মুঘল-ই-আজম

কে আসিফ পরিচালিত ১৯৬০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক রোমান্টিক ভারতীয় চলচ্চিত্র
(Mughal-e-Azam থেকে পুনর্নির্দেশিত)

মুঘল-ই-আজম (হিন্দি: मुग़ल-ए-आज़म; অনু. মোগল সম্রাট) ১৯৬০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত একটি ঐতিহাসিক রোমান্টিক ভারতীয় চলচ্চিত্র যার পরিচালনায় ছিলেন ভারতের বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার কে আসিফ এবং প্রযোজনা করেছেন সফররাজ পাল্লোনঝি। দিলীপ কুমার, মধুবালা, এবং পৃথ্বীরাজ কাপুর অভিনীত এই চলচ্চিত্রে মুলত মুঘল শাহজাদা সেলিমের সাথে মহলের নর্তকী আনারকলির প্রেমকে উপজীব্য করা হয়েছে এবং এই অসম প্রেম নিয়ে শেষ পর্যন্ত মুঘল-সম্রাট আকবরের সাথে পুত্র সেলিমের সংঘটিত যুদ্ধকে চলচ্চিত্রে বিধৃত করা হয়েছে।

মুঘল-ই-আজম
প্রেক্ষাগৃহে মুক্তির পোস্টার
পরিচালককে আসিফ
প্রযোজকসফররাজ পাল্লোনঝি
রচয়িতা
শ্রেষ্ঠাংশে
সুরকারনওশাদ
চিত্রগ্রাহকআর ডি মাথুর
সম্পাদকধর্মবীর
প্রযোজনা
কোম্পানি
স্টারলিং ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন
মুক্তি
  • ৫ আগস্ট ১৯৬০ (1960-08-05) (ভারত)
স্থিতিকাল১৯৭ মিনিট
দেশভারত
ভাষা
নির্মাণব্যয়১০.৫–১৫ মিলিয়ন
আয়৫৫ মিলিয়ন

পরিচালক আসিফ মুঘল-ই-আজম নির্মাণের অনুপ্রেরণা পান ১৯৪৪ সালে পঠিত একটি নাটক থেকে যা সম্রাট আকবরের সময়ে অর্থাৎ ১৫৫৬-১৬০৫ সালে লিখিত হয়েছিল। আর্থিক অনিশ্চয়তার দরুন এ প্রোডাকশনে বিলম্ব ঘটে এমনকি ১৯৫০-এর সময়ে মুল চিত্র ধারণের পূর্বে প্রযোজক সংকটের জন্য এর শিল্পী নির্বাচনেও পরিবর্তন আসে। সে সময়ে ঐতিহাসিক এই চলচ্চিত্রের নির্মাণ ব্যয় ছিল অত্যন্ত বেশি যার একটি গানের চিত্রায়নে যে পরিমাণ বাজেট ছিল, সে একই পরিমাণ অর্থে একটা পূণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব হত।

ভারতীয় শাস্ত্রীয় এবং ফোক সংগীতের প্রভাবে নির্মিত এর ১২টি গানে কণ্ঠ দিয়েছিলেন ভারতের স্বনামধন্য গায়িকা লতা মঙ্গেশকর এবং বড়ে গুলাম আলী খান

মুঘল-এ-আজম সেসময়কার ভারতীয় চলচ্চিত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় পরিসরে মুক্তি পায় এবং যার টিকিট প্রাপ্তির জন্য সারাদিন লম্বা লাইনে দর্শক দাঁড়িয়ে ছিল। আগস্ট ৫, ১৯৬০ সালে মুক্তির পর এই চলচ্চিত্র বক্স অফিসের অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে বলিউডের সর্বকালের সর্বোচ্চ আয় করা চলচ্চিত্রের তালিকায় স্থান করে নেয় যা ১৫ বছর অক্ষুণ্ণ ছিল। অন্যান্য অসংখ্য পুরস্কারের পাশাপাশি মুঘল-এ-আজম একটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং তিনটি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার জয় করে। প্রথম কোন ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে রঙ্গিন সংস্করণ করে ২০০৪ সালে বাণিজ্যিকভাবে পুনরায় মুক্তি দেয়া হয় এবং আবারো ব্যবসায়িকভাবে সাফল্য অর্জন করে।

