হিন্দু মন্দির

হিন্দুধর্মের উপাসনাগৃহ

হিন্দু মন্দির হল হিন্দুদের দেব-উপাসনার স্থান। ‘মন্দির’ বা ‘দেবালয়’ বলতে বোঝায় ‘দেবতার গৃহ’।[১] মানুষ ও দেবতাকে একত্রে নিয়ে আসার জন্য হিন্দুধর্মের আদর্শ ও ধর্মবিশ্বাস-সংক্রান্ত প্রতীকগুলির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মিত ভবন বা স্থানকেই ‘মন্দির’ বলা হয়।[২] জর্জ মিশেলের মতে, হিন্দু মন্দির এমন একটি আধ্যাত্মিক কেন্দ্র যেখানে মায়ার জগৎ থেকে মানুষ তীর্থযাত্রী বা পূণ্যার্থীর বেশে জ্ঞান ও সত্যের জগতের সন্ধানে আসেন।[১]

হিন্দু মন্দির

স্টেলা ক্র্যামরিসচের মতে,[২] হিন্দু মন্দিরের প্রতীকতত্ত্ব ও গঠনভঙ্গিমা বৈদিক ঐতিহ্যের মধ্যেই নিহিত আছে। একটি মন্দিরের মধ্যে হিন্দু বিশ্বতত্ত্বের সকল ধারণার সন্ধান পাওয়া যায়। এরমধ্যে ভাল, মন্দ ও মানবিক দিকগুলির সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুর কালচক্র ধারণা এবং পুরুষার্থ ধারণার সব কিছুই প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ধর্ম, কাম, অর্থ, মোক্ষ, কর্মভক্তির দার্শনিক ধারণাগুলিও প্রতীকের মাধ্যমে মন্দিরে উপস্থিত থাকে।[৩][৪]

হিন্দু মন্দিরে প্রতীকের মাধ্যমে উপস্থিত আধ্যাত্মিক আদর্শগুলির কথা পাওয়া যায় ভারতের প্রাচীন সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থগুলিতে (যেমন, বেদ, উপনিষদ্‌ ইত্যাদি)। অন্যদিকে মন্দিরের গঠনভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত, তা বর্ণিত হয়েছে স্থাপত্য-সংক্রান্ত সংস্কৃত প্রবন্ধগ্রন্থগুলিতে (যেমন, বৃহৎসংহিতা, বাস্তুশাস্ত্র ইত্যাদি)।[৫][৬] মন্দিরের নকশা, অলংকরণ, পরিকল্পনা ও নির্মাণশৈলীর মধ্যে প্রাচীন প্রথা ও রীতিনীতি, জ্যামিতিক প্রতীকতত্ত্ব এবং হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নিজস্ব বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে।[২] হিন্দু মন্দিরগুলি হিন্দুদের আধ্যাত্মিক গন্তব্য। সেই সঙ্গে মন্দিরগুলিকে কেন্দ্র করে প্রাচীন শিল্পকলা, সম্প্রদায়গত উৎসব ও আঞ্চলিক বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে।[৭][৮]

অঞ্চল ও সম্প্রদায়ভেদে মন্দিরগুলির গঠনভঙ্গিমা ও নির্মাণশৈলীর মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়।[৯] তা সত্ত্বেও হিন্দু মন্দিরগুলির মধ্যে কিছু সাধারণ মৌলিক ধারণা, প্রতীকতত্ত্ব ও বিষয়গত মিল দেখা যায়। মন্দিরের প্রাচুর্য দেখা যায় মূলত দক্ষিণ এশিয়া (প্রধানত ভারতনেপাল) এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে (প্রধানত কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপাঞ্চল ও মালয়েশিয়া)।[১০][১১] মরিশাস, ফিজি, গায়ানা, সুরিনাম, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইউরোপউত্তর আমেরিকায় যেখানে হিন্দু জনসংখ্যা উল্লেখযোগ্য সেখানেও প্রচুর মন্দির গড়ে উঠেছে।[১২] হিন্দু মন্দিরের বর্তমান অবস্থা ও বহিরাকৃতির মধ্যে কয়েক সহস্রাব্দ ধরে বিবর্তনশীল হিন্দু শিল্পকলার মিশ্রণ চোখে পড়ে। খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীর পর থেকে হিন্দুধর্ম ও ইসলামের মধ্যে যে সংঘর্ষ চলে আসছে, তারও প্রভাব হিন্দু মন্দিরগুলির উপর পড়েছে।[১৩]

কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হিন্দু মন্দির হল কাশী বিশ্বনাথ মন্দির, চারধাম মন্দির-চতুষ্টয় (পুরী জগন্নাথ মন্দির, রামনাথস্বামী মন্দির, দ্বারকাধীশ মন্দির, ও বদ্রীনাথ মন্দির), ছোটো চারধাম মন্দির-চতুষ্টয় (বদ্রীনাথ মন্দির, কেদারনাথ মন্দির, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী), জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দিরসমূহ, ৫১টি শক্তিপীঠ মন্দিরসমূহ, তিরুপতি বালাজি মন্দির, কামাখ্যা মন্দির ইত্যাদি। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কয়েকটি বিখ্যাত মন্দির হল কপিলমুনির মন্দির কালীঘাট মন্দির, দক্ষিণেশ্বর মন্দির, বেলুড় মঠ, তারাপীঠ মন্দির, তারকেশ্বর মন্দির, শ্রী স্বামীনারায়ণ মন্দির ইত্যাদি। বাংলাদেশের একটি বিখ্যাত মন্দির হল ঢাকেশ্বরী মন্দির

গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পাদনা

হিন্দু মন্দিরগুলি শিল্পকলা, ধর্মীয় বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও হিন্দু জীবনদর্শনের এক সংমিশ্রণ। এগুলি হল একটি পবিত্র ক্ষেত্রের মধ্যে মানুষ, দেবতা ও পুরুষের (ব্রহ্ম) মিলনকেন্দ্র।[১৪]

 
৯X৯ (৮১) গ্রিড-বিশিষ্ট ‘পরম সায়িক’ নকশা দেখা যায় বৃহদাকার প্রথাগত হিন্দু মন্দিরগুলিতে। হিন্দু মন্দির নির্মাণে যে বিভিন্ন প্রকার গ্রিড ব্যবহৃত হয়, এটি তার মধ্যে অন্যতম। এই ধরনের মন্দির হল সামঞ্জস্যপূর্ণ আকৃতির মন্দির। এখানে প্রত্যেকটি সমকেন্দ্রিক নকশার বিশেষ গুরুত্ব আছে। ‘পৈশাচিক পাদ’ নামে পরিচিত বাহ্যিক নকশাটি অসুর বা অশুভের প্রতীক। অন্যদিকে ভিতরের ‘দৈবিক পাদ’ নকশাটি দেবতা বা শুভের প্রতীক। শুভ ও অশুভের মধ্যে এককেন্দ্রিক ‘মানুষ পাদ’ মানবজীবনের প্রতীক। প্রতিটি নকশা ‘ব্রহ্মপাদ’কে ঘিরে থাকে। ব্রহ্মপাদ সৃষ্টিশক্তির প্রতীক। এখানেই মন্দিরের প্রধান দেবতার মূর্তি থাকে। ব্রহ্মপাদের একেবারে কেন্দ্রস্থলটি হল ‘গর্ভগৃহ’। এটি সবকিছু ও সবার মধ্যে অবস্থিত ব্রহ্মের প্রতীক।[২]

প্রাচীন ভারতীয় ধর্মগ্রন্থগুলিতে মন্দিরকে বলা হয়েছে ‘তীর্থ’।[২] এটি একটি পবিত্র ক্ষেত্র যার পরিবেশ ও নকশা হিন্দু জীবনদর্শনের প্রতিটি ধারণাকে প্রতীকের মাধ্যমে প্রকাশ করে।[১৪] জীবন সৃষ্টি ও রক্ষার প্রতিটি বিশ্বজনীন উপাদান হিন্দু মন্দিরে উপস্থিত – আগুন থেকে জল, দেবতার মূর্তি থেকে প্রকৃতি, পুরুষ থেকে নারীসত্ত্বা, অস্ফুট শব্দ ও ধূপের গন্ধের থেকে অনন্ত শূন্যতা ও বিশ্বজনীনতা – সবই মন্দিরের মূল আদর্শের অন্তর্গত।[২]

