ক্ষুদিরাম দাস
এই নিবন্ধে একাধিক সমস্যা রয়েছে। অনুগ্রহ করে নিবন্ধটির মান উন্নয়ন করুন অথবা আলাপ পাতায় বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করুন।
|
ক্ষুদিরাম দাস (৯ অক্টোবর ১৯১৬ – ২৮ এপ্রিল ২০০২) একজন পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, সমালোচক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও একজন ভাষাতত্ত্ববিদ ছিলেন।
ক্ষুদিরাম দাস | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ২৮ এপ্রিল ২০০২ | (বয়স ৮৫)
জাতীয়তা | ভারতীয় |
পিতা-মাতা | সতীশচন্দ্র দাস (পিতা) কামিনীবালা দাস (মাতা) |
পুরস্কার | বিদ্যাসাগর পুরস্কার(১৯৮৪) রবীন্দ্র পুরস্কার (১৯৯৪) |
ওয়েবসাইট | professorkhudiramdas |
ব্যক্তিগত জীবন
সম্পাদনাক্ষুদিরাম দাস জন্মগ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলায় অবস্থিত বেলিয়াতোড়ে গ্রামে। এই গ্রামেই জন্মেছেন বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ, শিল্পী যামিনী রায়। তার শৈশব বাল্যের দিনগুলি মূলত মধ্যযুগের ঐতিহ্যে লালিত। যাত্রা, কীর্তন, রামায়ণ গান, কথকতা এসবের প্রভাব তার অন্তরে স্থায়ীভাবে পড়েছিল। উত্তরকালে মধ্যযুগ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা আর লেখায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়।অন্যদিকে আধুনিক কালের নিঃশব্দ পদসঞ্চার ঘটছিল। আধুনিক শিক্ষার অনুপ্রবেশ পুরোনো সমাজব্যবস্থাকে নাড়া দিতে শুরু করেছিল। জাতিভেদ এবং অস্পৃশ্যতার বাধা অতিক্রম করে নিম্নবর্গের মানুষজন আধুনিক শিক্ষা লাভ করে মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল। জাতবৃত্তির দাসত্বে আর তাদের বন্দি করে রাখা যাচ্ছিল না। ক্ষুদিরাম দাস কালের এই সংকেতধ্বনিতে সাড়া দিয়েছিলেন। জাতিগত অপমান এবং লাঞ্ছনার বিরুদ্ধের দাঁড়িয়েছিলেন। প্রবল আত্মবিশ্বাস, অপরিসীম সাহস, অমিত অধ্যবসায় আর প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের সহায়তায় বিপুল প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিলেন। তার পিতা ছিলেন সতীশ চন্দ্র দাস এবং মাতা কামিনীবালা দেবী। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে তার ছোটবেলা কেটেছে। বাবার কোন কাজ থাকত না। জমিদার বাড়িতে ধান ভেনে সামান্য কিছু চাল নিয়ে আসতেন মা।[১] তিনি গ্রামের পাঠশালায় পড়া শেষ করে বেলিয়াতোড় মধ্য ইংরাজী স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন কিছুদিন। ১৯২৯ সালে বৃত্তি পেয়ে বাঁকুড়া জেলা স্কুলে ভর্তি হন। ওখান থেকে ১৯৩৩ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে সংস্কৃত ও বাংলায় লেটার সহ উত্তীর্ণ হন। তিনি সংস্কৃত কাব্যের 'আদ্য' এবং পুরাণ পরিষদের 'মধ্য' পরীক্ষাও পাস করেন ১৯৩৩-এ। ১৯৩৩ সালে বাঁকুড়া ওয়েজনিয়ান মিশন কলেজ (অধুনা 'খ্রিস্টান কলেজ') আই.এ. ক্লাসে ভর্তি হন এবং ১৯৩৫ সালে আই.এ. পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে সংস্কৃত ও বাংলায় লেটার সহ উত্তীর্ণ হন। বাঁকুড়া খ্রিষ্টান কলেজ থেকে তিনি সংস্কৃতে সাম্মানিক স্নাতক অর্জন করেন এবং প্রথম শ্রেণিতে তৃতীয় হন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ. পাস করেন, প্রথম বিভাগে প্রথম স্থানে,শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ড ভেঙে।বাংলা এম. এ. তে ১৯৩৯ সালে ৭২.৬% নম্বর পেয়ে নতুন রেকর্ড করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ স্বর্ণপদক-সহ ৫ টি স্বর্ণ পদক এবং স্যার আশুতোষ মুখার্জি রৌপ্য পদক দেওয়া হয়। ১৯৩৯ সালে তিনি কাব্যতীর্থ ও কাব্যরত্ন পরীক্ষা পাস করেন। তিনি ১৯৪১ সালে বি.