্করণ জনসাধারণের জন্য উপলব্ধ নয়। ফলে কাগজে বই প্রকাশ হারের কোন কমতি নেই।[২৫] তবে, সীমাহীন পুনঃবণ্টন এবং অসীম প্রাপ্যতার জন্য সর্বজনীন ডোমেনে থাকা বইগুলোকে ডিজিটাল মাধ্যমে রূপান্তর করার একটি প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। প্রজেক্ট গুটেনবার্গ ডিস্ট্রিবিউটেড প্রুফরিডারের সাথে সম্মিলিত এই প্রচেষ্টার নেতৃত্ব দিচ্ছে। বই প্রকাশের প্রক্রিয়াতেও নতুন নতুন অগ্রগতি হয়েছে। পিওডি (ইংরেজি:POD) বা "প্রিন্ট অন ডিমান্ড"-এর মতো প্রযুক্তি (যার মাধ্যমে এক সময়ে একটি বই ছাপানো সম্ভব) স্ব-প্রকাশনাকে (এবং ভ্যানিটি প্রকাশনা) অনেক সহজ এবং সাশ্রয়ী করে তুলেছে। অন-ডিমান্ড পাবলিশিং প্রকাশকদের গুদামজাতকরণের উচ্চ খরচ এড়িয়ে কম বিক্রি হওয়া বইগুলোকে ছাপার বাইরে রাখার পরিবর্তে মুদ্রণের সুযোগ করে দেয়।
ভারতীয় পাণ্ডুলিপি
সম্পাদনাকঙ্কালী টিলা থেকে খনন করে প্রাপ্ত ১৩২ খ্রিস্টাব্দে তৈরি দেবী সরস্বতীর মূর্তিটি তার বাম হাত বাঁধনের মতো করে একটি পাণ্ডুলিপি ধারণ করেছিল, যা বাঁধা তালপাতা বা বার্চ গাছের ছালের পাণ্ডুলিপি নির্দেশ করে। ভারতে বার্চের ছাল বা তালপাতার তৈরি আবদ্ধ পাণ্ডুলিপি প্রাচীনকাল থেকেই পাশাপাশি বিদ্যমান ছিল।[২৬] তাল পাতার পাণ্ডুলিপিতে লেখাটি একটি ছুরি কলম দিয়ে আয়তাকারে কাটা এবং দোষমুক্ত করা পাম পাতায় খোদাই করা হতো। এরপর পৃষ্ঠায় রঙ প্রয়োগ করে, কাটা খাঁজে কালি রেখে রঙ মুছে ফেলা হতো। প্রতিটি পাতায় সাধারণত একটি ছিদ্র থাকত যার মধ্য দিয়ে একটি দড়ি যেতে পারে। এই পাতাগুলোকে বইয়ের মতো বাঁধার জন্য একটি দড়ি দিয়ে একসাথে বাঁধা হত।
মেসোআমেরিকান কোডিস
সম্পাদনাপ্রাক-কলম্বিয়ান মেসোআমেরিকার (মেক্সিকো এবং মধ্য আমেরিকা) কোডেক্সগুলো ইউরোপীয় কোডেক্সের মতোই ছিল, এদেরকে ডুমুরের ছাল (অম্যাটল) বা উদ্ভিদ তন্তুর লম্বা ভাঁজযুক্ত টুকরা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। প্রায়শই এদের উপর লেখার আগে হোয়াইটওয়াশের একটি স্তর প্রয়োগ করা হতো। নয়াবিশ্বে কোডিস ১৬ শতকের শেষের দিকে লেখা হয়েছিল (যেমন: মায়া কোডিস এবং অ্যাজটেক কোডিস)। স্প্যানিশ বিজয়ের আগে যেগুলো লেখা হয়েছিল তার সবই একটি ভাঁজ করা লম্বা পাতা (কনসার্টিনা -স্টাইলের) ছিল বলে ধারণা হয়। কখনও কখনও স্থানীয় আমাতল কাগজের উভয় পাশেও লেখা হতো।
সমকালীন প্রকাশনা
সম্পাদনাবর্তমানে, সাধারণত প্রকাশনা সংস্থাগুলো বই তৈরি করে এবং পরিবেশক ও বইয়ের দোকানের মাধ্যমে বাজারে সরবরাহ করে। কোম্পানীগুলো লেখকদের রচনার মেধাস্বত্ব পাওয়ার জন্য অথবা একটি আনুষ্ঠানিক আইনি চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য লেখকদের সাথে আলোচনা করে। তারপর সেগুলো উৎপাদন এবং বিক্রির ব্যবস্থা করে। প্রকাশনা প্রক্রিয়ার প্রধান ধাপগুলো হলো: প্রকাশিত কাজ সম্পাদনা ও প্রুফরিডিং; মুদ্রিত বইয়ের নকশা করা; বই উৎপাদন ও বই বিক্রি, বিপণন এবং প্রচার । সাধারণত এই ধাপগুলো প্রকাশকের প্রদত্ত অর্থে তৃতীয় পক্ষের সংস্থাগুলো সম্পন্ন করে থাকে৷ এটি স্ব-প্রকাশনার বিপরীত একটি ব্যবস্থা। স্ব-প্রকাশনায় একজন লেখক প্রকাশনা সংস্থার সাথে জড়িত না হয়েই তাদের কাজ প্রকাশের ব্যবস্থা করেন।[২৭]
বর্তমানে ইংরেজি ভাষার প্রকাশনায় তথাকথিত "বিগ ফাইভ" প্রকাশকদের আধিপত্য রয়েছে। এগুলো হলো: পেঙ্গুইন র্যান্ডম হাউস , হ্যাচেট বুক গ্রুপ , হার্পারকলিন্স , সাইমন অ্যান্ড শুস্টার এবং ম্যাকমিলান পাবলিশার্স । এরা ২০২১ সালে সাধারণ পাঠকদের বইয়ের বাজারের প্রায় ৬০ শতাংশ দখল করবে বলে অনুমান করা হয়েছিল।[২৮]
বই মেলা
