১৯৯০ বাংলাদেশে হিন্দু বিরোধী সহিংসতা

ভারতের অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছে এমন গুজব ছড়িয়ে পরার পরে ১৯৯০ সালের অক্টোবরের শেষে ও নভেম্বরের প্রথম দিকে বাংলাদেশে বাঙালি হিন্দুদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আক্রমণ ঘটে। হিন্দুদের উপর ৩০ অক্টোবর থেকে হামলা শুরু হয় এবং বিরতিহীন ভাবে ২ নভেম্বর পর্যন্ত তা চলতে থাকে।[১] এছাড়া এই ঘটনার সূত্র ধরে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন মাত্রায় সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে হিন্দুদের উপর বিরামহীন অত্যাচার, নির্যাতন, লুটপাট, হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণের মত জঘন্য নিষ্ঠুরতা চালাতে থাকে মুসলিমরা।[২] বিশেষ করে ১৯৯২ সালের পুরোটা সময় ধরে এই বীভৎসতার মাত্রা ছিল বর্ণনাতীত।[২]

১৯৯০-এর বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সহিংসতা
স্থানবাংলাদেশ
তারিখ১৯৮৯-১৯৯৩
লক্ষ্যবাঙালি হিন্দু
হামলার ধরনহত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক ধর্মান্তর, লুটপাট, অপহরণ, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ
হামলাকারী দলস্থানীয় মুসলিম জনগোষ্ঠী
কারণঅযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার গুজব

পটভূমি সম্পাদনা

ভারতের উত্তর প্রদেশের অযোধ্যার 'রাম মন্দির' বিতর্ককে কেন্দ্র করে ১৯৮৯ সালে একটি হিন্দু বিরোধী প্রোগ্রাম শুরু হয় যার ফলশ্রুতিতে অত্যন্ত বৃহৎ পরিসরে হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস ও হিন্দুদের উপর নির্যাতন শুরু হয়।

১৯৯০ সালের ২৯ অক্টোবর,বাংলাদেশের ইসলামী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী অর্থায়িত সংবাদপত্র 'দৈনিক ইনকিলাবের' শিরোনাম ছাপায় 'বাবরী মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে'।[৩] ফলে সমগ্র বাংলাদেশ ব্যাপী বাবরী মসজিদ ধ্বংসের গুজব রটানো হয়। আর এতেই সবার দুশ্চিন্তার পারদ সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছে যায়।

আক্রমণ সম্পাদনা

ঢাকা সম্পাদনা

পুরনো ঢাকায় পুলিশের বাধা প্রদান সত্ত্বেও মুসলিমরা হিন্দু মন্দিরগুলোতে অগ্নিসংযোগের চেষ্টা করে।মন্দিরের বাইরে থাকা সংবাদিকদের হাতে থাকা ক্যামেরা গুলো ছিনতাই করে নেয় মুসলিমরা।এই ঘটনার প্রেক্ষিতে প্রশাসন ঢাকার অনেক জায়গাতে সান্ধ্য আইন জারি করে।[৪] ৩০ অক্টোবর, বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ তার বাসভবন বঙ্গভবনে যখন একটি যুব সম্মেলনে ভাষণ প্রদান করছিলেন ঠিক তখনও বঙ্গভবনের দক্ষিণে অবস্থিত একটি গৌড়ীয় মঠে আগুন ধরিয়ে দেয় সশস্ত্র মুসলিমরা এবং হিন্দু মালিকানাধীন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে নির্বিচারে লুটপাট ও হামলা চালায় তারা।[৪] ৩১ অক্টোবরে প্রায় ১,০০০ মুসলিম জনতার একটি সশস্ত্র দল ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসে উপর হামলা চালায় এবং দূতাবাসের বাইরে অপেক্ষারত এক মধ্যবয়স্ক হিন্দু ভদ্রলোককে নির্মমভাবে পিটিয়ে আহত করে।[৫] এরপরে সমগ্র ঢাকা শহরে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়।

ঢাকার লালবাগে অবস্থিত বাংলাদেশের জাতীয় মন্দির ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ তৎসংলগ্ন অন্যান্য ভবনগুলোতে মুসলিমরা লুটপাট চালায় এবং অগ্নি সংযোগ করে। মন্দিরের পুরোহিত এবং আরও দশটি হিন্দু পরিবারের উপর চালানো হয় বর্বর পৈশাচিক নির্যাতন। চার ঘণ্টা জুড়ে বাধাহীন ভাবে এই নিষ্ঠুরতা চলতে থাকে।[৬] লালবাগের একটি দুর্গা মন্দির, পুস্পরাজ সাহা লেনের গিরিগোবর্ধন জিউ মন্দির, হরনাথ ঘোষ লেনের রঘুনাথ জিউ আখড়া,কামরাঙ্গিচর শ্মশান সহ অসংখ্য হিন্দু উপাসনালয় লুটপাট ও ধ্বংস করে মুসলিমরা।।[৬]

