সরস্বতী (দেবী)

জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, বুদ্ধি ও বিদ্যার হিন্দু দেবী

সরস্বতী (সংস্কৃত: सरस्वती, সরস্ৱতী, উচ্চারিত [sɐrɐsʋɐtiː]) হলেন হিন্দুধর্মে জ্ঞান, সঙ্গীত, শিল্পকলা, বাক্য, প্রজ্ঞা ও বিদ্যার্জনের দেবী[৪] সরস্বতী, লক্ষ্মীপার্বতী হিন্দুধর্মে "ত্রিদেবী" নামে পরিচিত।[৫] দেবী রূপে সরস্বতীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঋগ্বেদে[৬] বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত হিন্দুধর্মে তিনি একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবীর স্থান অধিকার করে রয়েছেন।[৭] সরস্বতী সাধারণত দ্বিভুজা বা চতুর্ভুজা মূর্তিতে পূজিতা হন। দ্বিভুজা মূর্তিতে তাঁর হাতে থাকে বীণা ও পুস্তক অথবা লেখনী/ কলম ও পুস্তক; চতুর্ভুজা মূর্তিতে থাকে পুস্তক, অক্ষমালা, সুধাকলস ও বীণা; অথবা ব্যাখ্যা মুদ্রা, বীণা, সুধাকলস ও পুস্তক; অথবা অক্ষমালা, দুটি শ্বেত পদ্ম ও পুস্তক; অথবা পাশ, অঙ্কুশ , বিদ্যা বা পুস্তক ও অক্ষমালা। হিন্দুধর্মে এই প্রত্যেকটি বস্তুরই প্রতীকী অর্থ রয়েছে।

সরস্বতী
মাতৃকা দেবী; জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, বাক্য, প্রজ্ঞা, জ্ঞানার্জন ও নদী দেবী
ত্রিদেবী গোষ্ঠীর সদস্য
উনবিংশ শতাব্দীর একটি চিত্রকর্ম
অন্যান্য নামসারদা, ইলা, শতরূপা, মহাশ্বেতা, বীণাপাণি, বীণাবাদিনী, ভারতী, বাণী, বাগ্দেবী[১]
সংস্কৃত লিপ্যন্তরসরস্ৱতী
Devanagariसरस्वती
অন্তর্ভুক্তিদেবী, নদী দেবী, ত্রিদেবী, গায়ত্রী
আবাসসত্যলোক, মণিদ্বীপ
মন্ত্র॥ ওঁ ঐং সরস্বত্যই নমো নমঃ ॥ / ॥ ওঁ বদ বদ বাগ্বাদিনি স্বাহা ॥
প্রতীকসমূহসাদা রং, পদ্ম, বীণা, সরস্বতী নদী, পুস্তক[২]
দিবসশুক্রবার
বাহনরাজহংস
উৎসবশ্রীপঞ্চমীনবরাত্রি উৎসবের সপ্তম দিন
ব্যক্তিগত তথ্য
সঙ্গীব্রহ্মা[৩][৪]
সন্তাননারদ

হিন্দুদের একাংশ সরস্বতীর পূজা করেন শ্রীপঞ্চমী বা বসন্তপঞ্চমীর (মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথি, এই দিনটি ভারতের বিভিন্ন অংশে সরস্বতী পূজা বা সরস্বতী জয়ন্তী নামেও পরিচিত) দিন।[৮] এই দিনটিতে শিশুদের হাতেখড়ি অনুষ্ঠানের (প্রথম অক্ষর শিক্ষার অনুষ্ঠান) আয়োজন করা হয়।[৯] পশ্চিম ও মধ্য ভারতে জৈন ধর্মাবলম্বীরাও সরস্বতীর পূজা করেন।[১০] এছাড়া বৌদ্ধদের কোনও কোনও সম্প্রদায়েও সরস্বতী পূজা প্রচলিত।[১১][১২]