টি পরীক্ষা পাস করেন ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে। গবেষণায় আগ্রহ দেখাতে আচার্য সুনীতিকুমার যথার্থ বলেছিলেন, উনানে হাঁড়ি চড়িয়ে যাকে তণ্ডুলের সন্ধান করতে হয় তার পক্ষে গবেষণা সম্ভব হবে না। বিশ বছর পরে তিনি বাংলা সাহিত্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ডি-লিট পেলেন।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক পদ পাওয়ার সময় তাকে বারবার আঘাত করা হয়। তিনি প্রত্যাখ্যত হন। এমন কি নির্বাচক মণ্ডলীর কেউ তার সম্প্রদায় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাকে ঠেকানো যায়নি। তিনি রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক হয়েছিলেন। তার আগে এ পদে ছিলেন দীনেশ্চন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, খগেন্দ্রনাথ মিত্র, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও শশীভূষণ দাশগুপ্ত। তার বাস্তব জীবন ছিল বড়ই কঠিন, ভিতর ও বাইরে অপ্রতিহত সংগ্রাম, যাকে বলে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করা, তা চালিয়ে গেছেন সারাজীবন-প্রতিকূল পরিস্থিতি বা বিরুদ্ধ মানুষের সঙ্গে আপস করেন নি। নিজের যুক্তিবোধ ও বিবেকের কাছ থেকে একচুল সরে আসেননি। তার জীবনের দীর্ঘ ১৪ বছর (১৯৮২-১৯৯৬) অভিধানের পিছনে তার মূল্যবান সময় ও জীবন দিয়েছিলেন। যা আজও প্রকাশিত হয়নি কিছু মানুষের চক্রান্তের ফলে। যা প্রকাশিত হলে হয়তো অভিধান এবং তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব দুই-ই অনেক লাভবান হত। প্রথিতযশা এই অধ্যাপক বিপুলসংখ্যক ছাত্রছাত্রীর শিক্ষাগুরু। তার কৃতি ছাত্রদের তালিকায় রয়েছেন অধ্যাপক শঙ্করী প্রসাদ বসু, অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষ, অধ্যাপক অরুণকুমার বসু, অধ্যাপক শিশিরকুমার দাশ, অধ্যাপক উজ্জ্বল কুমার মজুমদার, অধ্যাপক ওয়াকিল আহমদ প্রমুখ। যথার্থই তিনি শিক্ষকদের শিক্ষক। কর্মজীবনে বহু বিশিষ্ট সহকর্মী অধ্যাপকের সান্নিধ্যে এসেছেন তিনি। সকলেই তার পাণ্ডিত্য মেধা স্মৃতিশক্তি, রসবোধ, এবং সারল্যে মুগ্ধ হয়েছে। জনার্দন চক্রবর্তী, কালীপদ সেনের মতো সহকর্মী অধ্যাপকের স্নেহধন্য ছিলেন তিনি। অন্যদিকে দেবীপদ ভট্টাচার্য, অজিতকুমার ঘোষ, অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূদেব চৌধুরী, ভবতোষ দত্তের মতো অনুজ সহকর্মী অধ্যাপকের শ্রদ্ধাভিষিক্ত হয়েছেন। তিনি তীক্ষ্ণ মেধা ও প্রখর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। যুক্তি আর বুদ্ধি দিয়ে সবকিছু বিচার করতেন। ছেঁদো কথা এবং বাঁধা বুলিতে তার আস্থা ছিল না। সাহিত্যের ব্যাখ্যায় দেশ-কাল-মানুষকে গুরুত্ব দিতেন। মৌলিকতা তিনি পছন্দ করতেন। চিন্তায়-ভাবনায় নিজে যেমন মৌলিক ছিলেন, তেমনই ছাত্রছাত্রীদের চিন্তা-ভাবনার মৌলিকতার ওপর তিনি জোর দিতেন। সহায়ক গ্রন্থ অপেক্ষা মূল গ্রন্থ পাঠের জন্যে তিনি ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহিত করতেন। নিয়মিত প্রশ্নোত্তর লিখে দেখাতে বলতেন। তার মত ছিল, এতে লেখার অভ্যেস হয়, চিন্তা-ভাবনা পরিণত ও স্বচ্ছ হয়। ব্যক্তিগত জীবনযাপনের দিক থেকে তিনি ছিলেন খুবই সাধারণ। ধুতি ও পাঞ্জাবি এবং আনুষ্ঠানিকভাবে খাদির জহরকোট এই ছিল তার পরিধেয়। তাও সংখ্যায় খুব বেশি নয়। আসলে আড়ম্বর, প্রাচুর্য, সঞ্চয় এগুলিকে তিনি ঘৃণা করতেন। তার পক্ষপাত ছিল সাধারণ দরিদ্র মানুষের প্রতি। তাই প্রতি পুজোয় কম্বল, ধুতি ইত্যাদি কেনা হত, বাড়ির জন্য নয়, তার অনুগৃহীত গরিব মানুষের জন্য। তিনি হোমিওপ্যাথি ডাক্তারিতে বিশ্বাস করতেন।