সিগনেট প্রেস

পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রকাশনা সংস্থা

সিগনেট প্রেস কলকাতার গৌরবোজ্জ্বল অতীতের এক প্রকাশনা সংস্থা। এটি ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা প্রকাশনাশিল্পে আধুনিকতার প্রবর্তক দিলীপকুমার গুপ্ত ( ডি.কে নামে পরিচিত) (১৯১৮-১৯৭৭) নীলিমা গুহঠাকুরতার (১৯০৩-১৯৮২) সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা করেন। সংস্থাটি সংস্কৃত কলেজের সামনে কলেজ স্ট্রিটের বিখ্যাত বই তোরণে অবস্থিত। তবে প্রকাশনা সংস্থাটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছিল ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০ অক্টোবর ১০/২, এলগিন রোড়ে নীলিমা গুহঠাকুরতার বাড়িতে। [১]

সিগনেট প্রেস
প্রতিষ্ঠাকাল৩০ অক্টোবর ১৯৪৩
প্রতিষ্ঠাতাদিলীপকুমার গুপ্ত
দেশভারত
সদরদপ্তর১২এ, বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০৭৩ সংস্কৃত কলেজ), কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ সম্মুখে
প্রকাশনাপুস্তক

খ্যাতিমান চলচ্চিত্র-পরিচালক সত্যজিৎ রায়  কর্মজীবনের শুরুতে এই প্রকাশনা সংস্থায় ভিজ্যুয়াল ডিজাইনার ছিলেন এবং অনেক বইয়ের প্রচ্ছদের অলংকরণ করেছিলেন। [২] প্রকাশনা সংস্থাটি জওহরলাল নেহরুর দ্য ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া (১৯৪৬), বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী, চাঁদের পাহাড়, জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা (১৯৫৭), বনলতা সেন (১৯৪৮),সাতটি তারার তিমির (১৯৪৮) এর মতো বহু বিখ্যাত বই প্রকাশ করেছিল।

প্রারম্ভ সম্পাদনা

ডি কে–র শাশুড়ি নীলিমা দেবীর থিয়েটার রোডের বাড়িতে সিগনেট প্রেসের উদ্বোধনী উৎসব হয়েছিল। ১৯৪৩–এ। উপস্থিত ছিলেন প্রফুল্লকুমার সরকার, সজনীকান্ত দাস, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শিবরাম চক্রবর্তী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুপ্রভা রায় প্রমুখ। খাতায় স্বাক্ষর আছে ছেচল্লিশজন অতিথির।

 
সিগনেটের প্রারম্ভমুহূর্তে সাক্ষী সেই ছেচল্লিশজন অতিথির স্বাক্ষর

সুকুমার রায়ের বই ছাপা হবে, সেই আসরে তাঁকে নিয়েই আলোচনা চলল। যে–মুহূর্তে তাঁর ‘খাই খাই করো কেন এসো বোসো আহারে’ পড়া শুরু হল, ঠিক তখনই সবাইকে অবাক করে দিয়ে ভোজবাজির মতো প্লেটে–প্লেটে উত্তম সব আহার্য এসে পৌঁছতে লাগল নিমন্ত্রিতদের কোলের কাছে।

১৯৪৪ থেকে ১৯৭৫, এই চার দশকে ১৩১টি বই বেরিয়েছে সিগনেট থেকে। এর মধ্যে আটটি বই মুদ্রণ, বাঁধাই বিভাগে সর্ব ভারতীয় পুরস্কার জিতেছে। ১৯৪৫-এ জহরলাল নেহরুর ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ প্রথম ছেপেছিল সিগনেট। বই ছাপার কাজ তখন চলছে, ১০/২ এলগিন রোডের বাড়িতে হঠাৎ এসে হাজির জহরলাল। কাঠের সিঁড়ি দিয়ে সোজা উঠে এলেন দোতলায়। নীলিমা দেবী তখন স্নান ঘরে। নেহরুকে গ্যালি প্রুফ দেখিয়েছিলেন কিশোরী নন্দিনী। পরে তিনিই ডি কে–র সহধর্মিণী হবেন।

সিগনেটের প্রথম দুটি বই ইংরেজিতে। একটি নীলিমা দেবীর ইংরেজি কবিতার সংকলন, আর একটি নীলিমা দেবীর অনুবাদে, ডি কে–র সম্পাদনায় Best Stories of Modern Bengal। প্রথম বছর বারোটা, দ্বিতীয় বছরে পনেরোটা বই প্রকাশ করে সাড়া ফেলে দিল সিগনেট। দ্বিতীয় বছরের প্রথম বইটাই ‘আম আঁটির ভেঁপু’, বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’র ডি কে-র লেখা কিশোর সংস্করণ, সঙ্গে সত্যজিতের অসাধারণ অলঙ্করণ। সত্যজিতের স্বীকারোক্তি,

”‘আম আঁটির ভেঁপু’ আমাকে চিত্রনাট্যের কাঠামো নির্ধারণ করতে অনেকটা সাহায্য করেছিলো।’

