অমিয় চক্রবর্তী
অমিয় চক্রবর্তী (জন্ম: এপ্রিল ১০, ১৯০১ - মৃত্যু: জুন ১২, ১৯৮৬) বাঙালি সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ। বিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ব্যক্তিত্ব। বাংলা আধুনিক কবিতার ইতিহাসে তিরিশের দশক এবং বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ ও বিষ্ণু দে'র সঙ্গে কবি অমিয় চক্রবর্তীর নাম অবিনাশী বন্ধন ও সমসাময়িকতার বিস্ময়ে জড়িয়ে আছে। শীর্ষস্থানীয় আধুনিক কবি এবং সৃজনশীল গদ্যশিল্পী অমিয় চক্রবর্তী শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
অমিয় চক্রবর্তী | |
---|---|
![]() | |
জন্ম | অমিয় চন্দ্র চক্রবর্তী ১০ এপ্রিল ১৯০১ |
মৃত্যু | ১২ ই জুন, ১৯৮৬ |
পেশা | অধ্যাপনা |
পিতা-মাতা |
|
পুরস্কার | পদ্মভূষণ, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার |
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ডি.ফিল. ডিগ্রি লাভ করেন। অমিয় চক্রবর্তী ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত হাওয়ার্ড, বস্টন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক প্রাচ্য ধর্ম ও সাহিত্য বিষয়ে অধ্যাপনা করেন। সেই সময় জর্জ বার্নাড'শ, আলবার্ট আইনস্টাইন, কবি ইয়েটস, রবার্ট ফ্রস্ট, আলবার্ট সোয়ইটজর, বোরিস পাস্তেরনাক, পাবলো কাসালস প্রভৃতি বিখ্যাত মনীষীর সান্নিধ্যে আসেন।
জন্ম ও পরিবার
সম্পাদনা১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ ১০ এপ্রিল তারিখে রবীন্দ্র-পরবর্তী যুগের অন্যতম কবি অমিয় চক্রবর্তীর জন্ম হয়েছিল মামা বাড়িতেক[›], বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে। তার পুরো নাম অমিয় চন্দ্র চক্রবর্তী।, তার পিতা দ্বিজেশচন্দ্র চক্রবর্তী উচ্চ শিক্ষিত; তিনি ইংরেজিতে এম. এ. এবং বি.এল. পাস করে আসামে গৌরীপুর এস্টেটের দেওয়ান হিসেবে কর্মরত ছিলেন।খ[›] তার মা অনিন্দিতা দেবী ছিলেন সাহিত্যিক -- তিনি "বঙ্গনারী" ছদ্মনামে প্রবন্ধ-নিবিন্ধ প্রকাশ করতেন। তিনি সংস্কৃতে পারদর্শী ছিলেন আর চার সন্তানকে সংস্কৃত শিখিয়েছিলেন নিজেই। গৌরীপুরের সংস্কৃত টোল থেকে প্রখ্যাত পণ্ডিতকে তিনি নিযুক্ত করেছিলেন কালিদাস, ভবভূতি, ভারবি প্রমুখের রচনা পাঠের সুবিধার্থে। এভাবেই অমিয় চক্রবর্তী শৈশবেই ব্যাকরণে পাণ্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।
শিক্ষাজীবন
সম্পাদনাঅমিয় চক্রবর্তীর বয়স যখন অল্প তখন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা অরুণ চক্রবর্তী আত্মহত্যা করে।গ[›] ভাইয়ের মৃত্যুতে তীব্র শোকে আক্রান্ত হন অমিয় চক্রবর্তী। তার স্বভাবে চিরস্থায়ী পরিবর্তন আসে; চঞ্চলতা ও ক্রীড়ানুরাগ তিরোহিত হয়ে আসে অন্তর্মুখীনতা; তিনি স্বল্পবাক ও ভাবুক হয়ে ওঠেন। এরপর কলকাতায় এসে হেয়ার স্কুলে ভর্তি হলেন আর থাকতেন মামার বাড়িতে। উচ্চ শিক্ষিত মামাদের সংস্পর্শে তরুণ অমিয় চক্রবর্তীর মানস জগৎ আলোকিত হয়ে ওঠে। তার বড় মামা নিখিলনাথ মৈত্র হয়ে উঠেন তার "চিন্তা-কল্পনার প্রধান অধিনায়ক।" সঙ্গীত ও সাহিত্যে তার বিশেষ অণুপ্রেরণা ছিল। বন্ধুস্থানীয় সেজ মামা সোমনাথ মৈত্রের প্রভাবও ছিল বেশ। তিনিই অমিয় চক্রবর্তীকে বীরবল ও সবুজপত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তার ভাষায় : “সবুজ পত্রের আসরে এবং পরে বিচিত্রার সভ্যরূপে সাহিত্যে সঙ্গীতের প্রেরণা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হল।”
কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর হাজারিবাগে আইরিশ মিশনের সেন্ট্ কোলাম্বাস কলেজ থেকে আই.এ. পাস করেন। একই কলেজ থেকে ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন, বটানিতে বি.এ. ডিগ্রি লাভ করেন। কিন্তু ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ থেকেই বিশ্বভারতীর কাজে কর্মে জড়িয়ে পড়লেন ঘনিষ্ঠভাবে। ফলে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেয়ার যে আশৈশব স্বপ্ন তার ছিল তা’ এক নিমেষে উবে গেল। প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সুযোগ হলো সংর্কীণ। তিনি এম. এ. পরীক্ষা দিলেন বটে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র হিসেবে নয়, পাটনায় প্রাইভেট ছাত্র হিসেবে। শেষাবধি পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. ডিগ্রী লাভ করেন তিনি ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে। অবশ্য পরে আবারো প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সুযোগ হয়। তিনি বিলেতের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলিয়ল কলেজের ছাত্র হিসেবে ১৯৩৪-৩৭ পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন, কবি টমাস হার্ডির কাব্য নিয়ে গবেষণার জন্য ডি. ফিল. লাভ করেন ১৯৩৭-সালে।ঘ[›]
অমিয় চক্রবর্তী তিরিশের অন্যান্য কবিদের তুলনায় ভিন্নরূপ ব্যক্তিত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছিলেন। শিবনারায়ণ রায় লিখেছেন: “অমিয়-র কোনো নিজস্ব পত্রিকা অথবা গোষ্ঠী ছিল না। ক্ষীণকায় মৃদুভাষী মানুষটির কিছু গভীর প্রত্যয় ছিল, কিন্তু বিতর্কে তিনি অনাগ্রহী অথবা আস্থাহীন। অপরপক্ষে জীবনানন্দের মতো তিনি সঙ্গ-বিমুখ ছিলেন;- বস্তুত নরনারী, পশুপাখি, শহরগ্রাম, বিশ্বের বিচিত্র অধিবাসী এবং বিভিন্ন অঞ্চলের হরেক রকম প্রাকৃতিক রূপ সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল ছিল অপরিসীম। সঙ্গ ভালোবাসতেন, কিন্তু সব সময়েই মনে হয় তাঁর অস্তিত্বের কেন্দ্র এক গভীর নিরাসক্তি তাঁকে সচল রাখত। প্যাশন বা আবেগের আতিশয্যকে তিনি সচেতনভাবে এড়িয়ে চলতেন।”
রবীন্দ্রনাথের সাহচর্য
সম্পাদনাপৃথিবীর নানা মনীষার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যোগাযোগ ছিল তার এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল ১৯২৬ থেকে ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য-সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।ঙ[›] এ সময় তিনি শান্তিনিকেতনে থাকতেন। তার কাজ ছিল, বিদেশী অতিথিদের পরিচর্য করা, ক্লাস নেওয়া, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নানা গ্রন্থ-তথ্য সংগ্রহরে দিয়ে সাহায্য করা, তার বিদেশ যাত্রার সঙ্গী হওয়া ইত্যাদি।
শৈশবেই দৃঢ় ব্যক্তিত্ব নিয়ে গড়ে উঠেছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। ফলে মাত্র পনের বৎসর বয়সেই রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন।চ[›] একইভাবে প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। প্রথমে “ডাকঘর” ও পরে “ফাল্গুনী”-তে অভিনেতা রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম দর্শন ঘটে। পরে প্রমথ চৌধুরীর বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তারপর কবির আহ্বানে তিনি শান্তিনিকেতনে যান। সেটি ১৯১৮ খিষ্টাব্দের কথা। সেখানেই রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সূত্রপাত। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে যোগাযোগ তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। শান্তিনিকেতনের-এর জীবন প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন :
“একান্ত উৎসাহে ভাস্বর সেই অভিজ্ঞতা আজ পর্যন্ত আমার মানসিক অধিকারের বাইরে রয়ে গেছে। শালবীথির তপ্ত ছায়াবৃত মর্মর, ছাতিমতলার শুভ্র স্তব্ধ পাথর এবং উৎকীর্ণ মন, রবীন্দ্রনাথের গভীর বাক্যালাপ এবং অজস্র আতিথ্য, প্রমথবাবুর হাস্যকৌতুকময় প্রখর মননশীল আলোচনা ও বন্ধুত্বের অযাচিত দান একটি অপরিণত, অজ্ঞাত বাঙালি ছেলের সাহস আশা-কল্পনাকে ছাপিয়ে অপরূপ হয়ে দেখা দিয়েছিল। আজও বুকে জেগে আছে আকাশ মাঠ খোয়াইয়ের পাণ্ডুর উজ্জ্বল বলয়-চক্র, দারুণ গ্রীষ্মে উৎফুল্ল আমলকী-সারি এবং বহু দূরে পাড়-বসানো সবুজ তালতড়ি। আশ্রমেরই অভিন্ন অন্তর্গত রূপে সেই দৃষ্টি আমার কৈশোর জীবনে প্রসারিত”।