প্রতি ছুটির দিনে কৃষ্ণনগরে বাড়ির বারান্দা রোগীর ভিড়ে ভরে থাকত। রোগীরা তার কাছে ওষুধ এবং পথ্য দুইই পেত। তথাকথিত এলিট সম্প্রদায়, ছাত্রছাত্রী, গুণী মানুষজন, বিদ্বৎসমাজ তাকে ঘিরে একটি পরিমণ্ডল রচনা করলেও এই খ্যাতি এই সম্মান তার ব্যক্তিত্বের সবটা প্রকাশ করে না। একেবারে ভূমি থেকে উঠে আসা এই মানুষটি তার শিকড়কে কখনোই ভোলেননি। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতায়, প্রগতিশীল চিন্তাচেতনায় প্রণিত আদর্শনিষ্ঠ সমাজ মনস্ক বুদ্ধিজীবী এবং নানা গঠনকর্মে নিষ্ঠায় আজীবন ব্রতী। সর্বপ্রকার সংকীর্ণতা ও গোঁড়ামিমুক্ত মুক্তমনের আধুনিক মানুষ, মানুষের কাছে দায়বদ্ধ সামাজিক মানুষ। ষাটের দশকের শেষে মৌলানা আজাদ কলেজের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। ঐ কলেজে অধ্যাপকদের বসার ঘরে চা পানি সরবরাহ করতো বয়স্ক বেয়ারা গণি। রোজার মাসে গণির শুকনো মুখ দেখে তিনি তার নিকট চা পানি না চেয়ে অধিকাংশ সময় বাইরে খেয়ে নিয়ে রোজাদার গণিকে বাঁচিয়ে দিতেন। তিনি ছিলেন মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের পক্ষে।মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের আন্দোলনে তিনি ছিলেন পুরোধা। ১৯৬৩ সালে সরকারে অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তারের পরিকল্পনাকে সার্থক করতে এগিয়ে এসেছিলেন এবং কৃষ্ণনগর পৌরসভার শিক্ষা সমিতির সভাপতি হয়েছিলেন। বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির ওপর হামলা রুখতে তার সভাপতিত্বে ১৯৮৯ সালে বঙ্গ-ভাষা প্রসার সমিতি গঠিত হয়। এই সমিতির উদ্দেশ্য ছিল বাংলার সুস্থ সংস্কৃতি ও ভাষা সাহিত্যকে পূর্ব মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা। বাংলার বুকে সমস্ত অফিস,আদালত, স্কুল, কলেজ, ব্যাঙ্ক, পোষ্ট অফিস ইত্যাদিতে বাংলা ভাষায় কাজকর্ম চালু করা। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে তিনি মেট্রোসিনেমার সামনে জনসভায় বাংলা ভাষার স্বাধিকারের পক্ষে বক্তব্য রেখেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে মহান একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনের স্মরণে মিছিলে পা মিলিয়ে ছিলেন। দূরদর্শনে বাংলা ভাষা ভিত্তিক অনুষ্ঠান কমিয়ে দেওয়ার এবং হিন্দির আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কলকাতা দূরদর্শনের কেন্দ্র অধিকর্তার কাছে প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছিলেন। কৃষ্ণনগরে দ্বিজেন্দ্র জন্মভিটায় অবস্থিত দ্বিজেন্দ্র পাঠাগারে তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা-সভাপতি, মৃত্যু পূর্বে তিনি তার বাড়ির ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারের আকর গ্রন্থাদি দ্বিজেন্দ্র পাঠাগারে ও পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমিকে দান করে গেছেন। তার সম্বন্ধে কথাসাহিত্যিক প্রাজ্ঞ চিন্তানায়ক অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন ' ডক্টর ক্ষুদিরাম দাস তার বিদ্যাবত্তার জন্য বিখ্যাত। যেমন সংস্কৃত তেমনি বাংলা উভয় ভাষায় তার অসীম অধিকার। তার চেয়েও প্রশংসনীয় লিখনশৈলী ও শব্দচয়ন। আমি তার বাংলা রচনার পক্ষপাতী পাঠক। তার চেয়েও প্রশংসনীয় তার মুক্ত মন। সংস্কারমুক্ত মনে তিনি ভারতের বিবিধ ভাষা অনুশীলন করেছেন। তিনি আবিষ্কার করেছেন যে বাংলা ভাষার অসংখ্য শব্দ এসেছে সাঁওতালি ভাষা থেকে। যাঁরা নিয়েছেন তারা সংস্কৃত দিয়ে শোধন করে মুখে তুলেছেন। বাংলাদেশ গোড়ায় ছিল আদিবাসীদের দেশ। তাদের ভাষার সঙ্গে সংমিশ্রণ সূত্রেই বাংলা ভাষার বিবর্তন ঘটেছে। ক্ষুদিরামবাবু সেই বিবর্তনের সন্ধান দিয়ে আমাদের অতীত সম্বন্ধে আমাদের সচেতন করেছেন। ক্ষুদিরামবাবু আরো একটি পরিচয় তিনি ভক্তিমান গৌড়ীয় বৈষ্ণব। তার রচনায় বৈষ্ণব তত্ত্বের ও পদামৃত রসের সমাবেশ। মানুষটিও সুরসিক। অনেক দুঃখ-কষ্ট তিনি হাসি মুখেই বহন করেছেন।'
