চন্দননগর
চন্দননগর (ফরাসি: Chandernagor, উচ্চারণ: [ʃɑ̃dɛʁnaɡɔʁ]) ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান বিভাগের হুগলি জেলার হুগলি মহকুমার চন্দননগর পৌরসংস্থার অন্তর্গত একটি শহর। এটি ফরাসডাঙা নামেও পরিচিত।
চন্দননগর Chandernagor (ফরাসি) | |
---|---|
শহর | |
চন্দননগর | |
চন্দননগর জোড়াঘাট | |
ডাকনাম: ফরাসডাঙা, চাঁদের নগর | |
পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রে চন্দননগরের অবস্থান | |
স্থানাঙ্ক: ২২°৫২′ উত্তর ৮৮°২৩′ পূর্ব / ২২.৮৭° উত্তর ৮৮.৩৮° পূর্ব | |
দেশ | ![]() |
রাজ্য | পশ্চিমবঙ্গ |
বিভাগ | বর্ধমান |
জেলা | হুগলি |
মহকুমা | চন্দননগর |
পৌরসংস্থা | চন্দননগর |
মহানগর | বৃহত্তর কলকাতা |
ফরাসি ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যাধীন ফরাসি ভারত | ১৬৯৬ |
ভারতের নিকট দে ফাক্তো হস্তান্তর | ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫১ |
ভারতের নিকট দে জুরে হস্তান্তর | ৯ জুন ১৯৫২ |
পশ্চিমবঙ্গে অন্তর্ভুক্তিকরণ | ২ অক্টোবর ১৯৫৪ |
প্রতিষ্ঠাতা | ফরাসি উপনিবেশবাদী |
নামকরণের কারণ | হুগলি নদীর অর্ধচন্দ্রাকার বাঁক |
সরকার | |
• ধরন | পৌরসংস্থা |
• শাসক | চন্দননগর পৌরসংস্থা |
• প্রশাসক | স্বপন কুণ্ডু |
আয়তন | |
• মোট | ১৯ বর্গকিমি (৭ বর্গমাইল) |
উচ্চতা | ৯ মিটার (৩০ ফুট) |
জনসংখ্যা (২০১১) | |
• মোট | ১,৬৬,৮৬৭ |
• জনঘনত্ব | ৮,৮০০/বর্গকিমি (২৩,০০০/বর্গমাইল) |
বিশেষণ | চন্দননগরী Chandernagorien(ne) |
ভাষা | |
• দাফতরিক | |
• সাংস্কৃতিক | ফরাসি |
সময় অঞ্চল | ভামাস (ইউটিসি+৫:৩০) |
ডাসূস | ৭১২১৩৬, ৭১২১৩৭, ৭১২১৩৮ |
টেলিফোন কোড | +৯১ ৩৩ |
যানবাহন নিবন্ধন | WB |
লোকসভা কেন্দ্র | হুগলি |
সাংসদ | লকেট চট্টোপাধ্যায় (বিজেপি) |
বিধানসভা কেন্দ্র | চন্দননগর |
এমএলএ | ইন্দ্রনীল সেন (এআইটিসি) |
ওয়েবসাইট | http://heritagechandernagore.com/ |



ইতিহাস সম্পাদনা
সাহিত্যের ইতিহাস প্রণেতা এবং ঐতিহাসিক-গবেষক ড. সুকুমার সেন মনে করেন যে, একসময় এই জনপদে চণ্ডীর মন্দির ছিল। তাই এই অঞ্চলকে বলা হতো চণ্ডীরনগর। এই চণ্ডীরনগর নাম থেকেই নাকি চন্দননগর নামের উৎপত্তি ঘটেছে। তবে এ নিয়ে দ্বিমতও রয়েছে।
একসময় চন্দননগর ছিল ফরাসি উপনিবেশ। ইংরেজশাসিত কলকাতার সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে ফরাসিশাসিত চন্দননগর। কলকাতার মতো চন্দননগরেও আছে স্ট্র্যান্ড, বড়বাজার, বাগবাজার, বউবাজার। ফরাসি আমলে চন্দননগরের প্রভূত উন্নতি হয়। রাস্তাঘাট, নিকাশি সবেতেই ফরাসি দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। ফরাসি উপনিবেশ হওয়ায় স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিপ্লবীরা এখানে আশ্রয় নিতেন। আলিপুর বোমার মামলায় অভিযুক্ত হয়ে অরবিন্দ ঘোষ ও অন্যান্য বিপ্লবী এখানে আশ্রয় নেন। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের কর্মীরা, বিপ্লবী গনেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, শহিদ জীবন ঘোষালরাও এখানে আত্মগোপন করে ছিলেন একসময়। ফরাসি উপনিবেশ, তাই ব্রিটিশ পুলিশকে অনুমতি নিয়ে এখানে ঢুকতে হতো। সেই সুযোগে বিপ্লবীরা পালাতেন। শহিদ কানাইলাল দত্তের শৈশব কেটেছে এই শহরে। তার ভিটে, নামাঙ্কিত একটি বিদ্যালয় ও ক্রীড়াঙ্গন এই শহরে রয়েছে। বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর পৈতৃক ভিটে এই শহরে ফটোকগোড়া এলাকায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধিকবার এই শহরে এসে থেকেছেন। তার স্মৃতিবিজড়িত পাতালবাড়ি স্ট্রান্ডের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত। তাঁতবস্ত্রের কেন্দ্র হিসেবেও চন্দননগরের নামডাক ছিল। চন্দননগরের আরেক নাম ফরাসডাঙা। এখানকার কাপড়ের খ্যাতি অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল।
স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পাদনা
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ও বৈপ্লবিক সংগ্রামের ইতিহাসে হুগলির চন্দননগর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ফরাসি উপনিবেশ থাকার কারণে বহু বিপ্লবী এখানে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকেছেন। বিপ্লবী কানাইলাল দত্ত ও উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম চন্দননগর শহরে। রাসবিহারী বসু ঋষি অরবিন্দ ঘোষ, গণেশ ঘোষ, শ্রীশচন্দ্র ঘোষ, মতিলাল রায়, জ্যোতিষ চন্দ্র ঘোষ, মণীন্দ্রনাথ নায়েক বারীন্দ্রকুমার ঘোষের স্মৃতিধন্য চন্দননগর ছিল অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের আখড়া। ১৯১১ সালে মতিলাল রায়ের প্রবর্তক সংঘর ভেতর প্রথম পরীক্ষা করা হয়েছিল রাসবিহারী বসুর বোমাটি। যা পরে নিক্ষেপ করা হয় বড়লাট হার্ডিঞ্জ এর ওপর। ঋষি অরবিন্দ এখানে কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকার পর পন্ডিচেরি চলে যান।
ভৌগোলিক উপাত্ত সম্পাদনা
শহরটির অবস্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ হল ২২°৫২′ উত্তর ৮৮°২৩′ পূর্ব / ২২.৮৭° উত্তর ৮৮.৩৮° পূর্ব।[১] সমুদ্র সমতল হতে এর গড় উচ্চতা হল ১০ মিটার (৩২ ফুট)।
জনসংখ্যার উপাত্ত সম্পাদনা
ভারতের ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুসারে চন্দননগর শহরের জনসংখ্যা হল ১৬২,১৬৬ জন।[২] এর মধ্যে পুরুষ ৫২% এবং নারী ৪৮%।
এখানে সাক্ষরতার হার ৭৮%। পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৮২% এবং নারীদের মধ্যে এই হার ৭৪%। সারা ভারতের সাক্ষরতার হার ৫৯.৫%, তার চাইতে চন্দননগর এর সাক্ষরতার হার বেশি।
এই শহরের জনসংখ্যার ৮% হল ৬ বছর বা তার কম বয়সী।
জগদ্ধাত্রী পুজো সম্পাদনা
চন্দননগরের চাউলপট্টিতে প্রতি বছর যে সময় দুর্গাপুজোয় সারা বাংলার মানুষ উৎসবে মাতেন, সেই সময়টা তাঁদের ব্যাবসায়িক কর্মব্যস্ততা তুঙ্গে থাকতো। লক্ষ মণ চাল মেপে আড়তে তুলে নৌকা ভরে নানা জায়গায় পাঠাতে হয়। এত ব্যস্ততা থাকতো যে দুর্গা পুজোর চারটে দিন কেটে যায় টেরও পান না তাঁরা।
