২০১৬ নাসিরনগর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা

২০১৬ নাসিরনগর হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা।

২০১৬ সালের নাসিরনগরের সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় ৩০ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলায় ইসলামিক উগ্রপন্থীদের দ্বারা সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলা হয়েছিল।[১] ৩০এ অক্টোবর ২০১৬-তে এক হিন্দু জেলে রসরাজ দাস দ্বারা ইসলামের বিরুদ্ধে [২]পোস্ট করার অভিযোগ করে এই হামলা করা হয়। এতে ১৯টি মন্দির হামলার শিকার হয়[৩] এবং প্রায় ৩০০টি বাড়ি ভাঙচুর ও ১০০ জনের উপরে হিন্দু আহত হয়।

ঘটনা সূত্রপাত সম্পাদনা

নাসিরনগরের হরিপুর গ্রামের রসরাজ দাস ফেসবুকে কাবা ঘরের সাথে শিবের ছবি জুড়ে দিয়েছেন এই অভিযোগে কিছু ইসলামিক উগ্রপন্থী ২৯ অক্টোবর রসরাজ দাসকে পিটিয়ে পুলিশকে দেয়। তার বিরুদ্ধে ইসলাম অবমাননার মামলা করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারায় তাকে জেলে চালান করা হয়।[৪] তবু একাধিক ইসলামী সংগঠন বিক্ষোভ-সমাবেশ করে। কিন্তু রসরাজ ফেসবুক চালাতে জানতেন না । তার তিনি ফেসবুকে কোনো স্ট্যাটাস দেননি ৷ তার ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক করে স্ট্যাটাস দেয়া হয় ৷ পোষ্টটিকেও পরে পাওয়া যায়নি।[৫][৬][৭]

হামলা সম্পাদনা

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ করে ২০১৬ সালের ‘খাঁটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’ নাসিরনগর সরকারি কলেজ মোড়ে বিক্ষোভ ও সমাবেশের ডাক দেয়। এই সমাবেশ থেকে হিন্দুদের উপর হামলা করা হয়। আটটি হিন্দু পাড়াতে প্রায় তিনশোটি বাড়ি-ঘর, মন্দির যেমনঃ গৌর মন্দির, নাসিরনগর, দেব-দেবীর মূর্তি ,আসবাব, প্রণামি বাক্স ভাঙচুর করা হয়। টেলিভিশন,মূল্যবান জিনিসপত্র,টাকাপয়সা লুট করা হয়। অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষকে এই হামলায় আহত হয়। রসরাজের বাড়িতে ভাংচুর করা হয় । মহাকাল পাড়ার গৌর মন্দিরের সেবায়েত শংকর সেন গুরুতর আহত হন । গৌর মন্দিরের পুরোহিত নরেন্দ্র প্রভুকে মারধর করা হয়। পশ্চিম পাড়ার জগন্নাথ মন্দির, নমশূদ্র পাড়ার কালীবাড়ি মন্দির, মহাকাল পাড়ার শিবমন্দির, দুর্গামন্দির, শীলপাড়ার লোকনাথ মন্দির, দত্তপাড়ার দত্তবাড়ি মন্দির, সূত্রধরপাড়ার কালীমন্দির,শ্রীশ্রী আনন্দময়ী কালী মন্দিরসহ ১৫টি মন্দির ও দুই শতাধিক বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়।[৮] ৪ নভেম্বর আবার হামলা করা হয় নাসিরনগরের হিন্দুদের উপরে। স্থানীয় এমপি ও তৎকালীন মৎস্য ও পানিসম্পদ মন্ত্রী মোহাম্মদ ছায়েদুল হক দ্বারা হিন্দুদের নিয়ে কটু মন্তব্যও এর জন্য দায়ী ।[৯] এই ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতারা উস্কানি দিয়েছে ।[১০][১১][১২][১৩]এই ঘটনার 'মাস্টারমাইন্ড' ছিল আওয়ামী লীগের হরিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমান আঁখি। এছাড়া আওয়ামী লীগের পূর্বভাগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমানের ভাই মো. আক্তার মিয়া ও নাসিরনগর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুল হাসেম এতে জড়িত ছিল।[১৪]

