ভিয়েতনাম
ভিয়েতনাম (ভিয়েতনামী: Việt Nam ভ়িয়েত্ নাম্) সরকারী নাম ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, ইন্দো চীন উপদ্বীপের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র। ভিয়েতনামের উত্তরে গণচীন, পশ্চিমে লাওস ও কম্বোডিয়া, দক্ষিণ ও পূর্বে দক্ষিণ চীন সাগর অবস্থিত। হ্যানয় ভিয়েতনামের রাজধানী। হো চি মিন সিটি হল বৃহত্তম শহর।
ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র Cộng hòa Xã hội chủ nghĩa Việt Nam | |
---|---|
নীতিবাক্য: Độc lập – Tự do – Hạnh phúc "Independence – Freedom – Happiness" | |
জাতীয় সঙ্গীত: Tiến Quân Ca "Army March" | |
![]() | |
রাজধানী | হ্যানয় |
বৃহত্তম নগরী | হো চি মিন সিটি |
সরকারি ভাষা | ভিয়েতনামী |
Official scripts | Vietnamese alphabet |
জাতীয়তাসূচক বিশেষণ | ভিয়েতনামী |
সরকার | মার্কসবাদী-লেনিনবাদী এক-দলীয় রাষ্ট্র |
গুয়েন সুয়ান ফুক | |
ফাম মিন চিন | |
গুয়েন ফু ত্রোং | |
Nguyễn Sinh Hùng | |
Trương Hòa Bình | |
আইন-সভা | National Assembly of Vietnam |
গঠন | |
৯৩৮ | |
২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ | |
২ জুলাই ১৯৭৬[১] | |
১৫ এপ্রিল ১৯৯২ | |
আয়তন | |
• মোট | ৩,৩১,২১০ কিমি২ (১,২৭,৮৮০ মা২) (৬৫তম) |
• পানি/জল (%) | ৬.৩৮ [২] |
জনসংখ্যা | |
• ২০১৯ আদমশুমারি | ৯৬,২০৮,৯৮৪ (১৫তম) |
• ঘনত্ব | ২৯০.৪৮ /কিমি২ (৭৫২.৩ /বর্গমাইল) (৪৬তম) |
জিডিপি (পিপিপি) | ২০১৯ আনুমানিক |
• মোট | $770.227billion[৩] (৩৫তম) |
• মাথাপিছু | $8,066[৪] (১২৮তম) |
জিডিপি (মনোনীত) | ২০১৯ আনুমানিক |
• মোট | $261.637 billion (৪৭ তম) |
• মাথাপিছু | $2740[৫] (১২৯ তম) |
জিনি (2008) | 38[৬] ত্রুটি: জিনি সহগের মান অকার্যকর |
মানব উন্নয়ন সূচক (2010) | ![]() ত্রুটি: মানব উন্নয়ন সূচক-এর মান অকার্যকর · 113th |
মুদ্রা | đồng (₫)[৮] (VND) |
সময় অঞ্চল | ইউটিসি+৭ (আইসিটি (ইন্দোচীন সময়) ইউটিসি+৭) |
• গ্রীষ্মকালীন (ডিএসটি) | ইউটিসি+৭ (No DST) |
গাড়ী চালনার দিক | ডান |
কলিং কোড | ৮৪ |
ইন্টারনেট টিএলডি | .vn |
![]() Map of Southeast Asia, showing Vietnam and its neighbors. | |
|
ভিয়েতনাম ভৌগোলিক ভাবে সরু ও দীর্ঘ। এর ভূমিরূপ বিচিত্র। উত্তর প্রান্তে ও মধ্যভাগের ভিয়েতনাম পাহাড়-পর্বতময়। উত্তরের উচ্চভূমিগুলি ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে পূর্বদিকের প্রশস্ত, নদীবহুল উপকূলীয় সমভূমির সঙ্গে মিশে গেছে। সমভূমিগুলিতে নিবিড় কৃষিকাজ হয় এবং বহু শতাব্দী ধরে ভিয়েতনামীয়রা এগুলিতে অনেক বাঁধ তৈরি করে ও খাল কেটে সেচকাজ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। মধ্য ভিয়েতনাম দেশের সবচেয়ে সরু অংশ; এখানে পর্বতগুলি সাগরপারের অনেক কাছে অবস্থিত, এমনকি কোন কোন জায়গায় এগুলি সাগরের একেবারে গা ঘেঁষে রয়েছে। দক্ষিণ ভিয়েতনাম মূলত মেকং নদীর অববাহিকা দ্বারা গঠিত প্রশস্ত এবং এই সমভূমি উর্বর। এখানে প্রচুর কৃষিকাজ হয় এবং মূলত ধান উৎপাদন করা হয় ।
ভিয়েতনাম একটি কৃষিভিত্তিক সমাজ হিসেবে গড়ে ওঠে। এখনও এখানকার অধিকাংশ লোক গ্রামে বাস করেন। ২০০৩ সালের হিসাব অনুযায়ী শহরে ২৬% লোকের বাস। তবে শহরমুখী জনসংখ্যার পরিমাণ ক্রমেই বাড়ছে, ফলে হো চি মিন সিটি, হানয় এবং অন্যান্য এলাকার জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
ভিয়েতনামে ৫৩টি ভিন্ন জাতিগত ও ভাষাগত গোষ্ঠী বসবাস করেন। তবে ভিয়েত বা ভিয়েতনামীয় জাতির লোকেরাই সর্বতোভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ভিয়েতনামীয় জাতির লোকেরা আদিতে লোহিত নদীর উপত্যকায় বাস করত। নদীটি দক্ষিণ চীনে উৎপত্তি লাভ করে উত্তর ভিয়েতনামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে টোনকিন উপসাগরে পতিত হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতকে চীন অঞ্চলটি দখল করে। ৯৩৯ সালে ভিয়েতনামীয়রা স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করে। পরবর্তী ১০০০ বছর ধরে ভিয়েতনাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি গতিশীল সভ্যতায় পরিণত হয় এবং উপকূল ধরে দক্ষিণ দিকে বিস্তার লাভ করতে থাকে।
