সুভাষ মুখোপাধ্যায় (কবি)
সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯ – ৮ জুলাই ২০০৩) ছিলেন বিংশ শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবি ও গদ্যকার। কবিতা তার প্রধান সাহিত্যক্ষেত্র হলেও ছড়া, রিপোর্টাজ, ভ্রমণসাহিত্য, অর্থনীতিমূলক রচনা, বিদেশি গ্রন্থের অনুবাদ, কবিতা সম্পর্কিত আলোচনা, উপন্যাস, জীবনী, শিশু ও কিশোর সাহিত্য সকল প্রকার রচনাতেই তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সম্পাদনা করেছেন একাধিক গ্রন্থ এবং বহু দেশি-বিদেশি কবিতা বাংলায় অনুবাদও করেছেন।[১] “প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য় এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা” বা “ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত” প্রভৃতি তার অমর পঙ্ক্তি বাংলায় আজ প্রবাদতুল্য। পরিণত বয়সে গায়ে খদ্দরের পাঞ্জাবি, পরনে সাদা পায়জামা, মাথাভর্তি ঘন কোঁকড়ানো চুল, বুদ্ধিদীপ্ত ঝকঝকে চোখ, চোখে চশমা, বামে চশমার নিচে বড় একটা আঁচিল - কলকাতার প্রতিবেশে এরকম একটি প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিলেন তিনি।[২]
সুভাষ
মুখোপাধ্যায় | |
---|---|
জন্ম | কৃষ্ণনগর, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা পশ্চিমবঙ্গ, ভারত) | ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯১৯
মৃত্যু | জুলাই ৮, ২০০৩ (বয়স ৮৪) কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত |
পেশা | কবি, রাজনীতিবিদ |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
ধরন | কবিতা, উপন্যাস, গীতিনাট্যকার, অনুবাদ |
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার | আকাদেমি পুরস্কার, আকাদেমি ফেলো, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার |
দাম্পত্যসঙ্গী | গীতা মুখোপাধ্যায় |
জীবন
সম্পাদনাপ্রাথমিক জীবন
সম্পাদনাকবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে মামাবাড়িতে। তার পিতার নাম ক্ষিতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মা যামিনী দেবী। পিতা ছিলেন সরকারি আবগারি বিভাগের কর্মচারী; তার বদলির চাকরির সুবাদে কবির ছেলেবেলা কেটেছিল পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে। তার ছেলেবেলার প্রথম দিকটা, যখন তার বয়স তিন-চার, সে সময়টা কেটেছে কলকাতায়, ৫০ নম্বর নেবুতলা লেনে। একটা ভাড়াবাড়ির দোতলায় যৌথ পরিবারের ভিড়ের মধ্যে।[৩] প্রথমে নওগাঁর স্কুলে এবং পরে কলকাতার মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন ও সত্যভামা ইনস্টিটিউশনে পড়াশোনা করেন। ভবানীপুরের মিত্র স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে সক্রিয় রাজনীতি করার মানসে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন।
নিজের বাল্যকাল সম্পর্কে এক চিঠিতে সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘আমার শৈশব কেটেছে রাজশাহীর নওগাঁয়। বাবা ছিলেন আবগারির দারোগা। নওগাঁ শহর ছিল চাকরি, ব্যবসা, নানা বৃত্তিতে রত বহিরাগতদের উপনিবেশ। হিন্দু-মুসলমান এবং বাংলার নানা অঞ্চলের মানুষজনদের মেলানো-মেশানো দিলদরাজ আবহাওয়ায় আমরা একটু অন্যরকমভাবে মানুষ হয়েছিলাম। একদিকে প্রকৃতি, অন্যদিকে যৌথ জীবন। সব সম্প্রদায়েই এমন সব মানুষের কাছে এসেছি যাঁরা স্বধর্মে গোঁড়া, কিন্তু মানুষের সম্বন্ধে উদার। আমার অক্ষরপরিচয় এবং প্রাথমিক শিক্ষা নওগাঁয়। পড়েছি মাইনর স্কুলে। পাঠ্যবইয়ের চেয়েও বেশি পড়েছি পাঠাগারের বই। সেই সঙ্গে আমাকে শিক্ষা দিয়েছে খেলার মাঠ, গান আবৃত্তি অভিনয়ের মঞ্চ। নওগাঁ শহরের জীবন আমার ব্যক্তিত্বের গোড়া বেঁধে দিয়েছিল।’[৪]
১৯৪১ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে অনার্স-সহ বিএ পাস করেন। পরে আশুতোষ কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নে প্রয়াসী হন। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার ফলে পঠনপাঠন বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। কবি শিক্ষকরূপে লাভ করেন কবি কালিদাস রায় ও কালি ও কলম পত্রিকার সম্পাদক মুরলীকৃষ্ণ বসুকে। বিদ্যালয়ে বন্ধুরূপে পেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, রমানাথ রায়, পরিমল সেনগুপ্ত, রমাকৃষ্ণ মৈত্র প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে। আরো পরে কর্মজীবনে তার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় কবি বিষ্ণু দে, সমর সেন, বুদ্ধদেব বসু, কারাজীবনের সঙ্গী আব্দুর রজ্জাক খান, সতীশচন্দ্র পাকড়াশী, উর্দু সাহিত্যিক পারভেজ শহীদী, চারু মজুমদার, গিরিজা মুখোপাধ্যায়, চিন্মোহন সেহানবীশ প্রমুখের।
রাজনৈতিক ও কর্মজীবন
সম্পাদনা১৯৩২-৩৩ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিশোর ছাত্রদল-এর সক্রিয় সদস্যরূপে যোগ দেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। এই সময় কবি সমর সেন তাকে দেন হ্যান্ডবুক অব মার্কসিজম নামে একটি গ্রন্থ। এটি পড়ে মার্কসীয় রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন কবি। ১৯৩৯ সালে লেবার পার্টির সঙ্গে সংযোগ হয় তার। ১৯৪০ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ পদাতিক। পরে ছাত্রনেতা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের প্ররোচনায় লেবার পার্টি ত্যাগ করে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৪২ সালে পান পার্টির সদস্যপদ। এই সময় সদ্যগঠিত ফ্যাসিবিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের সাংগঠনিক কমিটিতে কবি বিষ্ণু দে-র সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন সুভাষ মুখোপাধ্যায়। তারপর মাসিক ১৫ টাকা ভাতায় সর্বক্ষণের কর্মীরূপে যোগ দেন পার্টির জনযুদ্ধ পত্রিকায়। ১৯৪৬ সালে দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকায় সাংবাদিক হিসাবে যোগ দেন কবি। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে বহু কমিউনিস্ট বন্দীর সঙ্গে দু-বার কারাবরণ করেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ও। এই সময় তিনি সামিল হন দমদম জেলের অনশন ধর্মঘটে। ১৯৫০ সালের নভেম্বর মাসে পান মুক্তি।
মুক্তির পর কবির জীবনে দেখা দেয় প্রচণ্ড অর্থকষ্ট। একটি নতুন প্রকাশন সংস্থায় মাত্র ৭৫ টাকা বেতনে সাব-এডিটর নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৫১ সালে সেই চাকরি ত্যাগ করে পরিচয় পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই বছরই পরিণয়-সূত্রে আবদ্ধ হন সুলেখিকা গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ১৯৫২ সালে সস্ত্রীক কবি ওঠেন বজবজ এলাকার শ্রমিক বস্তির একটি মাটির ঘরে; আত্মনিয়োগ করেন সেই অঞ্চলের চটকল মজুর সংগঠনের কাজে। পরে কলকাতার বন্দর অঞ্চলে ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের কাজও করেন। ১৯৬৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হলে তিনি থেকে যান পুরনো পার্টিতেই। ১৯৬৭ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়া হলে আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙে দ্বিতীয়বার কারাবরণ করেন। এই দফায় ১৩ দিন কারারুদ্ধ ছিলেন কবি। মাঝে কিছুকাল সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে একযোগে সন্দেশ পত্রিকাও সম্পাদনা করেছেন তিনি।
সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে একে একে লিখে গেছেন অগ্নিকোণ, চিরকুট, কাল মধুমাস, ফুল ফুটুক, যত দূরেই যাই, ছেলে গেছে বনে, জল সইতে, একটু পা চালিয়ে ভাই প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ; হাংরাস, অন্তরীপ, হ্যানসেনের অসুখ বা ঢোলগোবিন্দের আত্মদর্শন প্রভৃতি গদ্যরচনা; চিঠি জুড়ে জুড়ে লেখা চিঠির দর্পণে-এর মতো অপ্রচলিত কাঠামোর উপন্যাস। অনুবাদ করেছেন নাজিম হিকমত, পাবলো নেরুদা ও হাফিজ-এর কবিতা, চর্যাপদ ও অমরুশতক ইত্যাদি।
শেষজীবন
সম্পাদনাবামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসে শেষ জীবনে। কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে হন বিতর্কিত।
১৯৭০-এর দশক থেকে তার রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিবর্তন সাধিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অকুণ্ঠ সমর্থন জোগালেও তিনি পশ্চিমবঙ্গের নকশাল আন্দোলনকে সমর্থন করেননি; কে কোথায় যায় উপন্যাসে এই আন্দোলনের প্রতি তার বিরূপতা ব্যক্ত করেছিলেন। সমর্থন করেন ১৯৭৭ সালের জরুরি অবস্থাকে। এই সময়েই অ্যাফ্রো-এশীয় লেখক সমিতির কাজের চাপে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন থেকে দূরে সরে আসতে থাকেন কবি। ১৯৮১ সালে রণকৌশল ও অন্যান্য কিছু রাজনৈতিক প্রশ্নে পার্টির সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় পার্টির সদস্যপদ ত্যাগ করেন। এরপর থেকেই বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়। ঘনিষ্ঠতা বাড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনগুলির সঙ্গে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় লাভ করেন তার সান্নিধ্য। ফলে সৃষ্টি হয় বিতর্ক। স্রোতের বিপরীতে চলে পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের কাছে সমালোচিত হন এ-যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত এই বিতর্ক তার পিছু ছাড়েনি।
যকৃৎ ও হৃদপিণ্ডের অসুস্থতার কারণে দীর্ঘকাল রোগভোগের পর ২০০৩ সালে কলকাতায় তার প্রয়াণ ঘটে। মৃত্যুকালে তিনি রেখে যান স্ত্রী ছাড়াও তার তিন পালিতা কন্যাকে।
কাব্য
সম্পাদনাতিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বাঙালি কবি। আধুনিক বাংলা কাব্যজগতে চল্লিশের দশকের অন্যতম কবি হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৪০-এ প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘পদাতিক' প্রকাশের মধ্য তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার জগতে নতুন সুর নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে মানুষের বৈষম্যলাঞ্চিত দুর্দশার বিরূদ্ধে দ্রোহ তাঁর কবিতার মূল সুর। ‘পদাতিক' প্রারম্ভে ছিল ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য কাঠফাঁটা রোদে সেঁকে চামড়া’। কথ্যরীতিতে রচিত তার কবিতা সহজবোধ্যতার কারণে ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর আনুকূল্য লাভ করে। মানবিক বোধ ও রাজনৈতিক বাণী তার কবিতার অন্যতম প্রধান অভিমুখ। পদাতিক কাব্যগ্রন্থের মে দিনের কবিতা কেবল শ্রমিক শ্রেণির এক বিজয়কাব্য নয়, এতে ব্যক্ত হয়েছে ঔপনিবেশবাদের উচ্ছেদসাধনের ঋজু প্রত্যয় –
“ |
শতাব্দী লাঞ্ছিত আর্তের কান্না |
” |
তার কাব্যভাষা নিরলংকার। নিজ উপলব্ধি ও প্রত্যয় তিনি গদ্যের সুরে ব্যক্ত করেছেন। এক স্বতন্ত্র উজ্জ্বল কণ্ঠস্বর। অগ্রজ আধুনিক কবিদের মতো তিনি দুর্বোধ্য নন, দুরূহ নন। সহজেই তার কবিতা পড়া যায়, বোঝা যায় এবং অনুভব করা যায়।[২] চল্লিশের যুদ্ধ-দাঙ্গা-তেভাগা-মন্বন্তর সঙ্কুলিত রাজনৈতিক টালমাটালের যুগসন্ধিক্ষণে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন—
“ |
‘আমি আসছি— |
” |
জগৎজুড়ে যে পথে ‘শান্তি’ আনা সম্ভব, সেই পথেররেখা তার কাছে ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট। তার কবিতায় সেই পথনির্দেশিকাও আছে। কবিতাটির নাম, ‘বাঁয়ে চলো, বাঁয়ে’—
“ |
‘বাঁয়ে চলো ভাই, |
” |
কখনো কখনো প্রতীয়মান হয় তার কবিতা চড়া সুরে বাঁধা। চল্লিশের দশক থেকে তার অ-রোম্যান্টিক গদ্যপ্রধান কাব্যভঙ্গী পরবর্তীকালের কবিদের কাছে অনুসরণীয় হয়ে ওঠে। সমাজের তৃণমূল স্তরে নেমে গিয়ে সেই সমাজকে প্রত্যক্ষ করে তবেই কবিতা রচনায় প্রবৃত্ত হতেন তিনি। আদর্শ তার কবিতাকে দিয়েছিল পরিব্যাপ্ত জনপ্রিয়তা। তবে কবিতার মাধ্যমে একটি বার্তা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে গিয়ে তিনি অক্ষরবৃত্তের চালে আধুনিক কবিতার গদ্যঋদ্ধ নতুন রূপ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠার পর কারাবন্দী হন তিনি। এ পর্যায়ে লিখেছিলেন ‘শতাব্দীলাঞ্ছিত আর্তের কান্না/ প্রতি নিশ্বাসে আনে লজ্জা।’ বেশ কিছু সময় পরে আবার লিখেছিলেন ‘লেনিন যেন চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললেন,/ শতাব্দী শেষ হয়ে আসছে—/ একটু পা চালিয়ে, ভাই, একটু পা চালিয়ে।।’ তার কাব্যভাষায় প্রচলিত ছন্দের কাঠামো ছিল না। তবে ছিল ছন্দের প্রাণবন্ত স্পন্দন।
সম্পাদক কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়
যে বয়সে মানুষ জীবিকা সন্ধানে মগ্ন হয়, অর্থনৈতিক সুখ স্বাচ্ছন্দ্যলাভের জন্য সেই বয়সে ভালোবাসার মানুষ কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের একনিষ্ঠ সৈনিক হয়ে গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-নগরে, কলে-কারখানায় চষে বেড়িয়েছেন অচেনা জগতের চিরদুঃখী মানুষের যন্ত্রণাকে আপন করে নিতেন। ১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দে জার্মানী সোভিয়েত আক্রমণ করলে তিনি ফ্যাসিস্ট বিরোধিতায় ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখক শিল্পীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সোভিয়েটের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপক পত্রে স্বাক্ষর করলেন। ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দে ফ্যাসিস্ট বিরোধী 'লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘে'র যুগ্ম সম্পাদক হিসাবে বিষ্ণু দে'র সঙ্গে তিনিও সম্মানিত হলেন এবং কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেলন। একই সঙ্গে তিনি 'বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গেও নিজিকে সামিল করলেন। 'পদাতিক' (১৯৪০) প্রকাশের পর স্বাভাবিকভাবে কবির কাব্যচর্চা একটু স্তিমিত হয়ে যায়। পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ 'অগ্নিকোণ' প্রকাশিত হয় ১৯৪৮-এ। ইতিপূর্বে তিনি একটি কবিতা সংকলন 'একসূত্রে' এবং 'কেন লিখি' দুটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। প্রভাত কুমার দাস, "সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত পরিচয়: কালানুক্রমিক সূচি” শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন - "ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের সংগঠক কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সুভাষ, ততদিনে 'একসূত্রে' ও 'কেন লিখি' দু'টি সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন যৌথভাবে, প্রথমটি গোলাম কুদ্দুস এবং দ্বিতীয়টি হিরণ কুমার সান্যালের সঙ্গে। ১৯৪৫-এর জানুয়ারীতে দুটি সংকলনই প্রকাশিত হয়েছিল, ফ্যাসিস্ট বিরোধী কবিতা সংকলনটির শিরোনাম 'একসূত্রে', আর বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাশিল্পীদের সংকলিত জবানবন্দীর নাম 'কেন লিখি'। শেষোক্ত গ্রন্থটি প্রায় অর্ধশতাধিক বছর পরে লোকচক্ষুর আড়াল থেকে প্রণব বিশ্বাসকে সঙ্গে নিয়ে নতুন করে প্রকাশ করার সময় 'ভূমিকা'য় সুভাষ জানিয়েছিলেন: 'বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়েও আমি তখন অগ্রজ কবি বিষ্ণু দে-র সাগরেদ হয়ে ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক ও শিল্পী সঙ্ঘের কাজে স্বেচ্ছাসেবক, 'কেন লিখি'র মাথা হাবলদা, আমি তার হাত-পা" (পরিচয় / ফেব্রু - জুলাই ২০০৪/পৃঃ-২৪৫) • শুরু হ'ল সম্পাদক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের হাতে-খড়ি।[সাহিত্য অঙ্গন প্ত্রিকা এবং আত্মবিকাশ সাহিত্য প্ত্রিকা থেকে নেওয়া ১]
এরপর কবির জীবন বর্ণময়। ১৯৪৮ খ্রীষ্টাব্দে উগ্রপন্থী দল হিসাবে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার কমিউনিস্ট দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। অন্যান্য নেতা কর্মীদের সঙ্গে কবিও বিনা বিচারে কারাবরণ করেন। দমদম জেলে কমিউনিস্ট বন্দীদের হাঙ্গার স্ট্রাইকে তিনি সামিল হয়েছিলেন বলে তাঁকে ভূটানের বক্সার-এ স্থানান্তরিত করা হয়। বন্দী থাকাকালীন তাঁর কাব্যগ্রন্থ 'চিরকুট' (এপ্রিল, ১৯৫০) প্রকাশিত হয়। ১৯৫০-এর নভেম্বরে কবি জেল থেকে ছাড়া পান। শুরু হল জীবনের আর এক পর্ব। জেল-মুক্তির পরে কবি গভীর আর্থিক সংকটে পড়েন। এই আর্থিক অনটনের হাত থেকে রেহাই পেতে 'বুক ওয়ার্ল্ড'-এ এডিটরের চাকরিতে যোগ দেন। 'দেশ' পত্রিকায় ১৬ আগস্ট ১৯৮৬ সংখ্যায় 'চিঠির দর্পণে' কবি লিখেছেন, 'তখন সবে একটা নতুন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠা 'বুক ওয়ার্ল্ড'-এ এডিটর হিসাবে এক চাকরী পেয়েছি। ৭৫ টাকা মাইনে।” একই সঙ্গে এই বছরের শেষে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, 'পরিচয়' পত্রিকার সম্পাদকের কাজে যুক্ত হলেন।
'পরিচয়' পত্রিকাটি আজও সগৌরবে চলছে। ১৩৩৮ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে 'পরিচয়' পত্রিকাটি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সম্পাদনায় প্রথম প্রকাশিত হয়। পাঁচ বছর পর পত্রিকাটি মাসিক পত্রিকা হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। 'দশম বর্ষ থেকে সম্পাদক হিসেবে সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে হিরণ কুমার সান্যালের নামও মুদ্রিত হয়। কিন্তু এর পর ১৩৫০-এর আষাঢ় সংখ্যার পর সুধীন্দ্রনাথ পরিচয় থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।' পত্রিকাটি কিনে নেন প্রগতিবাদীরা। সুশোভন সরকার জানিয়েছেন, 'ইন্টারন্যাশানাল প্রকাশনা আমার মাধ্যমে পরিচয় নিয়েছিল, ঠিক হল মাসে মাসে কিস্তিতে সুধীনকে দাম দিতে হবে, টাকাটাও যেত আমার হাত দিয়ে'। ইন্টারন্যাশানাল কমিউনিস্ট অনুরাগীদের প্রতিষ্ঠান, সুতরাং প্রকারান্তরে পরিচয় এসে পড়ল পার্টির আয়ত্তে। তবু পরিচয় কখনোই ঠিক পার্টি সম্মত হয়নি বলেই আমার বিশ্বাস।' (পুণঃ উদ্ধৃত - দিবারাত্রির কাব্য / জানুয়ারী-মার্চ ও এপ্রিল-জুন ২০০৮/পৃঃ ৩৯৭)। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে 'পরিচয়' পত্রিকাটি কখনো সাময়িক বন্ধ হয়েছে। আবার ১৯৫০-এর প্রথম চারমাসে নবপর্যায়ে এ চারখানি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। আবার পার্টির রণ-নীতির সঙ্গে সঙ্গে 'পরিচয়'-এর পথ কখনো কখনো রুদ্ধ হয়েছে। বিশতম বর্ষের চৈত্র-বৈশাখ ১৩৫৭-৫৮ থেকে সম্পাদক হিসাবে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যয় যোগ দেন। তিনি সচেতনভাবে অন্যতম প্রাক্তন সম্পাদক হিরণ কুমার সান্যালের কলমে 'পরিচয়'-এর কুড়ি বছর' শীর্ষক একটি ধারাবাহিক পর্ব সূচনা করেন। 'কথকের কৈফিয়ৎ' শিরোনামে হিরণ কুমার সান্যাল লিখেছিলেন, "পরিচয়ের প্রথম সম্পাদক সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ও বর্তমান সম্পাদক সুভাষচন্দ্র মুখোপাধ্যায় – এই দুইজনের মাঝখানে সময়ের ব্যবধান প্রায় বছর দশেক। মাঝামাঝি সময়টাতে আরো জনপাঁচেক সম্পাদকের আবির্ভাব ও তিরোভাব ঘটেছে।” কী ছিল না 'পরিচয়ে'- ছবি, গান, কবিতা, নাটক, উপন্যাস, সাহিত্য আলোচনা, অনুবাদ – সবই। দুটি পর্বে সুভাষ মুখোপাধ্যায় পরিচয় সম্পাদনার গুরু দায়িত্ব অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে পালন করেছেন পথম পর্ব ১৩৫৭ চৈত্র-বৈশাখ থেকে ১৩৫৯, ৪ কার্তিক। দ্বিতীয় পর্ব শ্রাবণ ১৩৭৪ থেকে বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য-আষাঢ় ১৩৭৫।
প্রভাত কুমার দাস যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন- "তিনি যে পত্রিকাটিকে সাহিত্য সংস্কৃতি মূলক একটি নিয়মিত মাসিক হিসেবে সব বয়সের পাঠকদের উপযোগী করে তুলতে চেষ্টা চালিয়েছিলেন সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। পূর্ববর্তী পর্বে হিরণ কুমার সান্যাল কিংবা হীরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে যেমন 'পরিচয়' পত্রিকার আদিপর্বের ইতিহাস কিংবা প্রগতি লেখক আন্দোলনের প্রারম্ভ যুগের স্মৃতিকথা প্রকাশের বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, তেমনি তিনি অন্নদাশংকর রায়, সুকুমার সেন, গোপাল হালদারের মতো প্রবীণদের সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য বেশ কয়েকজন তরুণকে উৎসাহিত করেছিলেন। তরুণতর লেখকদের কবিতা ছাড়াও বিদেশী কবিতা অনুবাদ ছাড়াও ভারতবর্ষের অন্য প্রদেশের কবিতা ও গল্পের অনুবাদ প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন। দেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সমীক্ষামূলক কয়েকটি নিবন্ধ প্রকাশ করে অভিনবত্ব প্রদর্শনে উদ্যোগী হয়েছিলেন, চা শ্রমিকদের বিবাহপ্রথা কিংবা কলকাতার গণিকাবৃত্তির বিষয়ে দুটি সাক্ষাৎকার সমীক্ষা ভিত্তিক প্রবন্ধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।” (পরিচয়/ফেব্রু-জুলাই' ২০০৪/পৃঃ-২৫৪)।
'পরিচয়' সম্পাদনার দুটি পর্বেই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনার বিশেষত্ব ও আন্তরিকতা সুস্পষ্ট। সময়ের তালে তাল মিলিয়ে তাঁর পত্রিকার সূচি ও তার বিন্যাস সত্যি বিস্ময়কর ও ঐতিহাসিক। ১০/১১/(১২) মে-জুন-জুলাই, ১৯৬৮। বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য-আষাঢ় ১৩৭৫ অর্থাৎ তাঁর সম্পাদিত 'পরিচয়'-এর শেষ সংখ্যায় তিনি যে সম্পাদকীয় লিখেছেন শেষ পৃষ্ঠায় 'পরিচয় পাঠক সমীপে' শিরোনামে, তা থেকে বোঝা যায় তিনি কত বিনয়ী ও কতটা স্পষ্টবক্তা- "কেন মাসে মাসে নিয়মিত পরিচয় বার করা যায় নি তার চুলচেরা বিশ্লেষণে যাব না। কারো পক্ষেই সেটা প্রীতিকর হবে না। মোটকথা অবস্থাচক্রে বাধ্য হয়েই আমাকে হাল ছাড়তে হয়েছে। কবি তরুণ সান্যাল এবং কথাসাহিত্যিক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় - স্বস্ব ক্ষেত্রে দু'জনেই দিকপাল। তাঁদের যোগ্য এবং যুগ্ম নায়কতায় এটা হবে পরিচয়ের দিন বদলের পালা। এ সংখ্যায় সম্পাদক হিসাবে আমার নাম থাকলেও সম্পাদনার কৃতিত্ব তাঁদেরই।” – এ তো মহৎ কবি ও সম্পাদকের স্বীকারোক্তি।
প্রশ্ন হতে পারে ১৯৫২ অর্থাৎ ৪ কার্তিক, ১৩৫৯- এর পর কবি কেন সম্পাদনার কাজ থেকে বিরত হয়েছিলেন? কবিপত্নী গীতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর উত্তর দিয়েছিলেন 'ভালোবাসার কথা' প্রবন্ধে। "১৯৫২ সালের এক ভোরবেলায় শ্বশুর মশাইয়ের চোখের জলের মধ্যে দিয়ে, 'ফিরে চল মাটির টানে' বলে ধড়বড়ে ট্রাকে কিছু নড়বড়ে তক্তপোষটোষ নিয়ে যখন উঠলাম গিয়ে বজবজের ব্যঞ্জনহোড়িয়া গ্রামের এঁদো পুকুরের ধারে এক মুসলমানের কুঁড়ে বাড়িতে, তখন কিন্তু এসব উঁচু নিচু সুর একটা মজাদার লয়ে বাঁধা পড়েছিল। আর বোধহয় সেই 'সুরে সুর মিলায়ে' সুভাষ আবার অনেকদিন পরে এক ঝুড়ি কবিতাও লিখে ফেলেছিল।” (সুভাষ মুখোপাধ্যায়: কথা ও কবিতা / পৃঃ ৭৮) চটকলের মজুরদের বোনাসের দাবিতে কখনো গেট মিটিং-এ সামিল, দুপুরে মেয়েদের নিরক্ষরতা দূর করতে সাজ্জাদার বাড়িতে দাওয়ায় মাদুর পেতে স্কুল চালানো। – খেটে খাওয়া মানুষের সাথে কবি নিজের জীবনকে মুড়ে দিলেন। লিখেছিলেন 'ভূতের বেগার' (১৯৫৩)। ১৯৫৪ সালে বজবজ থেকে ফেরেন আবার কলকাতায়। সম্পাদনা করেন 'পাতাবাহার' (১৯৫৪) এবং এরপর তাঁর বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ 'ফুল ফুটুক' প্রকাশিত হয় ১৯৫৭ সালে।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত 'পাতাবাহার' পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ভূমিকা সহ আবার প্রকাশিত হয়ে অক্টোবর ২০১২-তে। প্রকাশক অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী, ন্যাশানাল বুক এজেন্সি প্রাঃ লিমিটেড। পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, 'শারোদৎসবের প্রাক্কালে 'পাতাবাহার' প্রকাশিত হয়েছিল সাতান্ন বছর আগে, ১৩৬২-র আশ্বিনে। তারপর আর ছাপা হয় নি। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মনে বাল্য- কৈশোরে সুভাষ মুখোপাধ্যায় 'পাতাবাহার' পাঠের আনন্দ-স্মৃতি সজীব থাকলেও একালের ছোটরা তো নয়ই, বড়োরাও অনেকে জানেন না 'পাতাবাহার'-এর কথা।.অভিভূত হওয়ার মতো 'পাতাবাহার'-এর রচনা সম্ভার। সংকলনটির অঙ্গসজ্জা ও উপস্থাপনা চমৎকার। শুধুই ভালোলাগা, মুগ্ধতা। খালেদ চৌধুরীর আঁকা মলাট। ভেতরে সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ছবি। পূর্ণেন্দু পত্রীও ছবি এঁকেছিলেন।
'পাতাবাহার' সংকলনটি এই একটি সংখ্যায় সীমাবদ্ধ হওয়ায় বাঙালী পাঠক আরো অনেক প্রত্যাশা পূরণ থেকে বঞ্চিত রইল। তবুও এই একটি সংখ্যা অনন্যসাধারণ এবং চিরকালীন। আজও মুগ্ধ করে। সুকুমার রায়ের অপ্রকাশিত রচনা 'কলিকাতা কোথা রে' বর্তমান ঝাড়খণ্ডের গিরিডিতে। কবিতার শেষে লেখা 'হোমভিলা/ বারতাণ্ডা, গিরিডি/৮০০১.২২' এবং 'মিসেস এস. কে দত্তকে লেখা'। বেশ মজার কবিতা। বিস্মৃতির ঠেলায় 'কলিকাতা' কবিতার পংক্তিতে হয়ে গেল 'কলকেতা'। দেখে নেওয়া যাক এই সুযোগে কলকাতা নিয়ে কবি সুকুমার রায়ের মজাদার উপস্থাপন -
'বেঙাবাদ, বরাকর, ইদিকে পচম্বা
উদিকে পরেশনাথ, পাড়ি দাও লম্বা,
সব তার সড়গড় নেই কোন ভুল তায় –
'কলিকাতা কাঁহা' বলি সেও মাথা চুলকায়। (ছবি)
অবশেষে নিরুপায় মাথা যায় ঘুলিয়ে,
টাইমটেবিল' খোল দেখি চোখ বুলিয়ে!