সম্পাদনামেলা আমাদের মিলিয়ে দেয় মনে মনে, প্রাণে প্রাণে, মানুষে মানুষে। মেলা চিনিয়ে দেয় দেশকে। মেলারও বিচিত্র রূপ। রথের মেলা, চড়কের মেলা, ধর্মমেলা, বাণিজ্য মেলা, কৃষি মেলা, বস্ত্র মেলা- সবকে ছাপিয়ে এসেছে বইমেলা। ধর্মমেলায় হাজির হন মুমুক্ষুরা। বাণিজ্য মেলায় সামিল হন বিষয় নিষ্ঠরা। আর বইমেলায় ভিড় করেন জিজ্ঞাসু ও জ্ঞান পিপাসু মানুষেরা।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'লাইব্রেরি' প্রবন্ধে বলেছেন 'এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। বইমেলায় মানবাত্মার বাণী শৃঙ্খল মোচন করে মানুষের হৃদয় দ্বারে উপস্থিত হয়।'
যতদূর জানা গেছে, প্রথম বইমেলা বসেছিল জার্মানির ফ্রাঙ্কফুট শহরে ১৬২২ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বইমেলা হয় নিউইয়র্কে, ১৮০২ সালে। কলকাতায় বইমেলার সূচনা হয় ১৯৬০ সালে। এই বইমেলা বসেছিল চারুচন্দ্র কলেজে। আয়োজক ছিলেন বঙ্গীয় প্রকাশক ও পুস্তক বিক্রেতা সভা। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী জে.বি.এস হ্যালডেন এই বইমেলার উদ্বোধন করেন। ১৯৭৬ সাল থেকেই পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড প্রতিবছর কলকাতায় বইমেলা করছে। এটি এখন আন্তর্জাতিক বই মেলা।
এখন তো শীতকালের অন্যতম আকর্ষণীয় মেলা বইমেলা। গ্রামে, গঞ্জে, শহরে অন্যান্য মেলার সাথে সাথে বসছে এখন বইমেলা।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক জেম জয়েস বলেছেন- 'যদি কখনো পর জন্মের আকাঙ্খা প্রকাশ করি, তবে তা করব বই পড়ার জন্য।'[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
সত্যিই তো বই আমাদের নিত্য সঙ্গী। বই আমাদের পরম বন্ধু, বই আমাদের পরম প্রিয়। মানুষ বেইমানি করতে পারে। কিন্তু বই কখনো বেইমানি করে না। তাই মানুষের সবচেয়ে আদরের বস্তু বই। দার্শনিক বারটান্ড রাসেল বলেছেন, সংসারের জ্বালা এড়াবার একমাত্র উপায় হচ্ছে 'মনের ভেতরে আপন ভুবন সৃষ্টি করা আর বিপদ কালে তার মধ্যে ডুব দেওয়া।'[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
এই আপন ভুবন সৃষ্টি এবং জ্ঞানসমুদ্রে ডুব দেওয়ার হাতিয়ার বই। বেতার, দূরদর্শন, খবরের কাগজের মতো বইও এখন গণচেতনা বিকাশে সমাজে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। আমাদের সুস্থ সাংস্কৃতিক বোধের প্রসারণ, বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশে মানুষের সামাজিকীকরণে বই ও বইমেলা এক বিরাট ভূমিকা নেয়।
জ্ঞানের আলো জ্বালে বই। মনের খোরাক মেটায় বই। আনন্দের সঙ্গী বই। দুঃখকে বশ মানায় বই। শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে চাই বই। মানুষের জীবনে বই তাই অপরিহার্য। মানুষের মিলন মেলা, মনের মেলা তাই বইমেলা।[২৯]
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "869. বাংলা অভিধান - বাংলা একাডেমি"। doc.liberationwarbangladesh.net। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৫-০৫।
- ↑ "Book"। Dictionary.com। নভেম্বর ৩, ২০১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ৬, ২০১০।
- ↑ "Northvegr – Holy Language Lexicon"। November 3, 2008। No তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ December 30, 2016। অজানা প্যারামিটার
|1=
উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য); এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন:|আর্কাইভের-তারিখ=
(সাহায্য) - ↑ "codex"। Oxford Reference (ইংরেজি ভাষায়)। মে ৯, ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৫-০৯।
- ↑ https://www.merriam-webster.com/dictionary/bookworm
- ↑ Leila Avrin. Scribes, Script and Books, p. 173.