সিগনেটের প্রকাশনা সৌষ্ঠব প্রত্যেককে মুগ্ধ করেছিল বললে প্রায় কিছুই বলা হয় না। রাজশেখর বসু তাঁর মুগ্ধতা জানিয়ে চিঠি লিখেছেন ডি কে-কে। ৮ আগস্ট ১৯৫৬ যামিনী রায় লিখছেন,

” ‘ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ বইখানির বাহ্য রূপ দেখে প্রথমেই চোখে পড়ে ছাপার পরিচ্ছন্নতা ও বাঁধাইএর সুষ্ঠু, গুরুত্বপূর্ণ রূপ।’

জীবনানন্দ দাশ ১৯৫২-র ৭ সেপ্টেম্বর লিখছেন,

”‘‘বনলতা সেন’ বইটি পেয়ে খুবই আনন্দিত হয়েছি। খুবই চমৎকার বই হয়েছে।… সাহিত্য ও সংস্কৃতির ইতিহাস যে নতুন যুগে এনে দাঁড় করিয়েছে আমাদের- তা আগাগোড়া সিগনেটের স্বাক্ষরে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।’

 
জীবনানন্দ দাশ -র ধূসর পাণ্ডুলিপির সিগনেট সংস্করণের প্রচ্ছদ

অভিনব নানা রকম পরিকল্পনা ডি কে–র চিন্তায় সর্বদা ঘুরপাক খেত। কলেজ স্ট্রিট আর রাসবিহারী এভিনিউতে সিগনেটের দুটো দোকানেই পনেরো দিন পর পর পালটে যেত পুস্তকসজ্জা। কখনও লেখকদের ফটোগ্রাফ, কখনও পেইন্টিংস, কখনও বা শৌখিন ফুলদানি। রবীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষে পনেরো দিনের ‘কবিপক্ষ’ শব্দটির জন্য বাঙালি ঋণী হয়ে থাকবে ডি কে–র কাছে। ওই পক্ষে সিগনেট কাউন্টার সাজানো হত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ দাশ এবং অমিয় চক্রবর্তীর ফটোগ্রাফ দিয়ে। যে বছর অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘পরমপুরুষ’ বেরলো, গোটা দোকানটাকে সিল্কের দামি নামাবলি দিয়ে মুড়ে দেওয়া হত। বুক–সেলফে প্রতিটি বইয়ের ফাঁকে ফাঁকে কাগজের লাল জবা। ‘পরমাপ্রকৃতি শ্রীশ্রীসারদামণি’ প্রকাশিত হলে দোকান সাজানো হয়েছিল পুরানো আমলের কাঠের তৈরি লম্বা সিঁদুর কৌটো, শাঁখা আর লাল রুলি দিয়ে। আর যে বারে আবু সইয়দ আইয়ুব সম্পাদিত ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’ এল, প্রত্যেককে, দোকানে ঢুকলেই, উপহার দেওয়া হয়েছিল একটি করে কাগজের গোলাপফুল। তাতে সত্যিকারের গোলাপের গন্ধ। কলেজ স্ট্রিটের দোকান থেকে ওই রকম একটা গোলাপ পেয়ে শিবরাম চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, ‘‘কী মুশকিল বলো তো, এমন গোলাপটি উপহার দেবার জন্য আমি তেমন সুন্দরী মেয়ে খুঁজে পাই কোথায়?’’ এসবের সঙ্গে যুক্ত হল ডি কে পরিকল্পিত এবং নরেশ গুহ রূপায়িত ‘টুকরো কথা’। সাহিত্যের ইতিহাসে এমন একটি সংকলন এর আগে বা পরে আর কখনও হয়েছে কিনা গবেষণা সাপেক্ষ। পূর্ণেন্দু পত্রী তাঁর গুরুত্বকে বুঝিয়ে দিয়েছেন ঠিক এই ভাবে: ‘টুকরো কথা চালু হ’লো যখন, সিগনেট বুক শপ হয়ে উঠলো বাংলা সংস্কৃতির কেন্দ্র। ...বাংলাদেশে এক নজিরবিহীন ঘটনা।’

সিগনেট প্রেস ও বাংলা প্রকাশনা জগতে বিপ্লব সম্পাদনা

সিগনেট প্রেস দেশের স্বাধীনতার ও তার পরবর্তী সময়ে বাংলার প্রকাশনার জগতে যুগান্তর ঘটিয়েছিল, তা কেবল ভাল বইয়ের জন্য নয়, প্রকাশনার ধরনের জন্যও বটে। এ সম্পর্কে লীলা মজুমদারের বর্ণানাটিই উপযুক্ত -

”যার বানান অকাট্য, প্রচ্ছদ অতুলনীয়, ছবি অপূর্ব, বাঁধাই বলিষ্ঠ, দাম সর্বজননন্দিত।”

বলাই বাহুল্য, কর্ণধার দিলীপকুমার গুপ্তের সর্বদা সজাগ দৃষ্টি ছিল প্রকাশনার মান ও উৎকর্ষ-উন্নয়নে। এই প্রেস থেকে সাহিত্যের খবর সংবলিত “টুকরো কথা” বিনামূল্যে পাঠকদের বিলি করা হত। [৩]

শঙ্খ ঘোষের 'বইয়ের ঘর ' শীর্ষক বইটিতে আমরা সিগনেট প্রেসের কলেজ স্ট্রিটে বিপনী খোলার পরের কিছু ঘটনাবলীর বর্ননা পাই :

