ঢাকেশ্বরী মন্দির

ঢাকায় অবস্থিত বাংলাদেশের জাতীয় হিন্দু মন্দির

ঢাকেশ্বরী মন্দির বা ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত একটি হিন্দু মন্দির। এই মন্দিরটিকে বাংলাদেশের জাতীয় মন্দির ও বলা হয়। ঢাকেশ্বরী শব্দের অর্থ 'ঢাকার ঈশ্বরী'[১] বা 'ঢাকা শহরের রক্ষাকর্ত্রী'।[২] এই মন্দিরটি ভারতীয় উপমহাদেশের বিখ্যাত শক্তিপীঠ গুলির একটি। এখানে সতীর মুকুটের মণি পড়েছিল। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম মন্দির।[৩] অনেকের মতে, দেবী ঢাকেশ্বরীর নাম থেকেই ঢাকা নামের উৎপত্তি।

শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির
ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির
ধর্ম
অন্তর্ভুক্তিহিন্দুধর্ম
জেলাঢাকা জেলা
ঈশ্বরপার্বতী বা দুর্গা
অবস্থান
অবস্থানঢাকা
দেশবাংলাদেশ
ঢাকেশ্বরী মন্দির বাংলাদেশ-এ অবস্থিত
ঢাকেশ্বরী মন্দির
বাংলাদেশে অবস্থান
স্থানাঙ্ক২৩°৪৩′২৩″ উত্তর ৯০°২৩′২৩″ পূর্ব / ২৩.৭২৩০৬° উত্তর ৯০.৩৮৯৭২° পূর্ব / 23.72306; 90.38972
স্থাপত্য
ধরনসেন
সৃষ্টিকারীবল্লাল সেন
সম্পূর্ণ হয়১২শ শতাব্দী

সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেন দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান মন্দির কমপ্লেক্সটির দীর্ঘ অস্তিত্বকালে পুননির্মাণ ও সংস্কারের দরুন বর্তমানে এর আদি স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্যের কোনো কিছুই স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় না।[১] ১৯৪৮ সালে এই মন্দিরের দেবী ঢাকেশ্বরীর ৮০০ বছরের পুরোনো আসল মূল বিগ্রহটি দেশভাগ-পরবর্তী দাঙ্গার সময় আক্রমণ এবং লুন্ঠনের হাত থেকে রক্ষা করতে গোপনে এবং দ্রুততার সঙ্গে ঢাকা থেকে কলকাতার কুমারটুলি অঞ্চলে দুর্গাচারণ স্ট্রিটের শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মাতার মন্দিরে স্থানান্তর করা হয়।[৪]

ইতিহাস সম্পাদনা

 
ঢাকেশ্বরী মন্দির (১৮৯০)

ঢাকেশ্বরী মন্দিরের ইতিহাস সম্পর্কে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। ধারণা করা হয় যে, সেন রাজবংশের রাজা বল্লাল সেন দ্বাদশ শতাব্দীতে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে সেই সময়কার নির্মাণশৈলীর সাথে এর স্থাপত্যকলার মিল পাওয়া যায় না বলে অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন। কেউ কেউ দাবি করেন, ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমনের পূর্বে তথা সেন বংশের রাজত্বকালে বাংলার স্থাপত্যশিল্পে চুন-বালি মিশ্রণের ব্যবহার ছিল না। কিন্তু ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি আগাগোড়া চুন-বালির গাঁথনিতে নির্মিত। যা বাংলার মুসলিম আমলেরই স্থাপত্যরীতির বৈশিষ্ট্য। বিভিন্ন সময়ে এই মন্দিরের গঠন ও স্থাপনার নানা ধরনের পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে।

ধারণা করা হয়, এটি ঢাকার আদি ও প্রথম মন্দির। হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, ঢাকেশ্বরী শব্দ থেকেই ঢাকা নামের উৎপত্তি। ঢাকেশ্বরী দেবী ঢাকা অধিষ্ঠাত্রী বা পৃষ্ঠপোষক দেবী। কিংবদন্তি অনুযায়ী, রাজা আদিসুর তার এক রানীকে বুড়িগঙ্গার এক জঙ্গলে নির্বাসন দেয়। জঙ্গলে রানী প্রসব করে পুত্র বল্লাল সেন কে। জঙ্গলেই বেড়ে ওঠে বল্লাল সেন। শৈশবে জঙ্গলের মধ্যে বল্লাল সেন একটি দেবীমূর্তি পান (মতান্তরে, রাজ ক্ষমতায় বসার পর এই জঙ্গলে তিনি মূর্তিটি পান)। বল্লাল সেন বিশ্বাস করতে শুরু করেন জঙ্গলে সকল বিপদ-আপদ থেকে এই দেবী দুর্গাই তাকে রক্ষা করেছেন। পরে বল্লাল সেন রাজ ক্ষমতায় আসীন হলে তার জন্মস্থানে যেখানে দেবীর মূর্তি পেয়েছিলেন সেখানে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মূর্তিটি জঙ্গলে ঢাকা অবস্থায় পেয়েছিলেন যায় বলে দেবীর নাম হয় ‘ঢাকা+ঈশ্বরী’ বা ‘ঢাকেশ্বরী’। মন্দিরটিও ‘ঢাকেশ্বরী মন্দির’ নামে পরিচিতি পায়।

