দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি
দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি কলকাতার অদূরে গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। ১৮৫৫ সালের ৩১মে স্নান যাত্রার দিন প্রসিদ্ধ মানব দরদি জমিদার রানি রাসমণি এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন।[১] এই মন্দিরে দেবী কালীকে "ভবতারিণী" নামে পূজা করা হয়।[১] ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট যোগী রামকৃষ্ণ পরমহংস এই মন্দিরে কালীসাধনা করতেন।
দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি | |
---|---|
ধর্ম | |
অন্তর্ভুক্তি | হিন্দুধর্ম |
অবস্থান | |
অবস্থান | দক্ষিণেশ্বর, কামারহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা জেলা |
স্থাপত্য | |
ধরন | নবরত্ন মন্দির, বঙ্গীয় স্থাপত্যশৈলী, গৌড়ীয় স্থাপত্য |
সৃষ্টিকারী | রানি রাসমণি |
কথিত আছে, রানি রাসমণি দেবী কালীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন।[১] মন্দির প্রতিষ্ঠাকালে রামকৃষ্ণ পরমহংসের দাদা রামকুমার চট্টোপাধ্যায় রানিকে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন। রামকুমারই ছিলেন মন্দিরের প্রথম প্রধান পুরোহিত।[১] ১৮৫৭-৫৮ সালে কিশোর রামকৃষ্ণ পরমহংস এই মন্দিরের পূজার ভার গ্রহণ করেন।[১] পরবর্তীকালে তিনি এই মন্দিরকেই তার সাধনক্ষেত্ররূপে বেছে নেন।
দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি চত্বরে কালীমন্দির ছাড়াও একাধিক দেবদেবীর মন্দির ও অন্যান্য ধর্মস্থল অবস্থিত। মূল মন্দিরটি নবরত্ন মন্দির। এটি টালিগঞ্জের বাবু রামনাথ মণ্ডল নির্মিত নবরত্ন মন্দিরের আদর্শে নির্মিত।[১] [২][৩] মূল মন্দির ছাড়াও রয়েছে "দ্বাদশ শিবমন্দির" নামে পরিচিত বারোটি আটচালা শিবমন্দির। মন্দিরের উত্তরে রয়েছে "শ্রীশ্রীরাধাকান্ত মন্দির" নামে পরিচিত রাধাকৃষ্ণ মন্দির এবং মন্দিরের দক্ষিণে রয়েছে নাটমন্দির।[১] মন্দির চত্বরের উত্তর-পশ্চিম কোণে রয়েছে রামকৃষ্ণ পরমহংসের বাসগৃহ।[১] মূল মন্দির চত্বরের বাইরে রামকৃষ্ণ পরমহংস ও তার পরিবারবর্গের স্মৃতিবিজড়িত আরও কয়েকটি স্থান রয়েছে, যা আজ পুণ্যার্থীদের কাছে ধর্মস্থানরূপে বিবেচিত হয়।
ইতিহাস
সম্পাদনা১৮৪৭ সালে ধনী বিধবা জমিদারনি রানি রাসমণি দেবী অন্নপূর্ণাকে পূজার মানসে কাশীতে তীর্থযাত্রার আয়োজন করেন। ২৪টি নৌকায় আত্মীয়স্বজন, দাসদাসী ও রসদ নিয়ে তিনি রওয়ানা হন। কিংবদন্তি অনুসারে যাত্রার পূর্বরাত্রে রানি দেবী কালীর স্বপ্নদর্শন পান। দেবী তাকে বলেন,[৪]
“ | কাশী যাওয়ার প্রয়োজন নেই। গঙ্গাতীরেই একটি নয়নাভিরাম মন্দিরে আমার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করে পূজা কর। সেই মূর্তিতে আবির্ভূত হয়েই আমি পূজা গ্রহণ করব। | ” |
এই স্বপ্নের পর রানি অবিলম্বে গঙ্গাতীরে জমি ক্রয় করেন এবং মন্দির নির্মাণকাজ শুরু করেন। ১৮৪৭ সালে এই বিরাট মন্দিরের নির্মাণকাজ শুরু হয়; শেষ হয় ১৮৫৫ সালে।
মন্দিরের ২০ একরের প্লটটি জন হেস্টি নামে এক ইংরেজের কাছ থেকে কেনা হয়। লোকমুখে জায়গাটি পরিচিত ছিল সাহেবান বাগিচা নামে। এর একটি অংশ ছিল কচ্ছপাকার মুসলমান গোরস্থান। তাই তন্ত্রমতে স্থানটি শক্তি উপাসনার জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়।[৫] আটবছরে নয় লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই মন্দির নির্মিত হয়। ১৮৫৫ সালের ৩১ মে স্নানযাত্রার দিন মহাসমারোহে মন্দিরে মূর্তিপ্রতিষ্ঠা করা হয়। পূর্বে মন্দিরের আরাধ্যাকে মাতা ভবতারিনি কালিকা নামে অভিহিত করা হয়েছিল। রামকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রধান পুরোহিত পদে বৃত হন, তার ছোটো ভাই গদাধর বা গদাই (পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ পরমহংস) তার সহযোগী হন। পরে তার ভাগনে হৃদয়ও তাকে সহায়তা করতে থাকেন।[৬]
পরের বছরই রামকুমার দেহরক্ষা করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের স্থলাভিষিক্ত হন। তার সহধর্মিনী সারদা দেবী মন্দির চত্বরের বাইরে নহবতখানায় অবস্থান করতে থাকেন। এই নহবতখানা এখন সারদা দেবীর মন্দির।
এই সময় থেকে ১৮৮৬ পর্যন্ত প্রায় তিরিশ বছর শ্রীরামকৃষ্ণ এই মন্দিরে অবস্থান করেন। তার অবস্থানের কারণে পরবর্তীকালে এই মন্দির পরিণত হয় একটি তীর্থক্ষেত্রে।
স্থাপত্য
সম্পাদনামন্দিরটি বঙ্গীয় স্থাপত্যশৈলীর বা গৌড়ীয় স্থাপত্যের নবরত্ন স্থাপত্যধারায় নির্মিত। মূল মন্দিরটি তিন তলা। উপরের দুটি তলে এর নয়টি চূড়া বণ্টিত হয়েছে। মন্দির দক্ষিণমুখী। একটি উত্তোলিত দালানের উপর গর্ভগৃহটি স্থাপিত। এই দালানটি ৪৬ বর্গফুট প্রসারিত ও ১০০ ফুট উঁচু।[৭]
গর্ভগৃহে (স্যাঙ্কটাম স্যাঙ্কটোরিয়াম) শিবের বক্ষোপরে ভবতারিণী নামে পরিচিত কালীমূর্তিটি প্রতিষ্ঠিত। এই মূর্তিদ্বয় একটি রুপোর সহস্রদল পদ্মের উপর স্থাপিত।
মূল মন্দিরের কাছে যে বারোটি একই প্রকার দেখতে পূর্বমুখী শিবমন্দির রয়েছে সেগুলি আটচালা স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত। গঙ্গার একটি ঘাটে দুই ধারে এই মন্দিরগুলি দণ্ডায়মান। মন্দির চত্বরের উত্তর-পূর্বে রয়েছে রাধাকান্ত মন্দির। এই মন্দিরে একটি রুপোর সিংহাসনে সাড়ে একুশ ইঞ্চির কৃষ্ণ ও ষোলো ইঞ্চির রাধামূর্তি প্রতিষ্ঠিত। এবং রানি রাসমণির গৃহদেবতা (রঘুুবীর, জনার্দন(কৃষ্ণ), নাড়ু- গোপাল) বর্তমানে দক্ষিণেশ্বরে অধিষ্ঠান করছেন।
চিত্রকক্ষ
সম্পাদনা-
মূল মন্দির
-
রামকৃষ্ণ পরমহংস ১৮৫৫ সালে এই মন্দিরে আসেন তার দাদা প্রধান পুরোহত রামকুমারের সহযোগীরূপে এবং রামকুমারের মৃত্যুর পর তিনি দাদার স্থলাভিষিক্ত হন
-
শিবমন্দির
-
শ্রীরামকৃষ্ণের বাসকক্ষের প্রবেশপথ
-
ডালা আর্কেড, এখানে পূজার ফুল বিক্রি হয়
-
মন্দিরের টেরাকোটা ছাদ
-
নহবতের দক্ষিণ ভাগ, এখানেই একতলার একটি ছোটো ঘরে থাকতেন সারদা দেবী
-
সারদা দেবীর ঘর, এখন মন্দির
আরও দেখুন
সম্পাদনা- কালী, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী।
- রামকৃষ্ণ মন্দির, বেলুড় মঠ, দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির অদূরে অবস্থিত রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান কার্যালয়।
- রামকৃষ্ণ পরমহংস, দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির প্রাক্তন পুরোহিত এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশিষ্ট হিন্দু ধর্মগুরু
- সারদা দেবী, রামকৃষ্ণ পরমহংসের পত্নী তথা রামকৃষ্ণ মিশনের সংঘজননী; ইনিও স্বামীর সঙ্গে দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে বাস করতেন।
- রানি রাসমণি, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের প্রতিষ্ঠাত্রী।
- চাণক অন্নপূর্ণা মন্দির, দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির আদলে নির্মিত টিটাগড়ের একটি অন্নপূর্ণা মন্দির।
টীকা
সম্পাদনা- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ ছ জ পশ্চিমবঙ্গের কালী ও কালীক্ষেত্র, দীপ্তিময় রায়, মণ্ডল বুক হাউস, কলকাতা, ১৪১৪ মুদ্রণ, পৃ. ১০৭-১৩
- ↑ "কংক্রিটের আড়ালে মুখ ঢেকেছে মন্দিরশিল্প"। www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-১৪।
- ↑ "রানিকাহিনি"। www.anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-১২।
- ↑ Rosen, Steven (২০০৬)। Essential Hinduism। Greenwood Publishing Group। পৃষ্ঠা 201–202।
- ↑ Prabhananda 2003
- ↑ Mehrotra 2008 p.11
- ↑ Dakshineswar Temple Banglapedia.
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- Prabhananda, Swami (২০০৩)। "The Kali Temple at Dakshineswar and Sri Ramakrishna"। Vedanta Kesari। ২০ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ মে ২০০৯।
- "Map of Kali Temple at Dakshineshwar"। ২০০৮-০৬-১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-১১-০৫।
- Harding, Elizabeth U. (১৯৯৮)। Kali: The Black Goddess of Dakshineswar। Motilal Banarsidass। আইএসবিএন 8120814509।
- Mehrotra, Rajiv (২০০৮)। Thakur: A Life Of Sri Ramakrishna। Penguin Books India। আইএসবিএন 0143063715।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি-এর সাথে সম্পর্কিত ভৌগোলিক উপাত্ত দেখুন – ওপেন স্ট্রিট ম্যাপ এ