"তারপর এল সিগনেট। অর্থাৎ কলেজ স্ট্রিটে এল। আলো এসে পড়ল যেন আমাদের বইপড়াতে। বইপাড়াতে।

চল্লিশের দশকেও সিগনেট থেকে বই বেরিয়েছে অনেক, সুরুচির অভ্রান্ত চিহ্ন নিয়ে ছিল তার নির্বাচন আর মুদ্রণ। কিন্তু বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটে তার দোকানটি খুলবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এল সারি সারি কবিতার বই, জীবনানন্দ বা সুধীন্দ্রনাথ খুঁজতে দুয়োরে দুয়োরে আমাদের ঘুরতে হবে না আর। সবই আমরা—সবাই আমরা—পেয়ে যাব হাতে। মুদ্রণের পারিপাট্য নিয়ে দিলীপকুমার গুপ্তের অতন্দ্র তৎপরতা (ডি কে নামেই চেনেন যাঁকে সকলে), সত্যজিৎ রায়ের ছিমছাম মলাট ('পথের পাঁচালী' তৈরি হয়নি তখনও), আর আধুনিক কবিদের লেখা—এসব মিলেমিশে প্রায় এক স্বপ্নজগৎ তৈরি হলো যেন। বাহান্ন তিপ্পান্ন সাল, আমাদের কুড়ি-একুশ বছর বয়স, পর পর চোখের সামনে এসে পৌঁছচ্ছে 'বনলতা সেন' ‘সংবর্ত' ‘পারাপার' ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার' ‘অমাবস্যা'! হ্যাঁ, তারই সঙ্গে এল নতুনলেখা-ভূমিকাসুদ্ধ পরিবর্তিত ‘অর্কেস্ট্রা’, যার ভূমিকাংশ থেকে আমাদের মুখে মুখে ফিরতে লাগল : ‘আমি অন্ধকারে বদ্ধমূল, আলোর দিকে উঠছি'। এল ‘সমর সেনের কবিতা', এল ‘প্রতিধ্বনি'র অনুবাদগুলি, এল দুই কবির দুই নতুন প্রবন্ধের বই ‘সাহিত্যের ভবিষ্যৎ' আর ‘সাহিত্যচর্চা’, দুই সাহিত্যাদর্শে যেন ‘রাজায় রাজায়’ যুদ্ধ। ‘স্বগত'র নতুন সংস্করণ আর ‘কুলায় ও কালপুরুষ' অবশ্য আর কয়েক বছর পরের কথা। বলা নিশ্চয় যায় যে আধুনিক কবিতার প্রকাশনায় রুচির সঙ্গে একটা সাহসও এনে দিয়েছিল সিগনেট। নরেশ গুহ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মতো তরুণ কবিদের বইও ছাপতে শুরু করলেন তাঁরা। পাশাপাশি তাই দেখা দিল ভিন্ন বাড়িতে ছাপা ‘প্রথমা' আর 'সম্রাট'-এর নতুন সংস্করণ, কিংবা ‘শীতের প্রার্থনা : বসন্তের উত্তর'। কবিতাবইয়ের জন্য এখন আর ভাবনা নেই আমাদের। সিগনেট-প্রকাশিত না হলেও সিগনেটের দোকানে গেলেই খোঁজ মিলবে তার, এমন একটা নিশ্চিত বিশ্বাস আমাদের তৈরি হয়ে যায় তখন। তৈরি হয়, কেননা সিগনেটের আয়োজন ছিল সর্বব্যাপী, ‘কবিতা পড়ুন, কবিতা পড়ান'-এর উদার এক আহ্বান ছিল তার। এমনকী, উপহার লিখে দেবার জন্য বইয়ের সঙ্গে ছোটো ছোটো সুদৃশ্য কিছু স্লিপ দিয়ে দেবার মতো, উন্মুখ মনকে বহু দিক থেকে টেনে নেবার নতুন নতুন কত ভাবনা ছিল তার।

ছাপা হতে শুরু করল ‘টুকরো কথা'। নামের পাক্ষিক এক বুলেটিন। আধুনিক সাহিত্যের কিছু খবর থাকত তাতে, আর থাকত উসকে দেওয়া অনেক সাহিত্যিক ধাঁধা। পাঁচটি-সাতটি উদ্ধৃতি দিয়ে হয়তো প্রশ্ন করা হতো কারা তার রচয়িতা, কোন্ বইতে-বা পাওয়া যাবে সেগুলি। কবিতা বা গদ্যের সে-লাইনগুলির অনেকটাই হয়তো ধরা যেত সহজে, কিন্তু কয়েকটির জন্য খুঁজতেও হতো বই, তাই পড়তেই হতো বই। এই ধাঁধা থেকেই অনেককে একবার বিহ্বল করে দিয়েছিল জসীমউদ্দিনের প্রায় যেন অপ্রত্যাশিত এক লাইন, প্রিয়মুখের উপমান হিসেবে যেখানে উঠে এসেছিল নতুন চরের প্রতিমা। ছোট্ট দোকান, কিন্তু প্রথম প্রথম ভয় হতো তার ভিতরে পা দিতে। ফুটপাথের দিকে মুখ করিয়ে দাঁড় করানো আছে শেলফের ওপর অল্প কখানা বই, পথের ওপর সিঁড়িতে দাঁড়িয়েই তাকিয়ে থাকতাম আমরা। ‘ভিতরে আসুন না': কেউ হয়তো ডাকতেন সাদরে। ‘না, দেখছি শুধু, কিনবার টাকা নেই' এমন কোনো দ্বিধান্বিত উত্তর শুনলে বলতেন তাঁরা ‘তাতে কী হলো, ভিতরে আসুন, হাত দিয়ে দেখুন, পড়ুন। না কিনলেও চলবে।' বই না কিনেও হাত দেওয়া যাবে বইয়ে খুশিমতো? পড়া যাবে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই? এই নতুনরকমের অভ্যর্থনায় দিশেহারা হয়ে যাই আমরা, সময় পেলেই তাই চলে যাই একবার সিগনেটে।"

সত্যজিৎ রায় ও সিগনেট সম্পাদনা

একটা চাকরির আশায় দিলীপ গুপ্তর সঙ্গে দেখা করতে তাঁর রামময় রোডের বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়। সত্যজিৎ দোতলায় প্যাসেজের শেষ প্রান্তে বৈঠকখানায় বসে অপেক্ষা করেছিলেন। মিনিট খানেকের মধ্যেই চটির ভারী শব্দের সঙ্গে–সঙ্গে ডি কে–র প্রবেশ। কিমার কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ডি কে–র পছন্দ হয়ে গেল তরুণ শিল্পীকে। চাকরির প্রতিশ্রুতি দিলেও একটা কথা বলে সত্যজিৎকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন– ‘দ্য স্যালারি উইল ব্রেক ইওর হার্ট।’সত্যজিৎ কাজে যোগ দেওয়ার বছর খানেকের মধ্যেই সিগনেট প্রেসের যাত্রা শুরু।

সিগনেটের জন্য সত্যজিতের করা প্রথম প্রচ্ছদ অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ক্ষীরের পুতুল (১৯৪৪)। ছোটদের রূপকথাধর্মী এই লেখাতে রয়েছে আগাগোড়া একটা লৌকিক মেজাজ। সত্যজিৎ আঁকলেন মাথায় টোপর, কোঁচানো ধুতি আর নাগরা জুতো পায়ে পুতুল বর তাকিয়ায় ঠেসান দিয়ে বসে রয়েছে, পাশে রাখা গোড়ে মালা যা অনেকটা ফুলের আকৃতি নিয়েছে। কালো রঙের ড্রয়িং-এ তুলির টানের যে ছন্দ তৈরি হয়েছে সেটা গোটা ছবির মধ্যে বঙ্গীয় মোটিফের ছাপটিকে বেশ স্পষ্ট করে তুলছে। এর বেশ কয়েকবছর বাদে ক্ষীরের পুতুল-এর একটা পেপার-ব্যাক সংস্করণ প্রকাশ করে সিগনেট যার প্রচ্ছদটাও এঁকেছিলেন সত্যজিৎ

 
ক্ষীরের পুতুল, সিগনেটের জন্য আঁকা সত্যজিতের প্রথম প্রচ্ছদ

আগেরটার তুলনায় ছোট আর আড়াআড়ি লম্বাটে মাপের এই বইয়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রচ্ছদে দেখা গেল একেবারে অন্য থিম। দু'দিকে দু'জন বেহারা সমেত পালকি চেপে বিয়ে করতে চলেছে পুতুল বর। ডিজাইনটাও নতুন ধরনের, সবুজ আর লাল, শুধু এই দুটো রং, বেশির ভাগটাই ফ্ল্যাটভাবে লাগানো কিন্তু তারই মধ্যে কারুকার্য করা পালকি থেকে শুরু করে গোটা ছবির মধ্যে তৈরি হয়েছে নানারকম ডিটেলস। এখানে সত্যজিৎ দুটো রংকেই ছোট ছোট অংশে ভেঙে নিয়ে সাজিয়েছেন এমনভাবে যাতে ড্রয়িং-এর মধ্যে লোকশিল্পের ধাঁচটা বজায় থাকে।অবনীন্দ্রনাথের বুড়ো আংলা-র (১৯৫৩) প্রচ্ছদে আবার রয়েছে অদ্ভুত শুঁড়তোলা নকশা যার মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছে একটা মানুষের ফিগার — এখানেও যেটা সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছে ওই সাদা অংশটাই।

শুরু থেকেই সিগনেট প্রেস উদ্যোগী হয়েছিল, সুকুমার রায়ের যাবতীয় প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত রচনার নতুন প্রকাশে। অবধারিত ভাবে প্রচ্ছদ বা ছবি আঁকার পুরো দায়িত্বটাই পেয়েছিলেন সত্যজিৎ। মোটামুটি ভাবে ১৯৪৪ থেকে ১৯৫৬-র মধ্যে এ সব বই প্রকাশিত হয়েছে। যদিও পূর্ব প্রকাশিত আবোল তাবোল আর হযবরল-র প্রচ্ছদ নিজেই এঁকে গিয়েছিলেন সুকুমার, তবু সিগনেটের চাহিদা ছিল। আধুনিক সংস্করণের জন্য নতুন প্রচ্ছদ। ফলে সুকুমারের মূল ডিজাইনকে কতখানি রাখা হবে না হবে এই দোটানায় পড়ে এখানে সত্যজিৎ প্রচ্ছদ আঁকায় ঠিক কতটা স্বাধীনতা পেয়েছিলেন বলা শক্ত।

 
সত্যজিৎ রায়

এমনিতে মজার আঁকায় তিনি যে যথেষ্ট অভ্যস্ত সেটা তাঁর জীবনের প্রথম দুটো প্রচ্ছদেই বোঝা গিয়েছিল। সেই অনুসারে ১৯৪৬-এ সিগনেট যখন পাগলা দাশুর নতুন একটা সংস্করণ প্রকাশ করল তখন তার প্রচ্ছদে কোনও ঘটনা না দেখিয়ে শুধু দাশুর মুখটাকেই আঁকলেন সত্যজিৎ এবং তাতেই বোঝা গেল এই ধরনের ড্রয়িং-এ আগের থেকে তিনি আরও অনেক পাকাপোক্ত হয়ে উঠেছেন।আবোল তাবোল-এর পর ১৯৫০-এ সিগনেট থেকে প্রকাশিত হয় সুকুমারের আরও একটা ছড়া সংকলন খাই খাই এবং এরও প্রচ্ছদ আঁকেন সত্যজিৎ।

 
পাগলা দাশুর সিগনেট সংস্করণের প্রচ্ছদ

১৯৫৩ সালে সিগনেট থেকে প্রকাশ পায় , সত্যজিতের প্রচ্ছদে ,বিখ্যাত শিকারি জিম করবেট-এর লেখা ম্যান ইটারস অফ কুমায়ুন-এর বাংলা অনুবাদ কুমায়ুনের মানুষখেকো বাঘ।সত্যজিৎ বিষয়টাকে নিয়ে এখানে একটু অন্য ভাবে চিন্তা করেছেন। বাঘ অথবা শিকারি কোনওটাই নয়, তিনি চলে গিয়েছেন একেবারে মূল জায়গাটায় অর্থাৎ বাঘ শিকার-এ।গোটা প্রচ্ছদ জুড়ে তিনি বড় করে দেখালেন বাঘের গায়ে গুলি লাগার দাগ – শুধু এইটাই। অর্থাৎ আঁকা হল বাঘছালের একটা অংশ— যেখানে হলুদের ওপর কালো ডোরা ডোরা দাগ – যেটা নিজে থেকেই চমৎকার একটা প্যাটার্ন তৈরি করছে। সেই সঙ্গে গুলির দাগ বোঝাতে একটু অফসেন্টার-এ গোল কাট-আউট করা যার মধ্যে ছাপা হয়েছে বই আর লেখকের নাম। পিছনের প্রচ্ছদেও একই ডিজাইন এবং এখানেও একটা গোল কাট-আউট। অর্থাৎ বইটাকে পুরো মেলে ধরলে সামনের আর পিছনের প্রচ্ছদ নিয়ে মনে হবে বাঘের শরীরের দুটো দিক যার একটা দিয়ে গুলিটা ঢুকেছে আর অন্যটা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে।

এখানে সত্যজিৎ নজর রেখেছিলেন অত্যন্ত জরুরি একটা ডিটেলস-এর দিকে। যেহেতু নিয়ম হল গুলি বেরিয়ে যাওয়ার গর্তটা একটু বেশি বড় হয়, সেই হিসেবে পিছনের প্রচ্ছদের গুলির দাগটাকেও বেশি বড় করে দেখানো হয়েছে।

এরপর ১৯৫০-এর দশকের কথা— এই পর্বে এসেই সত্যজিৎ সম্ভবত তাঁর জীবনের সব থেকে স্মরণীয় কয়েকটি বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকেন। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলতে হয় বেশ কিছু কবিতার বই সম্পর্কে যেখানে দেখা যায় কাব্যের নিজস্ব ভাবনাগুলিকে ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভিসুয়ালের ধারাটাকেই তিনি পালটে দিয়েছিলেন কী অসাধারণ ভাবে।যেমন ১৯৫২-এ প্রকাশিত জীবনানন্দ দাশের কবিতা সংকলন বনলতা সেন|বনলতা যেন কবির রোমান্টিকতার সঙ্গে মিশে থাকা এক চিরন্তন বাঙালি নারী।

 
বনলতা সেনের সিগনেট সংস্করণ

প্রচ্ছদেও তাই ঘন লতাপাতার মাঝখান থেকে বেরিয়ে থাকে তাঁর ঘোমটা দেওয়া লম্বাটে মুখখানা— বনের পাক খাওয়া লতার মতোই যাকে বড় কোমল আর স্পর্শকাতর দেখায়। গোটা প্রচ্ছদ একরঙা সরু সরু অজস্র লাইনের নানারকম প্যাটার্ন দিয়ে ভরাট করা— বিশেষ করে বনলতার মুখ আর চুলের মধ্যে ঘন বুনোটগুলি তার চেহারাকে যেন অদ্ভুত সুররিয়ালিস্টিক করে তুলেছে। কিছুটা ধূসরতায় ঢাকা এই নারী হয়তো প্রথাগত ভাবে সুন্দরী নয় তবে জীবনানন্দের কবিতার মতোই এই মুখশ্রী যথার্থই রূপকধর্মী। প্রচ্ছদে বনলতার মুখের গড়নের সঙ্গে সম্পূর্ণ মানানসই করে সত্যজিৎ এঁকেছেন তাঁর টানাটানা দুটো চোখ যার মধ্যে খেলা করে অদ্ভুত একটা মোহময়ী ভাব, আড়চোখে তাকিয়ে থেকে সে অবশ্যই পাঠককে কবিতার বিশেষ অভিব্যক্তিগুলোকে ভীষণভাবে মনে পড়িয়ে দেয়।

নরেশ গুহ-র দুরন্ত দুপুর-ও কবিতার সংকলন (১৯৫২), সত্যজিৎ প্রচ্ছদ এঁকেছেন 'দুরন্ত দুপুর' কবিতাটি নিয়েই।


মলাট জোড়া কাঁচা হলুদ রঙে দুপুরের কড়া রোদের ইঙ্গিত, তারই মধ্যে গায়ের কাপড় আলগা করে, এলোচুল ছড়িয়ে ঘুমিয়ে রয়েছে এক সুন্দরী, যার শরীরের ওপর দিকটাই শুধু ফ্রেমের মধ্যে দেখা যায়। নিব-এর সরু টানে এই একাকিনীকে আঁকতে গিয়ে, তার দেহের ভঙ্গিমার মধ্যে সত্যজিৎ অনায়াসেই আরোপ করেছেন ফরাসি শিল্পী আঁরি মাতিসের ড্রয়িং-এর সাবলীল ছন্দোময়তা। নাক আর মুখ বাদে শরীরের বাকি অংশ অ্যানাটমি মেনে আঁকা। ফিমেল ফিগার সম্বন্ধে রীতিমতো স্টাডি না থাকলে এই ধরনের পরিকল্পনা রূপায়িত করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে শুয়ে থাকার সময় মাথার চুল যাতে মুখে না পড়ে সেজন্য মেয়েরা যে একটা হাত কপালের ওপর ফেলে রাখে, এই ব্যাপারটা কম্পোজিশনের মধ্যে সুন্দর ভাবে ব্যবহার করেছেন সত্যজিৎ। মেয়েটির ছড়ানো চুলকেও ছোট ছোট বাঁকা লাইনে ভেঙে নিয়ে গোটা ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা টেক্সচার তৈরি করে ফ্ল্যাট জায়গাটা ভরাট করে দিয়েছেন। ছবিটির মধ্যে সব মিলিয়ে যে একটা চাপা শরীরী আবেদন ফুটে উঠছে সেটা মূলত মেয়েটির বুকের কাছে এক হাতে কাপড়টি ধরে রাখার ভঙ্গিটির জন্য। সামান্য কয়েকটি লাইন দিয়ে ভাঁজ করা কাপড়টিকে সত্যজিৎ যেন একটা বিপজ্জনক বর্ডার লাইনে এনে ছেড়ে দিয়েছেন। একই সঙ্গে লিরিকাল ও সেনসুয়াস এই ছবি যেন শুধু বইয়ের প্রচ্ছদ নয়, হয়ে উঠেছে স্বতন্ত্র এক শিল্পসৃষ্টি।

১৯৫৩-য় সত্যজিৎ আঁকলেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর অমাবস্যা-র প্রচ্ছদ। কালো জমির ওপর সাদা প্যাস্টেলে আঁকা এক নারীর মুখ। কালোর ওপর সাদা রঙে আর এক নারীকে দেখা গেল বিষ্ণু দে-র কবিতার বই নাম রেখেছি কোমল গান্ধার-এর প্রচ্ছদে (১৯৫৩)

এখানে জলরঙে আঁকা ঊনিশ শতকের একটি কালীঘাট পটচিত্রে হাঁটু মুড়ে বসে থাকা এক বীণাবাদিনীর যেন রূপান্তর ঘটালেন সত্যজিৎ। ফিকে হলুদ ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর একটা কালো চৌখুপি যার মধ্যে সরু সাদা আঁচড় টেনে রঙিন ছবিটার শুধুমাত্র outline impressionটা ফুটিয়ে তোলা হল। একই সঙ্গে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশ্রণে গড়ে ওঠা এই লোকশিল্পের মূল ফর্মকে অক্ষুণ্ণ রেখেও সম্পূর্ণ অন্য একটা চেহারা দিয়ে দিলেন সত্যজিৎ। এর ফলে বাঙালি ও তার সংগীত চেতনার এই রেফারেন্স যেন বিশেষভাবে সার্থক করে তুলল বইয়ের নামকে।

সিগনেট-এর দুটি উপন্যাসের প্রচ্ছদকেও সত্যজিৎ যথেষ্ট লিরিকাল করে তুলেছিলেন দুটি নারীর মুখকে দু'রকম ভাবে ব্যবহার করে। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের নবনীতা-য় (১৯৫৪) গয়নাপরা নববধূর চোখ নামানো মুখখানা আঁকা হয়েছিল পেপার কাটিং পদ্ধতিতে। টুকরো টুকরো প্যাটার্ন দিয়ে তৈরি গোটা ছবিটায় কালোর মধ্যে সাদার ঝলমলে বাহার। খাঁটি উৎসবের একটা মেজাজ পাওয়া যায় খুব সহজেই।

আর এক নারী লীলা মজুমদারের জোনাকি-র(১৯৫৫) প্রচ্ছদে। গাঢ় নীলের মধ্যে সাদায় এক নারীর প্রোফাইল — যার চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে মোটা থেকে সরু হয়ে যাওয়া হালকা নীলে অজস্র সরু বাঁকা লাইন। তুলির শক্ত বাঁট-এর পিছন দিকটাকে রঙে ডুবিয়ে এমন দ্রুততার সঙ্গে লাইনগুলো টানা যে মনে হয় অন্ধকারে জোনাকির মধ্যে মিশে গিয়ে নিজেও এক জোনাকি হয়ে উঠেছে ওই নারী।


ডিজাইনের ব্যাপারে সিগনেট প্রেস যে সমস্ত অভিনব পরিকল্পনা নিত, তার মধ্যে একটা ছিল বইয়ের ‘টাইটেল পেজ' টাকে একটা বিশেষ চেহারা দেওয়া। প্রচ্ছদের বিকল্প হিসেবে যে কোনও বইতেই এই টাইটেল পেজের গুরুত্ব অনেকখানি।এখানে দেওয়া থাকে বই, লেখক, প্রকাশকের নাম, ঠিকানা ইত্যাদি। মূল প্রচ্ছদটি কোনও কারণে নষ্ট হয়ে গেলেও ভেতরের এই পাতাটা পড়ে পাঠক বইটার সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলি পেয়ে যান। প্রথম থেকেই সিগনেট চেয়েছিল যাতে এই পাতায় কোনওভাবে বইটির বিষয়বস্তুর একটা আভাস দেওয়া যায়। ঠিক হয় যে প্রচ্ছদেরই একটা extension হিসেবে এই কাজের দায়িত্ব নিতে হবে বইয়ের প্রচ্ছদ শিল্পীকেই। ফলে সিগনেট-এর বেশির ভাগ বইয়ের টাইটেল পেজের ডিজাইন সত্যজিতেরই করা। সামান্য একখানা পাতা যে গোটা বইয়ের মধ্যে কীভাবে একটা স্বতন্ত্র মেজাজ গড়ে তুলতে পারে, সত্যজিতের এই কাজগুলো না দেখলে সেটা বিশ্বাস করা যেত না।

সাধারণত প্রচ্ছদে কোনও ছবি থাকলে তারই একটা ছোট মোটিফ তিনি করে দিতেন টাইটেল-এর পাতায়। যেমন দুরন্ত দুপুর বা বনলতা সেন-এর ক্ষেত্রে প্রচ্ছদের দুই নারীকেই তিনি আঁকলেন প্রায় একই ভঙ্গিতে শুধু লাইনের ছন্দটা আরও সহজ আর স্পষ্ট হয়ে উঠল। বনলতা সেন-এ আবার মহিলার মাথার চুলের একটা অংশকে ঝুলিয়ে দিলেন বনলতা আর সেন এই দুটো লেখার মাঝখান দিয়ে—প্রচ্ছদে জোনাকির যেরকম একটা এফেক্ট এনেছিলেন সত্যজিৎ— টাইটেল-এও প্রায় সেইরকম একটা এফেক্ট তৈরি হল অন্যভাবে। এখানে জো, না, কি, এই তিনটে অক্ষরকে তিনি ছোট ছোট অংশে ভেঙে নিয়ে একটা ঝোপের মতো এঁকে তার মধ্যে ছড়িয়ে দিলেন— মনে হবে জোনাকিরা এখানে খেলা করছে। একই রকম অতুলনীয় রূপসী বাংলা-র (১৯৫৭) টাইটেল-এ নারীর মুখটা ছোট করে এঁকে তার চারপাশে তুলি দিয়ে লাল রঙের একটা পোঁচ টেনে দেওয়া। যার ফলে একই সঙ্গে মাথায় চুল আর শাড়ির লাল পাড় মিলিয়ে বাঙালি বধূর একটা নিখুঁত ছবি স্পষ্ট হয়ে উঠল।