তৎকালীন স্থানীয় জমিদার ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী এর সমাধানে এগিয়ে আসেন। চাউলপট্টির ব্যবসায়ীরা তাঁর কাছে এসে দরবার করলেন। ইন্দ্রনারায়ণ নন্দদুলাল মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন পূর্বেই । ১৭৫৪ খ্রিস্টাব্দে বহু আগে নদিয়ার মহারাজার স্বপ্নাদিষ্ট মহাদেবীর সর্বপ্রথম জগদ্ধাত্রী পুজো শুরু করেন। সেই পুজো কৃষ্ণচন্দ্র রায়-এর সমসাময়িক কালে, নদিয়ার মহারাজার হাতধরে চন্দননগরে রাজা ইন্দ্রনারায়ণ দ্বিতীয় জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন করেন। ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী ডেকে পাঠালেন সবাইকে। বললেন, দুর্গাপুজোর ঠিক এক মাস পরে তাঁর বাড়িতে মহা সমারোহে দুর্গারই আর এক রূপ—জগদ্ধাত্রীর পুজো করবেন তিনি। সেই পুজোয় সকলের আমন্ত্রণ। দুর্গাপুজোয় অংশগ্রহণ করতে না পারার কষ্ট ভুললেন চাউলপট্টির ব্যবসায়ীরা। চন্দননগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা হলো।
১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে চন্দননগরে জলপথ ও স্থলপথে সাঁড়াশি আক্রমণ চালালেন লর্ড ক্লাইভ। ব্যাপক লুঠতরাজ হল চন্দননগরে। ইন্দ্রনারায়ণের বাড়ি লুঠ করেই প্রায় ৬৫ লক্ষ টাকার অলঙ্কার নিয়ে যায় ইংরেজরা। ক্লাইভের গোলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল নন্দদুলালের মন্দিরও। প্রায় ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল ইন্দ্রনারায়ণের প্রাসাদ। ইন্দ্রনারায়ণ মারা যান ১৭৫৬ সালে। নিরাশ্রয় হলেন দেবীও। পরিস্থিতি দেখেশুনে ইন্দ্রনারায়ণের বাড়ির পুজো চাউলপট্টিতে নিয়ে গেলেন ব্যবসায়ীরা। আজও এই পুজো হয় সেখানেই। জগদ্ধাত্রীকে এখানে বলা হয় আদি মা।
চাউলপট্টির পুজোর প্রথম সঙ্কল্প করা হয়েছিল ইন্দ্রনারায়ণের নামে। এখনও এই পুজোর সঙ্কল্প হয় চৌধুরী পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যের নামে। বারোয়ারি পুজোয় কোনও পরিবারের সদস্যের নামে সঙ্কল্পের এমন উদাহরণ বিরল।
কালে কালে এই পুজো হয়ে ওঠে জাঁকজমকপূর্ণ. তার ওপর আলোর ব্যবহারে অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছে চন্দননগর সব মিলিয়ে চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পুজো মানেই এখন দর্শনার্থীদের ঢল নামে. দুর্গাপুজোর সপ্তমী থেকে ঠিক একমাস পর আসে জগদ্ধাত্রী পুজোর সপ্তমী দুর্গাপুজোর মতোই চারদিন ধরে পুজো হয়. শেষ দিন প্রায় ৩৫ ফিট উঁচু প্রতিমা বিসর্জন করা হয় বিসর্জনের জন্য নির্দিষ্ট রানিঘাটে. প্রতিবছরই দশমীর রাতে প্রতিমা নিয়ে শোভাযাত্রা হয়. তা দেখতে দেশবিদেশ থেকে বহু মানুষ জড়ো হন চন্দননগর কর্পোরেশন, পুলিশ, পুজো কমিটির উদ্যোক্তাদের নিয়ে তৈরি সেন্ট্রাল কমিটি জগদ্ধাত্রী পুজোর দায়িত্বে থাকে। শহরের প্রায় দেড়শো পুজোয় নজরদারির দায়িত্বও এই কমিটির এখানকার পুজো অত্যন্ত সুশৃঙ্খল।
বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ত্ব সম্পাদনা
- ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরী - ইউরোপীয় উপনিবেশকালে এই অঞ্চলের জমিদার, তথা জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তক।[৩]
- রাখালদাস মজুমদার - বাঙালি লেখক
- উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় - বাঙালি বিপ্লবী ও সম্পাদক
তথ্যসূত্র সম্পাদনা
- ↑ "Chandannagar"। Falling Rain Genomics, Inc (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ সেপ্টেম্বর ২৫, ২০০৬।
- ↑ "ভারতের ২০০১ সালের আদমশুমারি" (ইংরেজি ভাষায়)। Archived from the original on ১৬ জুন ২০০৪। সংগ্রহের তারিখ সেপ্টেম্বর ২৫, ২০০৬।
- ↑ "Indranarayan and Jagatdhatri Puja"।