সংস্কৃত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়
সংস্কৃত কলেজ উত্তর কলকাতার কলেজ স্ট্রিট চত্বরের এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে সংস্কৃত ভাষা, পালি ভাষা, ভারতীয় এবং বিশ্ব ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে স্নাতক ও স্নাকত্তোর পর্যায়ে পড়ানো হয়। ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে কলেজটি রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় সংস্কৃত কলেজ আইন ২০১৫-এর মাধ্যমে। অতীতে কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় ছিল।[১]
ধরন | সরকারি |
---|---|
স্থাপিত | ১৮২৪ কলেজ, ২০১৬ বিশ্ববিদ্যালয় |
অধিভুক্তি | বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ভারত) |
আচার্য | পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল |
উপাচার্য | সোমা বন্দ্যোপাধ্যায় |
অবস্থান | কলেজ স্ট্রিট, কলকাতা |
শিক্ষাঙ্গন | শহুরে |
সংক্ষিপ্ত নাম | সংস্কৃত কলেজ |
ওয়েবসাইট | www |
ইতিহাস
সম্পাদনাসংস্কৃত কলেজ স্থাপিত হয় ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে।[২] ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জুলাই গভর্নর জেনারেল কর্তৃক গৃহীত এক প্রস্তাবে ইতিপূর্বে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির জন্য জনশিক্ষা সংক্রান্ত একটি সাধারণ কমিটি গঠনের কাজ সক্রিয় বিবেচনাধীন ছিল। কমিটিতে এইচ টি প্রিন্সেপ, মেকলে ও এইচ এইচ উইলসনের মতো প্রাচ্যবিদসহ দশজন সদস্য অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যগণ প্রাচ্যদেশীয় বিদ্যা শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন এবং কলকাতায় সংস্কৃত কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবটি রামমোহন রায় এর প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হয়। তিনি ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দের ১১ ডিসেম্বর তারিখে গভর্নর জেনারেলের নিকট দাখিলকৃত এক স্মারকলিপিতে কমিটির সিদ্ধান্তের ব্যাপারে প্রচণ্ড আপত্তি তোলেন। এর পরিবর্তে তিনি প্রস্তাব করেন যে, সরকারের উচিত ইউরোপে শিক্ষালাভকারী বিদ্বান ব্যক্তিদের নিয়োজিত করার মাধ্যমে অন্যান্য উপযোগী বিজ্ঞানের সঙ্গে গণিত, প্রাকৃতিক দর্শন, রসায়নশাস্ত্র ও অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যাকে অন্তর্ভুক্ত করে অধিক উদারবাদী ও জ্ঞানালোকপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থাকে সম্মুখপানে এগিয়ে নেওয়া এবং প্রয়োজনীয় বইপত্র, সরঞ্জাম ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি দ্বারা সজ্জিত একটি কলেজ গড়ে তোলা।
লর্ড আমহার্স্ট অবশ্য এ স্মারকলিপিতে তেমন একটা কর্ণপাত করেননি এবং ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দর ১ জানুয়ারি কলকাতার বউবাজার স্ট্রিটে একটি ভাড়া করা বাড়িতে সংস্কৃত কলেজ যাত্রা শুরু করে। প্রারম্ভে শুধু ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের সংস্কৃত কলেজের ক্লাসে উপস্থিত থাকার অনুমতি দেওয়া হয়। ১৮২৭ খ্রিস্টাব্দর ১ মে প্রথমবারের মতো ইংরেজি ক্লাস, যদিও ঐচ্ছিক ভিত্তিতে, প্রবর্তন করা হয়। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ রামমাণিক্য বিদ্যালঙ্কারের মৃত্যুর পর পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দর সহকারী সচিব হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। সচিব রসময় দত্তের অবসর গ্রহণের পর শিক্ষা পরিষদ সংস্কৃত কলেজকে কলকাতা মাদ্রাসার সমমর্যাদা দেয় এবং বিদ্যাসাগরকে প্রথম অধ্যক্ষ নিয়োগ করে।
প্রতিষ্ঠার সময় থেকে কলকাতা সংস্কৃত কলেজকে এদেশীয় হিন্দু শিক্ষা প্রদান করার জন্য একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কল্পনা করা হয়েছিল। পাঠ্যসূচি ও ছুটির তালিকা প্রণয়ন এবং ব্রাহ্মণ ও বৈদ্যদের ছাড়া অন্য সকল বর্গকে শিক্ষার্থী হিসেবে এ বিদ্যাপীঠে প্রবেশ করতে না-দেওয়া ইত্যাদি বিষয়ে কলেজটি সনাতন ধারার প্রতি এর অনমনীয় আনুগত্য প্রদর্শন করেছে। প্রাকৃতিক দর্শন, ভূবিজ্ঞান ও ইতিহাসের ওপর লিখিত গ্রন্থাবলি বাংলায় অনুবাদের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। শিক্ষাদান কার্যে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হোত তা ছিল ইউরোপীয় ধরনের। উদাহরণ স্বরূপ, অঙ্গব্যবচ্ছেদবিদ্যায়, প্রাণিকুলের নরম অংশসমূহের ব্যবচ্ছেদসহ তৎকালে ইউরোপীয় চিকিৎসা-শাস্ত্রগত মূলনীতিসমূহের আদলে ক্লাসে শিক্ষাদান করা হোত। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর এই বিভাগটি তুলে দেওয়া হয়।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
সম্পাদনাকলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠানটিতে অনেক সংস্কার প্রবর্তন করেন। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দর জানুয়ারি মাসে কায়স্থদের এবং ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দর ডিসেম্বর মাসে সকল সম্মানিত হিন্দুদের জন্য কলেজের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়। পরিমিত শিক্ষা ফি প্রবর্তন করা হয় এবং এর সঙ্গে শৃঙ্খলার ও নিয়মিত উপস্থিতির ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। একটি আবশ্যিক বিষয় হিসেবে আরো বেশি জোর প্রদান করে ইংরেজি পুনঃপ্রবর্তন করা হয় এবং গণিত বিষয়টি ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। উপযোগিতার ওপর ভিত্তি করে পাঠক্রম পুরোপুরিভাবে ঢেলে সাজানো হয়। এই কলেজের স্নাতকগণ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদের জন্য উপযুক্ত বলে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এতদিন যাবৎ নবীন শিক্ষার্থীদের নিকট প্রতিবন্ধক বলে প্রমাণিত মুল্যবোধকে প্রতিস্থাপন করতে বিদ্যাসাগর নিজেই সংস্কৃত ব্যাকরণের ওপর দুটি পাণ্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। তার সংস্কারসমূহ একদিক থেকে সংস্কৃত কলেজকে খাঁটি ও গভীর জ্ঞানপূর্ণ সংস্কৃত শিক্ষার আবাস এবং একই সঙ্গে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের উন্নত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার ব্যাপারে তার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে চালিত হয়। সাধারণ জনগণের মধ্যে ওই বিদ্যা ছড়িয়ে দিতে শিক্ষকবৃন্দকে পুরোপুরিভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হোত।
অন্যান্য ব্যক্তিত্ব
সম্পাদনাএই কলেজের অধ্যাপকবৃন্দ ও প্রাক্তন ছাত্রদের কৃতিত্বসমূহ জরিপ করলে দেখা যায় যে, তারা শুধু বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃত ভাষাকে সমৃদ্ধই করেননি, বরং কলেজটি প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারায় নিমজ্জিত জনসাধারণের মধ্যে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণারও অপনোদন করে। বাংলা ভাষায় প্রথম অভিধান সঙ্কলক রামচন্দ্র তর্কবাগীশ বিধবা বিবাহের ব্যাপারে বিদ্যাসাগরের মতকে পূর্ব থেকেই সমর্থন জানিয়ে আসছিলেন। যিনি এটা প্রথম পালন করেন তিনি হলেন শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন। প্রথম বাংলা সাময়িকী সমাচার দর্পণ প্রকাশিত হওয়ার ব্যাপারে পণ্ডিত জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সাহিত্য প্রচেষ্টার গুরুত্ব অনেক। একজন নামজাদা সংস্কৃত কবি প্রাণকৃষ্ণ বিদ্যাসাগর সাফল্যের সঙ্গে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সমাচার চন্দ্রিকা সম্পাদনা করেন। ন্যায় ক্ষেত্রে জয়নারায়ণ তর্কপঞ্চাননের মতো জ্ঞানী ব্যক্তি, বিহারীলাল চক্রবর্তী, ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও তারানাথ তর্কবাচষ্পতির মতো সাহিত্যিক, কৈলাসচন্দ্র বিদ্যাভূষণ এর ন্যায় পণ্ডিত, শিবনাথ শাস্ত্রীর মতো সমাজ সংস্কারক এবং এরূপ আরো নাম এই প্রতিষ্ঠানটিকে গৌরবান্বিত করেছে।