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে স্থায়ীভাবে শান্তিনিকেতনে চলে আসেন অমিয় চক্রবর্তী। পরের বছর রবীন্দ্রনাথের উদ্যোগেই তার বিয়ে হল ড্যানিশ কন্যা কোপেনহেগেনবাসী হিয়োর্ডিস সিগার্ড (Hjordis Siggaard)-এর সঙ্গে।ছ[›] রবীন্দ্রনাথ বিদেশিনী নববধূর নাম দিয়েছিলেন হৈমন্তী। এ-বিয়েতে কন্যাসম্প্রদানের দায়িত্ব পালন করেছিলেন রবীন্দ্র-সহচর এণ্ড্রুজ। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে বার্মিংহামে থাকাকালীন সময়ে তাদের একটি কন্যা সেমন্তী (ভট্টাচার্য)-এর জন্ম হয়। সেমন্তী স্বামী ড. সুব্রত ভট্টাচার্য ও পুত্রকন্যাসহ শিকাগো-তে বাস করছেন।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব হিসেবে কাজ করেছেন। সাহিত্য সচিব হিসেবে যে-কাজ তাকে করতে হয়েছে কবি নিজে তার বর্ণনা দিয়েছেন : “কবিতা এবং অন্যান্য সব রচনার পাণ্ডুলিপি রক্ষাভার ছিল আমার ওপরে। তা’ ছাড়া নবরচিত গানের দ্রুত কয়েকটি কপি ক’রে দিনুবাবু (দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর) এবং শিক্ষার্থী তরুণ-তরুণীদের হাতে তা’ বিলি করতাম।”
বারবার পাণ্ডুলিপি সংশোধন করতেন রবীন্দ্রনাথ। এমনকী ছাপা হ’য়ে যাওয়ার পরও চলতো সংস্কার। আর ফলে ফর্মা ছাপাজ[›] হ’য়ে যাওয়ার পরও বিশ্বভারতীর প্রেসে ছুটে যেতে হয়েছে অমিয় চক্রবর্তীকে। খসড়ার পর বারবার ঘষা-মাজার অভ্যাস দাঁড়িয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের সবুজ পত্রের যুগ থেকে। ফলে একই রচনা বারবার কপি করতে হতো। এই কপি করার কাজেও অক্লেশে নিয়মিত অংশ নিতেন অমিয় চক্রবর্তী ও স্ত্রী হৈমন্তী। রবীন্দ্রনাথের জরুরি প্রয়োজনে একবার সারারাত জেগে তাকে ''মুক্তধারা'' নাটকটির কপি তৈরি করতে হয়েছিল।
সাহিত্য সচিবের দায়িত্ব ছাড়াও পরে অবশ্য বিশ্বভারতীর সকল প্রকার কাজেই অমিয় চক্রবর্তীকে জড়িয়ে পড়তে হল ; বিশেষ ক’রে রবীন্দ্রনাথ ও রথীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতে। বিশ্বভারতীর কাজেকর্মে রথীন্দ্রনাথ, প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশ, অপূর্বকুমার চন্দ প্রমুখের সঙ্গে অমিয় চক্রবর্তী ধীরে-ধীরে নেতৃস্থানীয় দায়িত্ব পালন করছেন। রবীন্দ্রনাথের উপদেশকদের মধ্যে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ঠাঁই পেয়েছেন। প্রাথমিকভাবে তার কাজ ছিল রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পনাগুলোর ওপর প্রতিবেদন তৈরি ক’রে সবাইকে জানিয়ে সে-সব বাস্তবায়নের সূত্রপাত করা।
একবার ঠিক হল ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩৪৭ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত লিখিত কবিতাগুলো রবীন্দ্রনাথের ১৩৪৭-এর জন্মদিনে একত্রে গ্রন্থনা ক’রে প্রকাশ করা হ’বে। কিন্তু কবিতা সবগুলো এক মেজাজ বা ধাঁচের ছিল না। অমিয় চক্রবর্তী প্রস্তাব করলেন অন্তত দু’টি গ্রন্থে ভিন্নধর্মী এই কবিতাগুলো সংকলণের জন্যে। একগুচ্ছ কবিতায় রয়েছে সুরের প্রাধান্য, "ভাব-রুচির চেয়ে হৃদয়বৃত্তির আলাপ” ; সেগুলো গ্রন্থিত হল ''সানাই'' নামে। আর অন্য গুচ্ছ যাতে কবিগুরুর “জীবনের দর্শন দুঃখ-মৃত্যু ছায়াকে অতিক্রম করে গেছে” সেগুলো সংগ্রন্থিত হল ''নবজাতক'' নামে।
বিশ্বপথিক অমিয় চক্রবর্তী
সম্পাদনাশিবনারায়ণ রায় ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত তার “কবির নির্বাসন ও অন্যান্য ভাবনা”[১] নামক বাংলা সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থটি অমিয় চক্রবর্তীকে উৎসর্গ করেছেন এই লিখে: “কবি ও মনীষী সহৃদয় বিশ্বনাগরিক অমিয় চক্রবর্তী শ্রদ্ধাভাজনেষু”।, আক্ষরিক অর্থেই কবি অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন একজন বিশ্বনাগরিক। পৃথিবীর নানা দেশে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন। কখনও জীবিকার তাগিদে, কখনও-বা নিছক পরিব্রাজক হিসেবে। ভ্রমণে আমৃত্যু ছিলেন অক্লান্ত।