১৯শ শতকের শেষ দিকে ফ্রান্স ভিয়েতনাম আক্রমণ করে। ফরাসিরা দেশটিকে তিনটি অঞ্চলে ভাগ করে দেয় এবং অঞ্চলগুলিকে কম্বোডিয়া ও লাওসের সাথে যুক্ত করে ইন্দোচীন ইউনিয়ন তথা ফরাসি ইন্দোচীন গঠন করে। ফরাসিরা নিজেদের সুবিধার জন্য ভিয়েতনামের সম্পদ আহরণ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর (১৯৩৯-১৯৪৫), ভিয়েতনামে উপনিবেশ বিরোধীরা সাম্যবাদী দলের নেতৃত্বে ফরাসি শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। ১৯৫৪ সালে দিয়েন বিয়েন ফু-তে ভিয়েতনামী সেনারা ফরাসি সেনাদের যুদ্ধে পরাজিত করে। এরপর ভিয়েতনামকে সাময়িকভাবে দুইটি অঞ্চলে ভাগ করা হয় --- উত্তর ও দক্ষিণ। উত্তর ভিয়েতনামে একটি সাম্যবাদী সরকার এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামে সাম্যবাদ বিরোধীরা শাসন করা শুরু করে। পরবর্তী ২০ বছর ধরে উত্তর ভিয়েতনামের নেতৃত্বে ভিয়েতনাম একত্রীকরণের একটি আন্দোলন শুরু হয় এবং দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় তাকে ব্যর্থ করে দেওয়ার চেষ্টা চালায়। ১৯৭৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সেনা সরিয়ে নেয় এবং দুই বছর পরে দক্ষিণ ভিয়েতনাম সাম্যবাদীদের করায়ত্ত করে। ১৯৭৬ সালে দুই ভিয়েতনামকে একত্রিত করে একটি সাম্যবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হয়, রাজধানী হয় হানয়। যদিও ভিয়েতনাম এখনও সাম্যবাদী শাসনের অধীন। বর্তমানে অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষ্যে বাজার অর্থনীতির বিভিন্ন দিক বাস্তবায়ন করা শুরু হয়েছে।
ইতিহাসসম্পাদনা
চীনা আধিপত্য ও প্রতিরোধসম্পাদনা
শত শত বছর ধরে চলা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ভিয়েতনামি জাতির জন্ম৷ খ্রীস্টপূর্ব ২২১ সালে চীনের ছিন রাজবংশ এই এলাকা দখল করে। ২১০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে ছিন রাজবংশের পতনের পর তাদের দক্ষিণাঞ্চলের সেনাপতি চাও থুও (ভিয়েতনামে ট্রিয়েউ দা নামে পরিচিত) সাম্রাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু এলাকা নিয়ে নাম ভিয়েত নামক নতুন রাজ্য গঠন করেন। পরবর্তীতে বর্তমান ভিয়েতনামের আরো এলাকা এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১১১ খ্রীস্টপূর্বাব্দে নাম ভিয়েত চীনা হান রাজবংশের দখলে চলে যায়। চৈনিক আধিপত্যের বিপক্ষে ভিয়েতনামিদের প্রতিরোধ বিক্ষিপ্তভাবে চলতে থাকে। অবশেষে ঙো কুইয়েনের নেতৃত্বে ৯৩৯ খ্রীস্টাব্দে তারা চীনাদের হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। নতুন রাজবংশের শুরু হয়। তবে অল্পদিনেই তাতে ভাঙ্গন ধরে। এরপর কিছুদিন গৃহযুদ্ধের পর ১০১০ সালে লি রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজ্যের নাম হয় দাই ভিয়েত। ১২২৫ সাল থেকে শুরু হয় ট্রান রাজবংশের শাসন। এই পুরো সময়টাতে তাদেরকে চীনের রাজাদের সাথে লড়তে হয়েছে। ত্রয়োদশ শতকে মঙ্গোলরা চীন দখল করে ইউয়ান রাজবংশের সূচনা করে, তারা ভিয়েতনামেও আক্রমণ চালায়, তবে সফল হয়নি। এদিকে দক্ষিণে অবস্থিত চাম্পা রাজ্য দখল করায় ভিয়েতনাম রাজ্যের পরিধি আরো বৃদ্ধি পায়। ১৪০৭ সালে চীনা মিং রাজবংশ ভিয়েতনাম দখল করে। তবে দুই দশকের মাঝে ভিয়েতনামিরা স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করে। শুরু হয় লে রাজবংশের শাসন। এটি প্রায় তিন শতক শাসন করে। তবে সপ্তদশ শতকে রাজ্যটি প্রশাসনিকভাবে কার্যত দুই ভাগ হয়ে যায়। এটি ইউরোপীয় শক্তির আধিপত্যবিস্তারকে সহজ করে দেয়।
ফ্রান্সের উপনিবেশসম্পাদনা
১৮৬০ সালে ইন্দোচায়না দখল করার পর থেকে ভিয়েতনাম দখল করার চেষ্টা চালাতে থাকে ফ্রান্স৷ এজন্য তাদের ৩০ বছর অপেক্ষা করতে হয়৷ ফ্রান্সের শাসন আমলে ১৯০০ সালের কাছাকাছি সময়ে ভিয়েতনাম উত্তরে টঙ্কিন, মধ্যাঞ্চলে আন্নাম ও দক্ষিণে কোচিন চায়না নামে তিন ভাগে ভেঙে যায়৷ এরপর আবার ধীরে ধীরে ভিয়েতনামিরা সংগঠিত হতে থাকে৷ ১৯২৯ সালে ভিয়েতনামে বেশ কিছু মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী পার্টির উদ্ভব হয়৷ পরের বছরই তারা হো চি মিঙের নেতৃত্বে ইন্দোচায়না কমিউনিস্ট পার্টি নামে একত্রিত হয়৷ পরবর্তীকালে দলটি তিন ভাগে ভেঙে আলাদা আলাদাভাবে লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামে কাজ চালিয়ে যেতে থাকে৷ ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত দলটি ভিয়েতনামে শ্রমিক পার্টি নামে পরিচিত হলেও পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টি অফ ভিয়েতনাম (সিপিভি) নাম ধারণ করে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভিয়েতনামি কমিউনিস্টরা জাপানিদের প্রতিরোধ করতে মিত্রশক্তিকে সহযোগিতা করে৷ ১৯৪১ সালে হো চি মিং ভিয়েত মিং বা স্বাধীনতা লীগ প্রতিষ্ঠা করেন৷ লক্ষ করুন ভিয়েতনাম ও ভিয়েত মিঙের অর্থ আলাদা৷ বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয়ের পর দেশটিতে ভিয়েত মিং ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে৷ তাদের একটি শক্তিশালী সেনাবাহিনী ছিল৷ ১৯৪৫ সালের আগস্টে ভিয়েতনামে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়৷ এর দুই সপ্তাহ পর হ্যানয় দখলকারী বিদ্রোহীরা ভিয়েতনামের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রচার করে৷ পাশাপাশি তারা ভিয়েতনামকে প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করে৷ রাজা বাও দাই পদত্যাগ করতে বাধ্য হন৷ তাকে নতুন শাসন ব্যবস্থার উপদেষ্টার পদ গ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হয়৷ ১৯৪৬ সালের মার্চে ভিয়েতনাম সরকারকে ফ্রান্স স্বীকৃতি দেয় এবং ফরাসি ইউনিয়নের অধীনে ভিয়েতনামকে মুক্ত দেশ হিসেবে মেনে নেয়৷ আর জুনে ফ্রান্স সাবেক রাজা বাও দাইকে রাষ্ট্রের প্রধান ঘোষণা করে৷ ভিয়েত মিং তখন গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে৷ দীর্ঘ নয় বছর যুদ্ধ করার পর ১৯৫৪ সালে দিয়েন বিয়েন ফু সামরিক ঘাঁটিতে ফরাসি বাহিনীকে পরাজিত করে ভিয়েত মিং চূড়ান্তভাবে বিজয়ী হয়৷
ভিয়েতনাম যুদ্ধসম্পাদনা
১৯৬০ সালে ডেমক্রেটিক, সোশ্যালিস্ট ও মার্কসবাদীরা আইনজীবী নুয়েন হু তো-এর নেতৃত্বে ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টে (এনএলএফ) একত্রিত হয়৷ সে সময়ই সায়গনের সামরিক সরকার ও আমেরিকার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয়৷ সায়গনে প্রথম সেনা ও উপদেষ্টা আমেরিকাই পাঠিয়েছিল৷ ১৯৬৯ সালে সায়গনে আমেরিকার ৫ লাখ ৮০ হাজার সেনা ছিল৷ ভিয়েতনামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও বেশি বোমা ফেলা হয়৷ আমেরিকা সেখানে পরীক্ষামূলক রাসায়নিক বোমাও ফেলেছিল৷ ১৯৬৯ সালেই হো চি মিন মারা যান৷ ১৫ বছরব্যাপী যুদ্ধে আমেরিকা ১৫০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে৷ আর ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলের ৭০ ভাগ গ্রাম একদম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয় হয়৷ তড়িঘড়ি করে আমেরিকান সৈন্যদের ভিয়েতনাম ছেড়ে যেতে হয়৷ ১৯৭৫ সালের এপ্রিলে এনএলএফ (ভিয়েতকং) সায়গনের নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করে৷ আর এর নাম বদলে তাদের প্রয়াত নেতার নাম অনুসারে হো চি মিন সিটি রাখা হয়৷ ১৯৭৬ সালের ২ জুলাই সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক অফ ভিয়েতনাম নামে পুরো অঞ্চলটির পুনএকত্রীকরণ ঘটে৷
একত্রীকরণ পরবর্তী ভিয়েতনামসম্পাদনা
শান্তি ভিয়েতনামে দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি৷ ১৯৭৯ সালের জানুয়ারিতে তারা পল পটের কাম্বোডিয়া সরকারের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে৷ পরবর্তীকালে পল পটকে সরিয়ে দিয়ে ভিয়েতনামপন্থী হেঙ্গ সামরিন কাম্বোডিয়ার ক্ষমতা দখল করলে চায়নিজ জনগণকে ভিয়েতনামিকরণ ক্যামপেইনের হাত থেকে বাঁচাতে ভিয়েতনামের উত্তরাঞ্চলে চীন হামলা চালায়৷ আর ১৯৮১ সালে প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান ভিয়েতনামে সাহায্য প্রদানে জাতিসংঘকে বাধা দেন৷ ১৯৮৫ সালের পরে হ্যানয় কয়েকজন রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেয়৷ পাশাপাশি আসিয়ান ও আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে সবরকম প্রচেষ্টা চালাতে থাকে৷ ১৯৮৬ সালে সিপিভির সাধারণ সম্পাদক লি ডুয়ান মারা যান৷ ভিয়েতনাম কংগ্রেস নুয়েন ভ্যান লিন-কে নতুন সম্পাদক মনোনীত করে৷ আশির দশকে ইওরোপের রাজনৈতিক কালচারের পরিবর্তন শুরু হলে ভিয়েতনামেও তার ঢেউ লাগে৷ পরিণতিতে দেশটিতে বহুদলীয় সংসদীয় ব্যবস্থার দাবি উঠতে থাকে৷ ১৯৮৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে নন-কমিউনিস্ট প্রার্থীরাও অংশ নেন৷ সে বছরই হং কংয়ে আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার ভিয়েতনামিজ উদ্বাস্তুকে বৃটেন বের করে দেয়৷ ১৯৯১ সালে সিপিভি সোশ্যালিজমের প্রতি তাদের দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে৷ একই বছরেই সিপিভির নতুন সাধারণ সম্পাদক হন দু মুয়োই৷ সভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পরও সিপিভি