নাম-ব্যুৎপত্তি সম্পাদনা

সরস্ (सरस्) ও ৱতী (वती) – এই দুই সংস্কৃত শব্দের সন্ধির মাধ্যমে সরস্বতী নামটির উৎপত্তি। সরস্ শব্দের আক্ষরিক অর্থ হ্রদ বা সরোবর হলেও এটির অপর অর্থ "বাক্য"; ৱতী শব্দের অর্থ "যিনি অধিষ্ঠাত্রী"। নামটি আদিতে "সরস্বতী" নামে পরিচিত এক বা একাধিক নদীর সঙ্গে যুক্ত হলেও এই নামটির আক্ষরিক অর্থ তাই হয় "যে দেবী পুষ্করিণী, হ্রদ ও সরোবরের অধিকারিণী" বা ক্ষেত্রবিশেষে "যে দেবী বাক্যের অধিকারিণী"। সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুযায়ী "সরস্বতী" শব্দটির সন্ধিবিচ্ছেদ এভাবেও হতে পারে - সরসু+অতি (सरसु+अति); সেক্ষেত্রে শব্দটির অর্থ দাঁড়ায় "যা প্রচুর জল ধারণ করে"।[১৩][১৪]

ঋগ্বেদে নদী ও গুরুত্বপূর্ণ এক দেবী উভয় অর্থেই "সরস্বতী" নামটি পাওয়া যায়। প্রাথমিক পংক্তিগুলিতে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে সরস্বতী নদী অর্থে এবং দৃশদ্বতী সহ বিভিন্ন উত্তরপশ্চিম ভারতীয় নদীর নামের সঙ্গে একই সারিতে। তারপর সরস্বতীকে এক নদী দেবতা হিসেবে উপস্থাপনা করা হয়েছে। ঋগ্বেদের দ্বিতীয় মণ্ডলে সরস্বতীকে শ্রেষ্ঠ মাতা, শ্রেষ্ঠ নদী ও শ্রেষ্ঠ দেবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে:[১৪]

অম্বিতমে নদীতমে দেবিতমে সরস্বতি (अम्बितमे नदीतमे देवितमे सरस्वति)
— ঋগ্বেদ ২.৪১.১৬[১৫]

সরস্বতী [হলেন] মাতৃকাগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, নদীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ [এবং] দেবীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।

ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে সরস্বতীকে প্রচুর প্রবহমান জলের আরোগ্যদাত্রী ও পাবনী শক্তির দেবী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে:

অপো অস্মান মাতরঃ শুন্ধয়ন্তু ঘর্তেন নো ঘর্তপ্বঃ পুনন্তু।

বিশ্বং হি রিপ্রং পরবহন্তি দেবিরুদিদাভ্যঃ শুচিরাপুত এমি।।

(अपो अस्मान मातरः शुन्धयन्तु घर्तेन नो घर्तप्वः पुनन्तु | विश्वं हि रिप्रं परवहन्ति देविरुदिदाभ्यः शुचिरापूत एमि ||)
— ঋগ্বেদ ১০.১৭[১৬]

মাতৃস্বরূপা জলসমূহ আমাদের পরিশুদ্ধ করুন,
যাঁরা ননীর দ্বারা শোধিত হয়েছে, তাঁরা আমাদের ননীর দ্বারা পরিশুদ্ধ করুন,
কারণ এই দেবীগণ কলুষ দূর করেন,
আমি এদের থেকে উঠে আসি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয়ে।
জন ম্যুয়ারের অনুবাদ অবলম্বনে

বৈদিক সাহিত্যে সরস্বতী প্রাচীন ভারতীয়দের কাছে সেই গুরুত্ব বহন করত (জন মুয়্যারের মত অনুযায়ী), যে গুরুত্ব তাদের আধুনিক উত্তরসূরিদের কাছে গঙ্গা নদী বহন করে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলেই সরস্বতীকে "জ্ঞানের অধিকারিণী" বলে ঘোষণা করা হয়েছে।[১৭] ঋগ্বেদের পরবর্তী যুগে রচিত বেদগুলিতে (বিশেষত ব্রাহ্মণ অংশে) সরস্বতীর গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায়। এই গ্রন্থগুলিতেই শব্দটির অর্থ "পবিত্রতাদানকারী জল" থেকে "যা পবিত্র করে", "যে বাক্য পবিত্রতা দান করে", "যে জ্ঞান পবিত্রতা দান করে" অর্থে বিবর্তিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত তা এমন এক দেবীর আধ্যাত্মিক ধারণায় রূপ গ্রহণ করে যিনি জ্ঞান, শিল্পকলা, সংগীত, সুর, কাব্য-প্রতিভা, ভাষা, অলংকার, বাগ্মীতা, সৃজনশীল কর্ম এবং যা কিছু একজন মানুষের অন্তঃস্থল বা আত্মাকে পবিত্রতা দান করে তার প্রতিভূ হয়ে হঠেন।[১৪][১৮] উপনিষদ্‌ধর্মশাস্ত্রগুলিতে সরস্বতীকে আবাহন করা হয়েছে পাঠককে সদ্গুণের ধ্যান, পবিত্রতার ফল, ব্যক্তির কর্মের অর্থ ও সারকথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য।