জীবনের শুরুতেই সূচনা হয় বিশ্ব পর্যটনের। অমিয় চক্রবর্তীর বিয়ের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রবীন্দ্র-ভক্ত এণ্ড্রুজের বন্ধু হরেস আলেকজান্ডার। তিনি অমিয় চক্রবর্তীকে বিলেতের বার্মিংহামের উডব্রুক কলেজে আমন্ত্রণণ জানালেন। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে সেই কবির প্রথম বিদেশ যাত্রা। সেখানে প্রায় এক বৎসর ধরে ভারতবর্ষ ও আন্তর্জাতিকতা এবং ধর্মবিষয়ে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ হল। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যয়ন ও গবেষণা করেছেন। অক্সফোর্ডের ব্রেজনোস্ কলেজে সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন ১৯৩৭ থেকে ১৯৪০ সাল অবধি। এ-সময় ব্যাপকভাবে ভারতবর্ষ-ইরান-আফগানিস্তান সফর করেছেন আধুনিক কালে ধর্মআন্দোলন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্যে।
রবীন্দ্রনাথের সহকারীরূপেও অনেক দেশে গিয়েছেন অমিয় চক্রবর্তী। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব-পরিব্রাজক রবীন্দ্রনাথের চেয়েও অনেক বেশি ভ্রমণ করেছেন তিনি। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানি, ডেনমার্ক, রাশিয়া এবং আমেরিকা ভ্রমণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের সহযাত্রী হিসেবে। পরে আরও দু’বার রাশিয়া ভ্রমণ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পারস্য ও মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণ করেছেন ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে।
বিশ্বনাগরিক অমিয় চক্রবর্তী প্রশান্ত এবং আটলাণ্টিক মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ, পর্ব ও পশ্চিম এশিয়া, দূরপ্রাচ্য, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং জাপান ও কোরিয়া সহ পৃথিবীর নানা দেশ-মহাদেশ বহুবার পরিভ্রমণ করেছেন। পৃথিবীর নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন যার মধ্যে রয়েছে আমেরিকার হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়, কান্সাস বিশ্ববিদ্যালয়, বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়, স্মিথ্ কলেজ, ন্যুইয়র্ক স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং ভারতের কলকাতা ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। বিভিন্ন দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছেন বক্তৃতা দেয়ার জন্যে। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এবং রবার্ট ওপেন্হাইমারের আমন্ত্রণে ১৯৫১-তে প্রিন্স্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ষ্টিট্যুট অব অ্যাডভান্স্ড স্টাডিস্-এর ফেলো হিসেবে ভ্রমণ করেছেন। ঐ ১৯৫১-রই গ্রীষ্মে পর্ব ও পশ্চিম বার্লিন প্রোটেস্টান চার্চ সম্মেলনে আমন্ত্রিত প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন। এই সময় পশ্চিম ও পর্ব জার্মানির বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ধর্ম এবং প্রাচ্য সাহিত্য বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন। একাধিকবার সুদর অস্ট্রেলিয়াতে গিয়েছেন শিবনারায়ণ রায়ের আমন্ত্রণে। তার মনোহর, অপ্রতীম বক্তৃতায় মুগ্ধ করেছেন মেলবর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের।