গবেষণা
সম্পাদনাতিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডি. লিট. উপাধিতে ভূষিত হন, ১৯৬২ সালে যা ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সেই প্রথম একটি বাংলা থিসিস, যা ডি. লিট. ডিগ্রি প্রাপ্ত হয়। রবীন্দ্র প্রতিভার পরিচয়, রবীন্দ্রনাথের কাব্যিক প্রতিভার উপর তার প্রথম বই, তাকে এই সম্মান অর্জন করায়।এই বইটি রবীন্দ্রসাহিত্য সম্পর্কে নতুন পথনির্দেশ। তিনি দেখালেন, নিসর্গ, মানুষ এবং রোমান্টিকতা এবং তা থেকে জাত একটি অধ্যাত্মচেতনা ক্রমপরিণামমুখী কবিসত্তাকে কীভাবে বিচিত্র পথ বেয়ে প্রৌঢ়তার দিকে নিয়ে গেছে এবং শেষ পর্যায়েও যার নূতনত্ব এবং গতিশীলতা অব্যাহত। রবীন্দ্র আবির্ভাবের পটভূমি হিসাবে ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে দেখিয়েছেন, সংস্কৃত সাহিত্য, সুফি ধর্ম এবং কাব্য ও বৈষ্ণব কাব্য সংস্কৃতির সমবায় কীভাবে তার মর্মমূলে কাজ করেছে। আলোচ্য গ্রন্থে তিনি রবীন্দ্র-প্রতিভার উন্মেষ বিকাশ ও পরিণামের ইতিহাস রচনা করেন। তার মতে, রবীন্দ্র কবিধর্মের বিশেষত্ব হল অন্তর্নিহিত গতিশীলতা। যা বহিরঙ্গ বৈচিত্র্য নিয়ে ক্রমবিকাশের পথে অগ্রসর। স্বাধীন ও মুক্ত মন নিয়ে তিনি এ গ্রন্থ রচনা করেছেন। পূর্বসূরি রবীন্দ্র-সমালোচকদের অনেকেরই লেখা তিনি পড়েননি। যেটুকু পড়েছিলেন তার কোনো সংস্কার তাকে আক্রমণ করেনি। তার পূর্বসূরি আলোচকেরা রবীন্দ্রনাথকে দেখেছিলেন উপনিষদের অনুসারী religious mystic কবি হিসাবে। কিন্তু তিনি রবীন্দ্রনাথের কাব্য ও নাটক সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করলেন যে, রবীন্দ্রনাথ আধুনিক কালের এক মহৎ রোমান্টিক-মিস্টিক কবি। এ-ব্যাপারে তিনি প্রাচ্য-পাশ্চাত্য দর্শন ও সাহিত্য সমালোচনার সাহায্য নিয়েছেন। পাণ্ডিত্য, মননশীলতা, রসবোধ ও সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টির সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটেছে এ-গ্রন্থে। এই নিবন্ধ-পরীক্ষক ছিলেন শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিয় চক্রবর্তী ও নীহাররঞ্জন রায়। অমিয় চক্রবর্তীর মতে এমন নিবন্ধ নাকি বিদেশেও সুদুর্লভ।
কর্মজীবন
সম্পাদনা১৯৪২ | কালনা ও খানাকূলে স্বল্পকালের জন্যে স্কুল সাব- ইন্সপেক্টরের পদে নিযুক্ত |
---|---|
১৯৪২-৪৩ | প্রায় দেড় মাস স্কটিশচার্চ কলেজের লেকচারার |
১৯৪৩-৪৫ জুলাই ৯ | কলকাতার উইমেনস কলেজে অধ্যাপনা। সেইসঙ্গে সিটি কমার্স কলেজের সান্ধ্য বিভাগে আংশিক সময়ের লেকচারার |
১৯৪৫ জুলাই ১০ - ২০ ডিসেম্বর ১৯৫৪ | প্রেসিডেন্সি কলেজে লেকচারার পদে বৃত |
১৯৫৪ ডিসেম্বর ২১ - ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ | কোচবিহার ভিক্টোরিয়া কলেজ (একালের ব্রজেন্দ্রনাথ শীল কলেজ) - অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর |
১৯৫৫ ফেব্রুয়ারি - ১১ অগাস্ট ১৯৫৫ | প্রেসিডেন্সি কলেজে প্রত্যাবর্তন |
১৯৫৫ অগাস্ট ১২ - ৩ জুলাই ১৯৫৯ | অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, কৃষ্ণনগর কলেজ |
১৯৫৯ জুলাই ৪ - ২ এপ্রিল ১৯৭৩ | অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, মৌলানা আজাদ কলেজ |
১৯৭৩ এপ্রিল ৩ - ৩১ অগাস্ট ১৯৭৩ | প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, হুগলী মহসীন কলেজ |