হাজারীবাগের ভাগলপুর লেনের তিনটি হিন্দু মন্দির লুটপাট ও ভাংচুর করা হয়।বেলতলী লেনে ১৭ জন নিরীহ হিন্দুকে কুপিয়ে জখম করে তারা।[৬] নগর বেলতলী এবং হাজারীবাগে কমপক্ষে ১০০ টি হিন্দু বাড়ি-ঘর,ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুটপাট করে স্থানীয় মুসলিমরা এবং এক ডজনেরও বেশি হিন্দু মন্দির ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে তারা। সুত্রাপুরে প্রত্যেকটি হিন্দু বাড়ি,ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুটপাট, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করে তারা।[৬] ১০০ টিরও বেশি বাড়িঘর ও দোকানপাটে লুটপাট চালানো হয় এবং সবগুলো ক্ষেত্রে লুটপাটের পরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হত।[৬]

চট্টগ্রাম সম্পাদনা

বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর চট্টগ্রাম যেখানে প্রায় ৩০% হিন্দুর বসবাস ছিল সেখানেও দুশ্চিন্তার পারদ উপরে চড়তে শুরু করে।[৭] ৩০ অক্টোবর সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর প্রথম আঘাত আসে। সেখানে বিভিন্ন রাস্তায় মুসলিমরা স্লোগান সহকারে মিছিল বের করে।[৭] পুলিশ ফাঁকা গুলি করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে এবং সান্ধ্য আইন জারি হয়।[৮] ৩০ অক্টোবর মধ্যরাতের পরে প্রায় ২,০০০ মুসলিম ছুরি,লোহার রড, রাম দা,খোন্তা সহ বিভিন্ন ধরনের মারণাস্ত্রসহ কৈবল্যধাম মন্দিরের চারপাশের প্রায় ৩০০ হিন্দু বাড়িঘরের উপর উন্মত্তভাবে হামলে পড়ে এবং আগুন ধরিয়ে দেয়।আগুন নেভাবে অগ্নিনির্বাপক কর্মীরা যখন সেখানে প্রবেশ করতে যায়, স্থানীয় মুসলিমরা তাদেরকে প্রবেশ করতে বাধা দেয়।[৮] মধ্যরাতে মুসলিমদের ভয়াবহ আক্রমণে চকবাজারের প্রায় ১,৫০০ হিন্দু জেলে পরিবার তাদের বাড়ি-ঘর ছেড়ে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। প্রায় ২০০ মুসলিম রিয়াজউদ্দিন বাজারের হিন্দু মন্দির ভেঙ্গে ফেলে এবং হিন্দু মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো লুটপাট করে। মুসলিমরা চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজেও অগ্নিসংযোগ করে। ৫০ টি জেলে পরিবারের খড়ের ঘরে আগুন লাগিয়ে ভস্মীভূত করে দেয়। একটি হিন্দু মালিকানাধীন গ্যারেজে আক্রমণ করে পাঁচটি গাড়ি লুট করে নিয়ে যায়। ৩১ অক্টোবর সকালে প্রায় ১০০ মুসলিম জনতার একটি দল কার্ফু ভঙ্গ করে একটি হিন্দু মন্দিরে হামলা করে সেটি অপবিত্র করে।[৮] ২ নভেম্বর শুক্রবারে জুম্মার নামাজের জন্য কার্ফু কিছুটা শিথিল করা হয়। কিন্তু এই সুযোগে প্রায় ৫০০ মুসলিমের একটি দল ছুরি, রাম দা, লাঠি, লোহার রড এবং ঘরে তৈরি বোমা নিয়ে শহরতলীর একটি মন্দিরে আক্রমণ করে।[৯] পাথরঘাটা,বোয়ালখালী, আনোয়ারা, হাটহাজারীতে প্রায় ১০০ হিন্দু, মুসলিমদের আক্রমণে আহত হয়।[৯]

অন্যান্য জায়গা সম্পাদনা

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ছাড়াও কমপক্ষে ১২ টি শহরের হিন্দুরা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার হয়ে।[৯] যশোর, নড়াইল, গাইবান্ধা, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, সিলেটের হিন্দুদের উপর মারাত্মক নির্যাতনের সংবাদ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।[১০]

ফলাফল সম্পাদনা

১৯৯০-এর বাংলাদেশে হিন্দু বিরোধী সহিংসতা ছিল বাবরী মসজিদ ধ্বংসের গুজব দ্বারা চালিত বাংলাদেশের মুসলিম জনগোষ্ঠী কর্তৃক হিন্দু নিধন কার্যক্রম।[২] এই ঘটনার সূত্রপাত ১৯৯০ সালে হলেও ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। ১৯৯০ ও ১৯৯২ সালে বাংলাদেশের জাতীয় মন্দির ঢাকেশ্বরী মন্দির আক্রান্ত হয়। আয়োজক হিসেবে বাংলাদেশ ১৯৯২ সালে চার দেশের সার্ক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শেষ পর্যন্ত সম্পন্ন করতে পারেনি।[১১][১২] তাছাড়া ঢাকার ভারতীয় দুতাবাসেও আক্রমণ করে মুসলিমরা।