এই ভ্রমণের সূত্রে বিশ্বখ্যাত অনেক মনীষীর সঙ্গেই তার ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জাপানে জেন মনীষী সুজুকি-র সঙ্গে গড়ে উঠে গভীর বন্ধুত্ব। আফ্রিকায় অ্যালবার্ট শোয়াইটজার এর সঙ্গে তার সেবাকেন্দ্র গাবুন অঞ্চলে লন্বারেনে-তে বাস, ১৯৫৪। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে কবি বরিস পাস্টেরনাকের সঙ্গে হয় ঘনিষ্ঠ পরিচয়। এছাড়াও কবি ইয়েটস্, জর্জ বানার্ড শ, কবি রবাট ফ্রস্ট, পাবলো কাসলস্ প্রমুখের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠে তার।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ভারত ছেড়ে স্থায়ীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হয়েছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। মার্কিন প্রবাস থেকে দেশের অমোঘ টানে পরপর ১৯৪৯-৫১-৫৪-৫৬-৬০-৬৩-৬৬-৭০-৭২-৭৫-৭৬ খ্রিষ্টাব্দে দেশে এসেছেন। মৃত্যুর আগে ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে আবার ঘরের ছেলে ঘরে ফিরেছেন স্ত্রী হৈমন্তী চক্রবর্তীর বিশেষ প্রেরণায়। এ-প্রসঙ্গে শিবনারায়ণ রায় জানিয়েছেন: "তাঁর আশঙ্কা ছিল শান্তিনিকেতন তাকে স্থানু করে রাখবে। যে ভ্রাম্যমাণতা তাঁর চারিত্র্য এবং কবি কল্পনাকে অবসিত হতে দেয় না, শান্তিনিকেতনে এসে তা হারিয়ে ফেলবেন। তিনি চেয়েছিলেন শেষ পর্যন্ত নিউ পলজ্-এই থাকবেন, এবং সেখান থেকে সাধ্যমতো ঘোরাফেরা করবেন। কিন্তু বয়স আশি পেরিয়েছিল, শরীর জীর্ণ হয়ে পড়েছিল, হৈমন্তী চক্রবর্তীর তাঁকে শান্তিনিকেতনে নিয়ে আসাই সংগত বিবেচনা করলেন।”
কবিতা
সম্পাদনা
আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ঘুরুক দেখুক থাকুক
কেমন যেন চেনা লাগে ব্যস্ত মধুর চলা —
স্তব্ধ শুধু চলায় কথা বলা —
আলোয় গন্ধে ছুঁয়ে তার ঐ ভুবন ভ’রে রাখুক,
আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ধুলোর রেণু মাখুক
. . . . , — "পিঁপড়ে" -অমিয় চক্রবর্তী
অনুগ্রহ করে এই নিবন্ধ বা অনুচ্ছেদটি সম্প্রসারণ করে এর উন্নতিতে সহায়তা করুন। অতিরিক্ত তথ্যের জন্য আলাপ পাতা দেখতে পারেন।
|
বাংলা কবিতায় আধুনিকতার পথিকৃৎ পঞ্চপাণ্ডবদের অন্যতম একজন অমিয় চক্রবর্তী। তার প্রথমদিককার কবিতা রবীন্দ্রনাথের প্রভাব থাকলেও তিনি অচিরেই স্বকীয়তা অর্জন করেন। প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ কবিতাবলী এবং উপহার প্রকাশের পর ১৯৩৮-এ প্রকাশিত হয় তার তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ খসড়া, যার মধ্য দিয়ে তিনি জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বিষ্ণু দে প্রমুখের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে স্থান দখল করে নেন। এ সময় কবিতা পত্রিকায় বুদ্ধদেব বসু মন্তব্য করেন যে, "খসড়া প্রকাশের পর অমিয় চক্রবর্তীকে উল্লেখযোগ্য বাঙালি কবিদের অন্যতম বলে মেনে নিতে আমাদের দ্বিধা করা উচিত নয়।" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছিলেন "অনুভূতির বিচিত্র সূক্ষ্ম রহস্য", বিশ্বসাহিত্যের স্পর্শ। সাহিত্যের ছাত্র ও অধ্যাপক, ধর্মতত্ত্ব-রাজনীতি, দশর্ন শাস্ত্রে সুপণ্ডিত, বিশ্বসাহিত্যের তন্নিষ্ঠ পাঠক অমিয় চক্রবর্তী ছিলেন মননঋদ্ধ মানুষ। তার কবিতায় আবেগের সঙ্গে মিশে গেছে মননশীলতা। তার কবিতায় প্রগাঢ় দার্শনিকতার মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে আছে প্রবল সময় ও সমাজ-সচেতনতা। একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন:
বাঙলার মেয়ে, এসে ছিল তার জীবনের দাবি নিয়ে,
দুদিনের দাবি ফলন্ত মাঠে, চলন্ত সংসারে;
কতটুকু ঘেরে কত দান ফিরে দিতে।
সামান্য কাজে আশ্চর্য খুশি ভরা।
আজ শহরের পথপাশে তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েকোথা
সভ্যতা ছোটে তেরোশো পঞ্চাশিকে।
ছন্দ, শব্দ চয়ন, শব্দ ব্যবহারের ধাঁচ, পঙ্ক্তি গঠনের কায়দা সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন বাঙালি কবিদের মধ্যে অনন্যসাধারণ। কঠিন সংস্কৃত শব্দও তার কবিতায় প্রবেশ করেছে অনায়াস অধিকারে। তার কবিতায় জাগ্রত চৈতন্যের সঙ্গে সঙ্গে অবচেতনার প্রক্ষেপ পরিলক্ষিত হয়।
সঙ্গীত
সম্পাদনাছেলেবেলা থেকেই সঙ্গীতে ছিল তার বিশেষ আকর্ষণ। তার শৈশব কেটেছে আসাম-গৌরীপুরে। গৌরীপুরে যাত্রা-নাটক আর জারি-সারি, বাউল-কীর্তণের আসরে তার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। অন্যদিকে মামার বাড়িতে ইয়োরোপীয় সঙ্গীতের সঙ্গে পরিচয় ঘটে। ইয়োরোপীয় ধ্রূপদী সঙ্গীতের সঙ্গে তার এই পরিচয় ছিল অসামান্য। রাশিয়ার ববোডিন, জার্মানির প্রাতিভ এবং পিয়ানো, ভায়োলিন ও অর্কেষ্ট্রার শ্রেষ্ঠ কম্পোজারদের সঙ্গীতের সঙ্গে-সঙ্গে ভারতীয় মার্গসংগীতের নিত্য শ্রোতা ছিলেন তিনি। তারপর এক সময় গান লিখতে শুরু করেন। আর তাতে কখনও কখনও তিনি নিজেই সুরারোপ করেছেন।