হামলার পরে সম্পাদনা

নাসিরনগরে হামলার ঘটনায় মোট আটটি মামলা হয় । একটি মামলার তদন্ত করে গোয়েন্দা বিভাগ। বাকি ছয়টি মামলার তদন্ত করে নাসিরনগর থানার পুলিশ। দুই হাজারেরও বেশি আসামি সনাক্ত করা হয়। যাদের মধ্যে ১২৬ জনকে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায় পুলিশ। ফরেনসিক রিপোর্ট অনুসারে রসরাজ দাসের মোবাইল থেকে ধর্ম অবমাননাকর ছবি আপলোড করা হয় নি। ফরেনসিক রিপোর্ট পাওয়ার পর ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি আদালত রসরাজকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেয়। অথচ তিনি এখনও এ মামলার আসামি। এখনও তিনি আদালতে হাজিরা দেন ।[১৫] পুলিশ আদালতে এই মামলার প্রতিবেদন দেয় নি। [১৬][১৭] ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ঢাকার ভাটারায় আতিকুর রহমান আঁখিকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আতিকুর রহমান আঁখি ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর উচ্চ আদালত থেকে জামিন পায় ।[১৮]

প্রতিক্রিয়া সম্পাদনা

এই হামলায় নিন্দা জানায় বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ। এর সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বিবৃতিতে বলেন -

এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্সের নীতির প্রতি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে এই ঘটনা।

তিনি এর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থার দাবি করেন।[১৬] আওয়ামী লীগের আতিকুর রহমান আঁখি এই ঘটনার মাস্টারমাইন্ড হওয়ায় দেশজুড়ে সমালোচিত হয় আওয়ামী লীগ। ২০১৭ সালের ২৩ জানুয়ারি আতিকুর রহমান আঁখি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় দ্বারা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত হয়। কিন্তু পরে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করে নিজের পদে ফিরে সে।[১৮]সহিংসতায় যুক্ত আতিকুর রহমান আঁখি, মো. আক্তার মিয়া ও আবুল হাসেমকে ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয়। সমালোচনার মুখে পড়ে আওয়ামী লীগর ১৩ অক্টোবর আবুল হাসেম ও আতিকুর রহমান আঁখির মনোনয়ন বাতিল করে ।[১৯]

আরো দেখুন সম্পাদনা

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "সাম্প্রদায়িক শক্তির মারাত্মক উত্থান"jagonews24.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩ 
  2. "Nasirnagar attacks driving away Hindus"Dhaka Tribune। ২০১৬-১১-০২। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৫-৩০ 
  3. "Rampage over Hindus in B'baria"The Daily Star। ২০১৬-১০-৩০। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-০৫-৩০ 
  4. "রসরাজ আজও আসামি"Bangla Tribune। ২০২১-০৮-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩ 
  5. "ভুয়া খবর ঘিরে বাংলাদেশে পাঁচটি বড় ঘটনা"BBC News বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩ 
  6. "ধর্ম নিয়ে সহিংসতা উস্কে দেয়া এতো সহজ কেন?"BBC News বাংলা। ২০১৯-১০-২৯। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩ 
  7. "রসরাজের ফেসবুক পোস্ট রসরাজের নয়"DW.COM। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩ 
  8. "ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাদ যায়নি মন্দিরও"SAMAKAL (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২১-০৮-২৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৯-০১ 
  9. "মন্ত্রী ছায়েদুল হকের পদত্যাগের দাবিতে প্রতিবাদমুখর ফেসবুক"Bangla Tribune। ২০২১-০৮-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩ 
  10. প্রতিবেদক, নিজস্ব। "নাসিরনগরে হিন্দু বাড়িঘরে ভাঙচুর-লুটপাট"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  11. "ভুয়া খবর ঘিরে বাংলাদেশে পাঁচটি বড় ঘটনা"BBC News বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩ 
  12. প্রতিবেদক, নিজস্ব। "সাম্প্রদায়িক সহিংসতার উৎসের সন্ধানে"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  13. "আমি জীবনে কাউকে 'মালাউন' বলিনি: ছায়েদুল হক"BBC News বাংলা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩ 
  14. হৃদয়, মাসুক; ব্রাহ্মণবাড়িয়া (২০২১-১০-১৩)। "নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলায় অভিযুক্ত ৩ জনকে আ. লীগের মনোনয়ন"The Daily Star Bangla (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-১৫ 
  15. "কেমন আছেন সেই রসরাজ"মানবজমিন। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩ 
  16. প্রতিবেদক, নিজস্ব। "নাসিরনগরে হিন্দু বাড়িঘরে ভাঙচুর-লুটপাট"Prothomalo। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩ [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  17. "রসরাজ আজও আসামি"Bangla Tribune। ২০২১-০৮-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৮-১৩ 
  18. হৃদয়, মাসুক; ব্রাহ্মণবাড়িয়া (২০২১-১০-১৩)। "নাসিরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলায় অভিযুক্ত ৩ জনকে আ. লীগের মনোনয়ন"The Daily Star Bangla (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-১৫ 
  19. "মন্দিরে হামলাকারী দুই আসামির মনোনয়ন বাতিল"Daily Nayadiganta। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-১০-১৫ 

আরও পড়ুন সম্পাদনা