সিপাহি বিদ্রোহ
সম্পাদনা১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের অব্যবহিত পরে কলেজের চতুষ্পার্শ্বস্থ অঙ্গনাদিসহ মূল ভবনকে সাময়িকভাবে যুদ্ধকালীন হাসপাতাল ও শুশ্রূষা কেন্দ্রে পরিণত করা হয়। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অধ্যক্ষের পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং দীনবন্ধু শর্মা তার স্থলাভিষিক্ত হন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের মতো দেশীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের নিকট থেকে প্রবল আপত্তি আসা সত্ত্বেও ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কলেজটির তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের ক্লাসসমূহ প্রেসিডেন্সি কলেজে স্থানান্তরিত করা হয়। হিন্দু আইনের অধ্যাপকের পদটি বিলুপ্ত করতে হয়। জনশিক্ষা পরিচালকের নিকট লেখা তার চিঠিসমূহে (১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ১৩ এবং ২৩ এপ্রিল তারিখে) অধ্যক্ষ তার আশঙ্কা ব্যক্ত করেন যে, ইংরেজি লোপ করা হলে তা ছাত্রদের দলবদ্ধভাবে অন্যত্র চলে যেতে প্ররোচিত করবে। মহামহোপাধ্যায় মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন ২৫ জন অবৈতনিক ছাত্র নিয়ে কলেজের টোল বিভাগটি পুনরায় চালু করেন, যা সনাতন পদ্ধতিতে পবিত্র গ্রন্থসমূহের ব্যাখ্যা প্রদান করত। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে বিশিষ্ট পণ্ডিতদের নিয়ে সংস্কৃত পরীক্ষার একটি বোর্ড গঠন করা হয়। ১৯১০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এর ছাত্রসংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে এবং বঙ্গে সংস্কৃত শিক্ষার উন্নতিসাধনে গুরুত্বপূর্ণ প্রেরণা যোগাতে কলেজটির ভূমিকা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের রিপোর্টে (১৯১৭-১৯১৯) প্রশংসিত হয়। এফএ পরীক্ষায় ইংরেজি, গণিত, সংস্কৃত, ইতিহাস ও যুক্তিবিদ্যার মতো বিষয়াবলি আবশ্যিক পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়। যে সকল ছাত্র রসায়ন অথবা পদার্থবিদ্যা মতো বিষয় পড়ার সিদ্ধান্ত নিত, তাদেরকে অবশ্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ক্লাস করতে হোত।
বর্তমান অবস্থা
সম্পাদনা১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে দশকব্যাপী দার্শনিক ও ইংরেজি ভাষায় সুপণ্ডিত ডক্টর সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত কলকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কলা বিভাগটি ইতিপূর্বেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয় এবং কলেজটিতে পালি, প্রাচীন ভারতীয় ও বিশ্ব ইতিহাস এবং ভাষাতত্ত্বের পাঠক্রমসমূহ পড়ানো হোত। সংস্কৃত ছাড়াও প্রাচ্যদেশীয় অথবা টোল বিভাগসমূহ এই কলেজের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ "INDIAN GOVERNMENT: Special commemorative postage stamp on Sanskrit College"। INDIAN GOVERNMENT। ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯। সংগ্রহের তারিখ ১৯ জানুয়ারি ২০১০।[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ রচনা চক্রবর্তী (২০১২)। "সংস্কৃত কলেজ, কলকাতা"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- প্রাতিষ্ঠানিক ওয়েবসাইট ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১৩ আগস্ট ২০২০ তারিখে