অপর কিংবদন্তি মতে, রাণী, রাজা বিজয় সেনের স্ত্রী স্নান করার জন্য লাঙ্গলবন্দ গিয়েছিলেন। ফিরে আসার সময় তিনি একটি পুত্রকে জন্ম দেন, যিনি বল্লাল সেন বলে পরিচিত হন। সিংহাসনে উঠার পর, বল্লাল সেন  তাঁর জন্মস্থানকে মহিমান্বিত করার জন্য এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। কিংবদন্তি আছে যে বল্লাল সেন একবার জঙ্গলে আচ্ছাদিত দেবতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বল্লাল সেন সেখানে দেবীকে আবিষ্কৃত করেন এবং একটি মন্দির নির্মাণ করান, মূর্তিটি ঢাকা ছিল বলে ঢাকেশ্বরী নামকরণ হয়।

আরেক প্রবাদ মতে, দেবী সতীর দেহের একান্নটি খণ্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে যে সব স্থানে পড়েছিল সে স্থানগুলো এক একটি পীঠস্থানে পরিণত হয়। সতীর দেহ ছিন্ন হওয়ার পর তার কিরিটের ডাক (উজ্জ্বল গহনার অংশ) এই স্থানে পড়েছিল তাই এটা উপপীঠ। সেই ডাক থেকেই ঢাকেশ্বরী নামের উৎপত্তি হয়।[৫] যতীন্দ্রমোহন রায় তার ঢাকা জেলার ইতিহাস গ্রন্থে বলেছেন: ভবিষ্য ব্রহ্মখণ্ডে বলা হয়েছে,

বৃদ্ধ গঙ্গাতটে বেদ বর্ষ সাহস্র ব্যত্যয়ে
স্থাপিতব্যঞ্চ যবনৈ জাঙ্গিরং পতনং মহৎ।
তত্র দেবী মহাকালী ঢক্কা বাদ্যপ্রিয়া সদাঃ
গাস্যন্তি পত্তনং ঢক্কা সজ্ঞকং দেশবাসিনঃ।

মানসিংহ ১৫৯৪-১৬০৬ সাল পর্যন্ত তিন দফায় বাংলার সুবেদার থাকাকালে মন্দিরটির জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে এটির সংস্কারের ব্যবস্থা করেন। এসময় তিনি মন্দির প্রাঙ্গণে ৪টি শিবলিঙ্গ স্থাপন করেন ও তার পাশাপাশি চারটি শিবমন্দিরও নির্মাণ করেন। তবে মানসিংহই মন্দিরটির সংস্কার করেছিলেন এমন সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এফ বি ব্রাডলী বার্ট ১৯০৬ সালে তার রোমান্স অব এ্যান ইস্টার্ন ক্যাপিটেল নামক গ্রন্থে লিখেছেন- “বর্তমান মন্দিরটি ২০০ বছরের পুরনো ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক হিন্দু এজেন্ট এটি নির্মাণ করেন।”[৬]

এই মন্দিরের দেবী ঢাকেশ্বরীর আসল ৮০০ বছরের পুরোনো বিগ্রহটি কলকাতার কুমারটুলি অঞ্চলে দুর্গাচারণ স্ট্রিটের শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মাতার মন্দিরে রয়েছে। দেশ ভাগের সময় একে ঢাকা থেকে কলকাতায় এটিকে আনা হয়। দেশভাগ-পরবর্তী দাঙ্গার সময় সম্ভাব্য আক্রমণ এবং লুন্ঠনের হাত থেকে দেবীকে রক্ষা করতে ঢাকার মূল বিগ্রহটিকে গোপনে এবং দ্রুততার সঙ্গে ১৯৪৮-এ কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন রাজেন্দ্রকিশোর তিওয়ারি (মতান্তরে প্রহ্লাদকিশোর তিওয়ারি) এবং হরিহর চক্রবর্তী। বিশেষ একটি বিমানে ঢাকেশ্বরী আসল বিগ্রহটি কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছিল। কলকাতায় বিগ্রহটি আনার পর প্রথম দু'বছর হরচন্দ্র মল্লিক স্ট্রিটে দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরির বাড়িতে দেবী পূজিতা হন। পরে ১৯৫০ নাগাদ ব্যাবসায়ী দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরী কুমারটুলি অঞ্চলে দেবীর মন্দির নির্মাণ করে দেন ও প্রতিষ্ঠা করে দেবীর নিত্য সেবার জন্য কিছু দেবোত্তর সম্পত্তি দান করেছিলেন। মূল দেবী বিগ্রহের উচ্চতা দেড় ফুটার মতো, দেবীর দশ হাত, কাত্যায়নী মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা রূপেই তিনি অবস্থান করছেন। পাশে লক্ষ্মী, সরস্বতী ও নিচে কার্তিকগণেশ। বাহন রূপে পশুরাজ সিংহ দণ্ডায়মান যার ওপর দাঁড়িয়ে দেবী মহিষাসুরকে বধ করেছেন। মানসিংহ এই বিগ্রহ ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করে আজমগড়ের এক তিওয়ারি পরিবারকে সেবায়েত নিযুক্ত করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে সেই পরিবারের বংশধরেরাই কলকাতায় এসে পুনরায় সেবায়েত নিযুক্ত হন, এখনো তারাই দেবীর নিত্য সেবা করেন।