- ↑ Bischoff, Bernhard (১৯৯০)। Latin palaeography antiquity and the Middle Ages। Dáibhí ó Cróinin। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 11। আইএসবিএন 978-0-521-36473-7। আগস্ট ২১, ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ আগস্ট ২৯, ২০২০।
- ↑ Avrin, Leila (১৯৯১)। Scribes, script, and books: the book arts from antiquity to the Renaissance। American Library Association; The British Library। পৃষ্ঠা 83। আইএসবিএন 978-0-8389-0522-7।
- ↑ Dard Hunter. Papermaking: History and Technique of an Ancient Craft New ed. Dover Publications 1978, p. 12.
- ↑ Leila Avrin. Scribes, Script and Books, pp. 144–145.
- ↑ The Cambridge History of Early Christian Literature. Edd. Frances Young, Lewis Ayres, Andrew Louth, Ron White. Cambridge University Press 2004, pp. 8–9.
- ↑ Leila Avrin. Scribes, Script and Books, pp. 207–208.
- ↑ Martin D. Joachim. Historical Aspects of Cataloguing and Classification. Haworth Press 2003, p. 452.
- ↑ Edith Diehl. Bookbinding: Its Background and Technique. Dover Publications 1980, pp. 14–16.
- ↑ Bernhard Bischoff. Latin Palaeography, pp. 16–17.
- ↑ Paul Saenger. Space Between Words: The Origins of Silent Reading. Stanford University Press 1997.
- ↑ Bernhard Bischoff. Latin Palaeography, pp. 42–43.
- ↑ W. Durant, "The Age of Faith", New York 1950, p. 236
- ↑ S.E. Al-Djazairi "The Golden Age of Islamic Civilization", Manchester 1996, p. 200
- ↑ Edmund Burke (জুন ২০০৯)। "Islam at the Center: Technological Complexes and the Roots of Modernity": 165–86 [43]। ডিওআই:10.1353/jwh.0.0045।
- ↑ Edmund Burke (জুন ২০০৯)। "Islam at the Center: Technological Complexes and the Roots of Modernity": 165–186 [44]। ডিওআই:10.1353/jwh.0.0045।
- ↑ Johs. Pedersen, "The Arabic Book", Princeton University Press, 1984, p. 59
- ↑ Clapham, Michael, "Printing" in A History of Technology, Vol 2. From the Renaissance to the Industrial Revolution, edd. Charles Singer et al. (Oxford 1957), p. 377. Cited from Elizabeth L. Eisenstein, The Printing Press as an Agent of Change (Cambridge University, 1980).
- ↑ Bruckner, D. J. R. (২০ নভেম্বর ১৯৯৫)। "How the Earlier Media Achieved Critical Mass: Printing Press;Yelling 'Stop the Presses!' Didn't Happen Overnight"। The New York Times। জুলাই ১, ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ আগস্ট ২০২০।
- ↑ "Bowker Reports Traditional U.S. Book Production Flat in 2009"। জানুয়ারি ২৮, ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা।
- ↑ Kelting, M. Whitney (২০০১)। Singing to the Jinas: Jain Laywomen, Mandal Singing, and the Negotiations of Jain Devotion (ইংরেজি ভাষায়)। Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-803211-3। ডিসেম্বর ১৪, ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ অক্টোবর ১৫, ২০২০।
- ↑ "SELF-PUBLISH definition | Cambridge English Dictionary"। Cambridge English Dictionary।
- ↑ "Memorandum Opinion [Redacted] | United States Department of Justice"। www.justice.gov। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-০২-০৪।
- ↑ পরম পরশ: আমার বই মেলা: তুষারকান্তি ষন্নিগ্রহী, শ্রীভূমি পাবলিশিং কোম্পানি, কলকাতা, বছর:২০০৯, পৃঃ ৫৫