ফকির (মুসলিম তপস্বী)
ফকির (আরবি : الفقير) হল একটি ইসলামি পরিভাষা, যা ঐতিহ্যগতভাবে সে সকল সুফি মুসলিম তপস্বীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যারা তাদের পার্থিব সম্পদ ত্যাগ করে এবং আল্লাহর উপাসনায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে। তারা অগত্যা সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে এবং দারিদ্র্যের শপথ নেয়। তাদের কেউ বাস্তবে দরিদ্র হতে পারে এবং কেউ ধনীও হতে পারে, তবে অস্থায়ী পার্থিব জীবনের উপকরণসমূহ আল্লাহর প্রতি তাদের অবিচ্ছিন্ন উৎসর্গ থেকে বিরত হয় না।[১] [২]
তারা জিকিরের প্রতি যত্মবান ও শ্রদ্ধাশীল হয়। [৩] প্রাথমিকভাবে মুসলিম বিশ্বে সুফিবাদের আবির্ভাব হয় উমাইয়া খিলাফতের সময় (৬৬১-৭৫০)[৪] এবং এটি ইসলামের দুটি মূলধারা সুন্নি এবং শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি রহস্যময় [৫] ঐতিহ্য হিসেবে বেড়ে ওঠে।[৫] সুফি মুসলিম তপস্বীগণ (ফকির ও দরবেশ) ইসলামের ইতিহাসে ইসলাম প্রচারে অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং ব্যাপকভাবে সফল ছিলেন।[৫] বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য এবং মুসলিমবিশ্বের সবচেয়ে দূরবর্তী অঞ্চল উত্তর আফ্রিকা,বলকান,ককেশাস,ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্য, পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে তাদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। [৫] সুফি মুসলমানরা দীর্ঘ একটি সহস্রাব্দ ধরে বিভিন্ন মহাদেশ ও সংস্কৃতিতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং আরবি,ফার্সি, তুর্কি, ভারতীয় ভাষাসহ বিশ্বের সকল প্রসিদ্ধ ভাষায় ইসলামের প্রচার ঘটিয়েছ।[৬]
সাম্পতিক ফকির শব্দটি এমন একজন সন্ন্যাসীর ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়, যিনি পার্থিব সম্পদ ত্যাগ করেন। এমনকি অমুসলিমদের ক্ষেত্রেও এটি প্রয়োগ হয়।[৭][৮] মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় ফকিরদের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে এবং তাদের বিশেষ ঐশী শক্তির অধিকারী মনে করা হয়।[৯] শব্দটি প্রায়শই হিন্দু সন্ন্যাসীদের (যেমন: সাধু, গুরু,স্বামী ও যোগী) ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়।[১০] এই ব্যবহারগুলি মূলত ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল যুগে বিকশিত হয়েছিল। উত্তর ভারতে ফকিরদের একটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীও পাওয়া যায়, যারা সুফি মাজারে বসবাসকারী ফকিরদের সম্প্রদায় থেকে এসেছে। ১ম শিখ গুরু শ্রী গুরু নানক দেব জিও "নানক শাহ ফকির" নামে পরিচিত ছিলেন। মাওলানা মাজদ্দেদ্দিন আলী বাগের শাহ তার একটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থে বলেন, "সুফি এমন একজন ব্যক্তি, যার আধ্যাত্মিক তপস্যার কারণে মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে এবং যিনি তার আসল পরিচয় জেনেছেন। সুফিরা একেবারে দরিদ্র হয় এবং জীবনের সত্য ছাড়া আর কিছুই দেখে না।"[১০]
ব্যুৎপত্তি
সম্পাদনাব্যুৎপত্তিগতভাবে ফকির শব্দটি আরবি। এটি ফকর ( আরবি: فقر) শব্দমূল থেকে এসেছে। এর অর্থ হল "দরিদ্র হওয়া বা দুঃখী হওয়া।[১১] এ হিসেবে ফকির শব্দের বাংলায় অর্থ হয় দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত বা দুঃখী।[১১] বর্তমান বাংলা ভাষায় গরিব বা দরিদ্র বোঝাতেও ফকির শব্দ ব্যবহৃত হয়।
ইতিহাস
সম্পাদনাইসলামের ৪র্থ খলিফা আলী ইবনে আবি তালিবের (রা.) পুত্র এবং নবি মুহাম্মদ (সা.)-এর নাতি হুসাইন ইবনল আলী তাসাউফের বিষয়ে মিরাত উল-আরফিন নামে একটি বই লিখেছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এটিকে সুফিবাদের উপর প্রথম বই বলা হয়। বিভিন্ন কারণে উমাইয়াদের শাসনামলে এই বইটি প্রকাশ করা যায়নি। হুসাইন ইবনে আলী (রা.)-এর পরে দীর্ঘকাল ধরে ফক্র, তাসাউউফ ও সুফিবাদের তথ্য ও শিক্ষা হৃদয় থেকে হৃদয়ে স্থানান্তরিত হতে থাকে। তবে এসব কথার কোনো শক্তিশালী ঐতিহাসিক ভিত্তি পাওয়া যায় না। সে হিসেবে অনেক গবেষক এসব কথা মেনে নিতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন।[১২]
বাংলায় ফকির বলতে দুটি অর্থ প্রকাশ করে, যার একটি মূলত একজন সন্ন্যাসী, সাধু পুরুষ বা দরবেশকে বোঝায়। শব্দটি মুসলিম বংশোদ্ভূত হলেও ভারতীয় উপমহাদেশে এটি গোস্বামী, সাধু, ভিক্ষুক এবং অন্যান্য উপাধির মতো হিন্দু তপস্বী এবং রহস্যবাদীদের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হয়েছে। ফকিররা সাধারণত অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী পবিত্র পুরুষ হিসেবে বিবেচিত হন। মুসলমানদের মধ্যে ফকিরদের প্রধান সুফি তরিকা হল:মাদারিয়া শাদিলিয়াহ, চিশতিয়া, কাদিরিয়া, নকশবন্দিয়া এবং সোহরাওয়ার্দিয়া। [১৩] কেমব্রিজ ইংলিশ ডিকশনারী ফকির শব্দটিকে "ইসলাম ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্য বা একজন পবিত্র মানুষ" হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।[১৪]
গুণাবলী
সম্পাদনাএকজন ফকিরের ঠিক কী কী গুণাবলী থাকতে হয় সে বিষয়ে অনেক মুসলিম পণ্ডিত লিখেছেন। প্রথম দিকের বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত আবদুল-কাদির জিলানি সুফিবাদ তাসাউউফ ও ফকরকে চূড়ান্তভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। একজন ফকিরের গুণাবলী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, “ফকির সে নয় যে কিছু করতে পারে না এবং তার আত্ম-সত্তায় কিছুই নেই। ফকিরের খোদাপ্রদত্ত অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে এবং তা তার থেকে প্রত্যাহার করা হয় না।[১৫][১৬]
ইবনে আরাবী ফকিরসহ সূফীবাদকে আরো বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি এই বিষয়ে ৫০০ টিরও বেশি বই লিখেছেন। তিনিই প্রথম মুসলিম পণ্ডিত যিনি খোলাখুলিভাবে ওয়াহদাত আল-ওজুদের ধারণাটি প্রবর্তন করেছিলেন। তার লেখা এই বিষয়ে একটি জটিল উৎস হিসাবে বিবেচিত হয়।[১৭][১৮][১৯][২০] অন্য একজন প্রসিদ্ধ মুসলিম সাধক সুলতান বাহু একজন ফকিরকে "আল্লাহর কাছ থেকে পূর্ণ কর্তৃত্ব অর্পণ করা হয়েছে" বলে বর্ণনা করেছেন। একই গ্রন্থে সুলতান বাহু বলেন, “ফকির আল্লাহর একত্বে বিলীন হয়ে অনন্তকাল লাভ করে। সে যখন নিজেকে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের কাছ থেকে মুছে ফেলে, তখন তার আত্মা ঐশ্বরিকতায় পৌঁছে যায়।[২১]
সমালোচনা
সম্পাদনাপ্রচলিত ফকির সমাজ ও তাদের কার্যক্রম নিয়ে মুসলিম বিশ্বের মূলধারার আলেমগণ অনেক সমালোচনা করেন। তাদের মতে, বর্তমান ফকিররা ইসলামের ঐশী স্প্রিট থেকে সরে গিয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছে। তাদের মতে, ফকির ও সুফি একই স্তরের নয়। সুফিবাদ মূলত ধর্মীয় গণ্ডিতে আবদ্ধ থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে শরিয়ত মেনে চলে আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জনের শিক্ষা দেয়। বিপরীতে প্রচলিত ফকিররা শরিয়ত থেকে মুক্ত হয়ে বিভিন্ন মনগড়া পন্থা অবলম্বন করে আত্মিক মুক্তির জন্য সাধনা করেন। তাই মূলধারার আলেমগণ সুফিবাদ ও ফকিরদের সাধনাকে আলাদা দুটি বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।[২২][২৩][২৪]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "Faqīr"। Oxford Reference (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২৩ মে ২০২০।
- ↑ "Faqir - Oxford Islamic Studies Online"। www.oxfordislamicstudies.com। সংগ্রহের তারিখ ২৩ মে ২০২০।
- ↑ A Prayer for Spiritual Elevation and Protection (2007) by Muhyiddin Ibn 'Arabi, Suha Taji-Farouki
- ↑ Hawting, Gerald R. (২০০০)। The first dynasty of Islam: The Umayyad Caliphate AD 661-750। Routledge। আইএসবিএন 978-0-415-24073-4। See Google book search.
