জপ
জপ (সংস্কৃত: जप) হলো ধ্বনির পুনরাবৃত্তিমূলক গান, যা সাধারণ এক বা দুই আবৃত্তি স্বনর স্বরতীক্ষ্ণতায় হয়। জপের সুরের স্বরমাধুর্য সরল থেকে অত্যন্ত জটিল হতে পারে। গ্রেগরীয় জপ পদ্ধতিতে সুরেলা উপশব্দের পুনরাবৃত্তি করা হয়। জপ শৈলীযুক্ত সঙ্গীত হিসাবেও বিবেচিত হয়। পরবর্তী মধ্যযুগে জপ কিছু ধর্মীয় মন্ত্র সঙ্গীতে বিকশিত হয়েছিল।[১]
আধ্যাত্মিক অনুশীলন হিসাবে জপ
সম্পাদনাজপ (যেমন, মন্ত্র, পবিত্র পাঠ, ঈশ্বর বা আত্মার নাম ইত্যাদি) সাধারণভাবে ব্যবহৃত আধ্যাত্মিক অনুশীলন। প্রার্থনার মতো, জপ ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠী অনুশীলনের উপাদান হতে পারে। আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যগুলো জপকে আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ বলে মনে করে। জপ বলতে গ্রেগরীয় জপ, বৈদিক জপ, কোরআন তেলওয়াত, ইসলামী জিকির, বাহাই জপ, বৌদ্ধ জপ, মন্ত্র পাঠ, ইহুদি ক্যান্টিলেশন, কিরিয়া ডক্সাই-এর এপিকিউরীয় পুনরাবৃত্তি, এবং বিশেষ করে রোমান ক্যাথলিক, পূর্ব সনাতনপন্থী, লুথেরান এবং অ্যাংলিকান গির্জাগুলিতে সঙ্গীত ও প্রার্থনাকে বোঝায়।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
জপ অনুশীলন বিচিত্রময়। থেরবাদ ঐতিহ্যে, জপ সাধারণত পালি ভাষায় এবং পালি ত্রিপিটক অনুসারে করা হয়। তিব্বতি বৌদ্ধ জপ অতিস্বরে গাওয়া হয়, যেখানে একাধিক মাত্রা ব্যবহার হয়। অনেক হিন্দু ঐতিহ্য এবং অন্যান্য ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত ভারতীয় ধর্মে মন্ত্র জপ করার ধারণাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতীয় ভক্তি ঐতিহ্য আনন্দমার্গ অনুসরণ করে কীর্তন করে। হরেকৃষ্ণ আন্দোলন বিশেষ করে বৈষ্ণব ঐতিহ্যে ঈশ্বরের সংস্কৃত নাম উচ্চারণের উপর ভিত্তি করে। চীনা শিজিং বা কবিতা, জেন বৌদ্ধ নীতির প্রতিফলন করে এবং ড্যান তাইন থেকে গাওয়া হয় - প্রাচ্যের ঐতিহ্যের শক্তির অবস্থান।[২] জপ মানে শুধুমাত্র মন্ত্র উচ্চারণ নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আরও অনেক গভীর কিছু। মহর্ষি নগেন্দ্রনাথ তার সন্ধান দিতে গিয়ে বলছেন :
“ | "শুধু মন্ত্রোচ্চারণ ক'রলে কি শুষ্কতা যায় গা? না, নামে প্রীতি জাগে? আনন্দ হয়? শুধু শুধু নামোচ্চারণ ক'রতে থাকলে আপনিই গলা শুকিয়ে যায়, জিভে আড়ষ্টতা আসে। জপ তিন রকম—বাচিক, উপাংশু ও মানসিক। যতদিন ভাবনা না জাগে, অর্থবোধ না হয়, ততদিন আওড়াতে হয়। দেখ না—ছোট ছোট ছেলেরা যখন প্রথম প্রথম বর্ণমালা বা নামতা শেখে, তখন অক্ষরের দিকে লক্ষ্য রাখে, আর উচ্চারণ ক’রতে থাকে। দেখতে দেখতে এবং উচ্চারণ করতে করতে তার একটা ছবি মনে আঁকা হয়ে যায় এবং সংস্কার হয়—এইরূপ আকারের হ’লে, তা’কে এই বর্ণ বলে। এইরূপ লেখা থাকলে তার উচ্চারণ এমনি হয়। প্রথম প্রথম অক্ষরগুলির উচ্চারণ আলাদা আলাদা ক'রে করে, শেষে একসঙ্গে উচ্চারণ করে। এইরূপে শেষে পূর্বসংস্কার ও স্মরণের বশে তদ্রূপ বর্ণসমবায় দেখলেই তা উচ্চারণ করতে বা প’ড়তে দেরী হয় না; তদ্রূপ ভগবানের নাম এমন ভাবে উচ্চারণ ক’রতে হয় যাতে নিজে শোনা যায়, নামোচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে নামের প্রতিপাদ্য সামনে আছেন, তিনিও শুনেছেন—এমন ভাবে জপ ক’রতে হয়। বার বার অভ্যাস করতে করতে নাম বিনা চেষ্টায় উচ্চারণ হয়; বার বার দেখতে দেখতে যেমন কোন বস্তুর সর্বাঙ্গ বাহিরে স্পষ্ট দেখা যায়, ভিতরে ও মনে আঁকা হ'য়ে যায়। যেমন তোমার ছেলের নাম রেখেছ কেশব, তাকে চোখে দেখছ এবং সময়ে-অসময়ে প্রয়োজনে - অপ্রয়োজনে যখন ডাক, ডাকার সঙ্গে সঙ্গে তার রূপটিও তোমার চোখে ভাসে, তেমনি জপ ক’তে ক’তে ইষ্টের রূপ ও তোমার মনে আঁকা হ’য়ে যাবে। শাস্ত্ৰ পড়ে এবং সাধু-গুরুর নিকটে তোমার ইষ্টের রূপ, গুণ ও ভক্তানুকম্পা প্রভৃতির কথা শুনতে শুনতে তোমারও তাঁর অনুগ্রহলাভের আকাঙ্খা জাগ্বে; তখন অনুগ্ৰহ পেয়ে কি ক’রতে হয় তা-ও শুনতে পাবে, বা তাঁদের কাছে জানতে আগ্রহ জাগবে; যখন প্রয়োজন তীব্র হবে, তখন তুমিও প্রাণপণ ক’রবে। পিত্তরোগী যেমন মুখের তিক্ততা কাটাবার জন্য মিছরীর টুকরো মুখের মধ্যে রাখে এবং শেষে মুখের তিতো ভাব কেটে যায়, মিষ্টতা আসে, তেমনি তুমি নাছোড়বান্দা হ’য়ে নাম ক’রে যাও, নামই তোমার শুষ্কতা নষ্ট ক’রে দেবে। আনন্দ কি এক আধ দিনে পাওয়া যায়?" | ” |
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ Stolba, K. Marie (১৯৯৪)। The Development of Western Music: A History (2nd সংস্করণ)। McGraw Hill। পৃষ্ঠা 734। আইএসবিএন 9780697293794।
- ↑ ReShel, Azriel (২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮)। "Neuroscience and the 'Sanskrit Effect'"। Uplift। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জানুয়ারি ২০২০।
- ↑ ব্রহ্মচারী ( সংকলক), শ্রীমদ্ ভক্তিপ্রকাশ (জুলাই ২০১১)। শ্রীশ্রীনগেন্দ্র-উপদেশামৃত [প্রথম খণ্ড]। শ্রীশ্রী নগেন্দ্রমঠ, ২ বি, রামমোহন রায় রোড, কলকাতা - ৯। পৃষ্ঠা ১৬।