কাহিনীসংক্ষেপ

সম্পাদনা
বহিঃস্থ চিত্র
  মুঘল-ই-আজমের চিত্রসমুহ এবং কাহিনীসংক্ষেপের বিস্তারিত

মুঘল সম্রাজ্যের অধিপতি আকবরের কোন সন্তান ছিল না, এক পীরের দরগায় প্রার্থনার ফলে জন্ম হয় শাহজাদা সেলিমের। ছেলের জন্মের সংবাদে খুশি হয়ে সম্রাট এক দাসীকে নিজের হাতের আংটি খুলে প্রতিজ্ঞা করেন যে দাসী যা চায় তিনি তাই দিবেন।

শাহজাদা সেলিম বেড়ে উঠতে থাকেন আত্ব-অহংকার আর অগোছালো ভাবে ফলে পিতা বাধ্য হয়ে ছেলেকে নিয়মনীতি আর শৃঙ্খলা শিখানোর উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন যুদ্ধক্ষেত্রে। দীর্ঘ চৌদ্দ বছর পর সেলিম এক নির্ভীকযোদ্ধা হয়ে ফিরে আসে মহলে এবং প্রেমে পড়ে মহলের এক নর্তকী নাদিরার (আনারকলি)। সেলিম আর আনারকলির প্রেমের মাঝে বাধা হয়ে আসে মহলের আরেক নর্তকী বাহার, যে কিনা সেলিমের মন জয় করে মুগল সম্রাজ্যের ভাবি মালিকা হবার স্বপ্ন দেখে। সেলিম-আনারকলির প্রেমের কথা আকবরের কানে পৌঁছায় সে। আর এ-ঘটনা জানার পর আকবর ঐ সম্পর্ক মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায় এবং আনারকলিকে বন্দী করে। শাহজাদা সেলিম আনারকলিকে মুক্ত করার জন্য পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং বন্দী হন। সম্রাট আকবরের আদালত সেলিমের মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করে, তবে সেলিমের মুক্তির শর্ত হিসেবে আনারকলিকে ফিরিয়ে দেবার কথা বলে। আনারকলি আকবরের কাছে নিজেকে সমর্পন করে এবং সেলিমের মুক্তিলাভ ঘটে। আনারকলির জীবনের শেষ ইচ্ছা সে সেলিমের প্রিয়তমা স্ত্রী হিসেবে কিছুক্ষণ তার সাথে কাটানোর ইচ্ছা পোষণ করলে, আকবর তা মঞ্জুর করে কিন্তু সেলিমের সাথে বিশেষ কোন সম্পর্ক স্থাপের পূর্বেই সম্রাটের নির্দেশে সেলিমকে বিশেষ চেতনানাশক সুগন্ধি দিয়ে অচেতন করা হয় এবং আনারকলিকে জীবন্ত কবরস্থ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।

শেষ দৃশ্যে সেলিমের জন্মের সংবাদ দেয়ার সময় আনারকলির মাকে দেয়া ওয়াদার কল্যাণে আনারকলির জীবন রক্ষা পায় তবে শর্ত হিসেবে তার মাকে আনারকলিকে নিয়ে মোগল সম্রাজ্য ছেড়ে বহুদূর চলে যেতে বলা হয় এবং আনারকলি মুক্ত হয় ঠিকই কিন্তু সেলিমের চোখে এবং মোগল সম্রাজ্যের ইতিহাসে তাকে মৃত হিসেবে প্রচার করা হয়।

অভিনয়ে

সম্পাদনা

প্রোডাকশন

সম্পাদনা

প্রাথমিক পরিকল্পনা

সম্পাদনা
 
আনারকলি ও সেলিমের গল্প অবলম্বনে নির্মিত ১৯২৮ সালের নির্বাক চলচ্চিত্রে, আনারকলি

১৯২২ সালে উর্দু নাট্যকার ইমতিয়াজ আলি তাজ সেলিম এবং আনারকলির প্রেমকে উপজীব্য করে একটি নাটক রচনা করেছিলেন,[][] ১৬'শ শতকের একটি কিংবদন্তির উপর ভিত্তি করে।[] যার মঞ্চ প্রযোজনা হয়েছিল দ্রুততর সময়ে এবং চলচ্চিত্রায়নও শুরু হয়েছিল।[] আরদেশির ইরানি ১৯২৮ সালে নির্বাক আনারকলি নির্মাণ করেন এবং ১৯৩৫ সালে যার শব্দ সংযোজনের মাধ্যমে পুনঃনির্মাণ করেন।[] ১৯৪০ সালের শুরুতে আনারকলির গল্প প্রযোজক সিরাজ আলী হাকীম এবং তরুণ নির্মাতা কে আসিফ'কে মুঘল-ই-আজম শিরোনামে চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুপ্রাণিত করে। যার ফলশ্রুতিতে তারা চার উর্দু লেখকঃ আমান (জিন্নাত আমানের পিতা, যিনি আমানুল্লাহ খান হিসেবে অধিক পরিচিত), ওয়াযাহাত মির্জা, কামাল আমরোহি, এবং এহসান রিজভীকে চলচ্চিত্রের সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচনার জন্য নিযুক্ত করেছিলেন।[] কীভাবে এই চার উর্দু লেখক তাদের কাজের সমন্বয় করেছিলেন তা জানা না গেলেও উর্দু সাহিত্যের কাব্যিক নির্যাস আর প্রবাদসমুহ সংলাপে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে এই চলচ্চিত্রের চরিত্রায়ন ও বর্ণনায় ভিন্ন মাত্র যোগ করেছেন।[] চিত্রনাট্য রচনার শেষার্ধে, আসিফ চন্দ্র মোহন, ডি.কে. সপ্রু, এবং নার্গিসকে যথাক্রমে আকবর, সেলিম ও আনারকলি চরত্রের জন্য কাস্ট করেছিলেন।[] ১৯৪৬ সালে বোম্বে টকিজ স্টুডিওতে এই চলচ্চিত্রের শ্যুটিং হয়েছিল।[]

চলচ্চিত্র প্রকল্পটির কাজ বিভিন্ন সময় নানা কারণে বাধাঁগ্রস্ত হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং ভারত বিভাগ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য এর শ্যুটিংয়ের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। দেশ বিভাগের কিছুদিন পর, শিরাজ আলী পাকিস্তান চলে যান, আসিফের তখন কোন লগ্নিকারক ছিল না।[][] অন্যদিকে অভিনেতা চন্দ্র মোহন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১৯৪৯ সালে।[] তবে শিরাজ আলী পূর্বে একবার বলেছিলেন যে, শিল্পপতি সফরাজ পাল্লোনঝি এই চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ কতে পারেন। যদিও পাল্লোঞ্ঝি চলচ্চিত্র প্রযোজনা সম্পর্কে কিছুই জানতেন না, তা সত্ত্বেও ১৯৫০ সালে শুধুমাত্র মোগল বাদশাহ আকবরের ইতিহাস সম্বন্ধে তার আগ্রহের নিমিত্তে তিনি এই চলচ্চিত্র প্রযোজনায় সম্মত হন।[১০][১১] এরপর নতুন শিল্পীদের নিয়ে পুনরায় কাজ আরম্ভ হয়।[১০]

ধারণা করা হয় যে, এই চলচ্চিত্রের আরেক রচনাকার কামাল আম্রহি (যিনি নিজেও ছিলেন নির্মাতা) মুঘল-ই-আজম বাদ দিয়ে নিজেই একই বিষয়ে আরেকটি চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। পরবর্তিতে আসিফের মূখমুখি হলে তিনি প্রকল্পটি নির্মাণ থেকে সরে আসেন।[১২] তবে একই মঞ্চ নাটকের পটভূমিতে নন্দলাল যসোয়ান্তাল আনারকলি নির্মাণ করেছলেন, যাতে অভিনয় করেছিলেন বীণা রায় এবং প্রদীপ কুমার, এবং যেটি ১৯৫৩ সালে সর্বাধিক আয় করা চলচ্চিত্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল।[১৩]

কাস্টিং

সম্পাদনা

প্রাথমিকভাবে আসিফ দিলীপ কুমারকে শাহজাদা সেলিমের চরিত্রের জন্য নির্বাচিত করেননি।[১৪] কুমার নিজেও এই ধরনের কালীন চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে ইচ্ছুক ছিলেন না, কিন্তু প্রযোজকের জোরাজুরুতিতে তিনি অভিনয় করতে সম্মত হয়েছিলেন।[১৫] কুমারের মতে, "আসিফ নিশ্চিত ছিলেন আমি সেলিম চরিত্রটি নিজের মধ্যে সম্পূর্ণ ধারণ করতে পারব।"[১৬] তবে এই চলচ্চিত্রে কাজ করার সময় রাজস্থানের গরম আবহাওয়া আর শরীরে পরা ধাতব আচ্ছাদন তাকে বেশ ভুগিয়েছিল[১৬] অন্যদিকে আনারকলি চরিত্রটি প্রথমে সুরাইয়াকে প্রস্তাব করা হয়েছিল[১৭] অবশ্য পরে এই উল্লেখযোগ্য চরিত্রে মধুবালা কাজ করেন।[১৮] সেসময় মধুবালা জটিল হৃদ রোগে ভুগছিলেন,[১৯] যে কারণে শ্যূটিংয়ের সেটে প্রায় মূর্ছা গিয়েছেন; এছাড়াও কারাবন্দী অবস্থার দৃশ্যধারণের সময় ত্বকে ভীষণভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন, তবে মানসিকভাবে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন চলচ্চিত্রে কাজ শেষ করার বিষয়ে।[২০]

সম্রাট আকবরের চরিত্র নিজের মধ্যে ধারণ করার জন্য, পৃথীরাজ কাপুর “সম্পূন্নভাবে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য ও পরিচালকের উপর নির্ভরশীল ছিলেন”।[] মেক-আপ নেয়ার পূর্বে কাপুর ঘোষণা দিতেন, "Prithviraj Kapoor ab jaa rahaa hai" ("পৃথীরাজ কাপুর এখন প্রস্থান করছে"); আবার মেক-আপের পর তিনি বলতেন, "Akbar ab aa rahaa hai" ("আকবর এখন আসতেছে")। চলচ্চিত্রে নিজের ভারী কস্টিউমের জন্য কাপুর নানাবিদ সমস্যার সম্মুক্ষীন হয়েছিলেন, তাছাড়া খালি পায়ে মরুভূমিতে হাঁটার একটি দৃশ্য ধারণের সময় তার পায়ে ফোসকা পড়ে গিয়েছিল।[] চলচ্চিত্রের দৃশ্য ধারণের সময় উপস্থিত ছিলেন আলোকচিত্রী ল্যান্স ডেন, তিনি বলেন কাপুরকে কিছু কিছু দৃশ্যে নিজের সংলাপ মানে রাখতে বেগ পেতে হয়েছে, একটি দৃশ্যের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন যে অই দৃশ্য ঠিকঠাকভাবে ধারণ করার জন্য কাপুরকে উনিশ বার টেক দিতে হয়েছিল।[২১] পরিচালক আসিফ জানিয়েছেন চিত্র গ্রহণের সময়ে কাপুর পরিমিত খাদ্য গ্রহণ করতেন যাতে নিজের ওজন হ্রাস পায় এবং সম্রাট আকবরের চরিত্রে যথাযথভাবে নিজেকে উপস্থাপনের জন্য।[২১] জাকির হোসেন, যিনি পরবর্তিতে ভারতের বিখ্যাত তবলা বাদক হয়েছেন, তাকে শাহজাদা সেলিমের যুবক বয়সের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রাথমিকভাবে মনোনীত করা হয়েছিল, কিন্তু পরে এই চরিত্রের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় জালাল আগার, যিনি পরে 'শোলে (১৯৭৫) চলচ্চিত্রে "মেহেবুবা মেহেবুবা" গানে পারফর্ম করেছিলেন[]

মুঘল-ই-আজম চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু পারিবারিক ইতিহাসকে কেন্দ্র করে যেখানে পিতা-পুত্রের বৈপরীত্য দেখানো হয়েছে তাদের কর্তব্যবোধে পরিবার ও জনসাধারণের প্রতি, এবং নারীদের মধ্যকার বিশেষত রাজগণিকাদের অন্তকোন্দল লক্ষণীয়। "ফ্লিমিং দ্য গডসঃ রিলিজিয়ন এ্যান্ড ইন্ডিয়ান সিনেমা" বইয়ের লেখক র‍্যাচেল দ্যয়ার এর মতে, এই চলচ্চিত্রে মুলত মুসলমান ও হিন্দু ধর্মের মধ্যকার ধর্মীয় সহিষ্ণুতাকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে হিন্দু রাণী জোদাবাঈ এর মুসলিম শাসক আকবরের বিচারালয়ে উপস্থিতি, আনারকলি কর্তৃক হিন্দু ধর্মীয় ভক্তিমুলক গান পরিবেশন, এবং জন্মাষ্টমী উদযাপনের অনুষ্ঠানে আকবরের উপস্থিতি ও এসময় আকবরকে কৃষ্ণের একটি প্রতিমাকে দোল খাওয়াতে দেখা যায়।[২২] চলচ্চিত্র সমালোচক মুকুল ক্যাসাভ্যান উল্লেখ করেন যে, হিন্দু-মুসলিম প্রেমের এমন কোন সিনেমার কথা তিনি স্মরণ করতে পারেন না যেখানে নারী চরিত্র (জোদাবাঈ) হিন্দু।[২৩] পণ্ডিত ভাস্কর এবং এ্যালান চলচ্চিত্রটিকে ইসলামি সংষ্কৃতির ত্যাবলিঁও ভিভ্যান্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন,[২৪] যা এই চলচ্চিত্রের জৌলুসপূর্ণ সেট, সংগীতের মাধুর্যপূর্ণ দৃশ্যায়ন যেমন; কাওয়ালির দৃশ্য, ও কাব্যিকতাময় উর্দু সংলাপ যথার্থ বলে বিবেচিত।[২৪] এই চলচ্চিত্রে শুধুমাত্র সাজ-পোশাক নয় জটিল ফার্সি সংলাপও মুসলিম শাসকশ্রেণীকে আলাদা করে রেখেছে সাধারণের থেকে।"[২৫]

সঙ্গীত

সম্পাদনা
মুঘল-ই-আজম
 
কর্তৃক সাউন্ডট্র্যাক অ্যালবাম
মুক্তির তারিখ১৯৬০
ঘরানাচলচ্চিত্র সাউন্ডট্র্যাক
দৈর্ঘ্য৪৯:০২
সঙ্গীত প্রকাশনীইএমাই রেকর্ডস
প্রযোজকনওশাদ
নওশাদ কালক্রম
কহিনুর
(১৯৬০)
মুঘল-ই-আজম
(১৯৬০)
গঙ্গা যমুনা
(১৯৬১)

চলচ্চিত্রের গানগুলোর সংগীতায়োজন করেছেন, সংগীত পরিচালক নওশাদ, গানগুলো লিখেছেন শাকিল বাদ্যয়ানি। চলচ্চিত্রের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হবার পর আসিফ, টাকার ব্রিফকেস নওশাদের হাতে দিয়ে বলেছিলেন মুঘল-ই-আজমের জন্য "স্মরনীয় সংগীত" চান তিনি। কিন্তু আসিফের টাকার বিনিময়ে কাজের মান ভালো করার প্রস্তাব পছন্দ হয়নি নওশাদের, তিনি স্ত্রীকে অবাক করে টাকা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। তবে পরবর্তিতে তার স্ত্রীর মধ্যস্থতায় দুজনের মধ্যে আপোস হয় এবং আসিফ ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এভাবেই নওশাদ এই চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনার প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন।[২৬]

নওশাদের অন্যান্য সাউন্ডট্রাকের মতো মুঘল-ই-আজম'র সংগীতসমুহ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত এবং লোক সঙ্গীত দ্বারা প্রভাবিত, বিশেষত রাগসমুহ যেমন দরবারি, দূর্গা, ব্যবহৃত হয়েছে "পেয়ার কিয়া তো ডারনা ক্যিয়া" গানের সংগীতায়োজনে,[২৭] এবং কেদার, "বেক্যাস পে কারাম ক্যিযিয়ে"।[২৮] তিনি সিম্ফোনি অর্কেস্ট্রা ও কোরাসের বিশেষ ব্যবহার করেছিলেন সংগীতে বিশালতা দানের জন্য।[২৯] মোট বারটি গানের এই সাউন্ডট্রাকে বিভিন্ন গানে কণ্ঠ দিয়েছেন প্লে-ব্যাক এবং শাস্ত্রীয় ধারার শিল্পীরা। এবং গানগুলোর দৈর্ঘ্য মোট চলচ্চিত্রের দৈর্ঘ্যের এক-তৃতীয়াংশ।[৩০]

সমালোচক প্রতিক্রিয়া

সম্পাদনা

মুঘল-ই-আজম সাউন্ডট্রাক ভারতের সমালোচকদের কাছ থেকে সার্বজনীন হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। কেউ কেউ একে বলিউড ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সাউন্ডট্রাক হিসেবেও উল্লেখ করেছেন,[৩১][৩২] এছাড়া এটি ষাটের দশকের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বলিউড অ্যালবাম।[৩৩] প্ল্যানেট বলিউড-এ, লেখক শাহেদ খান মুঘল-ই-আজম-এর সংগীতকে উল্লেখ করেছেন "সোল অফ দ্য ফিল্ম" হিসেবে।[৩৪] ২০০৪ সালে, সুভাষ কে জা পুনঃবার প্রকাশিত সাউন্ডট্রাকের আলোচনায়, এর প্রযুক্তিগত দিক এবং মূল শিল্পী লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠ শুনে আবারো এর ভূয়সি প্রশংসা করেন।[৩৫] ২০১৩ সালে, সান পোস্ট পত্রিকায় বলদেব এস চৌহান বলেছেন, হিন্দি সিনেমার অন্যতম সেরা কিছু গান[৩৬]

রঙ্গিন সংস্করণ

সম্পাদনা

চলচ্চিত্রটির রঙ্গিন সংস্করণ ২০০৪ সালের ১২ নভেম্বর মুম্বাইয়ের ৬৫ টি হল সহ ভারতে পুনরায় মুক্তি পায়। মুম্বাইয়ের একটি প্রতিষ্ঠান একাডেমি অফ আর্টস এন্ড এনিমেশনকে চলচ্চিত্রটি ৫ কোটি রুপি থেকে ১০ কোটি রুপি ব্যয়ের মধ্যে রঙ্গিন সংস্করণ করার জন্য কার্যাদেশ দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি ১৮ মাস পর ইফেক্ট প্লাস নামে প্রাকৃতিক রঙ্গিন সংস্করণেন জন্য একটি বিশেষ সফটওয়্যার তৈরি করে। ১৭৭ মিনিটের চলচ্চিত্রটির ৩ লক্ষ ফ্রেম, প্রতিটি ১০ মেগাবাইট ফাইল হিসাবে রঙ্গিন কাজ করতে আরও ১০ মাস প্রয়োজন হয়। আসল নেগেটিভের অনেক অংশ ছত্রাকের আক্রমণে বা ছোট ছোট পিনের মত ছিদ্রের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ ছিল, সেগুলিকে পুনরুদ্ধার করা হয়।[৩৭]

আরও দেখুন

সম্পাদনা

পাদটীকা

সম্পাদনা

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. Raheja, Dinesh (১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৩)। "Mughal-e-Azam: A work of art"Rediff.com। ১৭ অক্টোবর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুন ২০১২ 
  2. Pauwels 2007, পৃ. 123, 125, 130।
  3. Ganti 2004, পৃ. 152।
  4. Warsi 2009, পৃ. 38।
  5. Warsi 2009, পৃ. 39।
  6. "Where every line was a piece of poetry..."The Times of India। ৩১ জুলাই ২০১০। ২৯ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩ জুলাই ২০১২ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  7. Vijayakar, Rajiv (৬ আগস্ট ২০১০)। "Celluloid Monument"The Indian Express। ৩ জুলাই ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুন ২০১২ 
  8. Warsi 2009, পৃ. 52।
  9. "How well do you know Mughal-e-Azam?"। Rediff। ৫ আগস্ট ২০১০। ১ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুন ২০১২ 
  10. Warsi 2009, পৃ. 53।
  11. Us Salam, Zia (৩১ জুলাই ২০০৯)। "Saga of all sagas"The Hindu। ২১ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুন ২০১২ 
  12. Warsi 2009, পৃ. 39–40।
  13. "Box Office 1953"Box Office India। ৩০ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ জুলাই ২০১২ 
  14. Warsi 2009, পৃ. 50।
  15. Burman, Jivraj (৭ আগস্ট ২০০৮)। "Mughal-e-Azam: reliving the making of an epic"Hindustan Times। ২৪ জুন ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ জুন ২০১২ 
  16. Sinha, Meenakshi (৫ আগস্ট ২০১০)। "50 yrs [sic] on, Dilip Kumar remembers magnum opus Mughal-e-Azam"The Times of India। ২০১৩-১০-২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জুন ২০১২ 
  17. Us Salam, Zia (৩১ জুলাই ২০০৯)। "Mughal-e-Azam (1960)"The Hindu। ৫ আগস্ট ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুন ২০১২ 
  18. Sharma, Rohit (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১১)। "Still our Valentine"Hindustan Times। ২৫ জুন ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ জুন ২০১২ 
  19. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; newt নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  20. Kohli, Suresh (২৫ জুন ২০১২)। "Timeless appeal"Deccan Herald। ৮ ডিসেম্বর ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ জুন ২০১২ 
  21. Jain 2009, পৃ. 39।
  22. Dwyer 2006, পৃ. 116।
  23. Ahmed, Omair (১৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৮)। "Once Upon A Fable"Outlook48 (7): 76–77। 
  24. Teo 2012, পৃ. 57।
  25. Kavoori ও Punathambekar 2008, পৃ. 135।
  26. "Music mogul"Hindustan Times। ২ জুন ২০০৭। ৫ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১২ জুন ২০১২  – via Highbeam (সদস্যতা প্রয়োজনীয়)
  27. "The last Mughal of film music"Hindustan Times। ৬ মে ২০০৬। ৫ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ এপ্রিল ২০১৩At the time of premiere of the coloured version of Mughal-e-Azam, he had stated that today's generation should be acquainted with the classical Indian music. In that epic film, he had used Raga Darbari and Raag Durga to compose various songs like the immortal Pyar Kiya To Darna Kya  – via Highbeam (সদস্যতা প্রয়োজনীয়)
  28. "The breath of God blows through music"Hindustan Times। ৩০ মার্চ ২০০৭। ৫ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ এপ্রিল ২০১৩I managed a song in my beloved Raag Kedar, which is Hamir Kalyani in Carnatic music. It was Bekas pe karam kijiye, Sarkar-e-Madina from Mughal-e-Azam.  – via Highbeam (সদস্যতা প্রয়োজনীয়)
  29. Morcom 2007, পৃ. 144।
  30. Gokulsing ও Dissanayake 2013, পৃ. 273।
  31. Lall, Randy। "100 greatest soundtracks ever"। Planet Bollywood। ৬ মার্চ ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১ মে ২০১৫ 
  32. "Top 40 Soundtracks of All Time"। BBC News। সেপ্টেম্বর ২০০৫। সংগ্রহের তারিখ ১৯ আগস্ট ২০১৩ 
  33. "Music Hits 1960–1969"। Box Office India। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২ সেপ্টেম্বর ২০১৩ 
  34. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; planet নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  35. K Jha, Subhash (১১ নভেম্বর ২০০৪)। "Mughal-e-Azam music review"Indo-Asian News Service। Nowrunning.com। ২৫ আগস্ট ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ জুন ২০১২ 
  36. Baldev S Chauhan (৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩)। "Mughal-e-Azam : the Kohinoor of world cinema : Review"Sun Post। ২৯ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৫ আগস্ট ২০১৩ 
  37. The colour of profit, Frontline, The Hindu dot com, 19 November 2004

গ্রন্থপঞ্জি

সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা