জিম করবেট

শিকারী সংরক্ষণবাদী প্রকৃতিবিদ

জিম করবেট। পুরো নাম এডওয়ার্ড জেমস করবেট(জুলাই ২৫), ১৮৭৫ - এপ্রিল ১৯, ১৯৫৫)। জিম করবেট ছিলেন একজন ইংরেজ শিকারী। তবে জন্ম ভারতের কুমায়ুন অঞ্চলের নৈনিতাল শহরে। স্থানটি বর্তমানে উত্তরাখণ্ড রাজ্যে। তিনি নামকরা শিকারী ছাড়াও একজন বিখ্যাত পরিবেশবাদীও ছিলেন। [] তার নামানুসারে ভারতের জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কের নামকরণ করা হয়। [][] শিকার ও জঙ্গলের বিবরণ নিয়ে তিনি অনেক বই লিখেছেন। হিংস্র প্রাণী, মানুষ খেকো বাঘ এবং চিতা মেরে তিনি অনেক মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত থেকে তিনি চলে যান কেনিয়াতে। সেখানে শুরু করেন বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য এক মহান আন্দোলন। শেষ জীবন তার কেনিয়াতে কাটে।

জিম করবেট।
জিম করবেট
জন্ম(১৮৭৫-০৭-২৫)২৫ জুলাই ১৮৭৫
Naini Tal, United Provinces (বর্তমানে উত্তরাখণ্ড), British India (বর্তমানে ভারত)
মৃত্যু১৯ এপ্রিল ১৯৫৫(1955-04-19) (বয়স ৭৯)
জাতীয়তাইংরেজ
পেশাশিকারী, পরিবেশবাদী, লেখক

শুরুর জীবন

সম্পাদনা

১৮৭৫ সালের ২৫ শে জুলাই নৈনিতালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বেড়ে উঠেছিলেন ১৬ জন সন্তানের বড় এক পরিবারে যেখানে ৮জন সন্তানই ছিলো তার পিতা উইলিয়াম ক্রিস্টোফার করবেট এবং মা মেরি জেইন করবেটের। তার পিতা ক্রিস্টোফার করবেট শহরের পোস্টমাস্টার [] পদে নিয়োগপ্রাপ্তির পর তার পিতামাতা ১৮৬২ সালের দিকে নৈনিতালে আসেন। মাত্র চার বছর বয়সে জিম করবেট তার পিতাকে হারান। তার পিতার মৃত্যুর পর তার বড় ভাই টম নৈনিতালে'র পোস্টমাস্টার পদে নিযুক্ত হন। [] খুব অল্পবয়স থেকেই জিম করবেট কালাধুঙ্গিতে অবস্থিত তার বাড়ির চারিপাশের বন এবং বন্যজীবনের প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হতেন। তরুন বয়সে ঘন ঘন জঙ্গলে ভ্রমনের মাধম্যে তিনি বেশিরভাগ পশুপাখিকেই তাদের ডাক শুনে চিনতে পারার ব্যাপারটা শিখে গিয়েছিলেন। এরপর স্বল্প সময়ের মাঝেই তিনি বুনো পশুদের অনুসরণ এবং একজন ভালোমানের শিকারি হয়ে উঠেছিলেন।

শিকার জীবন

সম্পাদনা
 
রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো চিতার মৃতদেহের সাথে শিকারী জিম করবেট

আজও জিম করবেটের কিংবদন্তিগুলো শুধুমাত্র কুমায়ুন এবং গাড়োয়ালের মানুষদের হৃদয়েই নয় বরঞ্চ সারা বিশ্বের মানুষদের মনেই অম্লান হয়ে রয়েছে। ১৯০৭ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে করবেট মোট ৩৩টির মতো মানুষখেকো বাঘকে অনুসরণ এবং গুলিবিদ্ধ করেছিলেন। যদিও এদের মধ্যে মাত্র ডজনখানেককে ভালোভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছিলো। এটা বলা হয়ে থাকে যে, এসব বড় বেড়ালেরা ১২০০ এর উপর পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদেরকে হত্যা করেছিলো। তার প্রথম শিকার করা বাঘটি ছিলো চম্পাবতের। যেটি কিনা চম্বাবতের মানুষখেকো হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলো। বলা হয়ে থাকে যে, প্রায় ৪৩৬টি নথিভুক্ত মৃত্যুর জন্যে এ মানুষখেকো বাঘটি দায়ী ছিলো। [] যদিও করবেটের শিকার করা প্রাণীদের বেশীরভাগই ছিলো বাঘ তবে তিনি সফলতার সাথে অন্ততপক্ষে দুটো মানুষখেকো লেপার্ডকেও হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৯১০ সালে তিনি পানারে প্রথম লেপার্ডটিকে হত্যা করেছিলেন যেটি কিনা প্রায় ৪০০ মানুষকে হত্যা করেছিলো। আর দ্বিতীয়টি ছিলো কুমায়ুনের মানুষখেকো লেপার্ড। প্রায় আট বছর ধরে যেটি কিনা দৌরাত্ম্য করেছিলো এবং হত্যা করেছিলো ১২৬ এর অধিক মানুষকে। তার শিকার করা অন্যান্য আরও মানুষখেকোগুলোর মধ্যে তাল্লা-দেসের মানুষখেকো, মোহনের মানুষখেকো, থাক এর মানুষখেকো, মুক্তেশরের মানুষখেকো, চম্বাবতের বাঘিনী এগুলোর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ভয়ঙ্কর কোন শিকার ধরার সময় তিনি একাকী থাকতে পছন্দ করতেন এবং পায়ে হেঁটে পথ অতিক্রম করতেন। অনেক সময় তিনি রবিন নামের ছোট একটি কুকুরকে সঙ্গে নিয়ে শিকার করতেন। এ সময়ে তিনি অন্যদের জীবন রক্ষার্থে তার নিজের জীবনের উপর অনেক বড় ধরনের রিস্ক নিতেও পিছপা হতেন না। তিনি তার কর্মস্থলে গভীরভাবে সম্মানিত হতেন।