প্রাচীন হিন্দু সাহিত্যে সরস্বতী নানা নামে পরিচিত। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায় ব্রহ্মাণী (ব্রহ্মার শক্তি), ব্রাহ্মী (বিজ্ঞানের দেবী),[১৯] ভারতী (ইতিহাসের দেবী), বর্ণেশ্বরী (অক্ষরের দেবী), কবিজিহ্বাগ্রবাসিনী (যিনি কবিগণের জিহ্বাগ্রে বাস করেন) ইত্যাদি নাম।[১][৪] আবার সরস্বতী বিদ্যাদাত্রী (যিনি বিদ্যা দান করেন), বীণাবাদিনী (যিনি বীণা বাজান), পুস্তকধারিণী (যিনি হস্তে পুস্তক ধারণ করেন), বীণাপাণি (যাঁর হাতে বীণা শোভা পায়), হংসবাহিনী (যে দেবীর বাহন রাজহংস) ও বাগ্দেবী (বাক্যের দেবী) নামেও পরিচিত।

অপর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, "সর" শব্দের অর্থ "সার" বা "নির্যাস" এবং "স্ব" শব্দের অর্থ "আত্ম"। এই অর্থ ধরলে "সরস্বতী" নামটির অর্থ দাঁড়ায় "যিনি আত্মার সার উপলব্ধি করতে সহায়তা করেন" অথবা "যিনি (পরব্রহ্মের) সার ব্যক্তির আত্মার সঙ্গে মিলিত করেন"।

হিন্দু পুরাণে সরস্বতী সম্পাদনা

অথর্ব-বেদ, যজুর-বেদ এবং সংশ্লিষ্ট রচনাগুলির প্রাচীন গ্রন্থে সরস্বতীকে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে দেবতা হিসাবে আবাহন করা হয়েছে। তিনি রোগ নিরাময়, সন্তানসন্ততি, সম্পদ এবং অন্যান্য আকাঙ্ক্ষা প্রদানের জন্য অনুসন্ধান করা হয় এবং এমনকি যজুর-বেদে একজন চিকিত্সক হিসাবে বিবেচিত হয়। কিংবদন্তিগুলি বিকশিত হওয়ার সাথে সাথে সরস্বতীর ভূমিকা প্রসারিত হয়। একটি গল্পে, তিনি ভাকের রূপ ধারণ করেন, একজন মহিলা যিনি গন্ধর্বদের কাছ থেকে চুরি করা ঐশ্বরিক পানীয় সোমা উদ্ধার করেন, যা নারীদের প্রতি আকর্ষণের জন্য পরিচিত স্বর্গীয় প্রাণী। মহাভারতে সরস্বতীর উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে তিনি ইন্দ্রের দরবারে উন্নতি করেন, ঋষিদের উপদেশ দেন, ভগবান শিবের তিনটি শহরের ধ্বংসের সুবিধা দেন এবং যাজ্ঞবল্ক্য ঋষির কাছে একটি দর্শন হিসেবে আবির্ভূত হন। সরস্বতীর বহুমুখী প্রকৃতি, প্রজ্ঞা, সৌন্দর্য এবং বীরত্বপূর্ণ কাজগুলি তাকে প্রাচীন ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনীর বিভিন্ন দিক জুড়ে সম্মানিত ব্যক্তিত্ব করে তোলে।[২০]