সেথায় পাটনা, পুরী, গয়া, গোমো, মাল্দ,
বজবজ, দমদম, হাওড়া ও শিয়াল্দ, (ছবি)
ইত্যাদি কত নাম চেয়ে দেখি সামনেই;
তার মাঝে কোনোখানে কলিকাতা নাম নেই।"
– সত্যি তো, 'কলিকাতা' নামে শহর হলেও নির্দিষ্ট কোনো জায়গা তো ছিল না সেকালে। একালে অবশ্য হাওড়া, শিয়ালদার পরে এখন কলকাতা স্টেশন 'টাইম টেবিলে' অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এছাড়া সুখলতা রাও-এর কবিতা, লীলা মজুমদারের গল্প, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অন্নদাশঙ্কর রায়, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, তুষার চট্টোপাধ্যায়ের ছড়া, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প, বিমলচন্দ্র ঘোষ, মনীন্দ্র রায়ের কবিতা। এছাড়া সেকালের প্রখ্যাত লেখকের প্রবন্ধ ও গল্প মুদ্রিত হয়েছে। যেমন সমরেশ বসুর 'পুনিয়া' মন কাড়ার মত। ধন্যবাদ জানাই 'পাতাবাহার'-এই সংকলনটি পুণঃ মুদ্রণের জন্য। লক্ষণীয়, একালের সম্পাদকেরা নিজের পত্রিকায় নিজের লেখা ঢাক পিটিয়ে প্রকাশ করেন অথচ সম্পাদক সুভাষ মুখোপাধ্যায় অন্য লেখকদের শ্রেষ্ঠ সৃজনে সাজিয়েছেন 'পাতাবাহার', নিজের কোনো লেখাই নির্বাচনে রাখেন নি। বোঝা যায় সম্পাদক কতটা মগ্ন ছিলেন সম্পাদনায়। তাই পার্থজিৎ, গঙ্গোপাধ্যায় ভূমিকাতে যথার্থ বলেছেন, 'ভালো লেখার, মন-ছোঁয়া লেখার যেন শেষ নেই। কোনো সংকলনে একসঙ্গে এত ভালো লেখা আগে তো নয়ই, পরেও কি তেমন পাওয়া গিয়েছে?" সুতরাং যে কোনো পত্রিকার সংখ্যাধিক্যই কোনো সম্পাদককে গর্বিত করে না, গর্বিত করে কোনোও 'ভালো লেখা'র সম্ভারে পুষ্ট কোনো সংখ্যা।
এই সময় কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর কাজকে কখনো ভুলে থাকেননি। কাব্যচর্চার পাশাপাশি পার্টির কাজ – কোনোটাতেই খামতি নেই। একদিকে পোর্ট অামাচর্চার ন্ড ইউনিয়নের কাজ, অন্যদিকে পত্রিকা সম্পাদনা। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে 'সন্দেশ' পত্রিকার তৃতীয় পর্যায়ের কাজ, ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পাদনায় ডুব দিয়েছিলেন। গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় ধরা পড়েছে 'সন্দেশ' পত্রিকার সম্পাদনার কথা - "আমি পেটের দায়ে চাকরির সন্ধানে প্রশান্ত কুমার মহলানবীশের দ্বারস্থ হলাম। রোজ সকাল বিকেল বরাহনগর যাওয়া আর সাদার্ন এ্যাভেনিউতে সন্ধ্যেবেলা ন'নম্বর বাস থেকে নামা। তার মধ্যে অবশ্য 'সন্দেশ' আপিসে হানা দেওয়া, নাটকের রিহার্সাল, মেয়ে পুপেকে নিয়ে আদিখ্যেতাও। 'সন্দেশ' আপিস তখন ধর্মতলায় রমরম করে চলছে। সত্যজিৎ আর সুভাষের হাসি হাসি মুখে ডাঁই ডাঁই করে লেখা ফেরৎ দেওয়ার ব্যাপারটা তখন নব্য আর নামকরা লেখকদের মধ্যে 'অমায়িক' হয়ে নাম কিনেছে। অন্যান্য আনন্দের মধ্যে কিছু কবি কবি নতুন মুখ দেখা যেতে লাগল আপিসে।" (সুভাষ মুখোপাধ্যায়: কথা ও কবিতা)
বলা বাহুল্য এই কচি-কাঁচাদের দলে ছিলেন শিবানী রায়চৌধুরী। তাঁর জীবনের গল্প শোনা যাক। তাহলে আমরা অনায়াসে সম্পাদক সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে চিনতে পারব। দীর্ঘ গল্প, 'গল্প হলেও সত্যি'-
'১৯৬১ সাল। প্রেসিডেন্সি কলেজে বি.এ. ক্লাসে পড়ছি, এই সময় আমার একঘেয়ে সাদামাটা জীবনে একটা অসাধারণ ব্যাপার ঘটে গেল। ছোটবেলা থেকেই আমি গল্প-কবিতা লিখতাম আর ছবি আঁকতাম। দু'একটা কবিতা রামধনু কি মৌচাকে ছাপা হয়েছিল। কোনও একসময় কোলকাতা আকাশবাণীর বেতারজগৎ পত্রিকায় আমার আকা ছবি প্রকাশিত হয়েছিল। ইস্কুল ছেড়ে কলেজে ঢুকে প্রকাশ্যে ছবি আঁকলেও লেখাটা লুকিয়ে লুকিয়ে চলত। ১৯৬১ সালের যে মাসে সত্যজিৎ রায় ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় তৃতীয় পর্যায়ের 'সন্দেশ' পত্রিকা নতুন কলেবরে বের করলেন। রাস্তায় বইয়ের স্টলে পত্রিকাটা দেখে মোহিত হয়ে গেলাম।
সন্দেশের প্রথম সংখ্যাটা কিনে এনে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। দ্বিতীয় সংখ্যার অপেক্ষায় ছিলাম। ভাবছিলাম সন্দেশে একটা লেখা পাঠাই। কিন্তু কোথায় পাঠাবো সেটাই হয়েছিল আমার সমস্যা। আমি তখন ছোটদের 'হাত পাকাবার আসর'-এর বয়েস পেরিয়ে এসেছি। আবার বড়োদের মতো হাতটা পেকেছে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। অনেক ভেবেচিন্তে ঠিক করলাম- একটা লেখা পাঠিয়েই দেখি, কি হয়।....
লেখা পাঠাবার দু-দিন পরেই একটা তাজ্জব ব্যাপার ঘটল। সকাল বেলা কলেজ যাবার জন্য তৈরী হচ্ছি, এমন সময় ছোটবৌদি খুব উত্তেজিত হয়ে আমাকে ডাকল, 'সুভাষ মুখোপাধ্যায় তোমাকে টেলিফোন করেছেন।' আমি ভয়ে ভয়ে টেলিফোনের দিকে এগিয়ে গেলাম। দাদারা আশেপাশে দাঁড়িয়ে রইল। তারা সবাই ছিল 'পদাতিক' আর 'অগ্নিকোণ'-এর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের খুব ভক্ত।.... হুঁ-হ্যাঁ করে কথাবার্তা শেষ করে সবাইয়ের কৌতূহলের অবসান ঘটালাম। বললাম, 'আজ কলেজ থেকে ফেরার পথে ধর্মতলায় সন্দেশের অফিসে যেতে হবে। সত্যজিৎ রায় আর সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমার সঙ্গে দেখা করতে চান।'
টু-বি বাসে করে কলেজ থেকে ফেরার পথে মাঝ রাস্তায় নেমে ধর্মতলা স্ট্রীটে নেমে পড়লাম। একেবারে রাস্তার ওপর অফিস। দরজা খুললেই সরু লম্বা সিঁড়ি সটান ওপরে উঠে গেছে। মাঝপথে বাঁদিকে ন্যাশানাল বুক এজেন্সির অফিস। ওপরে উঠেই দেখি এক মাথা ঝাঁকড়া চুল, চোখে চশমা এক উজ্জ্বল বুদ্ধিদীপ্ত ভদ্রলোক বসে আছেন। আমি পরিচয় দিতেই দারুণ খুশী হয়ে বসতে বললেন। আধঘন্টা বাদে এক দীর্ঘদেহী পুরুষ ঘরে ঢুকলেন। এক ঝলকেই চিনতে অসুবিধে হল না সত্যজিৎ রায়কে।... সুভাষদা আবহাওয়াটা সহজ করে বললেন, 'আমার আর সত্যজিতের তোমার লেখাটা খুব পছন্দ হয়েছে। জুলাই সংখ্যায় ছাপতে চাই।'
সত্যজিৎ রায়ও আমার ছবির প্রশংসা করে বললেন, 'আপনার আঁকা ছবি দিয়ে ছাপতে চাই।'... সন্দেশের তৃতীয় সংখ্যায় 'ইন্তাবিলের পুঁথি' ছাপা হল। শিশুকিশোর পাঠকরা আমার লেখা পড়ে আনন্দ পেয়েছিল। কিছু প্রবীণ আর প্রাপ্ত বয়স্ক নাবালকদের কাছ থেকেও প্রশংসা পেয়েছিলাম। দুই সম্পাদকের প্রেরণা ও উৎসাহে নিয়মিত সন্দেশে লিখতে লাগলাম। এঁরা দু'জনেই খুব নিষ্ঠার সঙ্গে সন্দেশের সম্পাদনা করতেন।' (সন্দেশ, ডিসেম্বর, ২০১৮/পৃ: ৫)।
দীর্ঘ দু'বছর এমনভাবে নিরপেক্ষতায় ও লেখক এবং পাঠকদের প্রতি অকৃপণ ভালোবাসায় সন্দেশ সম্পাদনার কাজে যুক্ত ছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়; নিজেও লিখেছেন সন্দেশের পাতায়, সমৃদ্ধ করেছেন বাংলা শিশু-সাহিত্যের ভাণ্ডারকে। সবশেষে বলি, 'স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতীয় কবিতা' ক্যাপশনে সম্পাদনা করছেন 'বাংলা কবিতা সংকলন'। প্রকাশক ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট, ইণ্ডিয়া, নিউ দিল্লী, মার্চ ১৯৭৩। জীবনানন্দ দাশ থেকে শুরু করে চৌত্রিশ জন কবির কবিতা নিয়ে এই সংকলন নির্মাণ করেছেন কবি। প্রায় সব সেরা কবির কবিতা এই গ্রন্থে ঠাঁই পেয়েছে। কিন্তু অবাক করার মতো ঘটনা- কবি শঙ্খ ঘোষ কিংবা কবি অলোক সরকারের কবিতা এই সংকলনে অন্তর্ভূক্ত হয় নি। অবশ্য এ প্রশ্নের উত্তর হয়তো লুকিয়ে আছে তাঁর ছোট্ট সম্পাদনায়। লক্ষ্যণীয় এই গ্রন্থে কবি নিজের কোনো কবিতাকেও রাখেননি- এটা বড় বিস্ময়ের। নাকি সচেতন সম্পাদকের অধিক বিনয়? কবি 'ভূমিকা' লিখেছেন, "মনে রাখা দরকার, পঁচিশ বছরের সেরা কবি বা সেরা কবিতা নিয়ে এই সংকলন নয়। স্বাধীনতার পঁচিশ বছরের কথা মনে রেখে এমনভাবে কবিতা বাছাই করার চেষ্টা করেছি, যাতে বিশেষ করে দেশকালের একটা গতিময় বহুবর্ণ ছবি ফুটে ওঠে। শুধু পাওয়ার আনন্দ নয়, হারানোর বেদনা; শুধু অভীষ্ট লাভ নয়, সেই সঙ্গে আশা ভঙ্গ; শুধু পুরনো বিশ্বাস নয়, সেই সঙ্গে মূল্যবোধ। পঁচিশ বছরের এই কবিতা বিচিত্রায় যদি তার সামান্য লক্ষণও পাঠকের চোখে ধরা পড়ে, তাহলে শত অক্ষমতার মধ্যেও সংকলক হিসেবে আমি সান্তনার কিছুটা কারণ খুঁজে পাব।” – এই বক্তব্যেই প্রতিধ্বনিত হয় সম্পাদক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সংযত, বুদ্ধিদীপ্ত ও সযত্ন কণ্ঠস্বর। 'স্নেহ-ভালোবাসা-আন্তরিকতা- মাখানো এক অভিনব সংসার' – সম্পাদক সুভাষের। অত্যন্ত সচেতনভাবেই সবদিকে সতর্ক মনোনিবেশে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় 'পরিচয়', 'সন্দেশ' পত্রিকা যেমন সম্পাদনা করেছেন, তেমনি 'পাতাবাহার' কিংবা স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলা কবিতা সংকলনে স্বকীয়তার উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। স্বাভাবিকভাবে কবি সুভাষ যেমন বাঙালী পাঠকের কাছে একান্ত প্রিয়, সম্পাদক হিসাবেও তিনি অপরাজেয় আসনে আসীন ছিলেন।
কবিতার দৃষ্টান্ত
সম্পাদনাপদাতিক
সম্পাদনাএ গ্রন্থের বধূ কবিতায় রবীন্দ্রনাথের স্নিগ্ধ রোম্যান্টিকতার বিপরীত ধ্বনি শোনা যায়; কতকটা কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো গানের অনুষঙ্গে –
“ |
ইহার মাঝে কখন প্রিয়তম |
” |
চিরকুট
সম্পাদনাচিরকুট কাব্যটি বাংলা ফ্যাসিবিরোধী সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। শুধু ফ্যাসিবিরোধিতাই নয়, এই কাব্যে উঠে এসেছে ভারতের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের স্মৃতি। স্ফুলিঙ্গ, জবাব চাই, প্রতিরোধ প্রতিজ্ঞা আমার, ফের আসবো, এই আশ্বিনে, চিরকুট প্রভৃতি কবিতায় আছে বিশ্বাস, বলিষ্ঠতা, তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ আবার আবেগের বিধুরতাও। ঘোষণা কবিতায় দেখা যায় –
“ |
গঙ্গার জোয়ার এসে লাগে |
” |
অগ্নিকোণ
সম্পাদনা১৯৪৮ সালে পার্টির দৈনিকের টাকা তোলার জন্য কবি লেখেন মাত্র পাঁচটি কবিতার সংকলন অগ্নিকোণ। কবির ভাষায়, “রাজনীতিকে সঙ্গে নিয়ে রাজনীতির জন্যেই অগ্নিকোণের প্রকাশ”।[৫] এই কাব্যে কবি উদ্বেল হয়েছেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুক্তিসংগ্রামের সংবাদে –