ব্যক্তিগত জীবন

সম্পাদনা

জিম করবেট ছিলেন ছিলেন নীল চোখের ছয় ফুটের কিছু বেশি উচ্চতার সাধারণ এবং অত্যন্ত বিনয়ী একজন মানুষ। লাজুক প্রকৃতির হলেও তিনি তার ভারতীয় বন্ধুদের সঙ্গ উপভোগ করতেন। তিনি তাদের কাছে একজন শিকারি, একজন মানুষখেকো হত্যাকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ভারতীয়দেরকে ভালোবাসতেন এবং তাদের প্রয়োজনীয়তা এবং মন মানসিকতা বুঝতে পারতেন। তাদের জন্যে তিনি বহুবার তার জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন দশটি মানুষখেকোকে গুলি করতে গিয়ে! যাদের কথা তিনি তার 'কুমায়ুনের মানুষখেকো,' 'রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো লেপার্ড,' 'দ্যা টেম্পল টাইগার' বইগুলোতে উল্লেখ করেছেন। তিনি কখনোই কোন বাঘ কিংবা লেপার্ডকে গুলি করতেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি এদেরকে মানুষখেকো হিসেবে চিহ্নিত করতে পারতেন। নৈনিতালে তিনি তার বেশীরভাগ সময়ই মাছ ধরে এবং নৌকায় চড়ে অতিবাহিত করতেন। কালাধুঙ্গি ছিলো তার শীতকালীন আবাস। কালাধুঙ্গির জঙ্গলে তিনি তার প্রথম শিকার বিষয়ক শিক্ষাটা পেয়েছিলেন বড় ভাই টমের কাছ থেকে। তিনি ছয় বছর বয়সে প্রথম লেপার্ড শিকার করেন। চমৎকার দৃষ্টিশক্তি, তীক্ষ্ণ শ্রবণশক্তি, প্রখর স্মরণশক্তি এবং সাহস ও মনোবলের সাথে কোন কিছু পর্যবেক্ষণ করা ইত্যাদি নানাপ্রকার গুণ দ্বারা আশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন তিনি। পাশাপাশি তিনি গান গাইতে এবং গীটারও বাজাতে পারতেন। তার জীবদ্দশায় তিনি ২২ বছর(১৮৯২-১৯১৪) বিহার নর্থ ওয়েস্টার্ন রেলওয়েজে কাজ করেছিলেন। তিনি তার বই 'আমার ইন্ডিয়া'তে তার বিহার জীবন এবং ইন্ডিয়ার জীবনের নানান কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া তিনি সৈনিক দলকে জঙ্গলে প্রতিরক্ষারও প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এবং 'ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল' পদে উন্নিত হয়েছিলেন। তিনি সম্মানসূচক নানা উপাধি ও মেডেল অর্জন করেছিলেন।

শেষ জীবন

সম্পাদনা

জিম করবেট তার বোন ম্যাগির সাথে গারনি হাউজে বসবাস করতেন। তারা ১৯৪৭ সালের নভেম্বরে কেনিয়ায় উদ্দেশ্যে রওনা দেবার পূর্বে এ বাড়িটিকে মিসেস কলাবতী ভারমা এর কাছে বিক্রি করে দিয়ে যান যেটিকে কিনা পরবর্তীতে জাদুঘরে রুপান্তরিত করা হয় এবং এর নামকরণ করা হয় 'জিম করবেট জাদুঘর'। ১৯৪৭ সালের পর করবেট এবং তার বোন ম্যাগি কেনিয়ার নায়েরিতে অবসর গ্রহণ করেন। এবং করবেট সেখানে লিখালিখি শুরু করেন। করবেট তার ষষ্ঠ বই 'ট্রি টপস' লিখে শেষ করার অল্প কিছুদিন পরই হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন। নায়েরি'র সেন্ট পিটার'স অ্যাংলিকান চার্চে এই মহান শিকারিকে সমাধিস্থ করা হয়।

তার নামে ভারতের উত্তরখন্ডে 'জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক' নামে একটি পার্ক গড়ে তোলা হয়েছে। তার শিকার কাহিনীগুলোকে নিয়ে হলিউডেও একাধিক ছবি নির্মিত হয়েছে।

স্টিফেন অল্টার রচিত ইন দ্য জঙ্গলস অফ্ দ্য নাইটঃ আ নভেল আবাউট জিম করবেট (২০১৬) উপন্যাসটিতে জিম করবেট-এর জীবনী একটি সাহিত্যকেন্দ্রিক রচনা হিসাবে পরিবেশিত হয়েছে।

তথ্যসূত্র

সম্পাদনা
  1. "Explained: The story of Corbett National Park, and the man behind the name"The Indian Express (ইংরেজি ভাষায়)। ২০২১-১২-২৭। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-১১ 
  2. "Jim Corbett National Park | Uttarakhand Tourism"uttarakhandtourism.gov.in। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-১১ 
  3. "Website of Corbett National Park Uttarakhand India"www.corbettnationalpark.in। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-১১ 
  4. Booth:20.
  5. Kala, D. C. (1979) Jim Corbett of Kumaon. Ankur Publishing House, New Delhi
  6. Tiger and leopard attacks in Nepal BBC News (11 July 2012)

আরো পড়ুন

সম্পাদনা

বহিঃসংযোগ

সম্পাদনা