বিভিন্ন ভাষায় নাম সম্পাদনা

সরস্বতী ও বীণা
মরালবাহনা সরস্বতীর হস্তে উত্তর ভারতীয় শৈলীর বীণা (রুদ্রবীণা), আনুমানিক ১৭০০ খ্রিস্টাব্দ।
আলাপিণী বীণা হস্তে সরস্বতী, খ্রিস্টীয় দশম-দ্বাদশ শতাব্দী, পূর্ব ভারত অথবা বাংলাদেশ।
হিন্দু দেবী সরস্বতীকে শতাব্দী ভেদে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের বীণা হস্তে চিত্রিত করা হয়েছে। প্রাচীনতম জ্ঞাত সরস্বতী-সদৃশ খোদাই চিত্রগুলি পাওয়া গিয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ২০০ অব্দের সমসাময়িক বৌদ্ধ প্রত্নক্ষেত্রগুলি থেকে। এই চিত্রগুলিতে সরস্বতীর হাতে হার্প-জাতীয় বীণা দেখা যায়।[২১]

বাংলা ভাষায় সরস্বতীর অপরাপর নামগুলি হল সারদা, বাগ্দেবী, বাগ্বাদিনী, বাগীশা, বাগ্দেবতা, বাগীশ্বরী, বাঙ্ময়ী, বিদ্যাদেবী, বাণী, বীণাপাণি, ভারতী, মহাশ্বেতা, শতরূপা, গীর্দেবী, সনাতনী, পদ্মাসনা, হংসারূঢ়া, হংসবাহনা, হংসবাহিনী, কাদম্বরী, শ্বেতভুজা, শুক্লা ও সর্বশুক্লা ইত্যাদি।[২২] হিন্দি ভাষায় এই দেবীর নামের বানান হল হিন্দি: सरस्वतीতেলুগু ভাষায় দেবী সরস্বতী পরিচিত চদুবুলা তাল্লি (చదువుల తల్లి) বা শারদা (శారద) নামে। কোঙ্কণি ভাষায় সরস্বতীকে বলা হয় শারদা, বীণাপাণি, পুস্তকধারিণী ও বিদ্যাদায়িণী। কন্নড় ভাষায় সরস্বতীর যে নামান্তরগুলি প্রচলিত তার মধ্যে বিখ্যাত শৃঙ্গেরী মন্দিরে দেখা যায় শারদে, শারদাম্বা, বাণী ও বীণাপাণি নামগুলি। তামিল ভাষায় সরস্বতী পরিচিত কলৈমগল (கலைமகள்), নামগল (நாமகள்), কলৈবাণী (கலைவாணி), বাণী (வாணி) ও ভারতী (பாரதி) নামে। কুরল সাহিত্যের মাহাত্ম্যব্যঞ্জক পঞ্চান্নটি তামিল শ্লোকের সংকলন তিরুবল্লুব মালই গ্রন্থে এবং গ্রন্থকার বল্লুবর কর্তৃক সরস্বতী নামগল নামে বন্দিত হয়েছেন এবং কথিত আছে এই সংকলনের দ্বিতীয় শ্লোকটি স্বয়ং সরস্বতীর রচনা।[২৩][২৪]

সরস্বতী বানানটি অসমীয়া ভাষায় সৰস্বতী, মালয়ালম ভাষায় സരസ്വതി, তামিল ভাষায় சரஸ்வதி, ও ওড়িয়া ভাষায় ସରସ୍ଵତୀ। ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে বর্মি ভাষায় সরস্বতী পরিচিত থুরাথাডি (သူရဿတီ, উচ্চারিত: [θùja̰ðədì] বা [θùɹa̰ðədì]) বা তিপিটক মেডাউ নামে, চীনা ভাষায় পরিচিত Biàncáitiān (辯才天) নামে, জাপানি ভাষায় পরিচিত বেনজাইতেন (弁才天/弁財天) নামে এবং থাই ভাষায় পরিচিত সুরতসওয়াদি (สุรัสวดี) বা সরতসওয়াদি (สรัสวดี) নামে।[২৫]