বর্তমানে ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে থাকা বিগ্রহটি মূল মূর্তির প্রতিরূপ। এখানে প্রতি বছর ধুমধামের সাথে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়।

অবস্থান ও স্থাপনাসমূহ সম্পাদনা

ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির কমপ্লেক্স, ঢাকা, বাংলাদেশ। ৩৬০ ডিগ্রি দৃশ্য। মে-২০১৫

ঢাকেশ্বরী মন্দির ঢাকা শহরের পলাশী ব্যারাক এলাকায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসসমূহের দক্ষিণে ঢাকেশ্বরী সড়কের উত্তর পার্শ্বে একটি আবেষ্টনী প্রাচীরের মধ্যে অবস্থিত। মন্দির অঙ্গনে প্রবেশের জন্য একটি সিংহদ্বার রয়েছে, যা নহবতখানা তোরণ নামে পরিচিত। ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি কয়েকটি মন্দির ও সংলগ্ন সৌধের সমষ্টি, যা দুটি অংশে বিভক্ত। পূর্বদিকে অন্তর্বাটি ও পশ্চিমদিকে বহির্বাটি। পূর্বদিকের অন্তর্বাটিতে প্রধান মন্দির, নাটমন্দির ও অন্য ইমারত রয়েছে। এখানে আরেকটি তোরণদ্বার রয়েছে যেটি দিয়ে অন্তর্বাটিতে প্রবেশ করতে হয়। বহির্বাটিতে কয়েকটি মন্দির, একটি পান্থশালা ও বেশ কয়েকটি ঘর রয়েছে। এছাড়া পশ্চিমদিকে একটি প্রাচীন দিঘি রয়েছে। দিঘির দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটি প্রাচীন বটগাছ রয়েছে। দিঘির কাছেই কয়েকটি সমাধি রয়েছে। মূল মন্দির প্রাঙ্গনের বাইরে মহানগর পুজামণ্ডপ অবস্থিত।

মূল মন্দির এলাকার ভবনগুলি উজ্জ্বল হলুদাভ ও লাল বর্ণের। দিঘির উত্তর-পূর্ব কোণে একই সারিতে একই আয়তনের ও একই রকমের দেখতে চারটি শিব মন্দির রয়েছে।

মন্দিরের প্রশাসনিক ভবনের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে একান্ত নিজস্ব লাইব্রেরি।

মন্দিরের বেদখল সম্পত্তি সম্পাদনা

বিশ শতকের প্রথম দশকে ভাওয়াল পরগণার রাজা শ্রীযুক্ত রাজেন্দ্র নারায়ণ রায় বাহাদুর মন্দির পুনঃসংস্কার করে ২০ বিঘা ভূমি দেবোত্তর ভূমি হিসাবে রেকর্ডভুক্ত করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৪৮ সালে ভূমি অধিগ্রহণ (জরুরি) আইন, ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ১৯৬৫-এর পাক-ভারত যুদ্ধ, ১৯৬৯ সালের শক্র সম্পত্তি আইন (যা পরবর্তীতে অর্পিত সম্পত্তি আইন) ইত্যাদি ঘটনার পরিক্রমায় কিছু স্বার্থান্বেষী আগন্তুক এবং কতিপয় অসাধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জালিয়াতির মাধ্যমে ১৪ বিঘা জমি বেদখল হয়েছে। [৭]

চিত্রশালা সম্পাদনা

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "ঢাকেশ্বরী মন্দির - বাংলাপিডিয়া"bn.banglapedia.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৪ 
  2. "বস্ত্রালয় নয় মন্দির, আদি ঢাকেশ্বরী এত বিখ্যাত কেন?"EI Samay। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৪ 
  3. Chaudhury, Dipanjan Roy (২০১৮-১০-১৮)। "Sheikh Hasina gifts 1.5 bigha land to biggest hindu temple in Bangladesh"The Economic Timesআইএসএসএন 0013-0389। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৪ 
  4. "Maa Dhakeswari: দেশভাগে ছিন্নমূল, ঢাকা থেকে কলকাতায় উদ্বাস্তু হয়ে আসেন স্বয়ং ঢাকেশ্বরী"Aaj Tak বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০২-১৪ 
  5. সাহা, তমা (১৬ জুলাই ২০১৭)। "ঢাকেশ্বরী মন্দিরের একাল-সেকাল"যুগান্তর। সংগ্রহের তারিখ ১৮ মার্চ ২০১৯ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  6. Bradley-Birt, Francis Bradley (১৯০৬)। The Romance of an Eastern Capital (ইংরেজি ভাষায়)। Smith, Elder, & Company। পৃষ্ঠা ২৬৫। 
  7. http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/first-page/2015/09/05/70774.html

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা