রমনা কালী মন্দির

১৬শ শতাব্দী বাংলাদেশের হিন্দু মন্দির

রমনা কালী মন্দির ভারতীয় উপমহাদেশের সবচেয়ে বিখ্যাত হিন্দু মন্দিরসমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল। [১] এটি রমনা কালীবাড়ি নামেও পরিচিত। এটি প্রায় এক হাজার বছরেরও পুরাতন বলে বিশ্বাস করা হয় কিন্তু ইংরেজ আমলে এই মন্দিরটি আবার নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল । বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রমনা পার্কের (যার বর্তমান নাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বহির্ভাগে অবস্থিত।বর্তমানে বাংলার সংস্কৃতিতে এ মন্দিরের উল্লেখ্য ভূমিকা আছে। ভারত সরকারের অর্থায়নে বর্তমানে মন্দিরটি পুনর্নির্মিত হয়েছে। মন্দিরের চূড়ার বর্তমান উচ্চতা ৯৭ ফুট।

রমনা কালী মন্দির
রমনা কালী মন্দির
ধর্ম
অন্তর্ভুক্তিহিন্দুধর্ম
জেলাঢাকা জেলা
ঈশ্বরকালী
উৎসবসমূহকালী পূজা, দুর্গা পূজা, সরস্বতী পূজা
অবস্থান
দেশবাংলাদেশ
স্থাপত্য
প্রতিষ্ঠার তারিখ১৬শ শতাব্দী
উচ্চতা (সর্বোচ্চ)৯৬ ফুট

ইতিহাস সম্পাদনা

 
জোসেফ স্কট ফিলিপসের জলরঙের চিত্রে, রমনা কালী মন্দির (১৮৩৩)

জনশ্রুতি, প্রায় ৫০০ বছর আগে বদরীনাথের যোশীমঠ থেকে গোপালগিরি নামে এক উচ্চমার্গের সন্ন্যাসী প্রথমে ঢাকায় এসে সাধন-ভজনের জন্য উপযুক্ত একটি আখড়া গড়ে তোলেন। সেখানেই আরও ২০০ বছর পরে মূল রমনা কালীমন্দিরটি নির্মাণ করেন আর এক বড় সাধু হরিচরণ গিরি। তবে পরবর্তী সময়ে এই মন্দিরের প্রধান সংস্কারকার্য ভাওয়ালের ভক্তিমতী ও দানশীলা রানি বিলাসমণি দেবীর আমলেই হয়। ১৯৭১ সালের ২৬ ও ২৭ মার্চ। এই দুটো দিন রমনা কালীমন্দিরের পবিত্র ভূমি ঘিরে পাকিস্তানি সেনারা যে গণহত্যা পরিচালনা করেছিল তা রমনা গণহত্যা নামে পরিচিত। এক তীর্থভূমি রাতারাতি পরিণত হয়েছিল বধ্যভূমিতে। রমনা কালীমন্দিরের অধ্যক্ষ স্বামী পরমানন্দ গিরি সহ সেখানে উপস্থিত প্রায় ১০০ জন নারী ও পুরুষকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পাক সেনারা। শিশুরাও রেহাই পায়নি। এই হত্যাকাণ্ডের সময় রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম দাউ দাউ করে জ্বলেছিল। রমনা কালীমন্দিরের চূড়া ছিল ১২০ ফুট, যা বহুদূর থেকে দেখা যেত। সেটিও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয় ওই বর্বর সেনারা। [২][৩] পাকিস্তানি সৈন্যরা রমনা ত্যাগ করার আগে, জীবিত লোকদের পরের দিন সকালে ভারতে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। রমনা কালী মন্দিরের অধ্যক্ষ প্রয়াত পরমানন্দ গিরির স্ত্রী সুচেতা গিরি এবং মা আনন্দময়ী আশ্রমের তপস্বী জটালী মা গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া লোকেদের সাথে রমনা ছেড়েছিলেন। একাত্তরের এপ্রিল-মে মাস নাগাদ ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনায় পুনরায় পাকিস্তানি বর্বররা হামলা চালায়।

তদানীন্তন রেসকোর্স ময়দান ঢাকা ক্লাবের অধীনে ছিল। স্বাধীনতার পর তা গণপূর্ত বিভাগের হাতে হস্তান্তর করা হয়। গণপূর্ত বিভাগ মন্দির এবং আশ্রমের ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে নেয়। মন্দির এবং আশ্রমবাসী যারা গণহত্যা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন তারা আবার ফিরে আসেন এবং উক্ত স্থানে অস্থায়ী ভিটা করে বসতি স্থাপন করেন। সেখানে পূজা অর্চনার জন্য অস্থায়ী মন্দির স্থাপন করেন।

এই সময় রমনার অদূরে জাতীয় তিন নেতার মাজার সংলগ্ন শাহবাজ জামে মসজিদের খাদেম আবদুল আলী ফকির, জটালী মা এবং সুচেতা গিরি রমনা কালী মন্দির ও শ্রী মা আনন্দময়ী আশ্রমের ভক্তবৃন্দ ও অন্যান্য বাসিন্দাদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন এবং তাঁর কাছে একটি স্মারকলিপি হস্তান্তর করেন যা'তে মন্দির ও আশ্রম পুনঃনির্মাণের অনুরোধ জানানো হয়।

তিনি শহীদ পরিবারের উত্তরাধিকারীদের প্রত্যেককে একটি করে প্রশংসাপত্র ও প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে ২০০০ টাকার একটি চেক প্রদান করেন এবং মন্দির পুনঃনির্মাণের আশ্বাস দেন। ১৯৭৩ সালের ১৩মে সেখানকার বাসিন্দাদের পোস্তগলায় পাঠানো হয়। সেখানে শ্মশান সংলগ্ন বালুর মাঠে তারা বসতি স্থাপন করেন। তাদের জন্য রেশনের ব্যবস্থাও ছিল।

১৯৭৬ সালে তৎকালীন সামরিক সরকারের সময় পুলিশ দিয়ে অস্ত্রের মুখে তাদের উৎখাত করা হয়। তাদের ভারতে চলে যেতে ‘উপদেশ’ দেওয়া হয়। উক্ত স্থানে স্থাপন করা হয় সেনানিবাস। আবার বাস্তুচ্যুত হন রমনা কালী মন্দিরের বাসিন্দারা।

রমনায় প্রতি বছর দুর্গাপূজা করার উদ্ধোগ নেন স্থানীয়রা। কিন্তু প্রতিবারই তাদের বাঁধা দেওয়া হয়। শুধু ১৯৮২ সালে একবার কালী পূজার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৯৮৪ সালে মন্দির এবং আশ্রম ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে রতন সরকার বাদী হয়ে ঢাকার দেওয়ানী আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। নব্বইয়ের দশকে জটালী মা'র মৃত্যুর কয়েক বছর পর ১৯৯২ সালে ভারতে পাড়ি জমান সুচেতা গিরি।

২০০০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত গনতদন্ত কমিশনের সাংবাদিক সম্মেলনে রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ গণতদন্ত কমিশনের প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের হস্তক্ষেপে রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমের জমির একাংশ পুনরুদ্ধার হলে ২০০৬ সালে ভারত সরকার মন্দির ও আশ্রম পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। পুজোর্চ্চনাও শুরু হয়। ৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০২১ সালে রমনা কালী মন্দিরের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০বছর পূর্তিতে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ তা উদ্বোধন করেন আর রমনা কালী মন্দির ফিরে পায় তার ৫ শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য। [৪][৫]

বিগ্রহ সম্পাদনা

 
রমনা কালী মন্দিরে দেবী কালীর বিগ্রহ

তন্ত্রশাস্ত্রে মা কালীর নানাপ্রকারের বিগ্রহভেদ বর্ণনা করা হয়েছে। তার মধ্যে রমনা কালী মন্দিরের কালী বিগ্রহ অন্যতম। পাথরের বেদির ওপর শ্রীশ্রীভদ্রকালীর সুউচ্চ প্রতিমা। চতুর্ভুজা মাতৃবিগ্রহ। মহাদেবের শয়ান মূর্তির ওপর দণ্ডায়মান। দু’পাশে ডাকিনী-যোগিনী। ভদ্রকালিকা দেবীর কণ্ঠে মুণ্ডমালা। লালজবার মালা। দেবী মা লাল বস্ত্র পরিহিতা। ভদ্রকালিকার একপাশে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও মা সারদামণির ছবি।

স্থাপনাসূমহ সম্পাদনা

 
হরিচাঁদ মন্দির

রমনা কালী মন্দিরে বর্তমানে কালী মূর্তি ছাড়াও আরো বেশ কয়েকটি মন্দির রয়েছে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো, দুর্গা মন্দির, লোকনাথ মন্দির, রাধা গোবিন্দ মন্দির, মা আনন্দময়ীর মন্দির।

নকশা সম্পাদনা

 
মূল মন্দিরের চূড়া

মন্দিরটির স্থাপত্য শৈলী বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে। মন্দিরের সামনে একটি বড় দিঘি ছিল যা উপাসক এবং দর্শনার্থীদের সাঁতার কাটার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান ছিল। মন্দিরটিতে একটি উঁচু চূড়া রয়েছে। মন্দিরের পাশেই ছিল মা আনন্দময়ী আশ্রম, সেখানে থাকা ও গোসল করার সুবিধা ছিল।

অনুষ্ঠানমালা সম্পাদনা

রমনা কালী মন্দির এর মূল পূজা হলো কালী পূজা।।কালীপুজোয় সুন্দর করে সাজানো হয় গোটা মন্দিরকে। নানা অলংকারে সেজে ওঠেন শ্রীশ্রীভদ্রকালী মাতা।এখানে দুর্গাপুজোও খুব বড় করে হয়। তাছাড়া এখানে সরস্বতী পূজা, বাৎসরিক অনুষ্ঠান সহ নানা ধরনের ধর্মীয় উৎসব এখানে হয়ে থাকে ।বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বহু ভক্ত আসেন মন্দিরে। বিভিন্ন দেশ থেকেও ভক্তরা আসেন। উৎসবমুখর হয়ে ওঠে এই মন্দির।

পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক ধ্বংস ও গণহত্যা সম্পাদনা

 
মন্দির প্রাঙ্গণে নিহত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী/ স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনী " অপারেশন সার্চলাইট " শুরু করে। অপারেশনটি একটি গণহত্যা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত করে। অপারেশন সার্চলাইটের বেশিরভাগ লক্ষ্য ছিল তরুণ হিন্দু পুরুষ, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র এবং শিক্ষাবিদরা। অপারেশন সার্চলাইট জগন্নাথ হল ( ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে হিন্দু ছাত্রদের জন্য একটি হোস্টেল) এবং রমনা কালী মন্দির সহ বিশিষ্ট হিন্দু ধর্মাবলম্বীদেরকে লক্ষ্য করে।

১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী রমনা কালী মন্দির কমপ্লেক্সে প্রবেশ করে এবং এক ঘন্টার মধ্যে ১০০ জনেরও বেশি লোককে হত্যা করে। মন্দির চত্বরে আশ্রয় নেওয়া বেশ কিছু মুসলমানকেও হত্যা করা হয়।

২০০০ সাল পর্যন্ত, মন্দির ধ্বংসের প্রমাণগুলি বেঁচে থাকা এবং সাক্ষীদের মৌখিক সাক্ষ্যের উপর নির্ভর করেছিল। ২০০০ সালে, বাংলাদেশ সরকার আওয়ামী লীগ, তদন্তের জন্য একটি পাবলিক অনুসন্ধান খোলে। ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে চেয়ারম্যান বিচারপতি কে এম সোবহান একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন পেশ করেন।

গণহত্যার শিকার হয়েছে এমন প্রায় ৫০জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং অন্য নিহতদের স্বজনরা হয় মৃত বা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেছে। রমনা কালী মন্দির হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া মানুষের জীবিত আত্মীয়দের জন্য একটি বিশ্বব্যাপী আবেদন করা হয়েছে যাতে তারা তাদের মৃত পরিবারের সদস্যদের নাম ভবিষ্যতের স্মৃতিসৌধে তালিকাভুক্ত করতে অবদান রাখে।

চিত্রশালা সম্পাদনা

অবস্থান সম্পাদনা

 
মন্দিরের প্রবেশপথ

এটির অবস্থান সাবেক ঢাকা রেসকোর্সের পাশে, বর্তমানে যা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান নামে পরিচিত।

পুরো মন্দির কমপ্লেক্সটির আয়তন প্রায় ২.২৫ একর (৯,১০০ মি) এবং এটি রমনা পার্কের দক্ষিণে, বাংলা একাডেমির বিপরীতে অবস্থিত।

আরও দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "৭১-এ কালীমন্দির গুঁড়িয়ে দেয় পাকিস্তান! সেই ভয়াল স্মৃতি এখনও তাড়া করে"EI Samay। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-২৮ 
  2. "৭১-এ কালীমন্দির গুঁড়িয়ে দেয় পাকিস্তান! সেই ভয়াল স্মৃতি এখনও তাড়া করে"EI Samay। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-২৮ 
  3. "ঐতিহাসিক 'রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞের অজানা ইতিহাস" (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-২৮ 
  4. "গণহত্যার সাক্ষী ঢাকার ইতিহাস বহনকারী রমনা কালী মন্দির"Drishtibhongi দৃষ্টিভঙ্গি (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২০-১১-১৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-২৮ 
  5. "১৯৭১ সালে রমনা কালী মন্দিরের গণহত্যার ভুলে যাওয়া ইতিহাস - অগ্নিবীর"www.agniveerbangla.org। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৭-২৮ 

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা