সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী

বাঙালি লেখক

সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০ - ১৯৩১) ছিলেন একজন বাঙালি লেখক ও কবি। তিনি ১৯ ও ২০ শতকে বাঙালি মুসলিম পুনর্জাগরণের প্রবক্তাদের একজন।[১] তিনি মুসলিমদের জন্যে বিজ্ঞানসাধনা, মাতৃভাষাচর্চা, নারীদের শিক্ষা এসবের পক্ষে লেখালেখি করেন। তার অনল-প্রবাহ কাব্যগ্রন্থটি ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে এবং স্বাধীনতার জন্য লিখে উপমহাদেশের প্রথম কবি হিসেবে কারাবন্দী হন।[২] তিনি বাংলায় খিলাফত আন্দোলন প্রবর্তনের ক্ষেত্রেও ব্যাপক অবদান রাখেন,[৩] এবং বলকান যুদ্ধের সময় উসমানীয় সাম্রাজ্যকে চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন।[৪] তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ অনল-প্রবাহ সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ করা হয় এবং পরবর্তীকালে তিনি প্রথম দক্ষিণ এশীয় কবি হিসেবে ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ডাক দেন। সরকার তার জীবদ্দশায় ৮২ বার তার বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা জারি করেছে।[৫]

সৈয়দ

ইসমাইল হোসেন সিরাজী
জন্মজুলাই ১৩, ১৮৮০
দিয়ারধানগড়া,বাণীকুঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, ব্রিটিশ ভারত
মৃত্যুজুলাই ১৭, ১৯৩১
পেশাকবি, ঔপন্যাসিক, সম্পাদক
ভাষাবাংলা
জাতীয়তা ব্রিটিশ ভারত
নাগরিকত্বব্রিটিশ ভারতীয়
সময়কালউনবিংশ শতাব্দী, বিংশ শতাব্দী
ধরনকবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ
সাহিত্য আন্দোলনমুসলিম জাতীয়তাবাদ
উল্লেখযোগ্য রচনাবলিঅনল-প্রবাহ
রায়-নন্দিনী

প্রারম্ভিক জীবন সম্পাদনা

সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী ১৩ই জুলাই, ১৮৮০ সালে ব্রিটিশ ভারতের পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি জন্মস্থানের সম্মানে নামের শেষের 'সিরাজী' পদবী যুক্ত করেন।[৬] সৈয়দ শব্দটি তার আরব বংশকে বোঝায় যার পূর্বপুরুষ খলিফা আলী। তার পূর্বপুরুষ সৈয়দ আলী আজম ইরান থেকে বাংলায় পাড়ি জমান এবং মুঘল দরবারে চাকরি লাভ করেন। আজম প্রথমে নদিয়ার আমলাবাড়িতে বসতি স্থাপন করেছিলেন এবং তার বংশধরদের অনেকেই ইউনানি ওষুধের অনুশীলনকারী ছিলেন। সিরাজীর পিতা মৌলভী শাহ সৈয়দ আবদুল করিম খন্দকার (১৮৫৬-১৯২৪) ছিলেন একজন পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর এবং ইউনানি অনুশীলনকারী । তার মা নূর জাহান খানম ছিলেন পশতুন বংশোদ্ভূত।[৭]

শৈশবে তিনি স্থানীয় পাঠশালা ও জ্ঞানদায়িনী মাইনর ইংরেজি স্কুলে পড়েন। এরপর সিরাজগঞ্জ বনোয়ারীলাল হাই স্কুলে নবম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। সিরাজী পাঠশালায় ফার্সি এবং বাড়িতে সংস্কৃত ভাষা শিখেছিলেন আর সংস্কৃত ব্যাকরণ ও সাহিত্যের সাথে হিন্দুশাস্ত্র যেমন - বেদ, মনুস্মৃতিউপনিষদ প্রভৃতি অধ্যয়ন করেছিলেন।[৮]

কর্মজীবন সম্পাদনা

ইসমাইল হোসেন সিরাজী বক্তা হিসেবে খ্যাতিমান ছিলেন। তৎকালীন বাঙালি মুসলিমদের পুনর্জাগরণ ও রাজনৈতিক বিষয়ে তিনি বক্তৃতা করতেন। তিনি হিন্দু-মুসলিম সাম্যে বিশ্বাসী ছিলেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সমিতিতে তিনি সক্রিয় ছিলেন, যেমন, কংগ্রেস, পরবর্তীতে মুসলিম লীগ, জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ, স্বরাজ পার্টি, কৃষক সমিতি ইত্যাদি।[৯]

ছাত্রাবস্থায়ই সিরাজী কবিতা লিখতে শুরু করেন এবং ধর্মবক্তা মুনশী মেহের উল্লাহের এক জনসভায় তার অনল-প্রবাহ কবিতাটি পাঠ করেন।[১০] মুনশী মেহেরউল্লাহ কবিতা শুনে মুগ্ধ হন এবং নিজ ব্যয়ে ১৯০০ সালে কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেন। ১৯০৮ সালের শেষদিকে বইটির বর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় যা তৎকালীন বাংলা সরকার বাজেয়াপ্ত করে আর তার প্রতি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। সিরাজী তখন ফরাসী-অধিকৃত চন্দননগরে গিয়ে ৮ মাস আত্মগোপন করে থাকেন। পরে আত্মসমর্পণ করলে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের অভিযোগে তাকে দু'বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।[১১]

১৯১২ সালে বলকান যুদ্ধের সময় ভারতে ডাঃ মোখতার আহমদ আনসারীর নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান রেড ক্রিসেন্ট গঠিত হয়। এই সংগঠন একদল চিকিৎসকসহ 'অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল মিশন' প্রেরণ করে। ইসমাইল হোসেন সিরাজী মিশনের বঙ্গীয় প্রতিনিধি হিসেবে তুরস্কে যান।[১১] তিনি তুরস্ক ভ্রমণ (১৯১০) গ্রন্থে এই সফরের বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন।

১৯১৯ সালে সিরাজী মাসিক নূর নামে একটি পত্রিকা বের করেন। তার নিজের মহাশিক্ষা মহাকাব্য এবং নজরুলের কয়েকটি গল্প এ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২৩ সালে সিরাজী ও মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীর যুগ্ম সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ছোলতান। সিরাজীর অধিকাংশ প্রবন্ধই এই পত্রিকায় মুদ্রিত হয়।

প্রাথমিকভাবে সিরাজী সৈয়দ জামাল উদ্দিন আফগানির প্যান ইসলামিজম সম্পর্কে আগ্রহী ছিলেন।[১২] তবে তাকে মুসলিম পুনর্জাগরণের চিন্তায় বেশি প্রভাবিত করেন প্রায় সমসাময়িক শিবলী নোমানী এবং আল্লামা ইকবাল

সাহিত্য কর্ম সম্পাদনা

আর ঘুমিও না নয়ন মেলিয়া
উঠরে মোসলেম উঠরে জাগিয়া
আলস্য জড়তা পায়েতে ঠেলিয়া।
পূত বিভু নাম স্মরণ করি।
... অইরে মোসলেম! দেখরে চাহিয়া
নির্জীব যে জাতি তারাও সাজিয়া
তারাও কেমন সাহস ধরিয়া
উন্নতির পথে ধাইছে ছুটি।
তোমাদের তরে নিদ্রিত দেখিয়া
প্রকাশ্যে তোদেরে অবজ্ঞা করিয়া
দেখরে কেমন চলিছে ছুটিয়া
দেখরে মেলিয়া নয়ন দুটি।

— ইসমাইল হোসেন সিরাজী-এর "অনল প্রবাহ", প্রথম অনুচ্ছেদ

ইসমাইল হোসেন সিরাজী আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম দিকের মুসলমান লেখকদের অন্যতম। তার রাজনৈতিক আদর্শ সাহিত্যকর্মেও দৃশ্যমান। তার রচনাসমূহকে ইসলামি সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা যায়। তবে কবি আবদুল কাদির মন্তব্য করেন যে, বঙ্কিমচন্দ্রের বৈশিষ্ট্যসূচক "উগ্র জাতীয়তাবাদ" মুসলমানদের মধ্যে সিরাজীর রচনাতে প্রথম দেখা যায়।[১২] উল্লেখ্য, সিরাজী বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনীর প্রতিক্রিয়ায় তার রায়নন্দিনী লেখেন, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির প্রতিযোগী হিসেবে লেখেন প্রেমাঞ্জলি[১৩] তথাপি সময়োপযোগী হওয়ায় তখন তার উপন্যাস ও কবিতা পঠিত ও জনপ্রিয় হয়।

কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা

  • অনল-প্রবাহ (১৯০০)
  • আকাঙ্ক্ষা(১৯০৬)
  • উছ্বাস (১৯০৭)
  • উদ্বোধন (১৯০৭)
  • নব উদ্দীপনা (১৯০৭)
  • স্পেন বিজয় কাব্য (১৯১৪)
  • মহাশিক্ষা মহাকাব্য (১ম খণ্ড-১৯৬৯, ২য় খণ্ড-১৯৭১)

উপন্যাস সম্পাদনা

  • রায়নন্দিনী (১৯১৫)
  • তারাবাঈ (১৯১৬)
  • ফিরোজা বেগম (১৯১৮)
  • নূরউদ্দীন (১৯১৯)
  • জাহানারা (১৯৩১)
  • বঙ্গ ও বিহার বিজয় (১৮৯৯, অসমাপ্ত)
  • বঙ্কিম দুহিতা

বাংলা একাডেমি হতে তার উপন্যাস সমূহ প্রকাশিত হয়েছে।

সঙ্গীত গ্রন্থ সম্পাদনা

  • সঙ্গীত সঞ্জীবনী (১৯১৬)
  • প্রেমাঞ্জলি (১৯১৬)

প্রবন্ধ সম্পাদনা

  • স্ত্রীশিক্ষা
  • স্বজাতি প্রেম (১৯০৯)
  • আদব কায়দা শিক্ষা (১৯১৪)
  • স্পেনীয় মুসলমান সভ্যতা (১৯১৬)
  • সুচিন্তা (১৯১৬)
  • মহানগরী কর্ডোভা
  • আত্মবিশ্বাস ও জাতীয় প্রতিষ্ঠা
  • তুর্কী নারী জীবন (১৯১৩)।

তার প্রবন্ধ সংকলন জ্ঞানবিতরণী (৩৮/২, মান্নান মার্কেট, বাংলাবাজার) হতে প্রকাশিত হয়েছে।

ভ্রমণ কাহিনী সম্পাদনা

  • তুরস্ক ভ্রমণ (১৯১০)

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. রাণা রাজ্জাক (২০১২)। "সিরাজী, ইসমাইল হোসেন"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  2. "ইসমাইল হোসেন সিরাজী জাতীয় জাগরণের অগ্নিমন্ত্রদাতা"। risingbd। সংগ্রহের তারিখ ১৩ জুলাই ২০২১ 
  3. সুফিয়া আহমেদ (২০১২)। "খিলাফত আন্দোলন"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  4. Shah, Mohammad (এপ্রিল–জুন ২০০৩)। "Terrorism in Colonial Bengal: The Muslim Response"। Journal of the Pakistan Historical Society৫১ (২): ২৪। 
  5. "ইসমাইল হোসেন সিরাজী জাতীয় জাগরণের অগ্নিমন্ত্রদাতা"risingbd। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৩-০২ 
  6. রাণা রাজ্জাক (২০১২)। "সিরাজী, ইসমাইল হোসেন"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  7. আহমেদ, হাছনাইন (২০২১-০১-১৪)। ইসমাঈল হোসেন সিরাজী’র সাহিত্যে আরবী শব্দের প্রয়োগ ও ইসলামী ভাবধারা (MPhil)। Dhaka University International Repository। [স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
  8. কবির, নুরুল (২৭ অক্টোবর ২০১৩)। "Colonialism, politics of language and partition of Bengal PART XXVII"। New Age। New Age। ২০১৬-০২-১৫ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ 
  9. "বইপ্রেমী ওয়েবসাইট"। ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ অক্টোবর ২০১২ 
  10. মুসলিম বাংলার সাময়িক পত্র, আনিসুজ্জামান, পৃ. ২৮৭
  11. আবদুল কাদির ২০০৬, পৃ. 23-25।
  12. আবদুল কাদির ২০০৬, পৃ. 18-19।
  13. আবদুল কাদির ২০০৬, পৃ. 28-29।

গ্রন্থপঞ্জি সম্পাদনা

  • আবদুল কাদির, সম্পাদক (২০০৬)। ইসমাইল হোসেন শিরাজী রচনাবলী। ঢাকা: স্বদেশ প্রকাশ। 
  • মুহাম্মদ, শরীফ (২০১৫)। এই গরবের ধন। মধ্যবাড্ডা, ঢাকা: মাকতাবাতুল আযহার। পৃষ্ঠা ৩৯–৬৪। আইএসবিএন 4359681989064