সুজান লেওয়ান্ডোস্কি বলেছেন,[৫] সবকিছুই এক এবং সবকিছুই পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত – এই বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই হিন্দু মন্দির নির্মাণের মূল নকশাটি প্রস্তুত করা হয়। ৬৪-গ্রিড বা ৮১-গ্রিড গাণিতিকভাবে নির্মিত স্থান ও শিল্পকলায় মণ্ডিত স্তম্ভের মধ্য দিয়ে তীর্থযাত্রীকে স্বাগত জানানো হয়। মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলি – যেমন অর্থ (উন্নতি, সম্পদ), কাম (বিনোদন, যৌনতা), পুরুষার্থ (সদ্গুণ ও নৈতিক জীবন) ও মোক্ষ (জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্তি, আত্মজ্ঞান) – এগুলির অনুসন্ধানে মানুষকে প্রবুদ্ধ করার জন্য স্তম্ভগুলি খোদাইচিত্র বা মূর্তিতে শোভিত থাকে।[১৫][১৬] মন্দিরের কেন্দ্রে, সাধারণত দেবতার নিচে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপরে বা পাশে, খানিকটা ফাঁকা জায়গা রাখা হয়। এখানে কোনো অলংকরণ থাকে না। এটি সর্বোচ্চ উপাস্য ব্রহ্ম বা পুরুষের প্রতীক। ব্রহ্ম নিরাকার, সর্বত্রব্যাপী, সবকিছুর মধ্যে যোগসূত্ররূপী ও সবকিছুর সারবস্তু। হিন্দু মন্দিরের উদ্দেশ্য ব্যক্তির মনকে পবিত্র করা ও ভক্তের আত্মজ্ঞান জাগরিত করা।[২] বিশেষ পদ্ধতিগুলি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ। বিভিন্ন হিন্দু মন্দিরের প্রধান দেবতা এই আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রের বৈচিত্র্যের পরিচায়ক।

হিন্দুধর্মে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় চেতনার মধ্যে কোনো বিভাজনরেখা নেই।[৫] সেই অর্থে, হিন্দু মন্দিরগুলি শুধু পবিত্র স্থানই নয়, ধর্মনিরপেক্ষ স্থানও বটে। এগুলির অর্থ ও উদ্দেশ্য আধ্যাত্মিক জীবনের বাইরে সামাজিক রীতিনীতি ও দৈনিক জীবনের ক্ষেত্রেও প্রসারিত হয়ে এগুলিকে একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান করে তুলেছে। কোনো কোনো মন্দির বিশেষ বিশেষ উৎসবের জন্য বিখ্যাত। সেখানে নৃত্য ও গীতের মাধ্যমে শিল্পের চর্চা করা হয়। আবার হয় বিবাহ,[১৭] অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ ইত্যাদির মতো সামাজিক অনুষ্ঠানও পালিত হয়। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনেও হিন্দু মন্দিরগুলি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক হিন্দু রাজবংশের বংশপরম্পরার সঙ্গে হিন্দু মন্দিরের যোগাযোগ আছে। আবার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গেও অনেক হিন্দু মন্দির অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত।[১৮]

স্থাপত্য সম্পাদনা

প্রায় সব হিন্দু মন্দিরই দুই ধরনের হয়ে থাকে: গৃহ বা প্রাসাদ। গৃহ-আকৃতির মন্দিরগুলি সাধারণ আকারের হয়। এগুলি দেবতার সাধারণ গৃহ। মন্দির হল সেই উপাসনালয়, যেখানে ভক্তেরা এমনভাবে দেবতাকে দর্শন করতে আসেন, যেমনভাবে তারা আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে যান। হিন্দুধর্মের ভক্তিবাদী শাখায় মন্দির হল পূজার স্থান। পূজার মাধ্যমে ভক্তরা দেবতাকে শ্রদ্ধা জানান, ঈশ্বরকে ডাকেন এবং অধ্যাত্মচিন্তার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। হিন্দুধর্মের অন্যান্য শাখায় মন্দিরে ভক্তেরা জপ, ধ্যান, যোগ বা শাস্ত্রপাঠের মাধ্যমে সর্বোচ্চ উপাস্যের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন।

প্রাসাদ-আকৃতির মন্দিরগুলি বিরাট আকারের হয়। এগুলি স্থাপত্যের এক-একটি অসাধারণ নমুনা। এখানেও ভক্তেরা একই উদ্দেশ্যে ও একই ভাবে দেবতার উপাসনা করেন।

স্থান সম্পাদনা

প্রাচীন সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, মন্দির স্থাপনের উপযুক্ত স্থান হল জলাশয় ও উদ্যানের কাছে কোনো ভূখণ্ডে। যেখানে পদ্ম ও অন্যান্য ফুল ফোটে, হংস ও অন্যান্য পাখিরা চরে বেড়ায় এবং পশুরা কোনো রকম ক্ষতি ছাড়াই আশ্রয় নিতে পারে, এমন স্থানই মন্দির স্থাপনের উপযুক্ত।[২] উক্ত ধর্মগ্রন্থ অনুসারে, এই ধরনের জায়গাতেই দেবতারা খেলা করেন। তাই এই জায়গাই মন্দির নির্মাণের উপযুক্ত স্থান।[২][৫]

:দেবতারা খেলা করেন সেখানেই, যেখানে হ্রদ আছে,

যেখানে পাতার ছাউনি ভেদ করে সূর্যের আলো এসে পড়ে,
এবং যেখানে স্বচ্ছ জলে চলে বেড়ায় হংসের দল।
তাদের বুক এখানে ওখানে ছুঁয়ে যায় শ্বেতপদ্ম।
যেখানে হংস ও অন্যান্য পাখির ডাক শোনা যায়
এবং পশুরা নিকটবর্তী নদীর তীরে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম নেয়।
দেবতারা সেখানে খেলা করেন যেখানে নদীর অলংকার হংসের ধ্বনি,
জল তাদের বস্ত্র, বহমান সেই জল,
কর্ণের কুণ্ডল তীরের পুষ্পিত বৃক্ষরাজি,
নদীর মোহনা তাদের ওষ্ঠাধর,
উত্থিত বালুচর তাদের স্তন ও হংসপাখা তাদের ক্ষৌমবস্ত্র।
দেবতারা সর্বদা খেলা করেন যেখানে বন আছে, নদী আছে, পর্বত ও ঝর্ণা আছে, প্রমোদ-উদ্যানে ভরা নগরী আছে।
বৃহৎসংহিতা ১। ৬০। ৪-৮|খ্রিস্টীয় ৩য়-৬ষ্ঠ শতাব্দী[১৯]

সাধারণত নদীসংগম, নদীতীর, হ্রদ বা সমুদ্র উপকূল হিন্দু মন্দির স্থাপনের উপযুক্ত স্থান বলে বিবেচিত হলেও বৃহৎসংহিতা বা পুরাণ শাস্ত্রগুলিতে বলা হয়েছে প্রাকৃতিক জলাশয় নেই এমন স্থানেও মন্দির নির্মাণ করা যেতে পারে। তবে সেখানে মন্দিরের সামনে বা বাঁ দিকে কৃত্রিম জলাশয় নির্মাণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যদি প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম কোনো রকম জলাশয়ই মন্দিরের পাশে না থাকে তবে মন্দির বা দেবতা প্রতিষ্ঠার সময় প্রতীকীভাবে জলের কল্পনা করতে হয়। বিষ্ণুধর্মোত্তর পুরাণ (তৃতীয় খণ্ড, অধ্যায় ৯৩) অনুসারে,[২০] মন্দিরের মধ্যে, পাথর কেটে, পর্বতচূড়ায় যেখানে প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোরম, পর্বতের ঢালে যেখান থেকে সুন্দর উপত্যকা দেখা যায়, বনে, আশ্রমে, উদ্যাএর পাশে বা শহরের রাস্তার মোড়ে নির্মাণ করা যায়।

নির্মাণশাস্ত্র সম্পাদনা

হিন্দু মন্দিরের প্রাচীন নির্মাতারা বাস্তুশাস্ত্র (অর্থাৎ, বসতি-বিজ্ঞান। সংস্কৃত ভাষায় ‘বাস’ শব্দের অর্থ বসবাস করা এবং ‘তু’ শব্দের অর্থ ‘তুমি’) নামে এক স্থাপত্য শাস্ত্র রচনা করেছিলেন। এর অন্তর্গত ছিল বাস্তুবিদ্যা বা বসবাস-সংক্রান্ত জ্ঞান।[২১] মন্দির নির্মাণ-সংক্রান্ত অনেকগুলি বাস্তুশাস্ত্র রয়েছে। যেমন, তাক্কুর পেরু রচিত একটি শাস্ত্রে কোথাও ও কীভাবে মন্দির নির্মাণ করা উচিত তা বর্ণিত হয়েছে।[২২][২৩] খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে এই ধরনের বাস্তুশাস্ত্রগুলি সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল।[২৪] বাস্তুশাস্ত্রে গৃহনির্মাণ, নগর-পরিকল্পনা,[২১] এবং কীভাবে উপযুক্ত গ্রাম, শহর ও রাজ্যগুলি প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে মন্দির, জলাশয় ও উদ্যান নির্মাণ করতে পারে তা লিপিবদ্ধ আছে।[২৫][২৬] বারনেটের মতে,[২৭] এই ধরনের মন্দির ও নগর-পরিকল্পনামূলক গ্রন্থগুলি শুধুমাত্র তাত্ত্বিক আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল, না সেগুলির বাস্তবক্ষেত্রে যথাযথভাবে প্রয়োগ ঘটেছিল, তা স্পষ্ট বোঝা যায় না। তবে বাস্তুশাস্ত্র অনুসারে, নগর পরিকল্পনা ও মন্দির নির্মাণ হিন্দু সামাজিক ও আধ্যাত্মিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ও শিল্পকলার চূড়ান্ত নিদর্শন।[২১]

 
প্রাচীন ভারতে হিন্দু মন্দির পরিকল্পনা ও নির্মাণের জন্য অনেক শাস্ত্রগ্রন্থ রচিত হয়েছিল। এগুলিতে মন্দিরগুলিকে পরিপূর্ণ করে তোলার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল (উপরে)। তবে শিল্পীদের স্বাধীনতা দেওয়া হত পরীক্ষানিরীক্ষা করার জন্য এবং নিজেদের সৃষ্টিশীলতাকে মুক্তভাবে প্রকাশ করার জন্য।[২৮]

মন্দির নির্মাণ-সংক্রান্ত আরেকটি শাস্ত্র হল খ্রিস্টীয় ৯ম বা ১০ম শতাব্দীতে ওড়িশার রামচন্দ্র ভট্টারক কৌলাচার রচিত শিল্পপ্রকাশ[২৯] এই গ্রন্থে মন্দির ও প্রতীকতত্ত্বের প্রত্যেকটি দিককে জ্যামিতিক আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। যেমন, মানবজীবনের ১৬টি অনুভূতিকে ১৬ ধরনের নারীমূর্তি দ্বারা প্রকাশ করা হয়েছে। পূর্ব ভারতের মন্দিরগুলিতে এই ধরনের শৈলী বিশেষ জনপ্রিয়। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে রচিত শাস্ত্রগুলিতে আবার অন্য ধরনের স্থাপত্যশৈলী গৃহীত হয়। যেমন, পশ্চিম ভারতের সৌরাষ্ট্র প্রথার মন্দিরগুলিতে নারীমূর্তি, অভিপ্রকাশ ও আবেগগুলি ৩২ ধরনের ‘নাটকস্ত্রী’ মূর্তির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।[২৯] শিল্পপ্রকাশ শাস্ত্রে ১২ ধরনের হিন্দু মন্দিরের উল্লেখ আছে। পঞ্চরাত্র প্রসাদ প্রসাধন[৩০]শিল্প রত্নাকর[৩১] গ্রন্থে আরও অধিক সংখ্যক মন্দিরশৈলীর উল্লেখ পাওয়া যায়।

