বিহারীলাল চক্রবর্তী
বিহারীলাল চক্রবর্তী (২১ মে, ১৮৩৫ - ২৪ মে, ১৮৯৪) বাংলা ভাষার কবি। বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতি-কবি হিসেবে তিনি সুপরিচিত। রবীন্দ্রনাথ তাকে বাঙলা গীতি কাব্য-ধারার 'ভোরের পাখি' বলে আখ্যায়িত করেন। তার সব কাব্যই বিশুদ্ধ গীতিকাব্য। মনোবীণার নিভৃত ঝংকারে তার কাব্যের সৃষ্টি। বাঙালি কবি মানসের বহির্মুখী দৃষ্টিকে অন্তর্মুখী করার ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য।[১]
বিহারীলাল চক্রবর্তী | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | ২৪ মে ১৮৯৪ | (বয়স ৫৯)
পেশা | কবি, সাংবাদিক |
পরিচিতির কারণ | বাঙ্গালি কবি |
অতি অল্পকালের ভিতরে তিনি বাংলা কবিতার প্রচলিত ধারার পরিবর্তন ঘটিয়ে নিবিড় অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমে গীতিকবিতার ধারা চালু করেন। এ বিষয়ে তিনি সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্যের মাধ্যমে গভীরভাবে প্রভাবিত হন। বিহারীলাল তার কবিতায় ভাবের আধিক্যকে খুব বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। প্রকৃতি ও প্রেম, সংগীতের উপস্থিতি, সহজ-সরল ভাষা বিহারীলালের কবিতাকে দিয়েছে আলাদাধারার বৈশিষ্ট্য।[২]
জন্ম ও শৈশবসম্পাদনা
বিহারীলাল চক্রবর্তী ২১ মে, ১৮৩৫ তারিখে কলকাতার জোড়াবাগান অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম দীননাথ চক্রবর্তী। মাত্র চার বছর বয়সে মাতা মারা যান।[১]
শিক্ষাজীবনসম্পাদনা
বিহারীলাল চক্রবর্তী শৈশবে নিজ গৃহে সংস্কৃত ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে জ্ঞান অর্জন করেন। তিনি কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তিন বছর অধ্যয়ন করেন।[১]
বিবাহসম্পাদনা
বিহারীলাল চক্রবর্তী উনিশ বছর বয়সে দশ বছরের অভয়া দেবীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। [১]
কর্মজীবনসম্পাদনা
বিহারীলাল এর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ হল "স্বপ্নদর্শন"(১৮৫৮)। তার রচনাবলীর মধ্যে "স্বপ্নদর্শন" (১৮৫৮), "সঙ্গীত শতক" (১৮৬২), "বঙ্গসুন্দরী" (১৮৭০), "নিসর্গসন্দর্শন "(১৮৭০), "বন্ধুবিয়োগ "(১৮৭০), "প্রেম প্রবাহিনী" (১৮৭০), "সারদামঙ্গল "(১৮৭৯), " দেবরানী" (১৮৮২), "বাউলবিংশতি" (১৮৮৭), "সাধের আসন" (১৮৮৯), " ধূূমকেতু "(১৮৯৯) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তিনি "পূর্ণিমা" (১২৬৫ বঙ্গাব্দ), "সাহিত্য সংক্রান্তি"(১৮০৬)," অবোধবন্ধু "(১৮৬৩)ইত্যাদি তার সম্পাদিত পত্রিকা। সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেও তিনি যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন।[৩][৪]
"সারদামঙ্গল " কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কাব্য। আখ্যানকাব্য হলেও এর আখ্যানবস্তু সামান্যই। মূলত গীতিকবিতাধর্মী কাব্য এটি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই কাব্য সম্পর্কে লিখেছেন, “সূর্যাস্ত কালের সুবর্ণমণ্ডিত মেঘমালার মত সারদামঙ্গলের সোনার শ্লোকগুলি বিবিধরূপের আভাস দেয়। কিন্তু কোন রূপকে স্থায়ীভাবে ধারণ করিয়া রাখে না। অথচ সুদূর সৌন্দর্য স্বর্গ হইতে একটি অপূর্ণ পূরবী রাগিণী প্রবাহিত হইয়া অন্তরাত্মাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিতে থাকে।”[৫] সমালোচক শিশিরকুমার দাশের মতে, “মহাকাব্যের পরাক্রমধারার পাশে সারদামঙ্গল গীতিকাব্যের আবির্ভাব এবং শেষপর্যন্ত গীতিকাব্যের কাছে মহাকাব্যের পরাজয়ের ইতিহাসে সারদামঙ্গল ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ কাব্য।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] বিহারীলালের লেখা কবিতার চারটি চরণ খুবই বিখ্যাতঃ