প্রবন্ধ-নিবন্ধ
সম্পাদনাঅমিয় চক্রবর্তী যে সব পত্র-পত্রিকায় কম-বেশি নিয়মিত লিখেছেন তার মধ্যে রয়েছে কবিতা, বিচিত্রা, উত্তরসূরী, কবি ও কবিতা, পরিচয়, প্রবাসী প্রভৃতি। এর মধ্যে এক “কবিতা” পত্রিকাতেই অমিয় চক্রবর্তীর বেশ ক’টি গদ্য রচনা প্রকাশিত হয়েছিল: ‘এজরা পাউন্ড : কবিতা’র দরবারে পত্রাঘাত’ (পৌষ ১৩৫৫), ‘এলিয়টের নতুন কবিতা’ (পৌষ ১৩৫০), ‘জয়েস প্রাসঙ্গিকী’ (কার্তিক, ১৩৪৮), ‘মার্কিন প্রবাসীর পত্র’ (পৌষ, ১৩৬০), ‘রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি’ (আশ্বিন, ১৩৪৮), ‘শেষের কবিতা’র লাবণ্য’ (আশ্বিন, ১৩৫৩) এবং ‘সমালোচকের জল্পনা’ (আশ্বিন, ১৩৫০)।, এছাড়া বুদ্ধদেব বসুর “নতুন পাতা” এবং সমর সেনের “গ্রহণ ও অন্যান্য কবিতা” গ্রন্থদ্বয়ের সমালোচনাও প্রকাশিত হয়েছিল (যথাক্রমে পৌষ ১৩৪৭ এবং কার্তিক ১৩৪৭ সংখ্যায়)। “কবিতা” পত্রিকায় চৈত্র ১৩৬২ সংখ্যায় বুদ্ধদেব বসুকে লেখা একটি খোলা চিঠি মুদ্রিত হয়েছিল ‘ছন্দ ও কবিতা’ এই শিরোনামে ।
‘কাব্যাদর্শ’ শীর্ষক প্রবন্ধটি মুদ্রিত হয়েছিল ত্রিকালী পত্রিকায় ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে। ‘দুটি ইংরেজি কবিতা’ প্রকাশিত হয়েছিল পরিচয় পত্রিকায়, বৈশাখ ১৩৪২ সংখ্যায়। ‘প্রমথ চৌধুরী - ক্ষুদ্র অর্ঘ্য’ প্রকাশিত হয়েছিল “বিশ্বভারতী পত্রিকা”-এর শ্রাবণ-আশ্বিন ১৩৭৫ সংখ্যায়। “পারাপার”-এর অন্তর্ভুক্ত ‘বৃষ্টি’ কবিতাটি নিয়ে কবি নরেশ গুহ একটি আলোচনা লেখেন কবিতা-পরিচয় পত্রিকায়, আষাঢ় ১৩৭৩ সংখ্যায়। এই আলোচনার সূত্রে, মনুজেশ মিত্র, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত এবং সুতপা ভট্টাচার্য সমালোচনা করেন। অমিয় চক্রবর্তী নিজেও এ ব্যাপারে তার বক্তব্য প্রকাশ করেন। একই পত্রিকায় পরবর্তীতে প্রকাশিত ঐ লেখাটিতে তিনি লেখেন, “ ‘বৃষ্টি’র আলোচনায় দু-একটি প্রশ্ন আছে, তার উত্তরে কিছু বলতে চাই।”
দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার জন্য অমিয় চক্রবর্তীর অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ পত্রাকারে রচিত। এ-প্রকৃতির রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘মার্কিন প্রবাসীর পত্র’ এবং ‘ছন্দ ও কবিতা’। “কবিতা” পত্রিকায় বরিস পাস্টেরনাক ও তার ড.জিভাগো নিয়ে দু’টি চিঠি লিখেছিলেন অমিয় চক্রবর্তী। এ-ছাড়া পত্রাকারে রচিত প্রবন্ধ-নিবন্ধের মধ্যে রয়েছে ‘ইয়োরোপে রবীন্দ্রনাথ’।, শ্রীযুক্ত সোমনাথ মিত্রকে লেখা এ প্রবন্ধলিপিটি “প্রবাসী” পত্রিকার কার্তিক ১৩৩৭ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল। “মস্কো-এর চিঠি’’ নামে দু’টি প্রবন্ধ ছাপা হয়েছিল বিচিত্রা পত্রিকার বাংলা ১৩৩৮ সনের যথাক্রমে মাঘ ও ফাল্গুন সংখ্যায়। “প্রবাসী” পত্রিকায় আরও তিনটি পত্রাকার প্রবন্ধ-নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল; যথা (ক) ‘ফিনল্যান্ডের চিঠি’, কার্তিক, ১৩৪৩ সংখ্যায, (খ) ‘প্যালেষ্টাইন প্রাসঙ্গিক’ কার্তিক, ১৩৪৪ সংখ্যায এবং (গ)‘প্যালেষ্টাইনে হেরফের’, অগ্রহায়ণ, ১৩৪৪ সংখ্যা। এই ধাঁচের লেখাগুলো সম্পর্কে সুমিতা চক্রবর্তীর মন্তব্য এরকম: “ ... ভ্রমণমমূলক প্রবন্ধগুলিতে অমিয় চক্রবর্তীর মানসিক গঠনের একটা মৌলিক প্রাথমিক সূত্র পাওয়া যায়।”