উত্তরপশ্চিম ভারতের রাজস্থান অঞ্চলে যে প্রাচীন সংস্কৃত মন্দির-নির্মাণ শাস্ত্র আবিষ্কৃত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সূত্রধর মণ্ডনের প্রাসাদমণ্ডন (অর্থাৎ, মন্দির পরিকল্পনা ও নির্মাণ শাস্ত্র)।[৩২] দক্ষিণ ভারতের মন্দির-নির্মাণ শাস্ত্রগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মানসর। এটি আনুমানিক খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে প্রচলিত হয়েছিল।[৫][৩৩] দক্ষিণ ও মধ্য ভারতে প্রচলিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃত মন্দির-নির্মাণ শাস্ত্র ঈশানশিবগুরুদেব পদ্ধতি খ্রিস্টীয় ৯ম শতাব্দীতে প্রচলিত হয়। এটিতে মন্দির নির্মাণ শিল্পের বর্ণনা পাওয়া যায়।[৩৪][৩৫] উত্তর ভারতে বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতা একটি জনপ্রিয় মন্দির-নির্মাণ শাস্ত্র। খ্রিস্টীয় ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে রচিত এই গ্রন্থে ‘নাগর’ শৈলীর মন্দিরের নকশা ও নির্মাণপদ্ধতির বর্ণনা পাওয়া যায়।[২৮][৩৬][৩৭]

 
কলিঙ্গ শৈলীর হিন্দু মন্দিরের বিভিন্ন উপাদান। হিন্দু মন্দির নির্মাণের বিভিন্ন শৈলী আছে। কিন্তু প্রত্যেকটি শৈলীই একটি সাধারণ জ্যামিতিক আদর্শ, ধারণার প্রতীকতত্ত্ব ও মূল ধর্মবিশ্বাসের অভিপ্রকাশের উপর ভিত্তিতে রচিত হয়েছে।[২]