বাংলাদেশের হিন্দুদের উপর ১৯৯০ সালের অবর্ণনীয় অত্যাচারের ফলে অনেক জায়গা হিন্দু শুন্য হয়ে যায় এবং বহুস্থানের হিন্দুরা বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর হিন্দুরা সহায়-সম্বল,বাড়ি-ঘর সব হারিয়ে পাহাড়ের উপর কৈবল্যধাম মন্দিরের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণ করে। সেখানে কমপক্ষে ৫০০ টি হিন্দু পরিবার আশ্রয় নিয়ে তাদের জীবন রক্ষা করে।ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার চরপাতা ইউনিয়নের নলগোড়া গ্রামের সাধু সিংয়ের বাড়িতে ছয়টি পরিবার ছিল যারা সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার হয়ে ভারতে পাড়ি দিয়ে জীবন ও সম্মান রক্ষা করে। ১৯৯০ ও ১৯৯২ সালের সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের শিকার হয়ে ভোলা জেলার হাজার হাজার হিন্দু বাস্তুচ্যুত হয় এবং পালিয়ে চলে যায়। ফলে হিন্দু অধ্যুষিত ভোলা জেলা প্রায় হিন্দুশূন্য বর্তমানে।[১৩] সারা দেশ ব্যাপী অনেক হিন্দু জীবনের নিরাপত্তার জন্য তাদের জায়গা,সম্পত্তি,বাড়ি-ঘর ছেড়ে ভারতে আশ্রয়ের জন্য পালিয়ে চলে যায়।।[১৪][১৫]

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. Azad, Salam (২০০১)। হিন্দু সম্প্রদায় কেন বাংলাদেশ ত্যাগ করছে? [Why Are The Hindus Migrating From Bangladesh] (Bengali ভাষায়) (1st সংস্করণ)। Kolkata: Punascha। পৃষ্ঠা 60–64। [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  2. Ghosh Dastidar, Sachi (2008). Empire's Last Casualty: Indian Subcontinent's vanishing Hindu and other Minorities. Kolkata: Firma KLM. p. 209. ISBN 81-7102-151-4.
  3. Roy, Debajyoti (2005) [2001]. Kena udbāstu hate hala কেন উদ্বাস্তু হতে হল [Why Did We Become Refugees] (in Bengali). Kolkata: Shyamaprasad De Pal. p. 93. OCLC 924172721.
  4. "Primary Report"। HRCBM। সংগ্রহের তারিখ ১৭ নভেম্বর ২০১২ 
  5. Mansoor, Osman Ghani (৩১ অক্টোবর ১৯৯০)। "Moslems Attack Hindu Temples in Bangladesh"Associated Press। সংগ্রহের তারিখ ১৬ নভেম্বর ২০১২ 
  6. Azad, Salam (2001). হিন্দু সম্প্রদায় কেন বাংলাদেশ ত্যাগ করছে?[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] [Why Are The Hindus Migrating From Bangladesh] (in Bengali) (1st ed.). Kolkata: Punascha. pp. 60–64.
  7. Hossain, Farid (১ নভেম্বর ১৯৯০)। "Anti-Hindu Violence in Bangladesh Leaves One Dead"Associated Press। সংগ্রহের তারিখ ১৬ নভেম্বর ২০১২ 
  8. Mansoor, Osman Ghani (31 October 1990). "Moslems Attack Hindu Temples in Bangladesh". Associated Press. Retrieved 16 November 2012.
  9. Hossain, Farid (2 November 1990). "Two Killed, 350 Injured in Anti-Hindu Violence". Associated Press. Retrieved 16 November 2012.
  10. Hossain, Farid (1 November 1990). "Anti-Hindu Violence in Bangladesh Leaves One Dead". Associated Press. Retrieved 16 November 2012.
  11. "Bangladesh v India 'A' at Dhaka, 10 Dec 1992". cricinfo.com. Wisden CricInfo. Retrieved October 5, 2012.
  12. "India 'A' v Pakistan 'A' at Dhaka, 11 Dec 1992". cricinfo.com. Wisden CricInfo. Retrieved October 5, 2012.
  13. "১০ বছরে ৯ লাখ হিন্দু কমেছে-দৈনিক প্রথমআলো"। ২০১৪-১২-২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৬-১১ 
  14. সংখ্যালঘুদের স্বার্থ দেখবে কে?-দৈনিক যুগান্তর
  15. সংখ্যালঘুরা দেশ ছাড়বে, কেন ছাড়বে?-দৈনিক প্রথমআলো