সর্বদাই হু হু করে মন,
বিশ্ব যেন মরুর মতন।
চারি দিকে ঝালাফালা।
উঃ কী জ্বলন্ত জ্বালা,
অগ্নিকুণ্ডে পতঙ্গপতন।
তার প্রথম স্বার্থক গীতিকাব্য "বঙ্গসুন্দরী "(১৮৭০)। এই কাব্যটি দশটি সর্গে বিভক্ত।কবি এই কাব্যে বঙ্গ নারীর বন্দনা করেছেন। কাব্যের দশটি সর্গ হল "উপহার ", " নারী বন্দনা ", "সুরবালা " , "চিরপরাধিনী " "করুনাসুন্দরী " , "বিষাদিনী", "প্রিয়সখী ", "বিরহিনী", "প্রিয়়়তমা" ও " অভাগিনী "।
"পূর্ণিমা" (১২৬৫ বঙ্গাব্দ) নামে একটি পক্ষিক সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। এছাড়াও অবোধ বধূ ও সাহিত্য সংক্রান্তি তার সম্পাদিত পত্রিকা।
কাব্যসম্পাদনা
- "স্বপ্নদর্শন" (১৮৫৮) এটি তাঁর প্রথম রচনা।একটি গদ্য গ্রন্থ। সংস্কৃত কলেজে পাঠরত অবস্থায় কবি এই গ্রন্থ রচনা করেন "পূর্ণিমা" পত্রিকায়। "সংবাদ প্রভাকর " পত্রিকা(১৮৫৮,৩রা আগস্ট) এই গ্রন্থের প্রশংসা করে। গ্রন্থটির বিষয় ছিল দেশ ও দেশমাতৃকার দুর্ভাগ্যের জন্য গভীর আক্ষেপ।
- "সঙ্গীতশতক" (১৮৬২) এটি তাঁর রচিত দ্বিতীয় গ্রন্থ। গ্রন্থটি একশত(১০০) বাংলা গানের সমষ্টি। কবি এই গ্রন্থ সম্পর্কে অনাথবন্ধু রায়কে লিখেছিলেন, "১৫ হইতে ২৫ বৎসর পর্যন্ত আমার মনে যে যে ভাবোদগম হইয়াছিল,তাহার অধিকাংশ "সঙ্গীতশতক" এ বর্ণিত আছে।
এই "সঙ্গীতশতক" গ্রন্থটি দ্বিজেনদরনাথ ঠাকুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।
- "বঙ্গসুন্দরী" (১৮৭০) তাঁর প্রথম স্বার্থক গীতিকাব্য "বঙ্গসুন্দরী "(১৮৭০)। এই কাব্যটি দশটি সর্গে বিভক্ত।কবি এই কাব্যে বঙ্গ নারীর বন্দনা করেছেন। কাব্যের দশটি সর্গ হল "উপহার ", " নারী বন্দনা ", "সুরবালা " , "চিরপরাধিনী " "করুনাসুন্দরী " , "বিষাদিনী", "প্রিয়সখী ", "বিরহিনী", "প্রিয়়়তমা" ও " অভাগিনী "। এই গ্রন্থটির প্রথম সংস্করণের ছিল নয়টি সর্গ, দ্বিতীয় সংস্করণে আর একটি সর্গ "সুরবালা" সংযোজিত হয়।
- "নিসর্গ সন্দর্শন" (১৮৭০)। এটি ধারাবাহিক ভাবে "অবোধবন্ধু" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই কাব্য সাতটি সর্গে রচিত।
- "বন্ধুবিয়োগ" (১৮৭০)প্রথমে 'পূর্ণিমা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। চারটি সর্গে কবি তাঁর চারজন বন্ধু (পূর্ণচন্দ্র,কৈলাস, বিজয় ও রামচন্দ্র) এবং প্রথমা স্ত্রী অভয়ার বিয়োগব্যাথা ব্যক্ত করেছেন।
- "প্রেমপ্রবাহিনী" (১৮৭০)
- "সারদামঙ্গল" (১৮৭৯)
- "সাধের আসন" (১৮৮৯)
- "মায়াদেবী" (১৮৮২)
- "ধূমকেতু" (১৮৮২)
- "নিসর্গসঙ্গীত" (১৮৮২)
- "বাউল বিংশতি" (১৮৮৭)
- "গোধূলি" (১৮৯৯)
তথ্যসূত্রসম্পাদনা
- ↑ ক খ গ ঘ সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত; বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭; পৃষ্ঠা- ২৫২, আইএসবিএন ৯৮৪-০৭-৪৩৫৪-৬
- ↑ দৈনিক কালের কণ্ঠ, ২১ নভেম্বর ২০১২, দেশ জানো বিশ্ব জানো বিহারীলাল চক্রবর্তী[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ রফিকুল ইসলাম ও অন্যান্য সম্পাদিত; কবিতা সংগ্রহ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; জুলাই ১৯৯০; পৃষ্ঠা- ৪৫০-৪৫১।
- ↑ অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, নভেম্বর ২০১৩, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৪৯৪।
- ↑ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আধুনিক সাহিত্য; বিহারীলাল ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৪ মার্চ ২০১৬ তারিখে
"বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, আধুনিক যুগ, ড.দেবেশ কুমার আচার্য।