একদলীয় ব্যবস্থাকে ধরে রাখতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে৷ তবে শর্ত সাপেক্ষ বেসরকারি উদ্যোগ ও বৈদেশিক বিনিয়োগসহ সামগ্রিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়৷ ১৯৯১ সালের অক্টোবরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে প্যারিসে এক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে কাম্বোডিয়ার সঙ্গে ভিয়েতনামের চলমান অচলাবস্থার নিরসন হয়৷ চুক্তিটি চায়নার সঙ্গেও ভিয়েতনামের সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে কাজ করে৷ আর নভেম্বরে বৃটেন ৬৪ হাজার ভিয়েতনামিজ উদ্বাস্তুকে হং কংয়ের ক্যাম্পগুলোতে আবারো ফিরিয়ে নেয়৷ ১৯৯২ সালের নতুন সংবিধান স্বতন্ত্র প্রার্থীদেরও নির্বাচনে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেয়৷ তারপরও জুলাই নির্বাচনে দাঁড়ানো ৯০ ভাগ প্রার্থীই ছিলেন সিপিভি সদস্য৷ আর সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী ভো ভ্যান কিয়েট-এর সহযোগী জেনারেল লি দুক আন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার নেন৷ ১৯৯২ সালে বেসরকারিকরণ এবং বৈদেশিক বিনিয়োগের স্বাধীনতার কারণে ভিয়েতনামের জিডিপির প্রবৃদ্ধি এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৮.৩ ভাগে৷ সে সময় প্রচুর ধান উত্পাদনের কারণে দেশটির দক্ষিণাঞ্চল দারুণভাবে লাভবান হতে থাকে৷ আর পঞ্চাশ লাখ জনঅধ্যুষিত হো চি মিন সিটি দেশের অর্থনৈতিক রাজধানীতে পরিণত হওয়ার পাশাপাশি দেশের উত্তরাঞ্চলের কাছে এক নতুন উদাহরণ সৃষ্টি করে৷ নব্বই দশকের মধ্যভাগে বিশ্ব ব্যাংক ও এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে ভিয়েতনামের বেশির ভাগ এলাকায় টেলিযোগাযোগ, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং বৈদ্যুতিক খাতের সংস্কার করা হয়৷ আর ১৯৯৫ সালে আমেরিকার সঙ্গে ভিয়েতনামের কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়৷ ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে ট্রান দাক লুয়োং ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট এবং ফ্যান ভ্যান খাই প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন৷ আর ডিসেম্বরে সিপিভির শীর্ষ তিনটি পদে পরিবর্তন আনা হয়৷ ১৯৯৮ সালের এপ্রিলের অনাবৃষ্টিতে ভিয়েতনামের ২ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর চা বাগানের মধ্যে ৭ হাজার হেক্টর চা বাগান সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যায়৷ এতে দেশটির রফতানি খাত বড় ধরনের ধাক্কা খায়৷ পাশাপাশি নানা আঞ্চলিক সমস্যার কারণে দেশটির অর্থনীতিতে মন্দাভাব দেখা দেয়৷ জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৮ ভাগ থেকে ৬ দশমিক ১ ভাগে নেমে আসে৷ বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণও ৭০ ভাগ কমে যায়৷ আর সেপ্টেম্বরে ভিয়েতনাম এশিয়া-প্যাসিফিক ইকনমিক কো-অপারেশন (এপেক)-এর পূর্ণ সদস্য পদ পায়৷ ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে আট বছর ধরে চলা দেন-দরবারের পর চায়নার সঙ্গে ভিয়েতনামের সীমান্ত-চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ টাইফুন ও অতিবৃষ্টির কারণে ১৯৯৯ সালে ভিয়েতনামে ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়৷ পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো দেশটির বনাঞ্চল নিির্বচারে উজাড় হয়ে যাওয়াকেই এর প্রধানতম কারণ বলে দাবি করে৷ সে সময় ভিয়েতনামের সর্বত্র দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে৷ এক পর্যায়ে সিপিভি সংশ্লিষ্ট তিনজন শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে৷ পরিস্থিতি এতোটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করে যে, ১৯৯৯ সালে সিপিভি দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী নো জুয়ান লক-এর পদত্যাগ দাবি করে৷ ২০০০ সালে সিপিভি পলিটব্যুরো স্বীকার করে নেয় যে, দলটির সদস্যরা নানাভাবে দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেছে৷ আর এজন্য দলের পদাধিকারীরাও সমান দায়ী৷ দুর্নীতি কমাতে স্বায়ত্তশাসিত পর্যবেক্ষক কমিটি গঠন করার পাশাপাশি দলীয় নেতাদের সম্পত্তির বিবরণ দেয়ার নিয়ম বাধ্যতামূলক করা হয়৷ ২০০০ সালের নভেম্বরে ভিয়েতনাম সফরে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় দেশটিতে অবিস্ফোরিত বিস্ফোরকসমূহ ধ্বংস করার জন্য সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন৷ আর ২০০১ সালের এপ্রিলে সিপিভির নতুন সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন নোং দাক মান৷ ২০০২ সালের মে মাসে রাশিয়া ক্যাম রান উপসাগর থেকে তাদের নৌঘাঁটি প্রত্যাহার করে নেয়৷ আর জুলাইতে ট্রান দাক লুয়োং প্রেসিডেন্ট এবং ফ্যান ভ্যান খাই দেশটির প্রধানমন্ত্রী পদে পুনির্নর্বাচিত হন৷ ২০০৩ সালের জুনে হো চিন মিন সিটির শীর্ষ ছয় অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়৷ আর ২০০৪ সালে দেশটিতে বার্ড ফ্লু-এর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়৷ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দেশটিতে ১৬ জন মারা যায়৷
রাজনীতিসম্পাদনা
ভিয়েতনাম কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত একটি একদলীয় সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র। ১৯৪৫ সালের ২রা সেপ্টেম্বর দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। দেশের সর্বশেষ সংবিধান ১৯৯২ সালের ১৫ই এপ্রিল প্রণীত হয়। ভিয়েতনামের সরকার ব্যবস্থা তিনটি বিভাগ নিয়ে গঠিত। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাহী বিভাগের দায়িত্বে আছেন। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান এবং জাতীয় প্রতিরক্ষা ও সুরক্ষা কাউন্সিলের প্রধান। প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভা ও অন্যান্য কমিশনের প্রধান। জাতীয় সংসদের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ন্যস্ত। বিচার বিভাগ সুপ্রিম কোর্ট এবং অন্যান্য আদালত নিয়ে গঠিত। ভিয়েতনামের সংবিধান অনুসারে কেবল একটিই রাজনৈতিক দল স্বীকৃত এবং বৈধ, যার নাম ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট পার্টি। এর সদস্যসংখ্যা ৩০ লক্ষেরও বেশি। এটি অতীতে ভিয়েতনাম শ্রমিক দল নামে পরিচিত ছিল, যা আবার ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্দোচীন কমিউনিস্ট পার্টিরই বিবর্তিত রূপ। ভিয়েতনামে ভোটাধিকারের বয়স ১৮; নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই ভোট দিতে পারে।
প্রশাসনিক অঞ্চলসমূহসম্পাদনা
ভিয়েতনাম ৫৮টি প্রদেশ এবং ৫টি মিউনিসিপাল শহর নিয়ে গঠিত। মিউনিসিপালিটিগুলি হল কান থাও, হাইফং, দা নাং, হানয় এবং হো চি মিন শহর।
ভূগোলসম্পাদনা
ভিয়েতনাম দেশটির আকৃতি অনেকটা ইংরেজি এস (s) অক্ষরের মত। এটি উত্তরে চীনের সীমান্ত থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণে থাইল্যান্ড উপসাগর পর্যন্ত উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৫০০ কিলোমিটার বিস্তৃত। দেশের সবচেয়ে সরু অংশ দা নাং বন্দর শহরের ঠিক উত্তরে অবস্থিত; এখানে পূর্বের সাগর থেকে পশ্চিমের সীমান্তের দূরত্ব মাত্র ৫০ কিলোমিটার। ভিয়েতনামের মোট আয়তন ৩,৩১,৬৯০ বর্গকিলোমিটার। হানয় শহর ভিয়েতনামের রাজধানী। এখানে ৬২ লক্ষেরও বেশি লোক বাস করে। ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে শহরের সীমানা বাড়িয়ে পার্শ্ববর্তী হা তাই প্রদেশের পুরোটা এবং হোয়া বিনহ এবং ভিং ফুক প্রদেশের কিছু অংশ হানয়ের অংশ করে নেওয়া হয়। ভিয়েতনামের অন্যান্য শহরের মধ্যে হো চি মিন শহর (প্রাক্তন সাইগন শহর) সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য; এর জনসংখ্যাও ৬২ লক্ষের বেশি। হাইফং শহরে ১৭ লক্ষ লোক, দানাং শহরে ৮ লক্ষ লোক এবং কান থাও শহরে ১১ লক্ষ লোকের বাস।
ভৌগোলিক অঞ্চলসম্পাদনা
ভিয়েতনাম চারটি প্রধান ভৌগোলিক অঞ্চল নিয়ে গঠিত। উত্তরতম অঞ্চলটি মূলত ঘন অরণ্যাবৃত রুক্ষ পর্বতমালার এক জটপাকানো অঞ্চল; এটি গণচীনের ইউনান মালভূমি থেকে ভিয়েতনামে প্রসারিত হয়েছে। ভিয়েতনামে এই পর্বতগুলির মধ্য সর্বোচ্চটির নাম ফান সি পান; ৩,১৪৩ মিটার উচ্চতার ফান সি পান ভিয়েতনামের সর্বোচ্চ বিন্দু।
উত্তরের পার্বত্য উচ্চভূমির পূর্বে ও দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে লোহিত নদীর অববাহিকা; এটি মূলত একটি ত্রিভুজাকৃতির পলিময় সমভূমি যা দক্ষিণ চীন সাগরের একটি বাহু টংকিন উপসাগরের তীরে অবস্থিত।
লোহিত নদীর ব-দ্বীপের দক্ষিণেই রয়েছে ট্রুওং সন উচ্চভূমি, যা ভিয়েতনামের ঊর্ধ্ব-মধ্যভাগ বা "মেরুদণ্ড" গঠন করেছে। একই এলাকায় আরও আছে কেন্দ্রীয় উচ্চভূমি, যা মূলত ক্যাম্বোডিয়া সীমান্ত এবং দক্ষিণ চীন সাগরের মধ্যস্থলে অবস্থিত একটি বিশাল মালভূমি।
ভিয়েতনামের চতুর্থ এবং দক্ষিণতম অঞ্চলটি হল মেকং নদীর ব-দ্বীপ। জলাময় ও উর্বর এই সমতল ভূমিটি কেন্দ্রীয় উচ্চভূমির দক্ষিণ প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে দক্ষিণের কা মাউ উপদ্বীপের ম্যানগ্রোভ জলাভূমিগুলি পর্যন্ত বিস্তৃত।
ভিয়েতনামের দুইটি প্রধান নদী হল উত্তরের লোহিত নদী এবং দক্ষিণের মেকং নদী। দুইটি নদীই সম্পূর্ণ নাব্য। লোহিত নদী দক্ষিণ চীন থেকে উৎপত্তি লাভ করে দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হয়ে ভিয়েতনামের উত্তর-পশ্চিমের পার্বত্য উচ্চভূমিতে প্রবেশ করে সাগরে পতিত হয়েছে। অন্য দিকে মেকং নদী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে একটি অনিয়মিত গতিপথে প্রবাহিত হয়ে ভিয়েতনামে প্রবেশ করে দক্ষিণ চীন সাগরে পড়েছে।
অতীতে মেকং ব-দ্বীপ অববাহিকাতে চাষাবাদ বেশ কষ্টসাধ্য ছিল, কেন না দক্ষিণ চীন সাগরের লবণাক্ত পানি প্রায়ই নিম্নভূমিগুলিকে প্লাবিত করত। এই সমস্যা প্রতিরোধ করতে ফরাসিরা ২০শ শতকে এখানে বাঁধ নির্মাণ করে। বর্তমানে বাঁধ ও খালের এক জটিল ব্যবস্থার মাধ্যমে মেকং ও লোহিত নদীর ব-দ্বীপগুলিতে প্লাবন নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
ভিয়েতনামের অন্যান্য প্রধান নদীর মধ্যে হুয়ে শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া হুওং নদী এবং ভিনহ শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয় কা লং ও নদী উল্লেখযোগ্য।
ভিয়েতনামের সমুদ্র তটরেখা উত্তরে চীন সীমান্ত থেকে দক্ষিণে থাইল্যান্ড উপসাগরে ক্যাম্বোডিয়ার সাথে সীমান্ত পর্যন্ত ৩,৪৪৪ কিলোমিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে কিছু এলাকায়, যেমন কেন্দ্রীয় উচ্চভূমির পূর্বে এবং লোহিত নদীর ব-দ্বীপের উত্তরে পর্বতমালা সাগরের একেবারে তীর ঘেঁষে উঠে গেছে। এর ফলে জাহাজ পরিবহনের জন্য অনুকূল বেশ কিছু সুরক্ষিত প্রাকৃতিক পোতাশ্রয় সৃষ্টি হয়েছে; এদের মধ্যে দা নাং, কুই ন্হোন এবং ন্হা ট্রাং বন্দর শহরগুলি উল্লেখযোগ্য। পর্বতগুলি উপকূল এলাকায় সুন্দর পটভূমির সৃষ্টি করেছে এবং এ কারণে দা নাং ও ন্হা ট্রাং ভিয়েতনামের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলির অন্যতম। বাকী তটভূমিগুলি মূলত নদীর বয়ে নিয়ে আসা পলি নিয়ে গঠিত সমতল, ত্রিভুজাকৃতির ব-দ্বীপ।
জলবায়ুসম্পাদনা
ভিয়েতনামের জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র। মধ্য ও দক্ষিণ ভিয়েতনামে ঋতুভেদে জলবায়ুর পরিবর্তন সামান্য এবং এখানে মূলত শুষ্ক ও বর্ষা এই দুই ধরনের ঋতু বিদ্যমান। মেকং অববাহিকায় জানুয়ারিতে তাপমাত্রা ১৭-৩৪ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং জুলাই মাসে ২২-৩৩ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। মধ্যভাগের উপকূলে তাপমাত্রা জানুয়ারিতে ১৮-২৮ ডিগ্রী এবং জুলাইতে ২৪-৩৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস। উত্তরের সমভূমিতে ঋতুভেদে জলবায়ুর পার্থক্য অনেক বেশি এবং রাতের তাপমাত্রা অনেক কম থাকে; এখানে জানুয়ারি মাসে তাপমাত্রা ২০ ডিগ্রী বা তার নিচে থাকে এবং জুলাইতে তাপমাত্রা ২৫-ঊর্ধ্ব ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস হতে পারে।
সারা ভিয়েতনামেই প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। দক্ষিণ ও মধ্য ভিয়েতনামে মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে গ্রীষ্মকালীন সময়ে বৃষ্টিপাত হয়। মেকং অববাহিকাতে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দীর্ঘ সময় ধরে বৃষ্টিপাত হয়। মধ্য ভিয়েতনামে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়। উত্তর ভিয়েতনামেও প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। মধ্যভাগের উপকূলে মাঝে মাঝে টাইফুন আঘাত হানে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এগুলি বহু প্রাণহানি ও আবাদী জমির ক্ষয়ক্ষতির কারণ হয়েছে।
অর্থনীতিসম্পাদনা
চীনা ও ভিয়েতনামীয় রাজতন্ত্রের সময় ভিয়েতনামের সমাজ ছিল কৃষিভিত্তিক। ধান ছিল এর প্রধান উৎপন্ন কৃষিদ্রব্য। ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসনের সময় কৃষির আধিপত্য বজায় থাকলেও সাধারণ চাষাবাদের চেয়ে কৃষিদ্রব্য রপ্তানির উপর জোর দেওয়া হয়। ফলে ধানের পাশাপাশি কফি, চা, রবার এবং অন্যান্য ক্রান্তীয় শস্য উৎপাদন শুরু হয়। বড় শহরগুলিতে ক্ষুদ্র শিল্প ও বাণিজ্য খাতের বিকাশ ঘটে কিন্তু ফ্রান্সের সাথে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হবে বলে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসকেরা এগুলিকে তেমন উৎসাহিত করেননি।
১৯৫৪ সালের দেশ বিভাগের পর উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের সরকার নিজ নিজ অর্থনীতি বিকাশে আলাদাভাবে মনোযোগ দেয়। তারা পৃথক অর্থনৈতিক সম্পদের উপর ভিত্তি করে পৃথক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও বাণিজ্য অংশীদার নিয়ে যাত্রা শুরু করে। উত্তর ভিয়েতনামে অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত ও পরিকল্পিত অর্থনীতি বিরাজমান ছিল। অন্যদিকে দক্ষিণ ভিয়েতনামে মুক্ত বাজার অর্থনীতিকে উৎসাহ দেওয়া হয়। ১৯৭৬ সালে দুই ভিয়েতনাম একত্রিত হবার পর উত্তর ভিয়েতনাম ধীরে ধীরে তার পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গোটা ভিয়েতনামের উপর প্রয়োগ করে। ১৯৮৬ সালে অবশ্য সরকার একটি সংস্কার প্রকল্প হাতে নেয়, যার ফলে দেশটি একটি মিশ্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে ভিয়েতনামে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটতে শুরু করে। ১৯৯০-এর দশকে ভিয়েতনামের বার্ষিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭% হারে বৃদ্ধি পায়। অব্যাহত প্রবৃদ্ধির ফলে ২০০৮ সাল নাগাদ ভিয়েতনামের স্থূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দাঁড়ায় ৭০ বিলিয়ন ডলার। মাথাপিছু আয় ৩৫০০ ডলারের মত। সেবাখাত (৩৮%) ও শিল্পখাত (৪২%) প্রধান দুই অর্থনৈতিক খাত। তবে দেশের প্রায় ৫৭% শ্রমিক এখনও কৃষিজীবী।
জনপরিসংখ্যানসম্পাদনা
ভিয়েতনামীয় ভাষা ভিয়েতনামের সরকারি ভাষা। এছাড়াও ভিয়েতনামে আরও প্রায় ৭০টি ভাষা প্রচলিত। এদের মধ্যে তাই ভাষার বিভিন্ন উপভাষাতে ১০ লক্ষাধিক ব্যক্তি কথা বলেন। খমের ভাষা এবং মুওং ভাষা-তে আরও প্রায় ১০ লক্ষ করে লোক কথা বলেন। চীনা ভাষার ইউয়ে উপভাষাতে প্রায় ৫ লক্ষ লোক কথা বলেন। আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডে ফরাসি ভাষা ব্যবহার করা হয়।
ধর্মবিশ্বাসসম্পাদনা
ভিয়েতনামের সবচেয়ে প্রাচীন তিনটি ধর্ম হল মহায়ন,বৌদ্ধধর্ম, কনফুসিয়াসবাদ এবং দাওবাদ। এগুলি ভিয়েতনামে ত্রিধর্ম তথা tam giáo নামে পরিচিত। এছাড়াও এখানে রোমান ক্যাথলিক ধারার খ্রিস্টধর্ম, কাও দাই, হোয়াও হো ধর্মের উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আছে। সাম্প্রতিক শতকগুলিতে ভিয়েতনামে প্রোটেস্টান্ট ধারার খ্রিস্টধর্ম, ইসলাম, হিন্দুধর্ম এবং থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম প্রচলিত হয়।
ভিয়েতনামের বেশিরভাগ মানুষ নিজেদেরকে ধার্মিক দাবী করে না, তবে অনেকেই প্রতি বছর বেশ কয়েকবার ধর্মীয় মন্দিরগুলিতে যায়। ভিয়েতনামীয়দের আচার ও রীতিনীতিতে বিভিন্ন ধর্মের মিশ্রণ ঘটেছে; এদের মধ্যে উপরোল্লিখিত তিনটি প্রধান ধর্মের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। এই তিনটি ধর্ম বহু শতক ধরে ভিয়েতনামে সহাবস্থান করে আসছে।
পরিবহন ব্যবস্থাসম্পাদনা
অনুন্নত পরিবহন ব্যবস্থা বহুদিন ধরে ভিয়েতনামের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি বড় বাধা। যদিও ভিয়েতনামের সড়কব্যবস্থা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক ভাল, পরিবহনকারী যানবাহনগুলি অতি সাম্প্রতিক সময় পর্যন্তও অনেক পুরনো ছিল। এগুলি বেশির ভাগই ছিল ১৯৫০-এর দশকে নির্মিত সোভিয়েত ট্রাক। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় রেলব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি হয় এবং তহবিলের অভাবে এটিকে ঠিকমত মেরামত বা সম্প্রসারণ করা যায়নি। ১৯৯০-এর দশকের শেষ দিকে ভিয়েতনাম সরকার দেশের ট্রাকব্যবস্থা ও রেলব্যবস্থা আধুনিকীকরণ করার কাজ হাতে নেয়। তবে এখনও দেশের বেশির ভাগ পণ্য নদী ও খালপথে বার্জের মাধ্যমে পরিবহন করা হয়।
আন্তর্জাতিক পরিবহনের জন্য বন্দরগুলির মধ্যে হাইফং, দা নং, এবং হো চি মিন শহর উল্লেখযোগ্য। তবে এগুলির প্রায় সবগুলিতেই আধুনিক সরঞ্জামের অভাব রয়েছে।
বর্তমানে ভিয়েতনামে মোট ২,৬৫২ কিমি দীর্ঘ রেলপথ ও ১৭,২৯৫ কিমি দীর্ঘ জাতীয় সড়কপথ আছে। ১৭টি বেসামরিক বিমানবন্দর আছে, যার মধ্যে ৩টি আন্তর্জাতিক।
সংস্কৃতিসম্পাদনা
বিয়ে ও পরিবারসম্পাদনা
ঐতিহ্যগতভাবে বাবা-মারা সন্তানের বিয়ে ঠিক করতেন, কিন্তু এখন লোকেরা নিজেরাই বিয়ের আয়োজন করে। গড়ে পুরুষের ২৫ বছর বয়সে এবং মহিলারা ২৩ বছর বয়সে বিয়ে করে। সরকার পরিবার-পরিকল্পনা নীতির মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে এবং দেরীতে বিয়ে ও ছোট পরিবারের জন্য ভর্তুকি প্রদান করছে।
ভিয়েতনামে পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় হয় এবং পরিবারের সদস্যরা একে অপরকে সাহায্য করে। গ্রামীণ এলাকায় একান্নবর্তী পরিবার একই বাড়িতে বাস করে। অন্যদিকে শহরাঞ্চলে ছোট পরিবার আলাদাভাবে বাস করে। গড়ে প্রতি পরিবারে সদস্যসংখ্যা ৬।
খাদ্যাভ্যাসসম্পাদনা
ভাত ভিয়েতনামীয়দের প্রধান খাদ্য। ভাতের সাথে এক ধরনের মাছের গাঁজানো সুরুয়া, যার নাম nuoc mam, ব্যবহার করা হয়। একই সুরুয়াতে অন্যান্য বিশেষ খাবার ডুবিয়ে খাওয়া হয়। আঞ্চলিক খাবার দাবারও সুপ্রচলিত।
ভিয়েতনামীয়রা সুপ জাতীয় খাবার খেতে চামচ ব্যবহার করে এবং অন্যান্য খাবারের জন্য চপস্টিক্স ব্যবহার করে। সাধারণত টেবিলের মাঝখানে খাবার দেয়া থাকে এবং সেখান থেকে লোকেরা নিজের নিজের ভাতের বাটিতে খাবার নিয়ে নেয়। ভিয়েতনামীয়রা খাবার সময় সবসময় ভাতের বাটি এক হাতে ধরে রাখে। পানীয়ের মধ্যে চা, কফি ও বিয়ার জনপ্রিয়, তবে এগুলি খাবারের পরে পরিবেশন করা হয়।
সামাজিকীকরণসম্পাদনা
ভিয়েতনামীয়রা সাধারণত সাক্ষাত ও বিদায়ের সময় করমর্দন করে থাকে। সম্মান দেখানোর জন্য করমর্দনে দুই হাত ব্যবহার এবং মাথা সামান্য ঝোঁকানোর রেওয়াজ আছে। গ্রামীণ এলাকায় বৃদ্ধ লোকেদের সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান দেখানো হয়। মহিলারা সাধারণত করমর্দনের চেয়ে মাথা ঝোঁকাতে বেশি পছন্দ করে।
ভিয়েতনামীয়দের নাম পারিবারিক নাম দিয়ে শুরু হয় এবং প্রদত্ত নামে শেষ হয়। লোকে একে অপরকে প্রদত্ত নামে ডেকে থাকে। তবে এর সাথে অনেক সময় পারিবারিক বা বয়সে ছোট-বড় বোঝাতে বিভিন্ন শিরোনাম, যেমন "বড় ভাই/দা" ইত্যাদি জাতীয় শিরোনাম যোগ করা হয়। ভিয়েতনামীয়রা একে অপরকে Xin chao বলে প্রাথমিক সম্ভাষণ জানিয়ে থাকে, যা বাংলায় সালাম-আদাব বা নমস্কারের মত।
ভিয়েতনামীরা অতিথিপরায়ণ এবং অতিথিদের আসার আগে প্রস্তুতি নিতে পছন্দ করে। তাই নিমন্ত্রণ ছাড়া ভিয়েতনামী কারও বাসায় যাওয়া সাধারণত শোভন নয়। ভিয়েতনামীরা উপহার পেতে অপছন্দ করে না। ফুল, ধূপ বা চা সাধারণ উপহার হিসেবে প্রচলিত। ছোট ছেলেমেয়ে বা প্রবীণদের জন্যও ছোট উপহার নিয়ে যাওয়া যায়।
বিনোদনসম্পাদনা
ভিয়েতনামীয়রা ভলিবল, ফুটবল, ইত্যাদি দলগত খেলা পছন্দ করে। ব্যাডমিন্টন, টেবিল টেনিস, সাঁতার এবং টেনিসও জনপ্রিয় খেলা। শহরাঞ্চলে অনেকে জগিং, তাই চি চুয়ান নামের ছায়ামুষ্টিযুদ্ধ, যোগব্যায়াম, ইত্যাদি করতে ভালবাসে।
আরও দেখুনসম্পাদনা
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ Robbers, Gerhard (৩০ জানুয়ারি ২০০৭)। Encyclopedia of world constitutions। Infobase Publishing। পৃষ্ঠা 1021। আইএসবিএন 9780816060788। সংগ্রহের তারিখ ১ জুলাই ২০১১।
- ↑ Vietnam - Geography. Index Mundi, 12 July 2011. Retrieved 19 December 2011.
- ↑ https://www.imf.org/en/Publications/SPROLLs/world-economic-outlook-databases#sort=%40imfdate%20descending
- ↑ https://www.imf.org/en/Publications/SPROLLs/world-economic-outlook-databases#sort=%40imfdate%20descending
- ↑ https://www.imf.org/en/Publications/SPROLLs/world-economic-outlook-databases#sort=%40imfdate%20descending
- ↑ "Gini Index"। World Bank। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০১১।
- ↑ "Human Development Report 2010. Human development index trends: Table G" (পিডিএফ)। The United Nations। সংগ্রহের তারিখ ৫ জানুয়ারি ২০১১।
- ↑ "Socialist Republic of Vietnam"। Travelsradiate.com। ১০ মে ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ আগস্ট ২০১১।
বহিঃসংযোগসম্পাদনা
- Country Profile from BBC News
- সিআইএ প্রণীত দ্য ওয়ার্ল্ড ফ্যাক্টবুক-এ Vietnam-এর ভুক্তি
- Vietnam from UCB Libraries GovPubs
- কার্লিতে ভিয়েতনাম (ইংরেজি)
- উইকিমিডিয়া অ্যাটলাসে Vietnam
- Key Development Forecasts for Vietnam from International Futures
- সরকার
- Portal of the Government of Vietnam
- Communist Party of Vietnam
- National Assembly: the Vietnamese legislative body
- General Statistics Office
- Ministry of Foreign Affairs
- Chief of State and Cabinet Members
- গণমাধ্যম