প্রতিমাকল্প সম্পাদনা

ধ্যানমন্ত্রে বর্ণিত প্রতিমাকল্পটিতে দেবী সরস্বতী দেবীকে শ্বেতবর্ণা, শ্বেতপদ্মে আসীনা, মুক্তার হারে ভূষিতা, পদ্মলোচনা ও বীণাপুস্তকধারিণী এক দিব্য নারীমূর্তিরূপে কল্পনা করা হয়েছে। বলা হয়েছে,

ওঁ তরুণশকলমিন্দোর্বিভ্রতী শুভ্রকান্তিঃ কুচভরনমিতাঙ্গী সন্নিষণ্ণা সিতাব্জে।
নিজকরকমলোদ্যল্লেখনীপুস্তকশ্রীঃ সকলবিভবসিদ্ধ্যৈ পাতু বাগ্দেবতা নঃ।।

অর্থাৎ, “চন্দ্রের নূতন কলাধারিণী, শুভ্রকান্তি, কুচভরনমিতাঙ্গী, শ্বেতপদ্মাসনে (উত্তমরূপে) আসীনা, হস্তে ধৃত লেখনী ও পুস্তকের দ্বারা শোভিত বাগ্‌দেবী সকল বিভবপ্রাপ্তির জন্য আমাদিগকে রক্ষা করুন।”[২৬]

আবার পদ্মপুরাণ-এ উল্লিখিত সরস্বতীস্তোত্রম্-এ বর্ণিত হয়েছে,

শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা।
শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা॥১
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা।
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা॥২
ইত্যাদি

অর্থাৎ, “দেবী সরস্বতী আদ্যন্তবিহীনা, শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধে অনুলিপ্তা॥১॥ অধিকন্তু তাঁহার হস্তে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে ভূষিতা॥২॥”[২৭]

ধ্যান বা স্তোত্রবন্দনায় উল্লেখ না থাকলেও সরস্বতী দেবী ক্ষেত্রভেদে দ্বিভুজা অথবা চতুর্ভুজা এবং হংসবাহনা অথবা ময়ূরবাহনা রূপে পূজিত হন। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাধারণত ময়ূরবাহনা চতুর্ভুজা সরস্বতী প্রতিমার পূজা করা হয়। ইনি অক্ষমালা, কমণ্ডলু, বীণা ও বেদপুস্তকধারিণী। বাংলা তথা পূর্বভারতে সরস্বতী দ্বিভুজা ও রাজহংসের পৃষ্ঠে আসীনা।

বঙ্গভূমে শ্রী শ্রী সরস্বতী পুষ্পাঞ্জলি-মন্ত্র

ওঁ জয় জয় দেবি চরাচরসারে, কুচযুগশোভিতমুক্তাহারে

বীণাপুস্তকরঞ্জিতহস্তে, ভগবতি ভারতি দেবি নমস্তে॥

ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।

বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যা-স্থানেভ্য এব চ॥

এষ সচন্দনপুষ্পবিল্বপত্রাঞ্জলিঃ ঐং সরস্বত্যৈ নমঃ॥

প্রণাম-মন্ত্র:

সরস্বতি মহাভাগে বিদ্যে কমললোচনে।

বিশ্বরূপে বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমোঽস্তু তে॥

জয় জয় দেবি চরাচরসারে, কুচযুগশোভিতমুক্তাহারে।বীণাপুস্তকরঞ্জিতহস্তে, ভগবতি ভারতি দেবি নমস্তে॥