- ↑ ক খ গ ঘ Oxford Research Encyclopedia of Religion।
- ↑ Michael Sells, Early Islamic Mysticism, pg. 1
- ↑ Dobe, Timothy S. (২০১৫)। Hindu Christian Faqir: Modern Monks, Global Christianity, and Indian Sainthood। Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-934627-1। ডিওআই:10.1093/acprof:oso/9780199987696.001.0001।
- ↑ Nanda, B. R. (২০০৪)। Churchill's 'Half-naked Faqir'। Oxford University Press। আইএসবিএন 978-0-19-908141-7।
- ↑ "Encyclopædia Britannica"। britannica.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৫-০৭-১০।
- ↑ ক খ Colby, Frank Moore; Williams, Talcott (১৯১৮)। The New International Encyclopaedia (ইংরেজি ভাষায়)। Dodd, Mead। পৃষ্ঠা 343। সংগ্রহের তারিখ ৯ ডিসেম্বর ২০১৬।
- ↑ ক খ Encyclopaedia Islamica।
- ↑ A brief history of Islam by Tamara Sonn, 2004, p60
- ↑ "Online Dictionary / Reference"। Dictionary.com। সংগ্রহের তারিখ ১ অক্টোবর ২০১৪।
- ↑ "Dictionary of Cambridge"। সংগ্রহের তারিখ ১ অক্টোবর ২০১৪।
- ↑ Biographical encyclopaedia of Sufis: Central Asia and Middle East by N. Hanif, 2002
- ↑ The Sultan of the saints: mystical life and teaching of Shaikh Syed Abdul Qadir Jilani, Muhammad Riyāz Qādrī, 2000, p24
- ↑ Fusus al-hikam (The Bezels of Wisdom), ed. A. Affifi, Cairo, 1946;trans. R.W.J. Austin, The Bezels of Wisdom, New York: Paulist Press,1980
- ↑ al-Futuhat al-makkiyya (The Meccan Illuminations), Cairo, 1911; partial trans. Michel Chodkiewicz et al., Les Illuminations de la Mecque: The Meccan Illuminations, Textes choisis/Selected Texts, Paris: Sindbad,1988.
- ↑ The Sufi Path of Knowledge: Ibn al-'Arabi's Metaphysics of Imagination, Albany, NY: State University of New York Press.1981
- ↑ Sufis of Andalusia, London, George Allen & Unwin.1971
- ↑ "Reference from Sultan Bahoo's book"। সংগ্রহের তারিখ ১ অক্টোবর ২০১৪।
- ↑ "ইসলামী দর্শন ও তাসাউফ - প্রথম পত্র (ফাযিল স্নাতক তৃতীয় বর্ষ) - আল ফাতাহ পাবলিকেশন্স"। www.rokomari.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-৩১।
- ↑ "রাহে বেলায়াত - ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর"। www.rokomari.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-৩১।
- ↑ "তাসাউফ তরিকত উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ - প্রফেসর ড. আবুল বয়ান মুহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান"। www.rokomari.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-১০-৩১।