আবার অনেক জায়গায় একেবারেই কোনও ছবি না এঁকে সত্যজিৎ চমক লাগিয়েছেন শুধু ছাপার অক্ষর কাজে লাগিয়ে। যেমন সুধীন্দ্রনাথ দত্তের অর্কেস্ট্রা-র (১৯৫৪) তিনটে অক্ষরকে একই মাপ আর একই গ্রুপ থেকে নিয়ে পাশাপাশি বসিয়েছেন, প্রথমটাকে নর্মাল রেখে— পরের দুটোর একটা চওড়া করে (expanded) আর পরেরটাকে চেপে দিয়ে (condensed)। একই শব্দের অক্ষর বিন্যাসের মধ্যে এই ধরনের বৈচিত্র্য যেন ভিন্ন ভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের হারমনির মতো হয়ে গিয়ে (সুধীন্দ্রনাথ অনূদিত কবিতার সংকলন) অর্কেস্ট্রা কথাটাকে পুরোপুরি সার্থক করে তুলেছে। তবে এর থেকে আরও বেশি খেলাচ্ছলে তিনি প্রতিধ্বনি-র (১৯৫৪)টাইটেল-এ প্রতিধ্বনি জিনিসটাকে বুঝিয়েছেন— শব্দটির চারটে অক্ষরকে স্রেফ আলাদাভাবে চারটে কোনায় বসিয়ে দিয়ে। অক্ষরগুলোই যেন প্রতিধ্বনির মতো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। সিগনেট-এ টাইটেল পেজ আলাদা গুরুত্ব পেয়েছিল বলেই গ্রাফিক কমিউনিকেশন নিয়ে এই ধরনের অসাধারণ সব কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন সত্যজিৎ।১৯৫৯-য় প্রকাশিত হয় সিগনেট এর জন্য আঁকা সত্যজিতের সর্বশেষ বইয়ের প্রচ্ছদ— বিষ্ণু দে'র প্রবন্ধ সংকলন সাহিত্যের ভবিষ্যৎ। এরপর চিরকালের মতো সমাপ্তি ঘটে যায় শিল্পসৃষ্টির এক সুবর্ণ অধ্যায়ের। এক দিকে সিনেমার কাজের ক্রমবর্ধমান চাপ, অন্য দিকে পুনঃপ্রকাশিত সন্দেশ সম্পাদনা— সিগনেট থেকে সরে আসার পিছনে এই কারণগুলোর কথাই বলেছেন সত্যজিৎ। ১৯৫০-এর দশকের শেষ থেকে সিগনেট-এর ব্যবসা পড়তে শুরু করলেও প্রায় ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত অল্পবিস্তর বই তাদের ছাপা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও সত্যজিৎ এবং সিগনেট প্রেস-এর মধ্যে আর নতুন ভাবে কোনও যোগাযোগ ঘটেনি।

পতন ও পুনরুজ্জীবন সম্পাদনা

সত্তরের দশকের শেষের দিকে কর্ণধার ডি. কে অসুস্থ হয়ে পড়েন, সেকারণে ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের পর বহুদিন পুস্তক প্রকাশনা বন্ধ থাকে এবং ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুর পরে, সিগনেট পাবলিশিং হাউস বন্ধ হয়ে যায়।

প্রকাশনা সংস্থাটির গৌরবোজ্জল অতীতের কথা স্মরণে রেখে আনন্দ পাবলিশার্স এটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে কিনে নেয় এবং ২০১১ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর পুনরায় চালু হয়। পুরানো ঐতিহাসিক প্রকাশনা সংস্থার ক্লাসিক সংস্করণ এখন আবার সাধারণ পাঠকদের সহজলভ্য, তা সাম্প্রতিক কালের সমর সেনের কবিতা হোক, সুকুমার রায়ের রচনা হোক বা সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সংবর্ত বা বিষ্ণু দের -এর নাম রেখেছি কোমল গান্ধার।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য প্রকাশনা সম্পাদনা

  1. বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের “ প্রিজন ডে’জ” (১৯৪৫)
  2. কৃষ্ণা নেহেরু হাতিসিং-এর “উইথ নো রিগ্রেটস অ্যান অটোবায়োগ্রাফি” (১৯৪৫)
  3. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ভূতপতরির দেশ” (১৯৬৭) এবং খাতাঞ্জির খাতা” (১৯৭৩)
  4. বিষ্ণু দে’র "নাম রেখেছি কোমল গান্ধার" (১৩৬০ বঙ্গাব্দ) ,“চোরাবালি” (১৯৬০) এবং “উর্বশী ও অর্টেমিস” (১৯৬১)
  5. সুধীন্দ্রনাথ দত্ত -র সংবর্ত ,অর্কেস্ট্রা ,কুলায় ও কালপুরুষ আর স্বগত ।
  1. অমিয়ভূষণ মজুমদারের “দীপিতার ঘরে রাত্রি” (১৯৬৫)
  2. জীবনানন্দ দাশের “মহাপৃথিবী” (১৯৬৯), রুপসী বাংলা
 
রূপসী বাংলার প্রচ্ছদ
  1. সুনীল গঙ্গাপাধ্যায়ের “প্রতিদ্বন্দ্বী” (১৯৬৯)[১]
  2. লীলা মজুমদারের "সব ভুতুড়ে"
  3. দিলীপকুমার গুপ্তর "আম আঁটির ভেঁপু" (পথের পাঁচালীর শিশু সংস্করণ) এবং "কোন খেদ নেই" কৃষ্ণা নেহেরু হাতিসিং-এর বইটির বাংলা অনুবাদ।

তথ্যসূত্র সম্পাদনা

  1. "সিগনেটের ম্যাডাম"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০২-২৮ 
  2. Robinson, Andrew (২০০৪)। Satyajit Ray: the Inner Eye (ইংরাজীতে)। লন্ডন: I.B. Tauris। আইএসবিএন 1-86064-965-3 
  3. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬, পৃষ্ঠা ২৮৪, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