“ |
লক্ষ লক্ষ হাতে |
” |
অগ্নিকোণ ও ফুল ফুটুক কাব্য রচনার মধ্যবর্তী সময়ে কবি উপলব্ধি করেন এক চরম নান্দনিক সত্য:
“ | সেই শিল্পই খাঁটি শিল্প, যার দর্পণে জীবন প্রতিফলিত। তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে যা কিছু সংঘাত সংগ্রাম আর প্রেরণা, জয়, পরাজয় আর জীবনের ভালোবাসা, খুঁজে পাওয়া যাবে একটি মানুষের সব কটি দিক। সেই হচ্ছে খাঁটি শিল্প যা জীবন সম্পর্কে মানুষকে মিথ্যা ধারণা দেয় না। কবিতার গদ্যের আর কথা বলবার ভাষার বিভিন্নতা নতুন কবি স্বীকার করেন না। এমন এক ভাষায় তিনি লেখেন – যা বানানো নয়, কৃত্রিম নয়, সহজ, প্রাণবন্ত, বিচিত্র গভীর, একান্ত জটিল – অর্থাৎ অনাড়ম্বর সেই ভাষা।[৬] | ” |
এই সত্য প্রতিফলিত হয় তার পরবর্তীকালের কাব্যগুলিতে। কমিউনিজমের বাঁধা বুলি ছেড়ে তিনি চিত্রকল্প নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষায় রত হন এই কাব্যগুলিতে। ফুল ফুটুক কাব্যের আরও একটা দিন কবিতায় অন্ধকারের এক আশ্চর্য ছবি আঁকেন কবি,
“ |
জলায় এবার ভাল ধান হবে – |
” |
সম্মাননা
সম্পাদনাদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বঞ্চনা ও অসম্মান অনেক জুটলেও সাহিত্যের অঙ্গনে সম্মানিতই হয়েছিলেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার পান ১৯৬৪ সালে; ১৯৭৭ সালে অ্যাফ্রো-এশিয়ান লোটাস প্রাইজ; ১৯৮২ সালে কুমারন আসান পুরস্কার; ১৯৮২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রদত্ত মির্জো টারসান জেড পুরস্কার; ১৯৮৪ সালে আনন্দ পুরস্কার এবং ওই বছরেই পান সোভিয়েত ল্যান্ড নেহরু পুরস্কার ও ১৯৯২ সালে ভারতীয় জ্ঞানপীঠ পুরস্কার।[৭] ১৯৯৬ সালে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মাননা সাহিত্য অকাদেমী ফেলোশিপ পান সুভাষ মুখোপাধ্যায়। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানিত করেছিল তাদের সর্বোচ্চ সম্মান দেশিকোত্তম দ্বারা।
এছাড়াও প্রগ্রেসিভ রাইটার্স ইউনিয়নের ডেপুটি সেক্রেটারি ও ১৯৮৩ সালে অ্যাফ্রো-এশীয় লেখক সংঘের সাধারণ সংগঠক নির্বাচিত হন কবি। ১৯৮৭ সাল থেকে তিনি ছিলেন সাহিত্য অকাদেমির একজিকিউটিভ বোর্ডের সদস্য।
সত্তরের প্রথম ভাগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাসিবুল ইসলাম ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়: কবি ও কবিতা’ শিরোনামে একটি অভিসন্দর্ভ লেখেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্য। বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ মিলিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে বিদ্যায়তনিক পর্যায়ে এটি প্রথম গবেষণা। এর পর তাঁকে নিয়ে বহু লেখালিখি ও গবেষণা হয়েছে।[৪]
সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ পদাতিক-এর নামানুসারে ২০০৯ সালে শিয়ালদহ-নিউ জলপাইগুড়ি এক্সপ্রেসের নাম রাখা হয় "পদাতিক এক্সপ্রেস"।[৮] ২০১০ সালের ৭ অক্টোবর কলকাতা মেট্রো নিউ গড়িয়া স্টেশনটি কবির নামে উৎসর্গ করে, এই স্টেশনটি বর্তমানে "কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশন" নামে পরিচিত।[৯]
গ্রন্থাবলি
সম্পাদনাকাব্যগ্রন্থ
সম্পাদনাপদাতিক (১৯৪০), অগ্নিকোণ (১৯৪৮), চিরকুট (১৯৫০), ফুল ফুটুক (১৯৫৭), যত দূরেই যাই (১৯৬২), কাল মধুমাস (১৯৬৬), এই ভাই (১৯৭১), ছেলে গেছে বনে (১৯৭২), একটু পা চালিয়ে ভাই (১৯৭৯), জল সইতে (১৯৮১), চইচই চইচই (১৯৮৩), বাঘ ডেকেছিল (১৯৮৫), যা রে কাগজের নৌকা (১৯৮৯), ধর্মের কল (১৯৯১), ছড়ানো ঘুঁটি (২০০১) এবং নতুন কবিতার বই (দে'জ সংস্করণ ২০০৯)।
কবিতা সংকলন
সম্পাদনাসুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ), সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৭০), সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংগ্রহ, প্রথম খণ্ড (১৩৭৯ বঙ্গাব্দ), সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যসংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড (১৩৮১ বঙ্গাব্দ), কবিতাসংগ্রহ ১ম খণ্ড (১৯৯২), কবিতাসংগ্রহ ২য় খণ্ড (১৯৯৩), কবিতাসংগ্রহ ৩য় খণ্ড (১৯৯৪), কবিতাসংগ্রহ ৪র্থ খণ্ড (১৯৯৪)।
অনুবাদ কবিতা
সম্পাদনানাজিম হিকমতের কবিতা (১৯৫২), দিন আসবে (১৩৭৬ বঙ্গাব্দ, নিকোলো ভাপৎসারভের কবিতা), পাবলো নেরুদার কবিতাগুচ্ছ (১৩৮০ বঙ্গাব্দ), ওলঝাস সুলেমেনভ-এর রোগা ঈগল (১৯৮১ বঙ্গাব্দ), নাজিম হিকমতের আরো কবিতা (১৩৮৬ বঙ্গাব্দ), পাবলো নেরুদার আরো কবিতা (১৩৮৭ বঙ্গাব্দ), হাফিজের কবিতা (১৯৮৬), চর্যাপদ (১৯৮৬), অমরুশতক (১৯৮৮)।
ছড়া
সম্পাদনামিউ-এর জন্য ছড়ানো ছিটানো (১৯৮০)।
কবিতা সম্পর্কিত গদ্যরচনা
সম্পাদনাকবিতার বোঝাপড়া, টানাপোড়েনের মাঝখানে।
রিপোর্টাজ ও ভ্রমণসাহিত্য
সম্পাদনাআমার বাংলা (১৯৫১), যখন যেখানে" (১৯৬০), ডাকবাংলার ডায়েরি"(১৯৬৫), নারদের ডায়েরি (১৯৬৯), যেতে যেতে দেখা (১৩৭৬ বঙ্গাব্দ), ক্ষমা নেই (১৯৭২), ভিয়েতনামে কিছুদিন (১৯৭৪), আবার ডাকবাংলার ডাকে (১৯৮১), টো টো কোম্পানী (১৯৮৪), এখন এখানে (১৯৮৬), খোলা হাতে খোলা মনে (১৯৮৭)।
অর্থনৈতিক রচনা
সম্পাদনাভূতের বেগার (১৯৫৪, কার্ল মার্ক্স রচিত ওয়েজ লেবার অ্যান্ড ক্যাপিটাল অবলম্বনে)।
অনুবাদ রচনা
সম্পাদনাকত ক্ষুধা (১৯৫৩, ভবানী ভট্টাচার্যের সো মেনি হাঙ্গার্স উপন্যাসের অনুবাদ), রোজেনবার্গ-এর পত্রগুচ্ছ (১৯৫৪), ব্যাঘ্রকেতন (নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন ও কর্মভিত্তিক একটি অনুবাদ), রুশ গল্প সঞ্চয়ন (১৯৬৮), ইভান দেনিসোভিচের জীবনের একদিন (১৯৬৮), ডোরাকাটার অভিসারে ১৯৬৯, (শের জঙ্গের ট্রায়াস্ট উইথ টাইগার্স অবলম্বনে), চে গেভারার ডায়রি (১৯৭৭), আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরী (১৯৮২), তমস (১৯৮৮, ভীষম সাহানীর উপন্যাসের অনুবাদ)।
উপন্যাস
সম্পাদনাহাংরাস (১৯৭৩), কে কোথায় যায় (১৯৭৬), "অন্তরীপ বা হ্যানসেনের অসুখ" (১৯৮৩), "কাঁচাপাকা" (১৯৮৯), '"কমরেড, কথা কও"(১৯৯০)
জীবনী
সম্পাদনাজগদীশচন্দ্র (১৯৭৮), আমাদের সবার আপন ঢোলগোবিন্দর আত্মদর্শন (১৯৮৭), ঢোলগোবিন্দের এই ছিল মনে।
শিশু ও কিশোর সাহিত্য
সম্পাদনানীহাররঞ্জন রায় রচিত বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থের কিশোর সংস্করণ (১৯৫২), অক্ষরে অক্ষরে আদি পর্ব (১৯৫৪), কথার কথা (১৯৫৫), দেশবিদেশের রূপকথা (১৯৫৫), বাংলা সাহিত্যের সেকাল ও একাল (১৯৬৭), ইয়াসিনের কলকাতা (১৯৭৮)।
সম্পাদিত গ্রন্থ
সম্পাদনাকেন লিখি (১৯৪৫, বিশিষ্ট বাঙালি সাহিত্যিকদের জবানবন্দী, হিরণকুমার সান্যালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে রচিত), একসূত্র (১৯৫৫, ফ্যাসিবিরোধী কবিতা সংকলন, গোলাম কুদ্দুসের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনা), ছোটদের পুজো সংকলন – পাতাবাহার, বার্ষিক আগামী ইত্যাদি।
সংকলন
সম্পাদনাগদ্যসংগ্রহ, প্রথম খণ্ড (১৯৯৪), "গদ্যসংগ্ৰহ", দ্বিতীয় খণ্ড (১৯৯৬)
আরও দেখুন
সম্পাদনাতথ্যসূত্র
সম্পাদনা- বাংলা সাহিত্য পরিচয় ও সাহিত্যটীকা (প্রাচীন-মধ্য-আধুনিক যুগ), ডক্টর পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তুলসী প্রকাশনী, কলকাতা, ২০০৮ সংস্করণ
- সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (দ্বিতীয় খণ্ডের সংযোজন), অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ২০০৪
- সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী, শিশিরকুমার দাশ সংকলিত ও সম্পাদিত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ২০০৩
- সম্পাদক সুভাষ মুখোপাধ্যায়-ড. জয়গোপাল মণ্ডল, আত্মবিকাশ সাহিত্য পত্রিকা, ত্রয়োদশ বর্ষ - চতুর্থ সংখ্যা, মে ২০১৯, পৃ ঃ ২৭, ISSN : 2278-6171
- Sahitya Angan Patrika, Editor - Dr. Jaygopal Mandal, Janmo Satobarshe Subhash Mukhopadhyay, 31 July 2018, Page : 377, ISSN : 2394-4889
পাদটীকা
সম্পাদনা- ↑ http://bn.banglapedia.org/index.php?title=%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%96%E0%A7%8B%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%A7%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC,_%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B7 বাংলাপিডিয়া
- ↑ ক খ https://www.aajkaal.in/news/robibasar/sunday-story-on-6q8s ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে শতবর্ষী পদাতিক
- ↑ সন্দীপ দত্ত; সুভাষ মুখোপাধ্যায় : জীবন ও সাহিত্য; র্যাডিক্যাল ইম্প্রেশন, কলকাতা; অক্টোবর, ২০০২; পৃ. ২০১
- ↑ ক খ https://www.prothomalo.com/art-and-literature/article/1526441[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ] সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অপ্রকাশিত চিঠি
- ↑ মনোজ ভোজ : সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘মিছিলের মুখ’, ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায় : জীবন ও সাহিত্য’, শারদীয়া পত্রপুট, ১৪০২, পৃ. ১৩৫
- ↑ মুখবন্ধ : নাজিম হিকমতের কবিতা
- ↑ সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, সম্পাদনা: অঞ্জলি বসু, ২য় খণ্ড, চতুর্থ সংস্করণ, সাহিত্য সংসদ, ২০১৫, কলকাতা
- ↑ "Tracks & trains for 'backward' region"। Telegraph Calcutta। ৫ অক্টোবর ২০০৯। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০১২।
- ↑ "Kolkata metro reaches New Garia"। Railway Gazette। ৭ অক্টোবর ২০১২। ১৩ জানুয়ারি ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ জুলাই ২০১১।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস সাহিত্য প্রকল্পের জন্য কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্বরচিত কবিতা পাঠ
- কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে বিবিসি-র শ্রদ্ধা
- স্মরণ : সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯-২০০৩), পরবাস ই-পত্রিকা থেকে
- সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কয়েকটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ
- সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কয়েকটি কবিতার ইংরেজি অনুবাদ
উদ্ধৃতি ত্রুটি: "সাহিত্য অঙ্গন প্ত্রিকা এবং আত্মবিকাশ সাহিত্য প্ত্রিকা থেকে নেওয়া" নামক গ্রুপের জন্য <ref>
ট্যাগ রয়েছে, কিন্তু এর জন্য কোন সঙ্গতিপূর্ণ <references group="সাহিত্য অঙ্গন প্ত্রিকা এবং আত্মবিকাশ সাহিত্য প্ত্রিকা থেকে নেওয়া"/>
ট্যাগ পাওয়া যায়নি