১৯৭৩ সেপ্টেম্বর ১ - ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৮১ | কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে রামতনু লাহিড়ী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান |
১৯৬৯-এর নভেম্বর থেকে ১৯৭৩-এর অগাস্ট পর্যন্ত তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আংশিক সময়ের অধ্যাপক ছিলেন।
তিনি অনেক প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। তিনি বঙ্গীয় সংস্কৃত শিক্ষা পরিষদের (পশ্চিমবঙ্গের সরকারের) সভাপতি ছিলেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট আর্টস অনুষদ এবং পি.এইচ.ডি কমিটির সদস্য ছিলেন। সদস্য ছিলেন এগ্জিকিউটিভ কাউন্সিল অফ্ দি যাদবপুর ইউনিভারসিটি। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাডেমীর কার্যনির্বাহী কমিটি, রবীন্দ্র সদন কমিটি এবং রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশনা কমিটির (পশ্চিমবঙ্গ সরকারের) সদস্য ছিলেন। মেম্বার ইনফরমেশন এ্যাণ্ড কালচারাল অ্যাফেয়ারস্ গভঃ অফ্ ওয়েষ্ট বেঙ্গল। মেম্বার এইচ. এস. কাউন্সিল পঃ বঃ। মেম্বার স্কুল বোর্ড, গভরণিং বডিস অফ্ স্কুল এ্যাণ্ড কলেজেস্। সভাপতি পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক-শিল্পী সংঘের, বঙ্গভাষা-সংস্কৃতি প্রসার সমিতির। প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বাঁকুড়া লোক সংস্কৃতি পরিষদের। উপদেষ্টা রামকিংকর বেইজ স্মারক সমিতি। অনেক কলেজ ও স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। অবসর গ্রহণের পর ১৯৮২ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত তিনি প্রধান সম্পাদক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক বোর্ডের অধীনে বাংলা শব্দের ভাষাতাত্ত্বিক অভিধানের, যার নাম হল "Bengali Linguistic Dictionary for both Bengalis and Non-Bengalis"।
বক্তৃতা
সম্পাদনাকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে তিনি ডি. এল. রায় বক্তৃতা এবং বিদ্যাসাগর বক্তৃতা দেন।
গ্রন্থাবলী
সম্পাদনা- রবীন্দ্র প্রতিভার পরিচয় (১৯৫৩)
- বাংলা কাব্যের রূপ ও রীতি (১৯৫৮)
- চিত্র গীতময়ী রবীন্দ্র বাণী (১৯৬৬)
- বৈষ্ণব রস প্রকাশ (১৯৭২)
- সমাজ প্রগতি রবীন্দ্রনাথ (১৯৭৩)
- রবীন্দ্র কল্পনায় বিজ্ঞানের অধিকার (১৯৮৪)
- বাংলা সাহিত্যের আদ্য মধ্য (১৯৮৫)
- ব্যাকরণ (৩ খণ্ড)
- বানান বানানোর বন্দরে (১৯৯৩)
- চোদ্দশ সাল ও চলমান রবি (১৯৯৩)
- দেশ কাল সাহিত্য (১৯৯৫)
- সাঁওতালি বাংলা সমশব্দ অভিধান (১৯৯৮)
- বাছাই প্রবন্ধ (১৪ টি রচনার সংকলন, মানস মজুমদার দ্বারা সম্পাদিত) (২০০০)
- পথের ছায়াছবিতে অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাস (মানস মজুমদার দ্বারা সম্পাদিত) (১৯৯৬)
তিনি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিকঙ্কন চণ্ডী সম্পাদনা করেন ১৯৭৬ সালে।ক্ষেত্র-গবেষণা ও ভাষাতাত্ত্বিক অন্তর্দৃষ্টিতে কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলের যথার্থ পাঠ নির্ণয় করেছিলেন, এইটি তার ঐতিহাসিক প্রজ্ঞার পরিচয়। ছন্দবিশারদ প্রবোধ চন্দ্র সেন তাকে এক চিঠিতে লিখেছেন ' আপনার চণ্ডীমঙ্গল সম্পাদন একটি মহৎ কাজ হিসাবে স্মরণীয় হয়ে থাকার যোগ্য। বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির প্রতি সমস্ত জাতির পক্ষে একটি বৃহৎ কর্তব্য সাধন করেছেন। এতদিনে এই কবির প্রতি আমাদের জাতীয় কর্তব্য নিষ্পন্ন হল। আপনি সমগ্র জাতির আশীর্বাদভাজন হয়েছেন। তবু দুঃখের কথা এই যে, একাজ আপনাকে করতে হয়েছে ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায়। সরকার বা কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এবং অর্থ সাহায্যে এই জাতীয় কর্তব্য সম্পন্ন হওয়াই উচিত ছিল। তা হয়নি, এটাই দুঃখ ও দুর্ভাগ্যের বিষয়। কিন্তু তাতে আপনার কৃতিত্বই আরও উজ্জ্বল হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে এইজন্য আমি একক অভিযাত্রী হিসাবে আপনাকে অভিনন্দন জানাই। আর এই দুঃসাধ্য কাজের জন্য উত্তরাধিকারীরা সবাই কৃতজ্ঞচিত্তে আপনাকে আশীর্বাদ জানাবেন ---দেশমাতৃকার আশীর্বাদ। এই বই যদি আমি আরও কিছুদিন আগে পেতাম তাহলে বড় উপকৃত হতাম-বড় কাজে লাগত। আশা করছি এখনও কিছু কাজে লাগতে পারে '। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র প্রসঙ্গ (বাংলা ও ইংরেজিতে) তিনি সম্পাদনা করেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত তিনি প্রধান সম্পাদক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক বোর্ডের অধীনে বাংলা শব্দের ভাষাতাত্ত্বিক অভিধানের, যার নাম হল "Bengali Linguistic Dictionary for both Bengalis and Non-Bengalis"। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতনু লাহিড়ী চেয়ার প্রফেসর পদ থেকে অবসর নিলেন। শুরু করলেন ভারতীয় ভাষা নিয়ে ভাষাকর্মযজ্ঞ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাহায্যে অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়ে, তৎকালীন প্রেসিডেন্সি কলেজের একটি অপরিসর কক্ষে মাত্র দুজন কর্মীকে নিয়ে সুরু করেন ভাষা ভুবনের এক ভিন্ন মহৎ সাধনা। সেই মহৎ সাধনা সুধা আজও প্রকাশিত হয়নি। ভাষাতাত্ত্বিক ক্ষুদিরাম দাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ভাষাবিজ্ঞানের নতুন তত্ত্ব ও নিরীক্ষার ভিত্তিভূমিতে বাংলা- সাঁওতালি- মুণ্ডা-দ্রাবিড়- হিন্দি- ওড়িয়া- পর্তুগীজ- সংস্কৃত – তামিল – ইংরেজি প্রভৃতি ভাষায় আগমনের তুলনামূলক অভিধানটি প্রকাশিত হলে, তার ভাষা ঐশ্বর্যের ব্যাপক শক্তির প্রকাশ দেখতে পেতাম। আমরা সমৃদ্ধ হতাম। দুর্ভাগ্য কোনো এক রহস্য- ষড়যন্ত্রে লিঙ্গুয়িস্টিক ডিকশনারি ফর বেঙ্গলিস অ্যান্ড নন-বেঙ্গলিস’ অভিধানটি সরকারে ঘর থেকে হারিয়ে গেল। প্রায় অর্ধ শতাব্দীর ওপর তার লেখালেখি। বিরামহীন অক্লান্ত তার লেখনী চালনা। বহুবিচিত্র বিষয়ে কৌতূহলী তিনি। প্রাচীন ভারতীয় রসতত্ত্ব, সংস্কৃত সাহিত্য, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য, উনিশ ও বিশ শতকের বাংলা সাহিত্য, ভাষাতত্ত্ব, ব্যাকরণ, ছন্দ ও অলঙ্কার, সাহিত্যশৈলী, বিজ্ঞান ইত্যাদি নানান ব্যাপারে তার প্রবল অনুসন্ধিৎসা। সর্বোপরি রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্র-সাহিত্যের আলোচনায় তার অপরিমিত উৎসাহ, রবীন্দ্র-সাহিত্যের মর্মরহস্য উদ্ঘাটনে তিনি নিয়ত তৎপর, প্রায়শই আবিষ্কারকের ভূমিকায়। বাংলা মননশীল প্রবন্ধ সাহিত্যের ধারাটি তার লেখনী সঞ্চালনে পুষ্ট ও সমৃদ্ধ। এক হিসাবে উনিশ শতকীয় প্রবন্ধ সাহিত্যের নৈয়ায়িক ঐতিহ্যের তিনি অনুসারী। ভাষাতত্ত্ব এবং ছন্দতত্ত্ব নিয়েও তিনি মৌলিক চিন্তা করেছিলেন। ভাষাতত্ত্বের কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুকুমার সেনেরও বিরোধী হয়েছেন; ছন্দতত্ত্বের কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রবোধচন্দ্র সেনের প্রতিবাদ করেছেন।প্রবোধচন্দ্র সেন এক চিঠিতে তাকে লিখেছেন 'আমি তো কখনও নিজেকে অভ্রান্ত মনে করি না। সারা জীবনে কত ভুল করেছি (ছন্দের ব্যাপারেও) তা আমি ভুলি না। অন্য সবাই ভুল করছে কিংবা সকলেই আমার মত গ্রহণ করুক, এমন মনোভাব আমার নয়। এরকম মনোভাব তো মূঢ়তার লক্ষণ। সবাই কোনো বিষয়ে একমত হলে দুনিয়ার অগ্রগতির তো রুদ্ধ হয়ে যাবে। নানাজনের নানামতের আলোতেই তো সত্যের রূপ প্রকাশিত হয়। আপনার মতামতও আমি শ্রদ্ধাসহকারেই বিবেচনা করব এবং প্রয়োজন মতো তার আলোতে নিজের চিন্তাশোধন করব। এই কাজ আমি সারাজীবনই করে আসছি। বিনা বিচারে অন্য কারও মতকে আগ্রাহ্য করা চরম মূর্খতা বলেই মনে করি। আপনার মতো প্রবীণ অভিজ্ঞ ব্যক্তির মতামত সম্পর্কে কি উদাসীন থাকতে পারি ? -আপনার বই পাবার অপেক্ষা রইলাম '। শেষের দিকে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত নির্বাচিত সাঁওতালি শব্দের অভিধান রচনা করেছিলেন। বাংলা ভাষায় এ-ধরনের কাজ প্রথম। এই কাজ কেন তিনি হাত দিলেন তার ব্যাখ্যা করে তিনি জানালেন " সংস্কৃত প্রাকৃত থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত বাঙলা ভাষার বিকাশের মূল সূত্রগুলি অভ্রান্তভাবে নির্ণয় করে মদ্গুরু সুনীতিকুমার জাতির কৃতজ্ঞতাভাজন হয়ে রয়েছেন। কিন্তু কেবল সূত্র নির্ণয়ই নয়, উপাদান সংগ্রহও তার আশ্চর্য অধ্যবসায়ের সাক্ষ্য দিচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে তার আলোচনার নানান্ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তস্বরূপ এমন বহু শব্দই তাঁকে সঞ্চয়ন করতে হয়েছে, আর্যভাষায় অথবা আরবী ফারসীতে যেগুলির হদিস তিনি পান নি। এরকম শব্দগুলিকে সম্ভাব্য অনার্য বলে তিনি চিহ্নিত করেছিলেন। তার গবেষণা ও গ্রন্থরচনার কালে সাঁওতালি ভাষা নিয়ে তেমন চর্চা হয়নি এবং উল্লেখ্য সাঁওতালি অভিধানও প্রণীত হয়নি। অবশ্য পরবর্তী জীবনে তিনি এবিষয়ে জানাশোনার পর লিখনে ও ভাষণে বাঙলার উপর সাঁওতালির প্রভাবের বিষয় স্বীকার করেছেন। প্রকাশিত মদীয় অভিধানে আমি তার অপূর্ণ অভিলাষ কিছুটা পূর্ণ করায় প্রয়াস করেছি মাত্র।" যে ভাষার প্রাচীন লিপি নেই। যে ভাষার কোনো অভিধান রচিত হয়নি। সেই সাঁওতালি ভাষার সঙ্গে তুলনামূলক পর্যালোচনায় বাংলাকে মিলিয়ে দেওয়া- সত্যিকারের এক দুরূহ পরিশ্রমসাধ্য কাজ। বহুক্ষেত্রে শুধু সাঁওতাল-বাংলা নয়, হিন্দি, ফারসি, প্রাকৃত, সংস্কৃত শব্দের নমুনা দিয়ে, ভারতীয় ভাষা পরিবারের এক সুদৃঢ় ঐক্য দেখিয়েছেন। বাংলাভাষা তথা ভারতীয় ভাষা মানচিত্র দেশি-বিদেশি ভাষাবিদদের চর্চার ইতিবৃত্ত ‘সাঁওতালি –বাংলা সমশব্দ অভিধান’ গ্রন্থটি এক দুঃসাহসী পদক্ষেপ। লোকসাহিত্যের গবেষণা কর্মের মতো প্রাগাধুনিক সাহিত্যের গবেষণায় ক্ষেত্রেও তিনি প্রমাণ সংগ্রহের জন্য অক্লান্তভাবে ছুটে গেছেন গ্রামে গামান্তরে মাঠে মন্দিরে, খ্যাত-অখ্যাত প্রান্তে ও প্রান্তরে। বড়ু চণ্ডীদাসের ইতিহাস সন্ধানে ছুটে গেছেন বাঁকুড়া শালতোড়া গ্রামে, মুকুন্দের দেশ ত্যাগের মানচিত্র রচনার জন্য ধাবিত হয়েছেন দামিন্যা থেকে মেদিনীপুর আরঢা গ্রামের দিকে, আবার শ্রীচৈতন্যের জন্মভূমি-পুরাতন নবদ্বীপের সন্ধানে গঙ্গা ও জলঙ্গী নদীর তীর ধরে অনুসন্ধান করে সুনিশ্চিত সিদ্ধান্ত উপনীত হয়েছেন। তার পাণ্ডিত্য কেবল গ্রন্থার্জিত নয়, কষ্টার্জিত ক্ষেত্র সমীক্ষণের পাণ্ডিত্য। অনায়াস স্বাচ্ছন্দের তিনি বিচরণ করতে পারেন ধ্রুপদি সাহিত্যলোক থেকে লোকায়ত বঙ্গ-সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্তরে ও অন্দরমহলে।
তার ১০০ বছরের জন্ম বার্ষিকী উপলক্ষে 'মনীষয়া দীপ্যতি' নামক গ্রন্থটি দে'জ প্রকাশকের দ্বারা ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়। এই স্মারক গ্রন্থটি আমেরিকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরীতে আছে (Stand ford University, University of Chicago, University of California, U C Berkeley Libraries )। তার বিখ্যাত বইগুলো Digitized করেছে ২০০৬ ও ২০০৯ সালে Michigan University, and California University।