সরস্বতীর স্তবঃ

শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা।

শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতাগন্ধানুলেপনা॥

শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চ্চিতা।

শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা॥

বন্দিতা সিদ্ধগন্ধর্ব্বৈরর্চ্চিতা দেবদানবৈঃ।

পূজিতা মুনিভিঃ সর্ব্বৈর্ ঋষিভিঃ স্তূয়তে সদা॥

স্তোত্রেণানেন তাং দেবীং জগদ্ধাত্রীং সরস্বতীম্।

যে স্মরন্তি ত্রিসন্ধ্যায়াং সর্ব্বাং বিদ্যাং লভন্তি তে॥

শারদা সম্পাদনা

 
শারদা শক্তিপীঠ

শারদা রূপটি আবার সিংহবাহিনী। ধ্যানমন্ত্র অনুযায়ী দেবী হলেন ছয়টি হাতবিশিষ্টা সিংহবাহিনী। শারদা যিনি সমস্ত প্রাপ্তি প্রদান করেন। তার তিনটি চোখ, একটি পূর্ণিমার চন্দ্রের মতো উজ্জ্বল মুখ; তার ছয়টি উজ্জ্বল হাতে একটি বর্শা (শক্তি অস্ত্র), একটি ধনুক, তীর, একটি ঘণ্টা, অমৃতের একটি পাত্র; এবং একটি রত্নখচিত কলস। শারদা, শৈলে অবস্থিতা হাস্যরতা দেবী, তিনি হলেন ত্রিলোকজননী, সূর্য ও অগ্নি চক্ষুবিশিষ্ট এবং ছয়টি হাত সহ সর্বশক্তিমান রূপ। ভগবতীকে নমস্কার যা সাধকদের ভক্তি দ্বারা অর্জিত হয়। সিংহাসনে অধিষ্ঠিত শারদা শীঘ্রই কাঙ্ক্ষিত ফলদায়ক কল্যাণ পূর্ণ করুক! [২৮]

স্কন্দপুরাণে সম্পাদনা

জগতে সকল দেবতার তীর্থ আছে, শুধু ব্রহ্মার তীর্থ নেই – একথা ভেবে ব্রহ্মা পৃথিবীতে নিজের তীর্থ স্থাপনে উদ্যোগী হলেন। তিনি একটি সর্বরত্নময়ী শিলা পৃথিবীতে নিক্ষেপ করলেন। সেটি চমৎকারপুরে এসে পড়ল। ব্রহ্মা সেখানেই নিজের তীর্থ স্থাপন করবেন বলে ভাবলেন। ব্রহ্মার নির্দেশে তার স্ত্রী সরস্বতী পাতাল থেকে উঠে এলেন। ব্রহ্মা তাকে বললেন, “তুমি এখানে আমার কাছে সব সময় থাকো। আমি তোমার জলে ত্রিসন্ধ্যা তর্পণ করব।” সরস্বতী ভয় পেয়ে বললেন, “আমি লোকের স্পর্শ ভয় পাই বলে সব সময় পাতালে থাকি। কিন্তু আপনার আদেশ আমি অমান্যও করতে পারি না। আপনি সব দিক বিচার করে একটি ব্যবস্থা করুন।” তখন ব্রহ্মা সরস্বতীর অবস্থানের জন্য একটি হ্রদ খনন করলেন। সরস্বতী সেই হ্রদে অবস্থান করতে লাগলেন। ব্রহ্মা ভয়ংকর সাপেদের সেই হ্রদ ও সরস্বতীর রক্ষক নিযুক্ত করলেন।[২৯]

মহাপুরাণে (পৌরাণিক কাহিনী) সম্পাদনা

দেবীভাগবত পুরাণ সম্পাদনা

 
লক্ষ্মী ও সরস্বতী, রাজা রবি বর্মা অঙ্কিত

দেবীভাগবত পুরাণ অনুসারে, পরম কুস্মন্দেরে প্ৰথম অংশে দেবী সরস্বতীর জন্ম। তিনি বিষ্ণুর জিহ্বাগ্র থেকে উৎপন্ন হয়েছেন। সরস্বতী বাক্য, বুদ্ধি, বিদ্যা ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী; সকল সংশয় ছেদকারিণী ও সর্বসিদ্ধিপ্রদায়িনী এবং বিশ্বের উপজীবিকা স্বরূপিনী। ব্রহ্মা প্রথম তাঁকে পূজা করেন। পরে জগতে তাঁর পূজা প্রতিষ্ঠিত হয়। সরস্বতী শুক্লবর্ণা, পীতবস্ত্রধারিণী এবং বীণা ও পুস্তকহস্তা। তিনি নারায়ণ এর থেকে সৃষ্ট হন তাই তিনি তাঁকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেন। পরে তিনি গঙ্গার দ্বারা অভিশাপ পান ও তিনি এক অংশে পুনরায় শিবের চতুর্থ মুখ থেকে সৃষ্ট হন ও ব্রহ্মা কে পতি রূপে গ্রহণ করেন। তারপর শ্রীকৃষ্ণ জগতে তাঁর পূজা প্রবর্তন করেন। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে তাঁর পূজা হয়।[৩০]

গঙ্গা, লক্ষ্মী ও আসাবারী (সরস্বতীর পূর্ব জন্মের নাম) ছিলেন নারায়ণের তিন পত্নী। একবার গঙ্গা ও নারায়ণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসলে তিন দেবীর মধ্যে তুমুল বিবাদ উপস্থিত হয়। এই বিবাদের পরিণামে একে অপরকে অভিশাপ দেন। গঙ্গার অভিশাপে আসবারী নদীতে পরিণত হন। পরে নারায়ণ বিধান দেন যে, তিনি এক অংশে নদী, এক অংশে ব্রহ্মার পত্নী ও শিবের কন্যা হবেন এবং কলিযুগের পাঁচ হাজার বছর অতিক্রান্ত হলে সরস্বতী সহ তিন দেবীরই শাপমোচন হবে।[৩১]

গঙ্গার অভিশাপে আসাবারি মর্ত্যে নদী হলেন এবং ব্রহ্মার পত্নী হলেন ও শিবের চতুর্থ মুখ থেকে সৃষ্টি হয়ে তার কন্যা হলেন।[৩২]

শুক্ল যজুর্বেদ সম্পাদনা

রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চ হননের শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন, সে সময় জ্যোতির্ময়ী ব্রহ্মাপ্রিয়া সরস্বতী তাঁর ললাটে বিদ্যুৎ রেখার মত প্রকাশিত হয়েছিলেন। [৩৩]

সরস্+বতী=সরস্বতী অর্থ জ্যোতির্ময়ী। ঋগ্বেদে এবং যজুর্বেদে অনেকবার ইরা,ভারতী, সরস্বতীকে একসঙ্গে দেখা যায়। বেদের মন্ত্রগুলো পর্যালোচনায় ধারণা হয় যে, সরস্বতী মূলত সূর্যাগ্নি।[৩৪]