এ-ছাড়া “বিচিত্রা” পত্রিকার শ্রাবণ, ১৩৩৫ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘সাহিত্য ব্যবসায়’।, একই পত্রিকার শ্রাবণ, ১৩৩৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘সংকলন’। স্টেলা ক্রামরিশের লেখা একটি প্রবন্ধ তিনি ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদও করেছিলেন। এটি ‘ভারতীয় শিল্প প্রতিভা’ নামে “প্রবাসী”-এর আশ্বিন, ১৩২৯ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এ-ছাড়াও তিনি ইংরেজিতে বেশ কিছু সংখ্যক সংখ্যক প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করেছেন। এ-সকল প্রবন্ধ আন্তর্জাতিক মানের একাডেমিক জার্নাল সহ বিভিন্ন সংকলন-গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।
সমালোচনা
সম্পাদনাবুদ্ধদেব বসু অসংকোচে অমিয় চক্রবর্তীকে ‘কবির কবি’ অভিধায় আখ্যায়িত করেছিলেন। আর আবু সয়ীদ আইয়ুব অমিয় চক্রবর্তীকে তার ‘প্রিয়তম কবি’ বলেছেন। কিন্তু অমিয় চক্রবর্তীর কবিতার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে সমকালীন সাহিত্য আবহাওয়া সর্ম্পকেও ধারণা থাকা প্রয়োজন। এ সম্পর্কে শিবরারায়ণ রায় লিখেছেন : “তিরিশ এবং চল্লিশের দশকে বাংলা সাহিত্যে বহুজনিক প্রতিভার সেই একই সঙ্গে প্রস্ফুটন আজও অপ্রতিম। বঙ্কিমের পরে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে রবীন্দ্রনাথ এই সাহিত্যের বস্তুত: একচ্ছত্র সম্রাট; তাঁর অনিঃশেষ প্রতিভা তাকে নানা ভাবে পরিপুষ্ট এবং চালিত করে এসেছে; শরৎচন্দ্র, প্রমথ চৌধুরী এবং নজরুল ইসলাম তাঁর সমকালের শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী লেখক হওয়া সত্ত্বেও সাহিত্যে পর্বান্তর ঘটান নি। রবীন্দ্রপ্রতিভার বর্ণাঢ্য সূর্যাসকালে সাময়িকভাবে হলেও নতুন পর্ব সচিত হয়; গদ্যে-পদ্যে যুগপৎ দেখা দেয় অনেকগুলি প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। বিষয় নির্বাচনে, প্রতিন্যাসে, রীতিসংক্রান্ত পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যাঁদের মৌলিকতা আজ প্রশ্নাতীত। কবিতায় জসীমউদদীন, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্র, অমিয়, বুদ্ধদেব, বিষ্ণু, সমর সেন; কথাসাহিত্যে প্রেমেন্দ্র, বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, অন্নদাশঙ্কর, মানিক, ধূর্জটিপ্রসাদ প্রত্যেকের সাহিত্যসৃষ্টি নিজস্বতার দ্বারা চিহ্নিত এবং সমবেতভাবে নতুন পর্বের স্বাক্ষরবাহী।”
কিন্তু রবীন্দ্রনাথের খুব ঘনিষ্ঠ জন হয়েও কবিতায় অমিয় চক্রবর্তী সম্পূর্ণ স্বকীয়তার ও আধুনিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন। বলা যায় অক্লেশে তিনি রবীন্দ্র কাব্যবলয়ের বাইরে অবস্থান করেছেন শুরু থেকেই। এ বিষয়ে বুদ্ধদেব বসুর মন্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক : “রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর জগৎ মূলত এক হ’লেও উপাদানে ও বিন্যাসে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র।, প্রধান কথাটা এই যে রবীন্দ্রনাথের স্থিতিবোধ, অর্থাৎ ব্যক্তিগত জীবনে স্থায়িত্বের ভাব অমিয় চক্রবর্তীতে নেই। কোনো আধুনিক কবিতেই তা সম্ভব নয়। উপাদানের আয়তন ও বৈচিত্র্য তাঁকে বৈশিষ্ট্য দিয়েছে; রবীন্দ্রনাথের কাছে যা পেয়েছেন তার ব্যবহারের ক্ষেত্র আলাদা বলে তাঁর কবিতার রসবস' স্বতন্ত্র ; তাঁর কাছে আমরা যা পাই, রবীন্দ্রনাথ তা দিতে পারেন না।”
কবি আল মাহমুদ লিখেছেন, সুধীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ ও বুদ্ধদেব বসুর কাছে তার “ঋণ এমন অপরিশোধ্য যে, তা উচ্চারণ করাও বাহুল্য বলে গণ্য হতে পারে”।, অন্যদিকে কবি অমিয় চক্রবর্তী তাকে “ঋণগ্রস্ত না করে করেছিলেন বিস্মিত ও অভিভূত”। আল মাহমুদের আরো স্বীকারোক্তি এমন : “..... তার মিল ও পঙ্ক্তি বিন্যাসের অনভ্যস্ত প্রয়োগ আমার কাছে কিছু দিন অত্যন্ত লোভনীয় মনে হলেও এর দুরূহতা শেষ পর্যন্ত আমাকে নিশ্চেষ্ট না করে ছাড়ে নি। এমন কী পয়ারের কারুকাজেও।
আবদুল মান্নান সৈয়দও অমিয় চক্রবর্তীর অনন্যতা সম্পর্কে সমরূপ ধারণাই পোষণ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “... অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা একেবারেই অন্যরকম। কোন পোগান বা চীৎকৃত বাক্যের থেকে অনেক দূরে : মননাশ্রিত, এ্যাবস্ট্রাক্ট অথচ মমতার ঘন নিবিড়।”
১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত চরিতাভিধান-এ তাঁকে "সৃজনশীল গদ্য শিল্পী” হিসেবে আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে যে ত্রিশোত্তর বাংলা গদ্য সাহিত্যে তিনি একটি বিশিষ্ট রীতির প্রবর্তন করেন। অমিয় চক্রবর্তী মূলত কবি। কবিতাতেই তার শিল্পী মন ও মননশীলতার অকৃত্রিম ও বিশিষ্টতাপর্ণ প্রকাশ। তার প্রবন্ধসমূহ কোনো ক্রমেই অণুল্লেখ্য যদিও নয়, তবু শেষ বিচারে তিনি বিশেষ ভাবে প্রাবন্ধিক সত্তার অধিকারী ছিলেন বলে মনে হয় না। এ- গ্রন্থের প্রবন্ধগুলি তার প্রমাণ। এ-ছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রবন্ধ পত্রাকারে লিখিত যা এই ধারণাকে সমর্থন করে। প্রবন্ধের নিরেট কাঠামোর পরিবর্তে একটি ঢিলে-ঢালা ঘরোয়াভাব অধিকাংশ প্রবন্ধে পরিলক্ষিত হয়। কাঠামোর এই দুর্বলতা সত্ত্বেও তার প্রবন্ধসমূহ সাহিত্য-শিল্প বিষয়ে তার মৌলিক চিন্তা-চেতনায় অভিজ্ঞান হ’য়ে আছে। ব্যাপক পঠন-পাঠন, অভিজ্ঞতা আর মননশীলতার সংমিশ্রণে এই প্রবন্ধগুলি অনন্যসাধারণ অপ্রথাসিদ্ধ মাত্রা পেয়েছে। প্রাবন্ধিক অমিয় চক্রবর্তীকে এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করাই যথোপযুক্ত হবে।
প্রকাশিত গ্রন্থাবলি
সম্পাদনাকাব্য
সম্পাদনা- কবিতাবলী (১৩৩২ বঙ্গাব্দ)
- উপহার (১৩৩৪ বঙ্গাব্দ)
- খসড়া (১৯৩৮)
- এক মুঠো (১৯৩৯)
- মাটির দেয়াল (১৯৪২)
- অভিজ্ঞান বসন্ত (১৯৪৩)
- দূরবাণী (১৯৪৪)
- পারাপার (১৯৫৩)
- পালাবদল (১৯৫৫)
- ঘরে ফেরার দিন (১৯৬৪)
- হারানো অর্কিড (১৯৬৬)
- পুষ্পিত ইমেজ (১৯৬৭)
- অমরাবতী (১৯৭২)
- অনিঃশেষ (১৯৭৬)
- নতুন কবিতা (১৯৮০)
গদ্য রচনা
সম্পাদনাসম্মাননা
সম্পাদনা- ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬০) - চলো যাই গদ্যগ্রন্থের জন্য
- পদ্মভূষণ (১৯৭০)
- সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার (১৯৬৪) - ঘরে ফেরার দিন কাব্যগ্রন্থের জন্য
আরও দেখুন
সম্পাদনাপাদটীকা
সম্পাদনা^ ক: প্রকৃতপক্ষে সেটি মা অনিন্দিতার মামার বাড়ি।
^ খ: তখন গৌরীপুরের রাজা ছিলেন প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়া।
^ গ: কথিত আছে অরুণ চক্রবর্তী মৃত্যু সম্পর্কে কৌতূহলী ছিল, মৃত্যুর পরবর্তী জীবন কেমন এই জিগীষা ও আত্মহননে প্ররোচিত করেছিল।
^ ঘ: তাঁর গবেষণা অভিসন্দর্ভের শিরোনাম ছিল: The Dynasts and the post war poetry : a study in modern ideas।
^ ঙ: ঠিক কোন্ সময় থেকে অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য সচিব হিসেবে কাজ শুরু করেন তা নিয়ে বিভিন্ন মত আছে। অমিয় চক্রবর্তী নিজে বলেছেন ১৯২৪ খ্রি. থেকে, তবে রবীন্দ্রজীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় রবীন্দ্রজীবনী-এর ৩য় খণ্ডে লিখেছেন ১৯২৬-এর কথা। কেউ কেউ বলেছেন ১৯২৪-এরও আগে থেকে কাজ করছিলেন অমিয় বিশ্বকবির সঙ্গে।
Error on call to Template:cnote: Parameter #1 (name of content note) and parameter #2 (text of content note) must both be entered.
^ ছ: হিওর্ডিস শান্তিনিকেতনে এসছিলেন রথীন্দ্রনাথ ও প্রতিমা দেবীর পালিতা কন্যা নন্দিনীর শিক্ষক হিসেবে।
^ জ: অক্ষরবিন্যাসর মাধ্যমে লেটার প্রেসে ছাপার ক্ষেত্রে সাধারণ আকৃতির বই একসঙ্গে ১৬ পৃষ্ঠা করে ছাপা হতো। একে বলা হতো ‘ফর্মা। পরে ফর্মাগুলো সেলাই করে বাঁধাই করা হতো।
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ শিবনারায়ণ রায়: “কবির নির্বাসন ও অন্যান্য ভাবনা”, প্রকাশ ভবন, কলকাতা, ১৯৭৩: দ্রষ্ট্রব্য "উৎসর্গপত্র"।
- ↑ সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম সম্পাদিত; বাংলা একাডেমী চরিতাভিধান; ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৭; পৃষ্ঠা- ১০-১১।
বহি:সংযোগ
সম্পাদনাএই নিবন্ধটি অসম্পূর্ণ। আপনি চাইলে এটিকে সম্প্রসারিত করে উইকিপিডিয়াকে সাহায্য করতে পারেন। |