সম্মান
সম্পাদনাতিনি অনেক সম্মানে ভূষিত হন যাদের মধ্যে মুখ্য হল -
- প্রাণতোষ ঘটক স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৩)
- বিদ্যাসাগর স্মৃতি পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ সরকার) (১৯৮৪) [২]
- সরোজিনী বসু স্বর্ণ পদক (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) (১৯৮৭)
- সাহিত্য রত্ন উপাধিতে ভূষিত (হাওড়া পণ্ডিত সমাজ) (১৯৮৭)
- রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য উপাধি লাভ (টেগর রিসার্চ ইন্সিটিউট) (১৯৯২)
- রবীন্দ্র স্মৃতি পুরস্কার (পশ্চিমবঙ্গ সরকার) (১৯৯৪)
- নারায়ণ গাঙ্গুলী স্মারক পুরস্কার (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়) (১৯৯৫)
- রবিতীর্থঙ্কর উপাধি প্রাপ্তি (সংস্কৃত কলেজ) (১৯৯৮)
- ৭০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ১১ই জানুয়ারি ১৯৮৮ বাঁকুড়ায় নাগরিক সংবর্ধনা। স্বয়ং আচার্য তথা রাজ্যপাল ডঃ নুরুল হাসান হাজার হাজার নাগরিকদের সামনে উত্তরীয় পরিয়ে যথোচিত সম্মানে ভূষিত করেন।এই উপলক্ষে ডঃ ক্ষুদিরাম দাস সংখ্যা প্রকাশিত হয় বাঁকুড়া লোক সংস্কৃতি অকাদেমির পক্ষ থেকে।
- আশি বছর পূর্তিতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ দ্বারভাঙা হলে সাহিত্যেক্ষেত্রে তার বিশেষ অবদানের জন্য সংবর্ধনা জানায়। এই উপলক্ষে অনুষ্ঠানে 'পথের ছায়াছবিতে অধ্যাপক ক্ষুদিরাম দাস' নামক স্মারক গ্রন্থের উদ্বোধন করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ রথীন্দ্র নারায়ণ বসু। বইটিতে স্মৃতিচারণ এবং তার লেখালেখি নিয়ে আলোচনা করেছেন অন্নদাশঙ্কর রায়, ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মহাশ্বেতা দেবী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ডঃ শিশিরকুমার দাস, শঙ্খ ঘোষ, অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু, ডঃ অরুণ কুমার বসু, ডঃ সুধীর চক্রবর্তী, ডঃ জ্যোতির্ময় ঘোষ, ডঃ রবীন্দ্র গুপ্ত, ডঃ আবিরলাল মুখোপাধ্যায়।
তার স্মৃতিতে ক্ষুদিরাম দাস স্মারক বক্তৃতা অনুষ্ঠিত হয় প্রতি বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে।
জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ৯ অক্টোবর, ২০১৮-তে কৃষ্ণনগর পৌরসভার সহায়তায় তার আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয় কৃষ্ণনগর রবীন্দ্র ভবনের কাছে। তার জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের অঙ্গরূপে একটি আবক্ষ মূর্তি স্থাপন করা হয় ১লা মে ২০১৬ সালে তার বসত বাড়ি চৌধুরী পাড়া কৃষ্ণনগরে। আর কলকাতায় মহাবোধি সোসাইটি হলে ১৭ ডিসেম্বর ২০১৬ সালে শতবর্ষ স্মারক গ্রন্থ 'মনীষয়া দীপ্যতি' ও তিনটি ই-বই প্রকাশ করেন তারই ছাত্র কবি শঙ্খ ঘোঘ। আর অবনীন্দ্র সভাগৃহে ৫ অক্টোবর ২০১৬ সালে ওয়েবসাইট উদ্বোধন করেন চণ্ডী লাহিড়ী।
স্মারক পুরস্কার
সম্পাদনাস্নাতক স্তরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে উচ্চতম দক্ষতার জন্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেথুন কলেজে ক্ষুদিরাম দাস স্মারক পুরস্কার দেওয়া হয়।
মৃত্যু
সম্পাদনা২০০২ সালের ২৮ এপ্রিল ৮৫ বছর বয়সে কৃষ্ণনগরের একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে তার জীবনাবসান ঘটে।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯ পৃষ্ঠা ১০২, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
- ↑ "Chief Minister's Office - Government of West Bengal"। wbcmo.gov.in। ২০১৬-১১-২৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-১০-১৩।