পাদটীকা সম্পাদনা

  1. Balf, Edward (১৮৮৫)। The Encyclopædia of India and of Eastern and Southern Asia। পৃষ্ঠা 534 – Google Books-এর মাধ্যমে। 
  2. "Hinduism 101 Saraswati Symbolism"Hindu American Foundation (HAF) (ইংরেজি ভাষায়)। ১৬ অক্টোবর ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ 
  3. Dowling, Elizabeth; Scarlett, W George (২০০৫)। Encyclopedia of Religious and Spiritual Development । SAGE Publications। পৃষ্ঠা 204আইএসবিএন 978-0761928836 
  4. Kinsley, David (১৯৮৮)। Hindu Goddesses: Vision of the divine feminine in the Hindu religious traditions। University of California Press। পৃষ্ঠা 55–64আইএসবিএন 0-520063392 
  5. Encyclopaedia of Hinduism। Sarup & Sons। ১৯৯৯। পৃষ্ঠা 1214। আইএসবিএন 978-81-7625-064-1 
  6. "Saraswati"World History Encyclopedia। সংগ্রহের তারিখ ৯ জানুয়ারি ২০২১ 
  7. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; davidkinsley নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  8. "Vasant Panchami Saraswati Puja"। Know India – Odisha Fairs and Festivals। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  9. "The festival of Vasant Panchami: A new beginning"। United Kingdom: Alan Barker। ৪ অক্টোবর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  10. Guide to the collection। Birmingham Museum of Art। Birmingham, Alabama: Birmingham Museum of Art। ২০১০। পৃষ্ঠা 55। আইএসবিএন 978-1-904832-77-5। ১৪ মে ১৯৯৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  11. "5th Annual A World in Trance Festival Jayanthi Kumaresh: Invoking The Goddess Sarawati | TeRra Magazine" (ইংরেজি ভাষায়)। ২০১৯-০৩-৩০। ২০২১-০৪-১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৩-০৬ 
  12. Donaldson, Thomas (২০০১)। Iconography of the Buddhist Sculpture of Orissa। পৃষ্ঠা 274–275। আইএসবিএন 978-8170174066 
  13. "सुरस"। Sanskrit English Dictionary। Koeln, Germany: University of Koeln। ৪ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  14. Muir, John (১৮৭০)। Original Sanskrit Texts on the Origin and History of the People of India – Their Religions and Institutions5। পৃষ্ঠা 337–347 – Google Books-এর মাধ্যমে। 
  15. "Rigveda"। Book 2, Hymn 41, line 16। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  16. "Rigveda"। Book 10, Hymn 17। ৮ মে ২০১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  17. Colbrooke, H.T.। Sacred writings of the Hindus। London, UK: Williams & Norgate। পৃষ্ঠা 16–17। ১০ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  18. Moor, Edward (১৮১০)। The Hindu Pantheon। পৃষ্ঠা 125–127 – Google Books-এর মাধ্যমে। 
  19. "Sarasvati, The Goddess of Learning"। Stephen Knapp। ২৭ এপ্রিল ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  20. "Saraswati From Vedas To Our Altar"www.exoticindiaart.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৭-১৭ 
  21. Catherine Ludvík (২০০৭)। Sarasvatī, Riverine Goddess of Knowledge: From the Manuscript-carrying Vīṇā-player to the Weapon-wielding Defender of the Dharma। BRILL Academic। পৃষ্ঠা 227–229। আইএসবিএন 978-90-04-15814-6 
  22. সংসদ সমার্থশব্দকোষ, অশোক মুখোপাধ্যায়, সংকলন ও সম্পাদনা সহযোগিতা: সোমা মুখোপাধ্যায়, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ১৯৯৬ (সংশোধিত) মুদ্রণ, পৃ. ১৯৮-১৯৯
  23. Mohan Lal, 1992, পৃ. 4333।
  24. Kamil Zvelebil, 1975, পৃ. 129।
  25. Kinsley, David (১৯৮৮)। Hindu Goddesses: Vision of the divine feminine in the Hindu religious traditions। University of California Press। পৃষ্ঠা 95। আইএসবিএন 0-520-06339-2 – Google Books-এর মাধ্যমে। 
  26. সরস্বতীধ্যানম্: স্তবকুসুমাঞ্জলি, স্বামী গম্ভীরানন্দ সম্পাদিত, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৬১, পৃষ্ঠা ৩৫৪
  27. সরস্বতীস্তোত্রম্ (২): স্তবকুসুমাঞ্জলি, স্বামী গম্ভীরানন্দ সম্পাদিত, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৬১, পৃষ্ঠা ৩৫৬-৫৭
  28. Rudrayamala Tantram। India: Shrinath Udupa। ২০১৭। পৃষ্ঠা 306। Rudrayamal Sharda Shahasranama 
  29. স্কন্দপুরাণ, নাগখণ্ড, ৪০
  30. দেবীভাগবত পুরাণ, নবম স্কন্ধ, অধ্যায় ১, ২ ও ৪
  31. দেবীভাগবত পুরাণ, নবম স্কন্ধ, অধ্যায় ৭
  32. দেবীভাগবত পুরাণ, নবম স্কন্ধ, অধ্যায় ৮
  33. বাল্মীকি রামায়ণ
  34. শংকরনাথ ভট্টাচার্য

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  • Sailen Debnath, The Meanings of Hindu Gods, Goddesses and Myths, আইএসবিএন ৯৭৮৮১২৯১১৪৮১৫, Rupa & Co., New Delhi.
  • Saraswati, Swami Satyananda। Saraswati Puja for Childrenআইএসবিএন 1-877795-31-3 
  • Ankerl, Guy (২০০০)। Coexisting contemporary civilizations: Arabo-Muslim, Bharati, Chinese, and Western। INU societal research: Global communication without universal civilization। 1। Geneva: INU Press। আইএসবিএন 2-88155-004-5 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা

  • "Sarasvati"Encyclopædia Britannica 
  • "Sarasvati, The Goddess of Learning"Stephen Knapp 
  • Je Tsongkhapa (২৪ মার্চ ২০১৫)। Prayer to SarasvatiWisdom Publications। The Splendor of an Autumn Moon The Devotional Verse of Tsongkhapa। Gavin Kilty কর্তৃক অনূদিত। আইএসবিএন 9780861717705 – Google Books-এর মাধ্যমে।