বনলতা সেন
বনলতা সেন বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশ রচিত কাব্যগ্রন্থ।[১] এটি তার প্রকাশিত তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। সংকলটিতে রবীন্দ্রত্তোর সময়ে প্রেম, স্বাধীনতা এবং বেদনার দ্বারা কবির অনুভূত প্রাসঙ্গিক সংগ্রামকে প্রতিফলিত করে।[২] বইটির নামকরণ করা হয়েছে কাব্যগ্রন্থে সংকলিত "বনলতা সেন" শীর্ষক কবিতার নামানুসারে, যেটি একজন বৈদ্য বর্ণের নারীর রূপের মধ্য দিয়ে মানবিক পরিপূর্ণতাকে অন্বেষণ করে।[৩] সংকলনে এই চরিত্রকে হাইপারবোলাইজ করার মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে মানুষের পরিপূর্ণতা অন্বেষণ করার এই আদর্শ রূপ নজরে আসে।[১]
লেখক | জীবনানন্দ দাশ |
---|---|
প্রচ্ছদ শিল্পী | শম্ভু সাহা (কবিতা–ভবন সংস্করণ) |
দেশ | ভারত |
ভাষা | বাংলা |
ধরন | কাব্য |
প্রকাশিত | পৌষ ১৩৪৯ বঙ্গাব্দ (১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ) |
প্রকাশক | কবিতা–ভবন, সিগনেট প্রেস (১৯৫২) |
মিডিয়া ধরন | ছাপা (শক্তমলাট) |
পৃষ্ঠাসংখ্যা | ১৬ (প্রথম সংস্করণ) |
পুরস্কার | নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার (১৯৫৩) |
ওসিএলসি | ৪০৯৭১৭০৮ |
পূর্ববর্তী বই | ধূসর পাণ্ডুলিপি (১৯৩৬) |
পরবর্তী বই | মহাপৃথিবী (১৯৪৪) |
মূল পাঠ্য | উইকিসংকলনে বনলতা সেন |
১৯৫৩ সালে বনলতা সেনের সিগনেট প্রেসের পরিবর্ধিত সংস্করণটি নিখিল বঙ্গ রবীন্দ্র সাহিত্য সম্মেলনে বাংলা ১৩৫৯ সালের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ বিবেচনায় পুরস্কার লাভ করে।[৪][৫]
প্রকাশনা
সম্পাদনাকাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো ১৩৩২ থেকে ১৩৪৬ বঙ্গাব্দের মাঝে লেখা।[৬] গ্রন্থটি সর্বপ্রথম পৌষ ১৩৪৯ বঙ্গাব্দে (১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতার কবিতা–ভবন থেকে প্রকাশিত এক পয়সায় একটি গ্রন্থমালার অন্তর্ভুক্ত হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। জীবনানন্দ নিজেই এটি প্রকাশ করেছিলেন। ১৬ পৃষ্টার ডিমাই ৮ পেজি আকারের বইটির প্রচ্ছদ করেছিলেন আলোকচিত্রশিল্পী শম্ভু সাহা। এই সংস্করণে মোট ১২টি কবিতা সংকলিত হয়েছিল, যার মূল্য ছিল চার আনা। পরবর্তীকালে ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত তার চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ মহাপৃথিবীতে জীবনানন্দ বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের সকল কবিতাই অন্তর্ভুক্ত করেন। মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থেরও প্রথম কবিতাও ছিল "বনলতা সেন"।[৬]
জীবনানন্দের জীবদ্দশায় শ্রাবণ, ১৩৫৯ বঙ্গাব্দে, (১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে) কলকাতার সিগনেট প্রেস থেকে এই কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ৪৯ পৃষ্ঠার পরিবর্ধিত এই সংস্করণে পূর্বের ১২টি কবিতার সাথে নতুন ১৮টি কবিতা যোগ করে সর্বমোট ৩০টি কবিতা প্রকাশিত হয়। এই সংস্করণের প্রচ্ছদ করেছিলেন সত্যজিৎ রায়, যার মূল্য ছিল ২ টাকা। উক্ত সংস্করণের প্রকাশক ছিলেন দিলীপকুমার গুপ্ত।[৬]
শম্ভু সাহা অঙ্কিত প্রচ্ছদ নিয়ে জীবনানন্দের কোন বিরূপ মন্তব্য পাওয়া না গেলেও সত্যজিৎ রায়ের করা সিগনেট প্রেস সংস্করণের প্রচ্ছদ নিয়ে তার বিভিন্ন নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ পায়।[৭] দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের মাস তিনেক পর ১৯৫২ সালের ৬ অক্টোবর, সুরজিৎ দাশগুপ্তকে এক চিঠিতে জীবনানন্দ লিখেছেন,[৭]
"আমার বনলতা সেন দেখে আমি অত্যন্ত হতাশ হয়েছি। এত খারাপ প্রচ্ছদপট আমি জীবনে দেখিনি।"
গোপালচন্দ্র রায়কে এক সাক্ষাতে তিনি বলেছিলেন,[৭]
"কাগজ, ছাপা, বাঁধাই, সবই ভালো, কিন্তু ছবিটা আদৌ আমার পছন্দ হয়নি।"
এছাড়াও জীবনানন্দ তার বোন সুচরিতা দাশকে বলেছিলেন,[৭]
"...আমি কি রাজকুমারী অমৃতকুমারীকে ভেবে এইসব কবিতা লিখাছিলেম নাকি।"
অমৃতকুমারী ছিলেন রাজা হারনাম সিংয়ের কন্যা, যিনি স্বাধীন ভারতে প্রথম কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।
সূচি
সম্পাদনাপ্রথম সংস্করণের সূচি
সম্পাদনাকবিতা–ভবন থেকে প্রকাশিত প্রথম সংকলনে মোট ১২টি কবিতা সংকলিত হয়েছিল।
ক্রম | শিরোনাম | প্রথম প্রকাশ |
---|---|---|
১ | "বনলতা সেন" | কবিতা, ডিসেম্বর, ১৯৩৫ (সম্পা. বুদ্ধদেব বসু) |
২ | "কুড়ি বছর পরে" | |
৩ | "ঘাস" | |
৪ | "হাওয়ার রাত" | |
৫ | "আমি যদি হতাম" | |
৬ | "হায়, চিল" | |
৭ | "বুনো হাঁস" | |
৮ | "শঙ্খমালা" | |
৯ | "নয় নির্জন হাত" | |
১০ | "শিকার" | |
১১ | "হরিণেরা" | |
১২ | "বেড়াল" |
বর্ধিত সংস্করণের সূচি
সম্পাদনারচনা
সম্পাদনাসংকলনের রচনাশৈলী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং নজরুল ইসলামের দ্বারা প্রভাবিত বলে ধরা হয়, কারণ জীবনানন্দ জীবনের সমালোচনামূলক এবং জটিল দিকগুলিকে অন্বেষণ করার জন্য প্রেম এবং প্রকৃতিকে সংযুক্ত করেছেন।[২] যদিও বনলতা সেনের উপর এই কবিদের উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে, তবে বর্ধিত সংস্করণের ৩১টি কবিতা জুড়ে অনন্য আধুনিক শৈলী রয়েছে কারণ জীবনানন্দ চিত্রকল্পে বাঁকা সৃষ্টি মশ্য দিয়ে চিত্রগুলির বিকাশ করেছেন।[৩]
সাহিত্যালোচনা
সম্পাদনাসংকলনের "বনলতা সেন" কবিতাটি সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক পঠিত বাংলা কবিতাগুলোর একটি। জীবনানন্দের বিরুদ্ধে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ার বেশ আগেই এই কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছিল। সাধারণ পাঠকের কাছে কবিতাটি একটি প্রেমের কবিতা হিসেবে সমাদৃত হলেও, এর মর্মমূলে রয়েছে সুগভীর ঐতিহাসিকতা। বিভিন্ন আলোচনায় বলা হয়েছে, কবিতাটির সাথে এডগার অ্যালান পোর "টু হেলেন" ("হেলেনের প্রতি") কবিতাটির বিষয়গত সাদৃশ্য রয়েছে। জীবনানন্দ দাশ এই কবিতাটি পাঠের পর "বনলতা সেন" কবিতাটি রচনায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন বলে ধরে নেয়া হয়। যদিও "বনলতা সেন" এবং "টু হেলেন" কবিতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান।
কিংবদন্তি
সম্পাদনাসংকলনের "বনলতা সেন" কবিতার গভীর প্রভাব লক্ষণীয়। এর কারণ হল জীবনানন্দের চিত্ররূপময়ের শৈলী (চিত্রকল্পের জন্য বাংলা শব্দ) এবং চিত্র বাঁক ও ছাঁচনির্মাণের উপাদান সনাতন দিন্দার মতো কবি ও শিল্পীরা গ্রহণ করেছেন। [৮][৯]
অভিযোজন
সম্পাদনাবিভিন্ন সুরকারেরা এই সংকলনের বিভিন্ন কবিতার সুরারোপ করেছেন এবং বাঙালি পরিচালকরা এই কবিতা থেকে তাদের চলচ্চিত্রের কাহিনীরেখা নির্মাণ করেছেন।[৮][৯] বিভিন্ন অভিযোজনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল:
- "বনলতা সেন", বক্স অফিস ক্রিয়েশনের বাংলা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।[৮]
- সনাতন দিন্দার চিত্রকর্ম কল্লোলিনী তিলোত্তোমা।[৮][৯]
- সনাতন দিন্দার চিত্রকর্ম বনলতা।[৮] রামোনা এল. সেসিউ বলেন যে, “দিন্দার চিত্রগুলি দৃষ্টির গভীরতা, লাইনের কমনীয়তার সাথে মিলিত, একাধিক সাংস্কৃতিক প্রতীক সহ (যেমন ফুলের মালা, ময়ূরের পালক ইত্যাদি) নারীত্বের কবিতায় বোনা শহরের কবিতার একটি উপস্থাপনা।”[৯]
- অর্পিতা সিংয়ের চিত্রকর্ম বনলতা সেন, মিখাইল বাখতিনের "শিল্প এবং উত্তরযোগ্যতা" প্রবন্ধের সূত্র ধরে রামোনা এল. সেসিউ বলেন যে, অর্পিতা সিংয়ের চিত্রকর্ম বনলতা সেন "জীবনানন্দের পাঠ্যের ব্যাখ্যা হিসাবে জবাবদিহিতা এবং লেখকত্বের একটি উদাহরণ। একটি নতুন মূর্ত রূপ এবং একটি একক দৃশ্যত পাঠ্যের মধ্যে একাধিক বর্ণনার ধারণার উপর আঁকা।"[৮][১০]
- “বনলতা সেন”, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের বনলতা সেন ধারাবাহিকের কবিতা আবৃত্তির ভিডিও।[১১]
তথ্যসূত্র
সম্পাদনা- ↑ ক খ আহমেদ, তাজিন; হাসান, শেখ মেহেদী (১০ অক্টোবর ২০১২)। "Using Poems of Jibanananda Das and Rabindranath Tagore in Language Classrooms of Bangladesh"। Language in India। ১২ (১০): ৩৮–৪৪। আইএসএসএন 1930-2940।
- ↑ ক খ জর্জ, কে এম (১৯৯২)। Modern Indian Literature, an Anthology: Surveys and poems (ইংরেজি ভাষায়)। ১। সাহিত্য অকাদেমি। পৃষ্ঠা ৭১–৯৫, ৫০৯–৫১১। আইএসবিএন 978-81-7201-324-0।
- ↑ ক খ লাগো, মেরি এম; গুপ্তা, তরুণ (১৯৬৫)। "Pattern in the Imagery of Jibanananda Das"। দা জার্নাল অব এশিয়ান স্টাডিজ। ২৪ (৪): ৬৩৭–৬৪৪। জেস্টোর 2051109। ডিওআই:10.2307/2051109।
- ↑ আকতার, কামাল বেগম (অক্টোবর ২৮, ২০১৮)। "Jibannanda Das"। অথর ওয়ার্ল্ড। সেপ্টেম্বর ২৭, ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ সেপ্টেম্বর ১৫, ২০২৪।
- ↑ জুয়েল, মোঃ. জোবায়ের আলী (১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। "বনলতা সেনের অনুসন্ধান ও কবি জীবনানন্দ"। দৈনিক জনকণ্ঠ। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ ক খ গ "জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন"। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ২৯ মার্চ ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ জানুয়ারি ২০১৪।
- ↑ ক খ গ ঘ মিত্র, গৌতম। "সত্যজিৎ রায় ও 'বনলতা সেন'-এর প্রচ্ছদ : বৃষ্টির আশ্চর্য ছায়া"। শ্রী। ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪।
- ↑ ক খ গ ঘ ঙ চ সেসিউ, রামোনা এল (২০১৩)। "The Architectonics of Corporeal and Textual Selves: From Durga Via Banalata Sen to the Virtual Indian Woman"। Asian Studies। ১ (১): ৬৫–৯০। ডিওআই:10.4312/as.2013.1.1.65-90।
- ↑ ক খ গ ঘ ডালমিয়া, যশোধরা (২০০১)। "A Passion for the Human Figure"। The Making of Modern Indian Art: The Progressives। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস।
- ↑ বাখতিন, মিখাইল (১৯৯০)। Art and Answerability। টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস।
- ↑ "Banalata Sen | Soumitra Chattopadhyay | Collection of Jibanananda Das's famous poetries"। ইউটিউব। ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭।
বহিঃসংযোগ
সম্পাদনা- গ্রন্থাগারে (ওয়ার্ল্ডক্যাট ক্যাটালগ) বনলতা সেন