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. George Michell (1988), The Hindu Temple: An Introduction to Its Meaning and Forms, University of Chicago Press, আইএসবিএন ৯৭৮-০২২৬৫৩২৩০১, Chapter 4, pp. 61-65.
  2. Stella Kramrisch, The Hindu Temple, Vol 1, Motilal Banarsidass, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-২০৮-০২২২-৩
  3. Stella Kramrisch, The Hindu Temple, Vol 2, Motilal Banarsidass, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-২০৮-০২২২-৩, pp. 346-357 and 423-424
  4. Klaus Klostermaier, The Divine Presence in Space and Time - Murti, Tirtha, Kala; in A Survey of Hinduism, আইএসবিএন ৯৭৮-০-৭৯১৪-৭০৮২-৪, State University of New York Press, pp. 268-277.
  5. Susan Lewandowski, The Hindu Temple in South India, in Buildings and Society: Essays on the Social Development of the Built Environment, Anthony D. King (Editor), আইএসবিএন ৯৭৮-০৭১০২০২৩৪৫, Routledge, Chapter 4
  6. MR Bhat (1996), Brhat Samhita of Varahamihira, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১২০৮১০৬০০, Motilal Banarsidass
  7. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; bstein নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  8. George Michell (1988), The Hindu Temple: An Introduction to Its Meaning and Forms, University of Chicago Press, আইএসবিএন ৯৭৮-০২২৬৫৩২৩০১, pp. 58-65.
  9. Alice Boner (1990), Principles of Composition in Hindu Sculpture: Cave Temple Period, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১২০৮০৭০৫১, see Introduction and pp. 36-37.
  10. Francis Ching et al., A Global History of Architecture, Wiley, আইএসবিএন ৯৭৮-০৪৭০৪০২৫৭৩, pp. 227-302.
  11. Brad Olsen (2004), Sacred Places Around the World: 108 Destinations, আইএসবিএন ৯৭৮-১৮৮৮৭২৯১০৮, pp. 117-119.
  12. Paul Younger, New Homelands: Hindu Communities, আইএসবিএন ৯৭৮-০১৯৫৩৯১৬৪০, Oxford University Press
  13. For the effect on Hindu temples of Islam’s arrival in South Asia and Southeast Asia, see:
  14. George Michell (1988), The Hindu Temple: An Introduction to Its Meaning and Forms, University of Chicago Press, আইএসবিএন ৯৭৮-০২২৬৫৩২৩০১, Chapter 1
  15. Alain Daniélou (2001), The Hindu Temple: Deification of Eroticism, Translated from French to English by Ken Hurry, আইএসবিএন ০-৮৯২৮১-৮৫৪-৯, pp. 101-127.
  16. Samuel Parker (2010), Ritual as a Mode of Production: Ethnoarchaeology and Creative Practice in Hindu Temple Arts, South Asian Studies, 26(1), pp. 31-57; Michael Rabe, Secret Yantras and Erotic Display for Hindu Temples, (Editor: David White), আইএসবিএন ৯৭৮-৮১২০৮১৭৭৮৪, Princeton University Readings in Religion (Motilal Banarsidass Publishers), Chapter 25, pp. 435-446.
  17. Pyong Gap Min, Religion and Maintenance of Ethnicity among Immigrants - A Comparison of Indian Hindus and Korean Protestants, Editor: Karen Leonard (Immigrant Faiths), আইএসবিএন ৯৭৮-০৭৫৯১০৮১৬৫, Chapter 6, pp. 102-103.
  18. Susan Lewandowski, The Hindu Temple in South India, in Buildings and Society: Essays on the Social Development of the Built Environment, Anthony D. King (Editor), আইএসবিএন ৯৭৮-০৭১০২০২৩৪৫, Routledge, pp. 71-73.
  19. Stella Kramrisch, The Hindu Temple, Vol 1, Motilal Banarsidass, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-২০৮-০২২২-৩, page 4
  20. Stella Kramrisch, The Hindu Temple, Vol 1, Motilal Banarsidass, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-২০৮-০২২২-৩, page 5-6
  21. BB Dutt (1925), গুগল বইয়ে Town planning in Ancient India, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৮২০৫-৪৮৭-৫; See critical review by LD Barnett, Bulletin of the School of Oriental and African Studies, Vol. 4, Issue 2, June 1926, pp. 391.
  22. Stella Kramrisch (1976), The Hindu Temple Volume 1 & 2, আইএসবিএন ৮১-২০৮-০২২৩-৩
  23. Jack Hebner (2010), Architecture of the Vastu Sastra - According to Sacred Science, in Science of the Sacred (Editor: David Osborn), আইএসবিএন ৯৭৮-০৫৫৭২৭৭২৪৭, pp. 85-92; N Lahiri (1996), Archaeological landscapes and textual images: a study of the sacred geography of late medieval Ballabgarh, World Archaeology, 28(2), pp. 244-264
  24. Susan Lewandowski (1984), Buildings and Society: Essays on the Social Development of the Built Environment, edited by Anthony D. King, Routledge, আইএসবিএন ৯৭৮-০৭১০২০২৩৪৫, Chapter 4
  25. Sherri Silverman (2007), Vastu: Transcendental Home Design in Harmony with Nature, Gibbs Smith, Utah, আইএসবিএন ৯৭৮-১৪২৩৬০১৩২৬
  26. G. D. Vasudev (2001), Vastu, Motilal Banarsidas, আইএসবিএন ৮১-২০৮-১৬০৫-৬, pp. 74-92.
  27. LD Barnett, Bulletin of the School of Oriental and African Studies, Vol 4, Issue 2, June 1926, pp. 391.
  28. Michael Meister (1983), Geometry and Measure in Indian Temple Plans: Rectangular Temples, Artibus Asiae, Vol. 44, No. 4, pp. 266-296,
  29. Alice Boner and Sadāśiva Rath Śarmā (1966), গুগল বইয়ে Silpa Prakasa Medieval Orissan Sanskrit Text on Temple Architecture, E.J. Brill (Netherlands)
  30. H. Daniel Smith (1963), Ed. Pāncarātra prasāda prasādhapam, A Pancaratra Text on Temple-Building, Syracuse: University of Rochester, ওসিএলসি ৬৮১৩৮৮৭৭
  31. Mahanti and Mahanty (1995 Reprint), Śilpa Ratnākara, Orissa Akademi, ওসিএলসি ৪২৭১৮২৭১
  32. Amita Sinha (1998), "Design of Settlements in the Vaastu Shastras", Journal of Cultural Geography, 17(2), pp. 27-41, ডিওআই:10.1080/08873639809478319
  33. Tillotson, G. H. R. (1997). "Svastika Mansion: A Silpa-Sastra in the 1930s". South Asian Studies, 13(1), pp. 87-97
  34. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; skramrisch1958 নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  35. Ganapati Sastri (1920), Īśānaśivagurudeva paddhati, Trivandrum Sanskrit Series, ওসিএলসি ৭১৮০১০৩৩
  36. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; hgood নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
  37. H, Kern (1865), The Brhat Sanhita of Varaha-mihara, The Asiatic Society of Bengal, Calcutta

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ সম্পাদনা